image
মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউমকে উদ্বোধনী ম্যাচের টিকেট উপহার দেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো

২০২৬ বিশ্বকাপ নিয়ে স্বপ্ন ভাঙছে সমর্থকদের

শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ স্পোর্টস ডেস্ক

২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ফিফা যে ‘সবার জন্য বিশ্বকাপ’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, টিকেটের দাম প্রকাশের পর সেই স্বপ্ন এখন অনেক দেশের সমর্থকদের কাছে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মাঠে খেলা দেখতে যে খরচের বোঝা তৈরি হয়েছে, তা অনেক দেশের মানুষের মাসিক আয়ের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে সামনে থেকে প্রিয় দলকে দেখার সুযোগ ফিকে হয়ে এসেছে সাধারণ সমর্থকদের।

ফুটবল সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে এই টিকেটমূল্যকে সমর্থকদের প্রতি ‘হাস্যকর অপমান’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কারণ, অনেক ছোট ও তুলনামূলক দরিদ্র দেশের ক্ষেত্রে গ্রুপ পর্বের টিকেটের দামই একটি দেশের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে বেশি, যাতায়াত বা থাকার খরচ তো হিসাবেই ধরা হয়নি।

গতকাল শুক্রবার ফিফা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ বিশ্বকাপের টিকেটমূল্য প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, গ্রুপ পর্বের টিকেটের দাম ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের তুলনায় সর্বোচ্চ তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো ফাইনালের টিকেট, যার সবচেয়ে সস্তা ক্যাটাগরির দামই ৩,১১৯ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

এই মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সবচেয়ে বেশি লাগছে ছোট দেশগুলোর সমর্থকদের ওপর। উদাহরণ হিসেবে হাইতির কথাই ধরা যাক। ক্যারিবীয় এই দেশটি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। যেখানে গড় মাসিক আয় মাত্র ১৪৭ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার টাকা। অথচ ৫২ বছর পর বিশ্বকাপে হাইতির প্রথম ম্যাচ, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। দেখতে সবচেয়ে সস্তা টিকেটের দামই ১৮০ ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২০ হাজার টাকা।

হাইতিকে গ্রুপপর্বে আরও খেলতে হবে ব্রাজিল ও মরক্কোর বিপক্ষে। তিনটি ম্যাচের টিকেট কিনতে মোট খরচ দাঁড়াবে ৬২৫ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ শুধু স্টেডিয়ামে ঢোকার টিকেট কিনতেই একজন গড় হাইতিয়ানকে খরচ করতে হবে চার মাসের বেশি আয়ের সমান অর্থ।

ঘানার পরিস্থিতিও খুব একটা আলাদা নয়। সেখানে গড় মাসিক আয় প্রায় ২৫৪ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৮ হাজার টাকা। ঘানার সমর্থক জোজো কোয়ানসাহ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে জানিয়েছেন, এই টিকেটমূল্যের কারণে অনেক সমর্থক তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হবেন।

২০১৭ সালে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বিশ্বকাপকে ৪৮ দলে সম্প্রসারণের সময় বলেছিলেন, ফুটবল শুধু ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকার খেলা নয়- ফুটবল বৈশ্বিক। তার মতে, বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা একটি দেশের জন্য ফুটবল উন্মাদনা সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। কিন্তু টিকেটের দাম প্রকাশের পর সেই উন্মাদনাই এখন অনেক জায়গায় হতাশায় রূপ নিচ্ছে।

শুধু ছোট দেশ নয়, বড় ফুটবল শক্তির সমর্থকদের জন্যও বিশ্বকাপ দেখা সহজ ব্যাপার নয়। কেউ যদি প্রথম ম্যাচ থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত নিজের দলকে অনুসরণ করতে চান, তাহলে শুধু টিকেটেই ন্যূনতম খরচ হবে ৫,২০০ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ভ্রমণ ব্যয়। উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের সমর্থকদের কথা ধরা যাক, গ্রুপ পর্বে ডালাস, বোস্টন ও নিউইয়র্ক/নিউ জার্সিতে ম্যাচ দেখে দেশে ফিরতে ফ্লাইট খরচ পড়তে পারে প্রায় ১,৩০০ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে সবচেয়ে সস্তা ম্যাচ টিকেটের দাম প্রায় ৫২৬ পাউন্ড বা ৭৯ হাজার টাকা।

পুরো টুর্নামেন্টে যেতে চাইলে খরচ আরও বাড়ে। যদি ইংল্যান্ড গ্রুপ জিতে নেয় তাহলে আটলান্টা থেকে মেক্সিকো সিটি হয়ে মায়ামি, এই দুই ফ্লাইটেই খরচ পড়বে প্রায় ৮০০ পাউন্ড বা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লাইট খরচ দাঁড়াতে পারে প্রায় ২,৬০০ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। টিকেট যোগ করলে মোট ব্যয় গিয়ে ঠেকতে পারে প্রায় ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।

সমর্থকদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এই দামগুলো বর্তমান সময়ের হিসাব। অনেকেই নকআউট পর্বের ম্যাচ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফ্লাইট কাটতে চান না। কিন্তু তখন দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

ফিফার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রুপ পর্বের টিকেটের দাম নাকি দরপত্রে প্রস্তাবিত দামের কাছাকাছিই রয়েছে। যেমন স্কটল্যান্ড বনাম হাইতির ম্যাচে সবচেয়ে সস্তা টিকেটের দাম ১৮০ ডলার, যেখানে প্রাথমিক প্রস্তাবে ছিল ১৭৪ ডলার। কিন্তু আসল সমস্যা তৈরি হয়েছে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে।

প্রস্তাব অনুযায়ী ফাইনালের ক্যাটাগরি থ্রি টিকেটের দাম ছিল ৬৯৫ ডলার, মুদ্রাস্ফীতির হিসাব ধরলে যা হওয়ার কথা প্রায় ৮৯০ ডলার বা ৯৮ হাজার টাকা। কিন্তু ফিফা এখন সেই টিকেট বিক্রি করছে ৪,১৮৫ ডলারে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বিশ্বের অন্যান্য বড় ক্রীড়া ও বিনোদন আয়োজনের সঙ্গে তুলনা করলেও বিশ্বকাপের টিকেটমূল্য প্রশ্ন তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপার বোলের টিকেট সাধারণত ৩,৫০০-৫,০০০ পাউন্ডে পুনঃবিক্রি হয়। এনবিএ ফাইনালে আবার অনেক কম দামে টিকেট পাওয়া যায়। গত বছর ওকলাহোমা সিটি থান্ডারের ঘরের মাঠে টিকেট শুরু হয়েছিল মাত্র ৫২ পাউন্ড বা ৭,৮০০ টাকা থেকে। টেলর সুইফটের ‘এরাস ট্যুর’ কিংবা ডব্লিউডব্লিউই রাসেলম্যানিয়ার মতো আয়োজনেও টিকেটের দাম বিশ্বকাপ ফাইনালের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই কম।

বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় টিকেটের দাম ও দর্শকবান্ধবতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ২০২৬ বিশ্বকাপ ধীরে ধীরে এমন এক টুর্নামেন্টে রূপ নিচ্ছে, যেখানে মাঠে বসে খেলা দেখার সুযোগটা সাধারণ সমর্থকের চেয়ে ধনী দর্শকদের জন্যই বেশি সংরক্ষিত। প্রশ্নটা তাই আরও জোরালো হচ্ছে, বিশ্বকাপ কি সত্যিই সবার নাকি কেবল যাদের সামর্থ্য আছে তাদেরই

‘খেলা’ : আরও খবর

সম্প্রতি