image

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পার্শ্ববর্তী দেশের সংশ্লিষ্টতার দাবি বিএনপি নেতার, বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে ‘আল-বদর, আল-শামস’ নয়, বরং পার্শ্ববর্তী দেশের লোকেরা জড়িত ছিল বলে দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় একটি রাজনৈতিক দলের ওপর চাপানো হলেও সেটি সঠিক ইতিহাস নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বিএনপি নেতা টিপু। সোমবার তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা।

সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজনৈতিক দলকে দায়ী করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, এটি প্রকৃত ইতিহাস নয় এবং সেই রাজনৈতিক দলটির উচিত বর্তমান সরকারের কাছে ইতিহাস সংশোধনের দাবি জানানো।

এদিকে একই দিনে রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আরেক আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।

জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার বলেন, “বামপন্থি ও কলকাতাকেন্দ্রিক কিছু বুদ্ধিজীবী এবং ভারতপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নাম জড়িয়ে আসছেন। তবে ইতিহাসের নানা তথ্য ও সত্য সামনে আসায় প্রমাণ হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ড ভারতীয় সেনা ও গোয়েন্দাদের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। কারণ, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।”

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বক্তব্যের শুরুতে বিএনপি নেতা টিপু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। এরপর তিনি বলেন, “আজকেও পত্রিকা পড়লাম। পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামসহ বিভিন্ন জায়গায় লেখা হয়েছে যে, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে আল-বদর, আল-শামস। আমাদের ইসলামিক রাজনৈতিক দলের নেতারা এখানে আছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই—আপনারা বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেন। কিন্তু যখন আপনাদের দোষারোপ করে ইতিহাস লেখা হয়, তখন কেন আপনারা সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার দাবি জানান না?”

তিনি দাবি করেন, “১৪ ডিসেম্বর কোনো আল-বদর, আল-শামস আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেনি। যারা সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে চেয়েছিল, তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।”

টিপুর ভাষ্য অনুযায়ী, “পার্শ্ববর্তী কোনো এক দেশের লোকেরা পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধকে টার্গেট করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেক মেধাবী বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। তারা বেঁচে থাকলে অনেক আগেই দেশ স্বাধীন হতো।”

জামায়াত নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, “বাম সংগঠন ও বাম-মনা সাংবাদিকরা এখনো আপনাদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে কথা বলেন। কেন আপনারা এটা সংশোধনের দাবি জানান না? শুধু স্টেজে উঠলেই তারেক রহমান ও বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলেন, কিন্তু কোনোটা প্রমাণ করতে পারেন না।”

তিনি বলেন, ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরার দাবি না জানালে আগামী প্রজন্মের কাছে ইসলামিক দলগুলোই বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।

সভায় উপস্থিত জামায়াতের মহানগর কমিটির আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার বলেন, “আগামী সরকারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনার দাবি জানাই।” এ সময় তিনি কথা বলতে শুরু করলে টিপু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “বিগত ১৬ বছরসহ স্বাধীনতার পর অনেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। আমি সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। এই বক্তব্যে কারও গাত্রদাহ হলে, ভবিষ্যতে বক্তব্য দেওয়ার সময় আপনারাও বিএনপির গাত্রদাহের বিষয়টি খেয়াল করবেন।”

বক্তব্যে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানোর কথাও বলেন টিপু।

বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের কাছে বুদ্ধিজীবী হত্যার ইতিহাস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরার দাবি জানান। একই সঙ্গে আগামী বছর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস সংশোধনেরও আহ্বান জানান।

সভায় জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবির সভাপতিত্ব করেন। এতে জেলা সিভিল সার্জন এ এফ এম মুশিউর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আলমগীর হুসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদী, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, মহানগর জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল ইসলাম, এনসিপির জেলা কমিটির সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ আল আমিন, ইসলামী আন্দোলনের মহানগর সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ এবং গণঅধিকার পরিষদের জেলা সভাপতি মো. নাহিদ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় তাৎক্ষণিকভাবে টিপুর বক্তব্যের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ না জানালেও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

এনসিপি নেতা আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, “টিপু ভাই যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন আমি ও রাজিব ভাই পাশাপাশি বসা ছিলাম। আমরা দুজনই বিস্মিত হয়েছি। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে ধারণার ভিত্তিতে প্রশ্ন তোলা যায় না। বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় আমরা সভায় সরাসরি প্রতিবাদ করিনি, তবে কোনোভাবেই এই বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়।”

তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর। এখানে বিতর্কের সুযোগ নেই।”

গণসংহতি আন্দোলনের নেতা তরিকুল ইসলাম সুজন বলেন, “এ বিষয়ে যারা বিতর্ক তৈরি করছে, তারা হয় ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, নয়তো সচেতনভাবে দেশবিরোধীদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির এই অপচেষ্টা অনাকাঙ্ক্ষিত।”

সোমবার বিকেলে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বিএনপি নেতা টিপু তার বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মতামত, দলীয় অবস্থান নয়। তিনি দাবি করেন, যুদ্ধকে উস্কে দিতে এবং দেশকে মেধাশূন্য করতে তৃতীয় একটি পক্ষ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—এমন তথ্য তিনি ইতিহাসের বই ও রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে জেনেছেন।

তবে তার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং দলীয়ভাবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই।” বিষয়টি দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নজরে আনা হয়েছে এবং তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান তিনি।

‘রাজনীতি’ : আরও খবর

» বুদ্ধিজীবী হত্যা: এবার ‘পার্শ্ববর্তী দেশকে’ দায়ী করলেন বিএনপি নেতা

সম্প্রতি