ক্রমাগত হুমকি ও অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হয়ে এনসিপি নেত্রী জান্নাতারা রুমী পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি—এমন অভিযোগ তুলেছেন তার দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তিনি জানান, তথ্যপ্রমাণসহ অভিযুক্তদের ফেসবুক আইডি ও ফোন নম্বর পুলিশের কাছে দেওয়া হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে সহযোদ্ধা রুমীর মরদেহ দেখতে এসে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন সামান্তা। তিনি বলেন, দেশে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ জীবন হুমকির মুখে থাকলে এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কীভাবে সম্ভব—সে প্রশ্নও ওঠে।
সামান্তা শারমিন বলেন, “ওসমান হাদির মাথায় গুলি লাগার ঘটনা যেমন আমাদের ভেতরে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, রুমীর মৃত্যুও আমাদের সবাইকে নাড়া দিয়েছে। আমরা যারা এনসিপিসহ জুলাইয়ের সম্মুখসারীর যোদ্ধা—আমরা সবাই এই বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রে সম্মুখসারীর যোদ্ধা, শহীদ পরিবার এবং আহতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো স্পষ্ট ব্যবস্থা আমরা দেখিনি।”
৩০ বছর বয়সী জান্নাতারা রুমী ছিলেন এনসিপির ধানমন্ডি থানা শাখার যুগ্ম সমন্বয়কারী। তিনি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার মো. জাকির হোসেনের মেয়ে। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা রুমী মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। ঢাকার জিগাতলা পুরাতন কাঁচাবাজার রোড এলাকার একটি ছাত্রী হোস্টেলে তিনি থাকতেন।
বৃহস্পতিবার সকালে ৯৯৯ নম্বরে খবর পেয়ে পুলিশ ওই হোস্টেলের কক্ষ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে।
হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহাদাত হোসেন জানান, রুমীর কক্ষে ডিপ্রেশনের ওষুধ পাওয়া গেছে এবং আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
তদন্তকারীদের সামনে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। রুমীর চাচাতো ভাই মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের জানান, রুমীর দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং দুই সংসারই ভেঙে যায়। দুই সংসারে দুটি সন্তান রয়েছে, যারা বাবার কাছে থাকে। এসব বিষয় নিয়েও তিনি হতাশায় ভুগছিলেন।
এ ছাড়া গত ১৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ‘ঢাকা লকডাউন’ চলাকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এক মধ্যবয়সী নারীকে মারধরের ঘটনায় রুমী আলোচনায় আসেন। লাঠি হাতে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তার ঠিকানা ও পারিবারিক পরিচয় অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
এনসিপি নেতাদের অভিযোগ, এরপর তাকে এবং তার পরিবারকে গুরুতর হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এসব কারণে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ট্রমার মধ্যে ছিলেন এবং দলের কর্মসূচিতেও তাকে বিমর্ষ দেখা যেত।
এই প্রেক্ষাপটে সামান্তা শারমিন বলেন, “রুমীর প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টে, প্রায় প্রতিটি কমেন্টে এবং হাদির সুস্থতা কামনায় দেওয়া তার শেষ পোস্টেও তাকে বুলিং করা হয়েছে। ১৩ নভেম্বর রুমি ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন, যেখানে অ্যাকাউন্ট ও ফোন নম্বরসহ হুমকিদাতাদের তালিকা দেন।”
তিনি যোগ করেন, “আমরা তদন্ত করে যে তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ দিচ্ছি, সেগুলোর ভিত্তিতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না।”
এনসিপির এই নেত্রী বলেন, “সব রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন আমরা দেখছি জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর ওপর ক্রমাগত হুমকি আসছে। এনসিপির একাধিক নেতাকর্মীর ওপর হামলা ও হুমকি দুটোই চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটা শুধু এনসিপির বিষয় নয়; এটা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রশ্ন। দিল্লি, পিন্ডি ও নিউইয়র্কের আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামী যোদ্ধাদের প্রতিও হুমকি রয়েছে।”
সামান্তা শারমিন বলেন, “রুমীর মৃত্যু আমাদের ভয় দেখায় না; বরং সাহস জোগায়। রুমি ও হাদি আমাদের কাছে হিরো। আমরা শাহাদাতকে ভয় পাই না। তবে রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। ময়নাতদন্ত ও পুলিশি তদন্তে যেন কোনো তথ্য গোপন না হয়—সেদিকে আমরা সজাগ থাকব।”
তিনি অভিযোগ করেন, এআই ব্যবহার করে নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বুলিং চালানো হচ্ছে এবং দেশের একটি অংশ তা বিশ্বাস করছে। “আমি নিজেও আমার নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একটি আইডি বা অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি,” বলেন তিনি।
নারী নেতৃত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে সামান্তা বলেন, “প্রতিটি দলকেই নারী নেত্রীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এআইয়ের অপব্যবহার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। অনেক অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ এসব অপপ্রচার বিশ্বাস করছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, কেবল নির্বাচনের ডামাডোল আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে না; প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও বাস্তব।