খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বর্তমান ও সাবেক নেতাদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে আসছে। নগর বিএনপির বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতারা আ’লীগ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়’- দলের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির কেউ সিটি নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অন্যদিকে নগরের সাবেক নেতাদের সমর্থিত একটি অংশ নিজেদের রাজনৈতিক ও দলীয় সমর্থন ধরে রাখা ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে হলেও অংশ নেয়ার পক্ষে। তবে সিটি নির্বাচন নিয়ে বর্তমান ও সাবেক নেতাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বিএনপিসমর্থিত কেসিসির বর্তমান কাউন্সিলর, সাবেক কাউন্সিলর ও সম্ভাব্যপ্রার্থীরা প্রচন্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন। তারা অনেকটা নীরবে-নিভৃতে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিএনপি নেতা অধিকাংশই নগরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির সমর্থক হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিএনপির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করছেন।
এসব কারণে কাউন্সিলরপদে আগ্রহী বিএনপির নেতারা রাতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। মোবাইলফোন ও ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যে কেউ দলের নেতাকর্মী ও সমথর্কদের নিয়ে প্রচারণা করছেন না। তবে বিএনপির এই প্রার্থীরা তৃণমূলে ভোটারদের পাশে থেকে কাজ করার জন্য শেষ মুহূর্তে দল তাদের সমর্থন করবে বলে প্রত্যাশা করছেন।
বিএনপি দলীয় জানা গেছে, ২০১৮ সালে কেসিসি নির্বাচনে মেয়রপদে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পরাজিত হন। তবে কাউন্সিলর পদে ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের ৪১ জন কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপিসমর্থিত ১২ জন জয়লাভ করেন। পরে ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ নগরীর হাদিস পার্কে আওয়ামী লীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল ও সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপির আটজন কাউন্সিলর। তারা হলেন- ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাইফুল ইসলাম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুলতান মাহমুদ পিন্টু, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এইচএম ডালিম, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের মনিরুজ্জামান মনির, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান বিশ্বাস, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ হাফিজুর রহমান হাফিজ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ গাউসুল আজম।
আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিত হবে কেসিসি নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মেয়রপদে বিএনপির প্রার্থী থাকছে না, এটা চূড়ান্ত। সে কারণে নির্বাচনের আমেজ বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তবে ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপির বতর্মান চার কাউন্সিলরসহ অন্তত ২০ জন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে তারা প্রকাশ্যে প্রচারণা ও গণসংযোগ করছেন না।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের টানা তিন বারের কাউন্সিলর আশফাকুর রহমান কাকন বলেন, তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আছেন। তবে দলের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাজেদা খাতুন ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তিনি নির্বাচন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই বারের কাউন্সিলর হাফিজুর রহমান মনি বলেন, তিনি কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়েছেন। এলাকায় নিজের মতো করে কাজও করে যাচ্ছেন। তবে দলের নেতারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে তিনি বিচলিত। তিনিও দলের নেতাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন।
২৪ নম্বর ওয়াডের্র কাউন্সিলর ও সাবেক ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য শমশের আলী মিন্টু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই প্রচারণা চালাচ্ছেন। এছাড়া বিএনপির আরও ১৬ নেতাকর্মী সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী হতে নিজেদের ওয়ার্ডে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপির নেতাদের মধ্যে কাউন্সিলর প্রার্থী হতে ইচ্ছুকদের মধ্যে রয়েছেন সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সহসভাপতি চমন আক্তার, সংরক্ষিত ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আনজিরা খাতুন ও জেলা মহিলা দলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিসেস মনি, সংরক্ষিত ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর হাসনা হেনা, সংরক্ষিত ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সামছুন নাহার লিপি, সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক কাওছারী জাহান মঞ্জু এবং সংরক্ষিত ১০ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর রোকেয়া ফারুক।
সাধারণ ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ইমাম হোসেন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর শেখ শাহিনুল ইসলাম পাখি, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান বিশ্বাস, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর মাহাবুব কায়সার, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবু, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর মাহমুদ আলম বাবু মোড়ল, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর ওয়াহেদুর রহমান দিপু, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর গিয়াসউদ্দিন বনি এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর মুহা. আমান উল্লাহ আমান সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তারা দলের শীর্ষ নেতাদের ‘পজিটিভ’ ইঙ্গিতের দিকেও তাকিয়ে রয়েছেন।
খুলনা নগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। সে কারণে খুলনা নগর বিএনপির গত ২৯ এপ্রিলের নির্বাহী কমিটির সভায় কেসিসি নির্বাচনে দলের কোন নেতাকর্মী অংশ নিতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদি কেউ সিটি নির্বাচনে অংশ নেন, তবে সে তার নিজের দায়িত্বেই নেবেন বলেও জানান তিনি।
নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, তিনি কয়েক দিন আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হিসেবে কেসিসি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও রাজপথের আন্দোলন যুগপৎভাবে করার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় নির্বাচন থেকে সরে আসেন। তবে নগরের বর্তমান নেতৃত্ব দল শক্তিশালী করার নামে, যা করছে এবং নির্বাচন বিষয়ে জনপ্রিয় নেতাদের হুমকি দেয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থার অবসান হওয়ার বিষয়ে দলের মহাসচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে সিটি নির্বাচনে বিএনপি সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার একই বক্তব্য দিচ্ছেন জামায়াত নেতারা। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। নগরের পাঁচটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরপদে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জামায়াতনেতারা। তাদের প্রার্থীরা এরই মধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। নির্বাচনী কার্যক্রমও চালাচ্ছেন জোরেশোরে।
তবে খুলনা নগর জামায়াতের আমির মাহফুজুর রহমান বলেন, অতীতে অনেকবার প্রমাণ হয়েছে, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জামায়াত কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না।
তাহলে জামায়াত নেতারা কীভাবে প্রার্থী হলেন- জানতে চাইলে মাহফুজুর জানান, অনেক নেতা এবং তাদের পরিবার নিজ এলাকায় জনপ্রিয়। এর আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে অংশ নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও কেউ কেউ প্রার্থী হয়েছেন। এটি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে নির্বাচনে তাদের পক্ষে জামায়াতের কোন ভূমিকা থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে দৌলতপুর থানা জামায়াতের নায়েবে আমির আজিজুর রহমান স্বপন, ১২ নম্বরে নগর জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির মাস্টার শফিকুল আলম, ১৮ নম্বরে ওয়ার্ড আমির মশিউর রহমান রমজান, ১৯ নম্বরে সোনাডাঙ্গা থানা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম পান্না এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নগর জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল প্রার্থী হচ্ছেন।
এর মধ্যে মশিউর রহমান রমজান বাদে অন্য চারজন ২০১৩ ও ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল ২০১৩ সালে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে নগরের ৪ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জামায়াতের দুই নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আজিজুর রহমান স্বপন বলেন, গত নির্বাচনে প্রায় ২ হাজার ২০০ ভোট পেয়েছিলাম। কেন্দ্র দখলের কারণে জয়ী হতে পারিনি। দলের পদ এখানে মুখ্য নয়। এলাকার মানুষের অনুরোধে প্রার্থী হয়েছি।’ ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মনিরুল ইসলাম পান্না বলেন, গত দুটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। পারিবারিকভাবে এবারও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
খুলনা নগর জামায়াতের সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল বলেন, এর আগে কাউন্সিলর ছিলাম। মানুষের জন্য কাজ করেছি। এলাকাবাসীর অনুরোধে প্রার্থী হয়েছি।
এব্যাপারে নগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, কেন্দ্র থেকে আমাদের নির্বাচন বর্জন করতে বলা হয়েছে। খুলনার জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। তবে আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোন দলেরই অংশ নেয়া উচিত নয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৬ মে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। ২৫ মে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও ২৬ মে প্রতীক বরাদ্দ এবং ১২ জুন ভোটগ্রহণ করা হবে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ১৫ মে ২০২৩
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন নিয়ে বিএনপির বর্তমান ও সাবেক নেতাদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে আসছে। নগর বিএনপির বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতারা আ’লীগ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়’- দলের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির কেউ সিটি নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অন্যদিকে নগরের সাবেক নেতাদের সমর্থিত একটি অংশ নিজেদের রাজনৈতিক ও দলীয় সমর্থন ধরে রাখা ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে হলেও অংশ নেয়ার পক্ষে। তবে সিটি নির্বাচন নিয়ে বর্তমান ও সাবেক নেতাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বিএনপিসমর্থিত কেসিসির বর্তমান কাউন্সিলর, সাবেক কাউন্সিলর ও সম্ভাব্যপ্রার্থীরা প্রচন্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন। তারা অনেকটা নীরবে-নিভৃতে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিএনপি নেতা অধিকাংশই নগরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির সমর্থক হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিএনপির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করছেন।
এসব কারণে কাউন্সিলরপদে আগ্রহী বিএনপির নেতারা রাতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। মোবাইলফোন ও ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যে কেউ দলের নেতাকর্মী ও সমথর্কদের নিয়ে প্রচারণা করছেন না। তবে বিএনপির এই প্রার্থীরা তৃণমূলে ভোটারদের পাশে থেকে কাজ করার জন্য শেষ মুহূর্তে দল তাদের সমর্থন করবে বলে প্রত্যাশা করছেন।
বিএনপি দলীয় জানা গেছে, ২০১৮ সালে কেসিসি নির্বাচনে মেয়রপদে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পরাজিত হন। তবে কাউন্সিলর পদে ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের ৪১ জন কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপিসমর্থিত ১২ জন জয়লাভ করেন। পরে ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ নগরীর হাদিস পার্কে আওয়ামী লীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল ও সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপির আটজন কাউন্সিলর। তারা হলেন- ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাইফুল ইসলাম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুলতান মাহমুদ পিন্টু, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এইচএম ডালিম, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের মনিরুজ্জামান মনির, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান বিশ্বাস, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ হাফিজুর রহমান হাফিজ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ গাউসুল আজম।
আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিত হবে কেসিসি নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মেয়রপদে বিএনপির প্রার্থী থাকছে না, এটা চূড়ান্ত। সে কারণে নির্বাচনের আমেজ বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তবে ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপির বতর্মান চার কাউন্সিলরসহ অন্তত ২০ জন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে তারা প্রকাশ্যে প্রচারণা ও গণসংযোগ করছেন না।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের টানা তিন বারের কাউন্সিলর আশফাকুর রহমান কাকন বলেন, তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আছেন। তবে দলের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাজেদা খাতুন ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তিনি নির্বাচন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই বারের কাউন্সিলর হাফিজুর রহমান মনি বলেন, তিনি কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়েছেন। এলাকায় নিজের মতো করে কাজও করে যাচ্ছেন। তবে দলের নেতারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে তিনি বিচলিত। তিনিও দলের নেতাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন।
২৪ নম্বর ওয়াডের্র কাউন্সিলর ও সাবেক ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য শমশের আলী মিন্টু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই প্রচারণা চালাচ্ছেন। এছাড়া বিএনপির আরও ১৬ নেতাকর্মী সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী হতে নিজেদের ওয়ার্ডে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপির নেতাদের মধ্যে কাউন্সিলর প্রার্থী হতে ইচ্ছুকদের মধ্যে রয়েছেন সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সহসভাপতি চমন আক্তার, সংরক্ষিত ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আনজিরা খাতুন ও জেলা মহিলা দলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিসেস মনি, সংরক্ষিত ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক কাউন্সিলর হাসনা হেনা, সংরক্ষিত ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সামছুন নাহার লিপি, সংরক্ষিত ৯ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক কাওছারী জাহান মঞ্জু এবং সংরক্ষিত ১০ নম্বর ওয়ার্ডে নগর মহিলা দলের সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর রোকেয়া ফারুক।
সাধারণ ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ইমাম হোসেন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর শেখ শাহিনুল ইসলাম পাখি, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান বিশ্বাস, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর মাহাবুব কায়সার, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবু, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর মাহমুদ আলম বাবু মোড়ল, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর ওয়াহেদুর রহমান দিপু, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর গিয়াসউদ্দিন বনি এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর মুহা. আমান উল্লাহ আমান সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তারা দলের শীর্ষ নেতাদের ‘পজিটিভ’ ইঙ্গিতের দিকেও তাকিয়ে রয়েছেন।
খুলনা নগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর কোন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। সে কারণে খুলনা নগর বিএনপির গত ২৯ এপ্রিলের নির্বাহী কমিটির সভায় কেসিসি নির্বাচনে দলের কোন নেতাকর্মী অংশ নিতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদি কেউ সিটি নির্বাচনে অংশ নেন, তবে সে তার নিজের দায়িত্বেই নেবেন বলেও জানান তিনি।
নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, তিনি কয়েক দিন আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হিসেবে কেসিসি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও রাজপথের আন্দোলন যুগপৎভাবে করার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় নির্বাচন থেকে সরে আসেন। তবে নগরের বর্তমান নেতৃত্ব দল শক্তিশালী করার নামে, যা করছে এবং নির্বাচন বিষয়ে জনপ্রিয় নেতাদের হুমকি দেয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থার অবসান হওয়ার বিষয়ে দলের মহাসচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে সিটি নির্বাচনে বিএনপি সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার একই বক্তব্য দিচ্ছেন জামায়াত নেতারা। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। নগরের পাঁচটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরপদে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জামায়াতনেতারা। তাদের প্রার্থীরা এরই মধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। নির্বাচনী কার্যক্রমও চালাচ্ছেন জোরেশোরে।
তবে খুলনা নগর জামায়াতের আমির মাহফুজুর রহমান বলেন, অতীতে অনেকবার প্রমাণ হয়েছে, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জামায়াত কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না।
তাহলে জামায়াত নেতারা কীভাবে প্রার্থী হলেন- জানতে চাইলে মাহফুজুর জানান, অনেক নেতা এবং তাদের পরিবার নিজ এলাকায় জনপ্রিয়। এর আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে অংশ নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও কেউ কেউ প্রার্থী হয়েছেন। এটি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে নির্বাচনে তাদের পক্ষে জামায়াতের কোন ভূমিকা থাকবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে দৌলতপুর থানা জামায়াতের নায়েবে আমির আজিজুর রহমান স্বপন, ১২ নম্বরে নগর জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির মাস্টার শফিকুল আলম, ১৮ নম্বরে ওয়ার্ড আমির মশিউর রহমান রমজান, ১৯ নম্বরে সোনাডাঙ্গা থানা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম পান্না এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নগর জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল প্রার্থী হচ্ছেন।
এর মধ্যে মশিউর রহমান রমজান বাদে অন্য চারজন ২০১৩ ও ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল ২০১৩ সালে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে নগরের ৪ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জামায়াতের দুই নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আজিজুর রহমান স্বপন বলেন, গত নির্বাচনে প্রায় ২ হাজার ২০০ ভোট পেয়েছিলাম। কেন্দ্র দখলের কারণে জয়ী হতে পারিনি। দলের পদ এখানে মুখ্য নয়। এলাকার মানুষের অনুরোধে প্রার্থী হয়েছি।’ ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মনিরুল ইসলাম পান্না বলেন, গত দুটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। পারিবারিকভাবে এবারও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
খুলনা নগর জামায়াতের সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল বলেন, এর আগে কাউন্সিলর ছিলাম। মানুষের জন্য কাজ করেছি। এলাকাবাসীর অনুরোধে প্রার্থী হয়েছি।
এব্যাপারে নগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, কেন্দ্র থেকে আমাদের নির্বাচন বর্জন করতে বলা হয়েছে। খুলনার জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। তবে আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোন দলেরই অংশ নেয়া উচিত নয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৬ মে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। ২৫ মে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার ও ২৬ মে প্রতীক বরাদ্দ এবং ১২ জুন ভোটগ্রহণ করা হবে।