নাজমুল হুদা খান
অন্যান্য আরব দেশের মত কুয়েতেও পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। প্রাচীন যুগ থেকে সামাজিক সংস্কৃতিতে বংশের বন্ধনটিকেযেমন তারা গুরুত্ত্ব প্রদান করে থাকে, তেমনি পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ত্ব ও সম্মানের চোখেদেখে থাকেন কুয়েতের নাগরিকগন। সামাজিক সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠান, পার্বণ একসাথে উদযাপনে তাদের জুড়ি নেই।এসবকে তারা জীবনের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ন অংশই মনে করেন।
কুয়েতিদের সামাজিক সংস্কৃতিতে বিয়ের সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্ববহ। প্রাচীন যুগ থেকে আরবরা বিয়েকে পারিবারিক, বংশীয় ওসামাজিক বন্ধন দৃঢ়তর করা ও নিজের শক্তি, মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান সংহত করার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।যদিও স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এ ধ্যান ধারণা অনেকাংশেই বদলেছে।
পরিবার, বংশ বা স্বজনদের মধ্যে পছন্দসই পাত্র-পাত্রী যুৎসই না হলে বা না পেলে আমাদের দেশের মত ঘটক বা ম্যাচমেকারনিয়োগ করা হয়ে থাকে। পাত্রী প্রাথমিকভাবে পছন্দ হলে পাত্রের পিতাকে সম্যক অবহিত করা হয়। পাত্রপক্ষ সম্মতি প্রদানকরলে, পাত্রীপক্ষের মতামত নেন নিয়োজিত ঘটক। এরপর দু’পক্ষের সম্মতিতে পারিবারিক মিটিং এর আয়োজন করা হয় এবংআলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তি সিদ্ধান্তে গৃহিত হয়।
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে পাত্রীর বাড়ীর বাইরে বের হওয়া কিংবা পরিবারের সদস্য ব্যতিত অন্য কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎনিষিদ্ধের রেওয়াজ রয়েছে। এ সময় পাত্রের পিতা বা অভিভাবক পাত্রীকে বিয়ের জন্য উপহার সামগ্রী ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদানকরে থাকেন। আঞ্চলিক ভাষায় এ উপহার সামগ্রীকে “ডাজা” বলা হয়ে থাকে। ডাজায় সাধারনত এক জোড়া পরিধেয় বস্ত্র, তোয়ালে, বিছানার চাদর ও কম্বল অন্তর্ভূক্ত। উপহার সামগ্রী ক্রয়ের পর পরবিবার ও স্বজনদের মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ ও সম্মানিত নারীসদস্যের একটি দল সেগুলো সপ্তাহের সোম অথবা বৃহস্পতিবার পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে নিয়ে যায়। এ সময় তারা আঞ্চলিকরীতিতে বিয়ের গান গেয়ে উপহার প্রদান অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে থাকে। রীতি অনুয়ায়ী হারিকেনের আলোয় আলেকসজ্জ্বাকরতে দেখা যায়। পাত্র ও পাত্রী দু’পক্ষের নারী সদস্যগনই এ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। পাত্রীর পিতা বা পরিবারের পক্ষে অন্যতমমুরুব্বী এ উপহার সামগী গ্রহন করা মানেই এ বিয়েতে তাদের চূড়ান্ত মত রয়েছে। তারপর দু’পক্ষ বিয়ের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞে হাতদেন।
বিয়ের রাতে বর তার বাড়ী থেকে পিতা, চাচা, ফুফা, মামা, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের নিয়ে কনের বাড়ীতে গমন করে। কনেরবাড়ীতে বর পক্ষ পৌঁছার পর কনে পক্ষের পুরুষ আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে যুবকগন কুয়েতের রীতি অনুয়ায়ী গান গেয়ে তাদেরঅভ্যর্থনা জানায়।
একই সময় অন্দরমহলে কনেকে ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “জালওয়া”। কনেসাধারনত সবুজ রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী চেয়ার বা ষ্টেজে আসন নেয়, একই রঙের একটি স্কার্ফ মাথারউপর উঠা নামা করে এবং নারী স্বজনেরা বিয়ের গান করে উদযাপন করে থাকে। পরবর্তীতে পৃথক কক্ষে অপেক্ষমান বরের কাছেকনেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিয়ের প্রথম সপ্তায় নতুন দম্পতি কনের বাড়ীতে অবস্থান করে। এরপর এ দম্পতি একসাথে বরের বাড়ীতে গমন করে, তাদেরসহযাত্রী হন কনে পক্ষের নিকটাত্মীয়গন। তবে কনের মায়ের এ যাত্রায় যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সামাজিক রীতিতে।
বিয়ে পরবর্তি সুবিধাজনক সময়ে বিবহোত্তর সম্বর্ধনা আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাধারনত আবাসিক এলাকার কমিউনিটি হলেপুরুষদের জন্য এবং বরের বাড়ীতে মহিলা স্বজনদের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় বর একটি নির্দিষ্ট স্থানেঅবস্থান করে। আগত অতিথিগণ ক্রমানুসারে বরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে; এ সময় বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রীপ্রদানের রীতিও লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সম্ভর্ধনাস্থলে পুরুষ বিশেষ করে তরুন স্বজন ও বন্ধুরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে কাঁধে কাঁধমিলিয়ে আরব রীতিতে নেচে নেচে গান করতে দেথা যায়। মহিলা সম্ভর্ধনাস্থলেও মহিলাগনও একই ভাবে গান করে থাকেন।
তবে সময়ে পরিক্রমায় সামাজিক রীতি নীতিতে অনেক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। এখন তরুন তরুনীগন শিক্ষাংগনে, বিভিন্নসামাজিক প্রতিষ্ঠান যথা শপিং মল, বিনোদন কেন্দ্র বা রেস্টুরেন্টে নিজেদের পছন্দসই পাত্রপাত্রী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও চোখে পড়ে।
নিকটাত্মীয় বা বংশের বাইরেও পাত্র পাত্রী বাছাইয়ে কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি বিদেশে পড়াশুনা বা কর্মেনিয়োজিত থাকাকালীন অন্য দেশের নাগরিককেও বিয়ে করতে দেখা যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে পাত্র পাত্রী বা সন্তানগননাগরিকত্বের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী বিদেশী পাত্র বা পাত্রী বিয়ের পর কেউ নাগরিকত্ব পায় না; বরকুযেতি ও কনে ভিনদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতি নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে কনে কুয়েতি এবং বর বিদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেনা।
[লেখক: প্রাক্তন সহকারী পরিচালক , কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]
নাজমুল হুদা খান
বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
অন্যান্য আরব দেশের মত কুয়েতেও পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। প্রাচীন যুগ থেকে সামাজিক সংস্কৃতিতে বংশের বন্ধনটিকেযেমন তারা গুরুত্ত্ব প্রদান করে থাকে, তেমনি পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ত্ব ও সম্মানের চোখেদেখে থাকেন কুয়েতের নাগরিকগন। সামাজিক সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠান, পার্বণ একসাথে উদযাপনে তাদের জুড়ি নেই।এসবকে তারা জীবনের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ন অংশই মনে করেন।
কুয়েতিদের সামাজিক সংস্কৃতিতে বিয়ের সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্ববহ। প্রাচীন যুগ থেকে আরবরা বিয়েকে পারিবারিক, বংশীয় ওসামাজিক বন্ধন দৃঢ়তর করা ও নিজের শক্তি, মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান সংহত করার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।যদিও স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এ ধ্যান ধারণা অনেকাংশেই বদলেছে।
পরিবার, বংশ বা স্বজনদের মধ্যে পছন্দসই পাত্র-পাত্রী যুৎসই না হলে বা না পেলে আমাদের দেশের মত ঘটক বা ম্যাচমেকারনিয়োগ করা হয়ে থাকে। পাত্রী প্রাথমিকভাবে পছন্দ হলে পাত্রের পিতাকে সম্যক অবহিত করা হয়। পাত্রপক্ষ সম্মতি প্রদানকরলে, পাত্রীপক্ষের মতামত নেন নিয়োজিত ঘটক। এরপর দু’পক্ষের সম্মতিতে পারিবারিক মিটিং এর আয়োজন করা হয় এবংআলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তি সিদ্ধান্তে গৃহিত হয়।
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে পাত্রীর বাড়ীর বাইরে বের হওয়া কিংবা পরিবারের সদস্য ব্যতিত অন্য কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎনিষিদ্ধের রেওয়াজ রয়েছে। এ সময় পাত্রের পিতা বা অভিভাবক পাত্রীকে বিয়ের জন্য উপহার সামগ্রী ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদানকরে থাকেন। আঞ্চলিক ভাষায় এ উপহার সামগ্রীকে “ডাজা” বলা হয়ে থাকে। ডাজায় সাধারনত এক জোড়া পরিধেয় বস্ত্র, তোয়ালে, বিছানার চাদর ও কম্বল অন্তর্ভূক্ত। উপহার সামগ্রী ক্রয়ের পর পরবিবার ও স্বজনদের মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ ও সম্মানিত নারীসদস্যের একটি দল সেগুলো সপ্তাহের সোম অথবা বৃহস্পতিবার পাত্রীপক্ষের বাড়ীতে নিয়ে যায়। এ সময় তারা আঞ্চলিকরীতিতে বিয়ের গান গেয়ে উপহার প্রদান অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে থাকে। রীতি অনুয়ায়ী হারিকেনের আলোয় আলেকসজ্জ্বাকরতে দেখা যায়। পাত্র ও পাত্রী দু’পক্ষের নারী সদস্যগনই এ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। পাত্রীর পিতা বা পরিবারের পক্ষে অন্যতমমুরুব্বী এ উপহার সামগী গ্রহন করা মানেই এ বিয়েতে তাদের চূড়ান্ত মত রয়েছে। তারপর দু’পক্ষ বিয়ের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞে হাতদেন।
বিয়ের রাতে বর তার বাড়ী থেকে পিতা, চাচা, ফুফা, মামা, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের নিয়ে কনের বাড়ীতে গমন করে। কনেরবাড়ীতে বর পক্ষ পৌঁছার পর কনে পক্ষের পুরুষ আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে যুবকগন কুয়েতের রীতি অনুয়ায়ী গান গেয়ে তাদেরঅভ্যর্থনা জানায়।
একই সময় অন্দরমহলে কনেকে ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “জালওয়া”। কনেসাধারনত সবুজ রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী চেয়ার বা ষ্টেজে আসন নেয়, একই রঙের একটি স্কার্ফ মাথারউপর উঠা নামা করে এবং নারী স্বজনেরা বিয়ের গান করে উদযাপন করে থাকে। পরবর্তীতে পৃথক কক্ষে অপেক্ষমান বরের কাছেকনেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিয়ের প্রথম সপ্তায় নতুন দম্পতি কনের বাড়ীতে অবস্থান করে। এরপর এ দম্পতি একসাথে বরের বাড়ীতে গমন করে, তাদেরসহযাত্রী হন কনে পক্ষের নিকটাত্মীয়গন। তবে কনের মায়ের এ যাত্রায় যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সামাজিক রীতিতে।
বিয়ে পরবর্তি সুবিধাজনক সময়ে বিবহোত্তর সম্বর্ধনা আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাধারনত আবাসিক এলাকার কমিউনিটি হলেপুরুষদের জন্য এবং বরের বাড়ীতে মহিলা স্বজনদের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় বর একটি নির্দিষ্ট স্থানেঅবস্থান করে। আগত অতিথিগণ ক্রমানুসারে বরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে; এ সময় বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রীপ্রদানের রীতিও লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সম্ভর্ধনাস্থলে পুরুষ বিশেষ করে তরুন স্বজন ও বন্ধুরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে কাঁধে কাঁধমিলিয়ে আরব রীতিতে নেচে নেচে গান করতে দেথা যায়। মহিলা সম্ভর্ধনাস্থলেও মহিলাগনও একই ভাবে গান করে থাকেন।
তবে সময়ে পরিক্রমায় সামাজিক রীতি নীতিতে অনেক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। এখন তরুন তরুনীগন শিক্ষাংগনে, বিভিন্নসামাজিক প্রতিষ্ঠান যথা শপিং মল, বিনোদন কেন্দ্র বা রেস্টুরেন্টে নিজেদের পছন্দসই পাত্রপাত্রী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও চোখে পড়ে।
নিকটাত্মীয় বা বংশের বাইরেও পাত্র পাত্রী বাছাইয়ে কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি বিদেশে পড়াশুনা বা কর্মেনিয়োজিত থাকাকালীন অন্য দেশের নাগরিককেও বিয়ে করতে দেখা যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে পাত্র পাত্রী বা সন্তানগননাগরিকত্বের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী বিদেশী পাত্র বা পাত্রী বিয়ের পর কেউ নাগরিকত্ব পায় না; বরকুযেতি ও কনে ভিনদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতি নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে কনে কুয়েতি এবং বর বিদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেনা।
[লেখক: প্রাক্তন সহকারী পরিচালক , কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]