জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ হলে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, “আমাদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। একটা লাশ পড়লে আমরা কিন্তু লাশ নেব। অত সুশীলতা করে লাভ নেই। কারণ, অনেক ধৈর্য ধরা হয়েছে।”
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলোচনায় আসা ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ সোমবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সর্বদলীয় সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন মাহফুজ আলম। ইনকিলাব মঞ্চ এই সমাবেশের আয়োজন করে।
গত শুক্রবার ঢাকার বিজয়নগরে মোটরসাইকেল আরোহী দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদিকে গুলি করে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আজ সরকারি ব্যবস্থাপনায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। ওসমান হাদি ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রচার চালাচ্ছিলেন।
পুলিশের ধারণা, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট বানচাল করার উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছে। গুলিবর্ষণকারী হিসেবে পুলিশ যাকে চিহ্নিত করেছে, সেই ফয়সল করিম মাসুদ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে থাকা সন্দেহভাজন আরেক হামলাকারী শেখ আলমগীর ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওসমান হাদির ওপর হামলার পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বৈঠকে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজকের সমাবেশে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা অংশ নেন।
নির্বাচনের আগে গত ১০ ডিসেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া মাহফুজ আলমকে আজই প্রথম কোনো প্রকাশ্য সভায় দেখা যায়। তিনি বক্তব্যে দেশের সামনে একটি ‘সংকটময়’ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
মাহফুজ আলম বলেন, “৫ আগস্টের পর যখন মুজিববাদীদের, আওয়ামী লীগ ও ১৪–দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রতিটি বাড়ি চুরমার করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, সেদিন আমরা নিজেদের সংবরণ করেছিলাম। আজ আমরা সংবরণ করেছিলাম বলেই তারা এই সাহস পাচ্ছে। আমরা ক্ষমা করে যদি ভুল করে থাকি, তাহলে আমরা প্রতিজ্ঞা নেব—আমরা আর ক্ষমা করব না।”
বাংলাদেশে থেকে যারা ভারত ও ভিনদেশিদের স্বার্থ রক্ষা করবে, তাদেরও নিরাপদ থাকতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “দেশের ভেতরের রাজনৈতিক লড়াইকে যারা বাইরে নিয়ে গেছে, তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই—যদি দেশের লড়াই দেশের বাইরে যায়, তাহলে মুক্তির লড়াইও এ দেশের বাইরে যাবে। আমরা যদি নিরাপদ না থাকি, এই দেশে আমাদের শত্রুরাও নিরাপদে থাকতে পারবে না। এটা হচ্ছে বেসিক কন্ডিশন।”
গত বছর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার সেখান থেকে দেওয়া বক্তব্য–বিবৃতির প্রসঙ্গ টেনে মাহফুজ আলম বলেন, “ভারত থেকে আপনারা সন্ত্রাসের উসকানি দেবেন, সন্ত্রাস চালাবেন, আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালাবেন—এটা আমরা বরদাশত করব না।”
তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে জেলায় জেলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, জুলাইয়ের শক্তি গঠনমূলকভাবে শক্তিশালী হলে বিভিন্ন লড়াই মোকাবিলা করা সহজ হবে।
মুজিববাদীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের ঘোষণা নাহিদ ইসলামের
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ওসমান হাদিকে গুলি করার মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব ও বাংলাদেশকে আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার রাস্তায় রাস্তায় ‘প্রতিরোধযাত্রা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তাঁর ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও আইন অঙ্গনে যারা মুজিববাদের রাজনীতি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ চলবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ভারত যদি মনে করে আগের মতোই বাংলাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নির্বাচনে কারসাজি করা যাবে, তাহলে তারা ভুল ভাবছে। তিনি বলেন, ভারতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের সাবধান থাকতে হবে।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। নাহিদ ইসলাম বলেন, “এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার পর সিইসির দায়িত্বে থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ চাই, কিন্তু এই অথর্ব কমিশনের অধীনে তা সম্ভব বলে মনে করি না।”
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর মানবতাবিরোধী অপরাধী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। তিনি ভারতের কাছে দাবি জানান, হাসিনাসহ বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক খুনিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
‘নীল দলের’ শিক্ষকদের বের করে দেওয়ার আহ্বান
সমাবেশে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ভারত বাংলাদেশকে ফিলিস্তিন বানাতে চায়। ওসমান হাদির ওপর যারা আক্রমণ করেছে এবং দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীরা—তাদের ভারত আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “এটা চলতে থাকলে আমরাও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন ‘নীল দল’-এর প্রসঙ্গ টেনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “নীল দলের পা চাটা শিক্ষকদের ধরে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিতে হবে।” তিনি আরও বলেন, নাটক–সিনেমা থেকে আওয়ামী লীগ ও মুজিবের দালালদের বের করে দিতে হবে। তাঁর অভিযোগ, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বৈধতা উৎপাদনকারী ‘টক শোজীবীরা’ ফ্যাসিস্টদের মানবাধিকারে বিশ্বাস করলেও মজলুমদের মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ভারত যদি মনে করে শেখ হাসিনা ও ওসমান হাদির ঘাতকদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে, তা কখনোই সম্ভব হবে না।
বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণ
মাহমুদুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবেরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আপ বাংলাদেশ, লেবার পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সমিতি রাওয়া ক্লাবের সভাপতি কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান, খেলাফত মজলিসের নেতা আহমদ আলী কাসেমী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ, জনতার দলের মহাসচিব আজম খান, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম, রাকসুর জিএস সালাউদ্দিন আম্মার এবং ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ফাতিমা তাসনিম জুমা।