ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ২৫৮২ মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। প্রতি আসনে গড়ে ৮টি মনোনয়ন জমা পড়েছে।
ঢাকায় তারেক রহমান, শফিকুর রহমান, নাহিদ ইসলাম পৃথক আসনে
চট্টগ্রামে হট্টগোল, বেশিরভাগ স্থানে উৎসবমুখর
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিনে ঢাকাসহ সারাদেশে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়গুলোতে প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান; জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ অধিকাংশ দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে সোমবার,(২৯ ডিসেম্বর ২০২৫) (শেষ দিন) মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
বেশিরভাগ স্থানে উৎসবমুখর পরিবেশে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হলেও চট্টগ্রাম-১০ আসনে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। ওই আসনে বিএনপির প্রার্থী সাঈদ আল নোমান শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে শোডাউন করে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের ধস্তাধস্তি হয়। পরে পুলিশ প্রধান ফটক আটকে দিলে প্রার্থী হাতেগোনা কয়েকজনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মোট ৩ হাজার ১৪৪টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে গতকাল রোববার পর্যন্ত ১৬৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ দিনেই অধিকাংশ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে থাকেন। সোমবার শেষ দিনে মোট কতজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, সব রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তথ্য আসার পর তা জানানো হবে।
এ বিষয়ে সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুরোটা সংকলন করা শেষ হলে রাত ১০টার দিকে তা জানাতে পারবো।’
কয়েকটি দল থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় বাড়ানোর কথা উঠেছিল। মনোনয়নপত্রের সময়সীমা ইসি বাড়াচ্ছে কিনা জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘না। সময় বাড়ছে না।’
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ নিবন্ধিত ৫৮টি দলের এবার ভোটে অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জানিয়েছে তারা এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। আর নিবন্ধন স্থগিত থাকায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না আওয়ামী লীগ।
খালেদা-তারেক-ফখরুলের মনোনয়নপত্র
ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছে। একইদিনে ঢাকা-১৭ ও বগুড়া-৬ আসনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সোমবার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা ইশরাত ফারজানার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
জামায়াতের আমির, ববি
হাজ্জাজের মনোনয়নপত্র
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে ঢাকা-১৫ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন।
একই ভবনে দুপুর দেড়টার দিকে মনোনয়নপত্র জমা দেন এনডিএমের ববি হাজ্জাজ। তিনি বিএনপির প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে ঢাকা-১৩ আসন থেকে লড়বেন। সোমবার সকালে
ঢাকার আগারগাঁওয়ে ইটিআই ভবনে ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলীর কাছে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘কৌশলগত কারণে আমরা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছি। আশা করি, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করবে।’
নাহিদ-পরওয়ার, রুমিন, অন্যান্য
জামায়াতের ছেড়ে দেয়া ঢাকা-১১ (রামপুরা-বাড্ডা-ভাটারা-হাতিরঝিল আংশিক) আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সোমবার দুপুরে ঢাকার সেগুনবাগিচায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়।
খুলনা-৫ আসনে সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ ও বিজয়নগরের একাংশ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানা। সোমবার দুপুরের পর রুমিন ফারহানা নিজে উপস্থিত হয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুবকর সরকারের কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আল্লাহর পরিকল্পনা মানুষের বোঝার বাইরে। আল্লাহর এই পরিকল্পনায় আমার বাবা ৭৩ সালে আওয়ামী লীগের জোয়ারের বিপক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন। রাব্বুল আলামিনের কী অদ্ভুত পরিকল্পনা! ২০২৬ সালে এসে ধানের শীষের জোয়ারের বিপক্ষে আমাকে স্বতন্ত্র লড়াই করতে হচ্ছে। আল্লাহর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া মানুষের বোঝার বাইরে।’
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা-১২, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক পটুয়াখালী-৩, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদ ছেড়ে সদ্য বিএনপিতে যোগ দেয়া রাশেদ খাঁন।
হাদির আসনে নাসীরুদ্দীন
জামায়াতে ইসলামীর দশ দলীয় জোট থেকে ঢাকা-৮ আসনে সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদির এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য বিজয়নগর এলাকায় গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতলে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৮ ডিসেম্বর হাদির মৃত্যুর খবর আসে।
*বাবরের সঙ্গে স্ত্রী *
নেত্রকোনা-৪ (মোহনগঞ্জ, মদন ও খালিয়াজুড়ি) আসনে সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণীও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সোমবার বিকেলে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মো. সাইফুর রহমান বলেন, তাহমিনা জামান শ্রাবণী স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়েছেন। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বাবর। ফলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন।
*বাছাই, প্রত্যাহার, প্রচারণা*
গত ১১ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন।
তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বাছাই হবে আজ থেকে আগামী ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের শেষ তারিখ ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি (১৮ ডিসেম্বর সংশোধিত); কমিশনে দায়েরকৃত আপিল নিষ্পত্তি ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারি (১৮ ডিসেম্বর সংশোধিত); প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি; চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ ২১ জানুয়ারি।
নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা যাবে আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।
ব্যালট পেপারের মাধ্যমে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হবে।
*প্রথম থেকে দ্বাদশ সংসদ*
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল অংশ নেয়। দলীয় ও স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হতে ২ হাজার ৭৪১ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিএনপিসহ ১৪টি দল ভোটের বাইরে ছিল।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে সে বছর মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে দলীয় মনোনয়নপত্র ছিল ২ হাজার ৫৬৭টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র ছিল ৪৯৮টি। ওই নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দল অংশ নেয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৬১ জন। তাদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী ১৭৩৩ জন; বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র।
দশম সংসদ নির্বাচনে ১২টি দল অংশ নিয়েছিল। মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল ১ হাজার ১০৭টি, বাছাইয়ের পর টিকে ছিলেন ৮৭৭ জন। ১৫৩টি আসনের প্রতিটিতে একজন করে প্রার্থী ছিলেন বলে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের পদ্ধতির বাধ্যবাধকতা শুরুর পর নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ২৮টি দল; প্রার্থী ছিলেন ১,৫৬৭ জন।
নিবন্ধন চালু হওয়ার আগে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৫টি দল অংশ নেয়, প্রার্থী ছিলেন ১,৯৩৯ জন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৮১টি দল অংশ নেয়, ২,৫৭২ জন প্রার্থী ছিলেন। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ১,৪৫০ জন প্রার্থী ছিলেন, দল ছিল ৪২টি। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ২,৭৮৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, দল ছিল ৭৫টি।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৮টি দল অংশ নিয়েছিল, প্রার্থী ছিলেন ৯৭৭ জন। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ১,৫২৭ জন প্রার্থী ছিল, দল ছিল ২৮টি। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯টি দল অংশ নেয়, প্রার্থী ছিলেন ২,১২৫ জন। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনে ১৪টি দল অংশ নেয়, ১,০৯১ জন প্রার্থী ছিলেন।