পাকিস্তানী দুঃশাসনের ২৪ বছরের মধ্যে নানা মেয়াদে প্রায় দীর্ঘ ১৪ বছর বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর অবর্তমানে পরিবারকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি রাজনৈতিক সহযোগিতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিব। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়ে এই দম্পতির বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বেড়ে ওঠেন বাবার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন ও মায়ের সব দিক সামলিয়ে গুরুদায়িত্ব পালনের এক বিরল আবহে।
আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় ১৯৬২ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ হাসিনা। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন এবং বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালোরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-সহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের নির্মম-বর্বর হত্যাকান্ডের ছয়বছর পর যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। জার্মানিতে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। এরপর জার্মানি থেকে ভারতে তাঁদের আশ্রিত জীবন শুরু হয়। তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। বেদনাবিধুর ও ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিজের দুই সন্তানকে ভিনদেশে রেখে একা বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত বজ্রকঠিন ছিল তাঁর জন্য। তাঁর নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার জগৎ বলে কিছু ছিল না সেদিন। তিনি দেশে ফিরেই বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় করতে।’ এই কথায় জাদু ছিল, ছিল সম্মোহন ও অপরিসীম প্রাণশক্তি।
অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বর্বর শাসন তখন চেপে বসেছে জাতির কাঁধে, সংবিধান থেকে মুছে দেয়া হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ- ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ , কারাগারে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জাতীয় চার নেতাকে, ’৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করার জন্য ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে আইনে পরিনত করা হয়েছে , নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের , আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের কারাবন্দি করে বিনা বিচারে নির্যাতন করা হয়েছে, দালাল আইন বাতিল ও ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ’৭১ এর ঘাতক দালালদের রাজনীতি ও সমাজে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে এক প্রবল হতাশা বিরাজ করছিলো এই সামরিক ও সাম্প্রদায়িক দানবকে রুখতে না পারার ব্যর্থতায়।
শোকে আচ্ছন্ন তখনো, তবু ঋজু, তবু দৃঢ় শেখ হাসিনা ফিরে আসেন তাঁর পিতার নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে। বৃষ্টিস্নাত সেই বিকেলে বিমানবন্দরে অপেক্ষমান হাজারো শোকার্ত মানুষ তাঁকে গ্রহন করে পরম আবেগে; যেন তিনিই মুক্তি, তিনিই এই গাঢ় অন্ধকারের উৎস হতে জেগে ওঠা এক আলোকবর্তিকা।
শোকের বিপুলভার বহন করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরের সময়টুকুও সহজ ছিলোনা তাঁর জন্য। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিশ্বস্ত বলে কথিত অনেকের বিশ্বাসঘাতকতা, তাঁকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকের অপচেষ্টা- এসব মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন তিনি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে, তাদের সুসংগঠিত করতে। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলি, ২০০৪-এ গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার হত্যা প্রচেষ্টা তাঁকে দমাতে পারেনি।
শেখ হাসিনা ফিরে আসার কিছুদিন পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিহত হন সামরিক অভ্যুত্থানে। এরপর ক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের ছায়া আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ’৭১ এর শীর্ষ ঘাতক গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আহ্বানে ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি। ঘাতক দালালদের বিচারের যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা করেছিলেন, ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ তিনি শুরু করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের আইনি বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শীর্ষ ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়। বিদেশী শক্তিসহ নানা মহলের চাপ উপেক্ষা করে এই বিচারের আয়োজন কেবল শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব-এ সত্য অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে ’৭৫ এর খুনিদের নিয়মতান্ত্রিক বিচারের ব্যবস্থা করে জাতিকে কলংকমুক্ত করেন তিনি।
টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল এই দেশের জনগনের জন্য যেনো এক আশীর্বাদ। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, নারীশিক্ষায় অগ্রগতি ও নারীর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা ধরনের ভাতা প্রদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন, সর্বজনীন পেনশন স্কীম চালু- এসব সম্ভব হয়নি আগে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সমুদ্রসীমা বিজয়, দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, জিডিপির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ইত্যাদি অভূতপূর্ব সাফল্যের বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়ন বিস্ময়। এসকল কিছু শেখ হাসিনারই অর্জন, দেশের মাটি ও মানুষের অর্জন।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছিলো অবিস্মরনীয়। তাঁর কুটনৈতিক সাফল্যে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের সকল মানুষ বিনামুল্যে কোভিড ভ্যাক্সিন গ্রহন করতে পেরেছেন। গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তাঁর প্রণীত “কমিউনিটি ক্লিনিক” মডেল প্রশংসিত হয়েছে সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর অনেক দেশ কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিকভাবে হিমশিম খেলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মহামারী পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায়ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহন করেন। “সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই মুজিব বর্ষের লক্ষ্য”- তাঁর এই ঘোষণা অনুযায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের তালিকা তৈরি শুরু হয়। উপকারভোগী প্রতিটি পরিবারকে দুই শতক জমির রেজিস্টার্ড মালিকানা দলিল হস্তান্তরসহ নতুন খতিয়ান ও সনদ হস্তান্তর এবং প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিটি দুই রুমের সেমি পাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দাসহ বিদ্যুৎ ও পানির নাগরিক সুবিধা প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়। এ পর্যন্ত ৭ লক্ষ ৭১ হাজার ৩০১ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। পরিবার প্রতি ৫ জন হিসেবে এ কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৮ লক্ষ ৫৬ হজার ৫০৫ জন। কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এভাবেই মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সমগ্র বাংলাদেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেওয়া হবে, যাতে দেশের একটি লোক ও গৃহহীন না থাকে। যাতে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দেবো। যাদের থাকার ঘর নেই, ঠিকানা নেই, আমরা তাদের যেভাবেই হোক একটা ঠিকানা করে দেবো।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই তাঁর ব্যক্তিত্বে ধারণ করেন দুস্থ মানুষের জন্য কল্যাণ-কামনা। নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে প্রায় দশ-বারো লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত, শেখ হাসিনার কাছে তাঁরা যেন অতিথি। অতিথি সৎকারের জন্য তৈরি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাসানচর প্রকল্প। শেখ হাসিনার জন্য অভিধা এসেছে ‘মানবতার জননী’ (Mother of Humanity)।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্প গ্রহন করেছিলেন। তিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছিলেন এই জাতিকে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার রূপান্তরকারী নেতৃত্বে ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্পের সফল বাস্তবায়ন ঘটছে। ভিশন ২০৪১, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান ও ডেল্টাপ্লান ২১০০ প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নত, সমৃদ্ধ, টেকসই, স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে নিরলস কাজ করছেন তিনি।
সুখী, সমৃদ্ধ, মানবিক, উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে শেখ হাসিনা অবিকল্প। তাঁর জয় মানেই বাংলাদেশের অব্যাহত জয়যাত্রা।
জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য আমাদের সবার কামনা।
পরিশেষে প্রাণপ্রিয় নেত্রীর প্রিয় কবিতার পংক্তি স্মরণ করি,
"চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ- শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"
জয়তু শেখ হাসিনা।
ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি,
অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ,
সভাপতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
পাকিস্তানী দুঃশাসনের ২৪ বছরের মধ্যে নানা মেয়াদে প্রায় দীর্ঘ ১৪ বছর বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর অবর্তমানে পরিবারকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি রাজনৈতিক সহযোগিতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিব। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়ে এই দম্পতির বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বেড়ে ওঠেন বাবার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন ও মায়ের সব দিক সামলিয়ে গুরুদায়িত্ব পালনের এক বিরল আবহে।
আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় ১৯৬২ সালের হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ হাসিনা। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন এবং বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালোরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-সহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের নির্মম-বর্বর হত্যাকান্ডের ছয়বছর পর যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। জার্মানিতে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। এরপর জার্মানি থেকে ভারতে তাঁদের আশ্রিত জীবন শুরু হয়। তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। বেদনাবিধুর ও ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিজের দুই সন্তানকে ভিনদেশে রেখে একা বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত বজ্রকঠিন ছিল তাঁর জন্য। তাঁর নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার জগৎ বলে কিছু ছিল না সেদিন। তিনি দেশে ফিরেই বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি এসেছি আপনাদের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় করতে।’ এই কথায় জাদু ছিল, ছিল সম্মোহন ও অপরিসীম প্রাণশক্তি।
অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বর্বর শাসন তখন চেপে বসেছে জাতির কাঁধে, সংবিধান থেকে মুছে দেয়া হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ- ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ , কারাগারে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জাতীয় চার নেতাকে, ’৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করার জন্য ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে আইনে পরিনত করা হয়েছে , নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের , আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের কারাবন্দি করে বিনা বিচারে নির্যাতন করা হয়েছে, দালাল আইন বাতিল ও ধর্মীয় রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ’৭১ এর ঘাতক দালালদের রাজনীতি ও সমাজে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে এক প্রবল হতাশা বিরাজ করছিলো এই সামরিক ও সাম্প্রদায়িক দানবকে রুখতে না পারার ব্যর্থতায়।
শোকে আচ্ছন্ন তখনো, তবু ঋজু, তবু দৃঢ় শেখ হাসিনা ফিরে আসেন তাঁর পিতার নেতৃত্বে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে। বৃষ্টিস্নাত সেই বিকেলে বিমানবন্দরে অপেক্ষমান হাজারো শোকার্ত মানুষ তাঁকে গ্রহন করে পরম আবেগে; যেন তিনিই মুক্তি, তিনিই এই গাঢ় অন্ধকারের উৎস হতে জেগে ওঠা এক আলোকবর্তিকা।
শোকের বিপুলভার বহন করে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরের সময়টুকুও সহজ ছিলোনা তাঁর জন্য। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিশ্বস্ত বলে কথিত অনেকের বিশ্বাসঘাতকতা, তাঁকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকের অপচেষ্টা- এসব মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন তিনি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে, তাদের সুসংগঠিত করতে। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলি, ২০০৪-এ গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার হত্যা প্রচেষ্টা তাঁকে দমাতে পারেনি।
শেখ হাসিনা ফিরে আসার কিছুদিন পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিহত হন সামরিক অভ্যুত্থানে। এরপর ক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের ছায়া আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ’৭১ এর শীর্ষ ঘাতক গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আহ্বানে ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি। ঘাতক দালালদের বিচারের যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা করেছিলেন, ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ তিনি শুরু করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের আইনি বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শীর্ষ ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়। বিদেশী শক্তিসহ নানা মহলের চাপ উপেক্ষা করে এই বিচারের আয়োজন কেবল শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব-এ সত্য অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে ’৭৫ এর খুনিদের নিয়মতান্ত্রিক বিচারের ব্যবস্থা করে জাতিকে কলংকমুক্ত করেন তিনি।
টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল এই দেশের জনগনের জন্য যেনো এক আশীর্বাদ। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, নারীশিক্ষায় অগ্রগতি ও নারীর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা ধরনের ভাতা প্রদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন, সর্বজনীন পেনশন স্কীম চালু- এসব সম্ভব হয়নি আগে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সমুদ্রসীমা বিজয়, দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, জিডিপির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ইত্যাদি অভূতপূর্ব সাফল্যের বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়ন বিস্ময়। এসকল কিছু শেখ হাসিনারই অর্জন, দেশের মাটি ও মানুষের অর্জন।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছিলো অবিস্মরনীয়। তাঁর কুটনৈতিক সাফল্যে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের সকল মানুষ বিনামুল্যে কোভিড ভ্যাক্সিন গ্রহন করতে পেরেছেন। গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তাঁর প্রণীত “কমিউনিটি ক্লিনিক” মডেল প্রশংসিত হয়েছে সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর অনেক দেশ কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিকভাবে হিমশিম খেলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মহামারী পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায়ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এক যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহন করেন। “সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই মুজিব বর্ষের লক্ষ্য”- তাঁর এই ঘোষণা অনুযায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের তালিকা তৈরি শুরু হয়। উপকারভোগী প্রতিটি পরিবারকে দুই শতক জমির রেজিস্টার্ড মালিকানা দলিল হস্তান্তরসহ নতুন খতিয়ান ও সনদ হস্তান্তর এবং প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিটি দুই রুমের সেমি পাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, টয়লেট, বারান্দাসহ বিদ্যুৎ ও পানির নাগরিক সুবিধা প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়। এ পর্যন্ত ৭ লক্ষ ৭১ হাজার ৩০১ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। পরিবার প্রতি ৫ জন হিসেবে এ কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৮ লক্ষ ৫৬ হজার ৫০৫ জন। কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এভাবেই মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সমগ্র বাংলাদেশের গৃহহীনদের নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দেওয়া হবে, যাতে দেশের একটি লোক ও গৃহহীন না থাকে। যাতে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারে, আমরা সে ব্যবস্থা করে দেবো। যাদের থাকার ঘর নেই, ঠিকানা নেই, আমরা তাদের যেভাবেই হোক একটা ঠিকানা করে দেবো।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর মতোই তাঁর ব্যক্তিত্বে ধারণ করেন দুস্থ মানুষের জন্য কল্যাণ-কামনা। নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে প্রায় দশ-বারো লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত, শেখ হাসিনার কাছে তাঁরা যেন অতিথি। অতিথি সৎকারের জন্য তৈরি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাসানচর প্রকল্প। শেখ হাসিনার জন্য অভিধা এসেছে ‘মানবতার জননী’ (Mother of Humanity)।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্প গ্রহন করেছিলেন। তিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছিলেন এই জাতিকে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার রূপান্তরকারী নেতৃত্বে ‘সোনার বাংলা’ রূপকল্পের সফল বাস্তবায়ন ঘটছে। ভিশন ২০৪১, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান ও ডেল্টাপ্লান ২১০০ প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নত, সমৃদ্ধ, টেকসই, স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে নিরলস কাজ করছেন তিনি।
সুখী, সমৃদ্ধ, মানবিক, উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে শেখ হাসিনা অবিকল্প। তাঁর জয় মানেই বাংলাদেশের অব্যাহত জয়যাত্রা।
জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য আমাদের সবার কামনা।
পরিশেষে প্রাণপ্রিয় নেত্রীর প্রিয় কবিতার পংক্তি স্মরণ করি,
"চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ- শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"
জয়তু শেখ হাসিনা।
ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি,
অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ,
সভাপতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।