আসফাক বীন রহমান
‘ঝক্কড় ঝক্কড় মৈমনসিং ঢাকা যাইতে কতদিন’
আজকেও ঈশা খাঁ লেট। সেই কখন থেকে মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি- এখনো আসছে না। যদি সাড়ে তিনটার মধ্যে না আসে তবে অন্য ব্যবস্থা। এখান থেকে ভৈরব প্রায় ১৫ কিলোমিটার; মাঝখানে শ্রীনিধি আর দৌলতকান্দি স্টেশন। তিতাস কমিউটারের টিকেট বিক্রেতা জাফর মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে দশাসই শরীরে হাসির কাঁপন উঠিয়ে বলল- ‘গরিবের ট্রেন ঈশা খাঁ মেইলরে পুছে কেডা?’
জাফর মিয়া জানালো- ‘ঈশা খাঁ মেইল এহন আমীরগঞ্জে হাওয়া বাতাস খাইতাছে, আসর তামাতি আইতে পারে। আপনে স্যার তুলাতুলী থাইক্যা বারৈচা যাইয়া বাস ধরুইন।’ আমার টার্গেট বিকালে ঢাকা থেকে পৌঁছানো মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস। মেথিকান্দায় মহানগরের স্টপেজ নাই। আব্বা ট্রেন প্রেফার করেন, আমারও খুব পছন্দ রেলজার্নি।
রায়পুরা হাসপাতালে জয়েন করার পর থেকে একদিন ভোরবেলা তিতাস কমিউটারে মেথিকান্দায় নামি; পরদিন ডিউটি শেষে ঈশা খাঁ ধরে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই। বাংলাদেশ রেলওয়ের অবহেলিত ট্রেন ঈশা খাঁ মেইল; সকাল ১১টা ৩০ মিনিট নাগাদ কমলাপুর থেকে ছাড়ে আর রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ময়মনসিংহে পৌঁছার কথা। মাঝখানে গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছে। পাড়ি দেয় একচল্লিশটি স্টেশন। রাজধানী ঢাকাকে হাওরের উপজেলাগুলোর সঙ্গে কানেক্ট করেছে। কত সুন্দর সুন্দর নামের স্টেশনÑ নলছাটা, আড়িখোলা, হাঁটুভাঙ্গা, কালিয়াপ্রসাদ, ছয়সূতি, নীলগঞ্জ, গৌরীপুর। হুমায়ূন আহমেদ সূত্রে ‘সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট’, ‘গৌরীপুর জংশন’ ইত্যাদি নামগুলো ঈশা খাঁ মেইলে উঠলেই মনে নাড়া দেয়। মেইল ট্রেনের সঙ্গে থাকে একটি ডাকবাক্স রঙের লাল বগি।
এই ট্রেনে ‘সময় যেন থমকে দাঁড়ায়’। গ্রামীণ মানুষের কোন তাড়াহুড়া নেই; ঢাকা শহরের যানজট, টাইম ইজ মানি, প্র্যাকটিস নিয়ে কামড়াকামড়ি, হা-হুতাশ কিছুই নেই। প্রায় প্রত্যেক যাত্রী নিরাবেগ- ‘উঠছি যহন একসময় পৌঁছাইবাম’ অ্যাটিচুড। পুরোপুরি পারিবারিক পরিবেশ- দুই কথা তিন কথার মধ্যেই একজন আরেকজনের আপনজন হয়ে যায়।
‘স্যার এক কাপ চা খাইন’, পেটানো স্বাস্থ্যের বাদল মিয়া। উনার বাড়ি স্টেশনের আশপাশে মেথিকান্দা বা টুকিপুরা গ্রামে; পেশায় পাইপ মিস্ত্রি। হাসপাতালের পানির পাইপের কোন সমস্যা থাকলেই বাদল মিয়াকে যন্ত্রপাতিসহ দেখা যায়। লোকমুখে শুনতে পেয়েছি উনি খুব দুর্ধর্ষ মানুষ; তবে আমার চোখে কোন আলামত ধরা পড়ে নাই। এই এক সমস্যা- মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়ালে অনেকে চা-পান সাধেন আবার অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে পাশের জনকে ফিসফিস করে কিছু হয়তো বলেন। এর মধ্যে জাফর মিয়া এক অন্ধ গাতকের হাতের ডানায় ধরে আমার কাছে নিয়ে আসেন। ‘স্যার, মন্তাজ খুব ভালো গায়-একটা গান অর্ডার করেন।’ অন্ধ মন্তাজ মিয়াকে মাঝে মাঝে স্টেশনে দোতারা নিয়ে গাইতে দেখি। মন্তাজ মিয়া খুব চিন্তার স্বরে বলেন- ‘জাফর বাই, ঈশা খাঁ কি আউজকা আইতো না?’
‘আরে মন্তাজ পাগলা তুই আইজকা লায়পুরায় বেড়াইবি, ভৈরব যাওয়া লাগতো না’- জাফর মিয়া মন্তাজ মিয়াকে নিয়ে রাগ করে। মন্তাজ মিয়া বড় জামগাছের নিচে জুতমতো বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে গলায় সুর তোলে-
‘আমায় উদাসী বানাইলো গো
মরার কোকিলে।
আমায় উদাসী বানাইয়া গেল
বসন্তেরি কালে গো
মরার কোকিলে।’
বাদল মিয়ার চা আর মন্তাজ মিয়া-জাফর মিয়ার গানের পরিবেশনাও আমার মনের টেনশন কমাতে পারলো না। হঠাৎ মনে হলো আজকে একটা অ্যাডভেঞ্চার করলে কেমন হয়? এ সময় ভৈরব বা নরসিংদী থেকে কোন ট্রেন নাই। রেললাইনের স্লাবের উপর দিয়ে হেঁটে শ্রীনিধি স্টেশন পর্যন্ত গেলে কেমন হয়? ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তে আস্তে রেললাইনের উপর দিয়ে শ্রীনিধি স্টেশনের দিকে এগোতে থাকি। এই চার-সাড়ে চার কিলোমিটার পথ হাঁটতে এক ঘণ্টার কম সময় লাগবে। এখানকার সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকি। হাতে বিকল্প আছে; মাঝে মাঝে গ্রামীণ সড়কের উপর দিয়ে চলা রিকশা। টায়ার্ড হয়ে গেলে রিকশায় উঠে পড়ব। শ্রীনিধি পৌঁছার পর চা খেতে খেতে ট্রেনের ঘোষণা শুনলাম।
গত রাতটা ভালো যায়নি। মির্জারচর থেকে টেঁটাযুদ্ধের চার-পাঁচজন আহত সৈনিক এসেছে। একজন তো বাঁশের হাতলসহ টেঁটা নিয়েই এসেছেন। তার অবর্ণনীয় কষ্ট দেখার মতো না। মাঝে মাঝে রোগীদের কষ্ট আর আত্মীয়স্বজনদের আকুতিতে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে মন চায়; কিন্তু আমাদের ট্রেনিং, পেশাদারিত্ব ও মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে অনেক যাতনা দেখতে হয়। ইমার্জেন্সি স্টাফ আলী হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য সহকারী কামরুল সাহেব আর সিস্টার মিলে ওটি রুমের করাত দিয়ে বাঁশের হাতল কেটে রোগীকে কিছুটা রিলিভ দেন। বাঁশগাড়ি, মধ্যনগর, শ্রীনগর, চর মধুয়া মেঘনার বিভিন্ন চরের ইউনিয়ন ও গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে গেলেই টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়। ঘোষণা দিয়ে এ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বছরের পর বছর চলছে। ২৪টি বিশাল ইউনিয়ন নিয়ে রায়পুরা উপজেলার মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র-আড়িয়াল খাঁ নদের অনেকগুলো চর পুলিশের কাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাজি লোকজন কোন কুকর্ম করে একদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, আশুগঞ্জ, অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নরসিংদীর সদর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নৌপথে পালিয়ে যায়। আলী হোসেন মিয়া নরম মানুষ। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রোগীর পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে রোগীর লোকদের মৃদু ভর্ৎসনা করেন এই বর্বর যুদ্ধের জন্য। রোগীর লোকজন নিজেদের উপর টেঁটা পড়ায় হুঁশে আসে- ‘ফরেন পার্টি আর গেরাইম্যা টেন্ডলগুলোর জন্য এই যুইজ্জ বছরের পর বছর চলতাছে, লকত ঝড়তাছে’। মামলা-মোকদ্দমায় চরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই অশান্তি।
বুড়া দাদি নাতি-নাতনি সামলে পানের বাটা খুলে পান চিবুচ্ছেন। উনার ছেলে স্টেশনে আসলেই ‘সিকরেট’ ফুকতে নিচে নামেন। একটু পরপর ধারাবিবরণী দিয়ে যান- ‘এহনও লাল বাত্তি জ্বলতাছে, আল্লাহ আল্লাহ করো এদিক থাইক্যা একটা কম্পুটার আর হেদিক থাইক্যা এক্সপ্রেইস ট্রেইন গেলেগাই আমরারে কেডা ঠেকায়।’
‘বাজান, কলা খাইন’- সামনের বুড়া দাদি আমার দিকে দুটি চম্পাকলা বাড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ আগে উনার বৌমা কুড়িদরে চম্পা কলা কিনেছেন। এর মধ্যে সালামত মিয়া চিরপরিচিত হাসি দিয়ে বলে- ‘আওজকা বিজনেস ডাইল’। সালামত মিয়া তেজগাঁও থেকে পুরো ঈশা খাঁ মেইল ট্রেনের উপরের তাক জুড়ে নিয়ে আসেন পাউরুটি। কমপক্ষে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটা পাতিভর্তি পাউরুটি। ট্রেনে দেদার বিক্রি হচ্ছে; একটা করে স্টেশন আসলেই সালামত মিয়া অতি তৎপরতার সঙ্গে জানালা দিয়ে পাতির পর পাতি পাউরুটি স্টেশনের চা দোকানগুলোতে সাপ্লাই দিতে থাকেন। মানিকখালী, বাজিতপুর, সরারচর যেতে যেতে টু-থার্ড পাউরুটি সাবাড়।
টিকেট চেকার ধীরে সুস্থে এদিক-ওদিক তাকান। এই একমাত্র ট্রেন দেখলাম যেখানে যাত্রীরা টিকেট চেকারকে ভয় পান না; আর টিকিট চেকারও টিকেট দেখতে সরমিন্দা হন। আমি লালচে ছোট শক্ত টিকেটটা দিতেই পেন্সিল দিয়ে রাইট চিহ্ন দিয়ে স্বস্তির হাসি হাসেন চেকার- উনার চাকরির মর্যাদা রক্ষা করতে পারায়। এই মেইল ট্রেনটাকে যাত্রীরা নিজের মনে করেন আর সরকারও ভর্তুকি দিয়ে গরিব যাত্রীদের সেবা দেন- টিকেট চেকারদের জোড়াজুড়ি নাই। বুড়া দাদি ‘বাজান, আরেক দিন টিকেট নিয়েন, আওজকা পান খাইন’- বলে টিটির দিকে পান বাড়িয়ে ধরেন।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]
আসফাক বীন রহমান
বৃহস্পতিবার, ০৬ জুলাই ২০২৩
‘ঝক্কড় ঝক্কড় মৈমনসিং ঢাকা যাইতে কতদিন’
আজকেও ঈশা খাঁ লেট। সেই কখন থেকে মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি- এখনো আসছে না। যদি সাড়ে তিনটার মধ্যে না আসে তবে অন্য ব্যবস্থা। এখান থেকে ভৈরব প্রায় ১৫ কিলোমিটার; মাঝখানে শ্রীনিধি আর দৌলতকান্দি স্টেশন। তিতাস কমিউটারের টিকেট বিক্রেতা জাফর মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে দশাসই শরীরে হাসির কাঁপন উঠিয়ে বলল- ‘গরিবের ট্রেন ঈশা খাঁ মেইলরে পুছে কেডা?’
জাফর মিয়া জানালো- ‘ঈশা খাঁ মেইল এহন আমীরগঞ্জে হাওয়া বাতাস খাইতাছে, আসর তামাতি আইতে পারে। আপনে স্যার তুলাতুলী থাইক্যা বারৈচা যাইয়া বাস ধরুইন।’ আমার টার্গেট বিকালে ঢাকা থেকে পৌঁছানো মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস। মেথিকান্দায় মহানগরের স্টপেজ নাই। আব্বা ট্রেন প্রেফার করেন, আমারও খুব পছন্দ রেলজার্নি।
রায়পুরা হাসপাতালে জয়েন করার পর থেকে একদিন ভোরবেলা তিতাস কমিউটারে মেথিকান্দায় নামি; পরদিন ডিউটি শেষে ঈশা খাঁ ধরে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই। বাংলাদেশ রেলওয়ের অবহেলিত ট্রেন ঈশা খাঁ মেইল; সকাল ১১টা ৩০ মিনিট নাগাদ কমলাপুর থেকে ছাড়ে আর রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ময়মনসিংহে পৌঁছার কথা। মাঝখানে গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছে। পাড়ি দেয় একচল্লিশটি স্টেশন। রাজধানী ঢাকাকে হাওরের উপজেলাগুলোর সঙ্গে কানেক্ট করেছে। কত সুন্দর সুন্দর নামের স্টেশনÑ নলছাটা, আড়িখোলা, হাঁটুভাঙ্গা, কালিয়াপ্রসাদ, ছয়সূতি, নীলগঞ্জ, গৌরীপুর। হুমায়ূন আহমেদ সূত্রে ‘সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট’, ‘গৌরীপুর জংশন’ ইত্যাদি নামগুলো ঈশা খাঁ মেইলে উঠলেই মনে নাড়া দেয়। মেইল ট্রেনের সঙ্গে থাকে একটি ডাকবাক্স রঙের লাল বগি।
এই ট্রেনে ‘সময় যেন থমকে দাঁড়ায়’। গ্রামীণ মানুষের কোন তাড়াহুড়া নেই; ঢাকা শহরের যানজট, টাইম ইজ মানি, প্র্যাকটিস নিয়ে কামড়াকামড়ি, হা-হুতাশ কিছুই নেই। প্রায় প্রত্যেক যাত্রী নিরাবেগ- ‘উঠছি যহন একসময় পৌঁছাইবাম’ অ্যাটিচুড। পুরোপুরি পারিবারিক পরিবেশ- দুই কথা তিন কথার মধ্যেই একজন আরেকজনের আপনজন হয়ে যায়।
‘স্যার এক কাপ চা খাইন’, পেটানো স্বাস্থ্যের বাদল মিয়া। উনার বাড়ি স্টেশনের আশপাশে মেথিকান্দা বা টুকিপুরা গ্রামে; পেশায় পাইপ মিস্ত্রি। হাসপাতালের পানির পাইপের কোন সমস্যা থাকলেই বাদল মিয়াকে যন্ত্রপাতিসহ দেখা যায়। লোকমুখে শুনতে পেয়েছি উনি খুব দুর্ধর্ষ মানুষ; তবে আমার চোখে কোন আলামত ধরা পড়ে নাই। এই এক সমস্যা- মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়ালে অনেকে চা-পান সাধেন আবার অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে পাশের জনকে ফিসফিস করে কিছু হয়তো বলেন। এর মধ্যে জাফর মিয়া এক অন্ধ গাতকের হাতের ডানায় ধরে আমার কাছে নিয়ে আসেন। ‘স্যার, মন্তাজ খুব ভালো গায়-একটা গান অর্ডার করেন।’ অন্ধ মন্তাজ মিয়াকে মাঝে মাঝে স্টেশনে দোতারা নিয়ে গাইতে দেখি। মন্তাজ মিয়া খুব চিন্তার স্বরে বলেন- ‘জাফর বাই, ঈশা খাঁ কি আউজকা আইতো না?’
‘আরে মন্তাজ পাগলা তুই আইজকা লায়পুরায় বেড়াইবি, ভৈরব যাওয়া লাগতো না’- জাফর মিয়া মন্তাজ মিয়াকে নিয়ে রাগ করে। মন্তাজ মিয়া বড় জামগাছের নিচে জুতমতো বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে গলায় সুর তোলে-
‘আমায় উদাসী বানাইলো গো
মরার কোকিলে।
আমায় উদাসী বানাইয়া গেল
বসন্তেরি কালে গো
মরার কোকিলে।’
বাদল মিয়ার চা আর মন্তাজ মিয়া-জাফর মিয়ার গানের পরিবেশনাও আমার মনের টেনশন কমাতে পারলো না। হঠাৎ মনে হলো আজকে একটা অ্যাডভেঞ্চার করলে কেমন হয়? এ সময় ভৈরব বা নরসিংদী থেকে কোন ট্রেন নাই। রেললাইনের স্লাবের উপর দিয়ে হেঁটে শ্রীনিধি স্টেশন পর্যন্ত গেলে কেমন হয়? ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তে আস্তে রেললাইনের উপর দিয়ে শ্রীনিধি স্টেশনের দিকে এগোতে থাকি। এই চার-সাড়ে চার কিলোমিটার পথ হাঁটতে এক ঘণ্টার কম সময় লাগবে। এখানকার সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকি। হাতে বিকল্প আছে; মাঝে মাঝে গ্রামীণ সড়কের উপর দিয়ে চলা রিকশা। টায়ার্ড হয়ে গেলে রিকশায় উঠে পড়ব। শ্রীনিধি পৌঁছার পর চা খেতে খেতে ট্রেনের ঘোষণা শুনলাম।
গত রাতটা ভালো যায়নি। মির্জারচর থেকে টেঁটাযুদ্ধের চার-পাঁচজন আহত সৈনিক এসেছে। একজন তো বাঁশের হাতলসহ টেঁটা নিয়েই এসেছেন। তার অবর্ণনীয় কষ্ট দেখার মতো না। মাঝে মাঝে রোগীদের কষ্ট আর আত্মীয়স্বজনদের আকুতিতে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে মন চায়; কিন্তু আমাদের ট্রেনিং, পেশাদারিত্ব ও মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে অনেক যাতনা দেখতে হয়। ইমার্জেন্সি স্টাফ আলী হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য সহকারী কামরুল সাহেব আর সিস্টার মিলে ওটি রুমের করাত দিয়ে বাঁশের হাতল কেটে রোগীকে কিছুটা রিলিভ দেন। বাঁশগাড়ি, মধ্যনগর, শ্রীনগর, চর মধুয়া মেঘনার বিভিন্ন চরের ইউনিয়ন ও গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে গেলেই টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়। ঘোষণা দিয়ে এ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বছরের পর বছর চলছে। ২৪টি বিশাল ইউনিয়ন নিয়ে রায়পুরা উপজেলার মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র-আড়িয়াল খাঁ নদের অনেকগুলো চর পুলিশের কাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাজি লোকজন কোন কুকর্ম করে একদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, আশুগঞ্জ, অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নরসিংদীর সদর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নৌপথে পালিয়ে যায়। আলী হোসেন মিয়া নরম মানুষ। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রোগীর পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে রোগীর লোকদের মৃদু ভর্ৎসনা করেন এই বর্বর যুদ্ধের জন্য। রোগীর লোকজন নিজেদের উপর টেঁটা পড়ায় হুঁশে আসে- ‘ফরেন পার্টি আর গেরাইম্যা টেন্ডলগুলোর জন্য এই যুইজ্জ বছরের পর বছর চলতাছে, লকত ঝড়তাছে’। মামলা-মোকদ্দমায় চরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই অশান্তি।
বুড়া দাদি নাতি-নাতনি সামলে পানের বাটা খুলে পান চিবুচ্ছেন। উনার ছেলে স্টেশনে আসলেই ‘সিকরেট’ ফুকতে নিচে নামেন। একটু পরপর ধারাবিবরণী দিয়ে যান- ‘এহনও লাল বাত্তি জ্বলতাছে, আল্লাহ আল্লাহ করো এদিক থাইক্যা একটা কম্পুটার আর হেদিক থাইক্যা এক্সপ্রেইস ট্রেইন গেলেগাই আমরারে কেডা ঠেকায়।’
‘বাজান, কলা খাইন’- সামনের বুড়া দাদি আমার দিকে দুটি চম্পাকলা বাড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ আগে উনার বৌমা কুড়িদরে চম্পা কলা কিনেছেন। এর মধ্যে সালামত মিয়া চিরপরিচিত হাসি দিয়ে বলে- ‘আওজকা বিজনেস ডাইল’। সালামত মিয়া তেজগাঁও থেকে পুরো ঈশা খাঁ মেইল ট্রেনের উপরের তাক জুড়ে নিয়ে আসেন পাউরুটি। কমপক্ষে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটা পাতিভর্তি পাউরুটি। ট্রেনে দেদার বিক্রি হচ্ছে; একটা করে স্টেশন আসলেই সালামত মিয়া অতি তৎপরতার সঙ্গে জানালা দিয়ে পাতির পর পাতি পাউরুটি স্টেশনের চা দোকানগুলোতে সাপ্লাই দিতে থাকেন। মানিকখালী, বাজিতপুর, সরারচর যেতে যেতে টু-থার্ড পাউরুটি সাবাড়।
টিকেট চেকার ধীরে সুস্থে এদিক-ওদিক তাকান। এই একমাত্র ট্রেন দেখলাম যেখানে যাত্রীরা টিকেট চেকারকে ভয় পান না; আর টিকিট চেকারও টিকেট দেখতে সরমিন্দা হন। আমি লালচে ছোট শক্ত টিকেটটা দিতেই পেন্সিল দিয়ে রাইট চিহ্ন দিয়ে স্বস্তির হাসি হাসেন চেকার- উনার চাকরির মর্যাদা রক্ষা করতে পারায়। এই মেইল ট্রেনটাকে যাত্রীরা নিজের মনে করেন আর সরকারও ভর্তুকি দিয়ে গরিব যাত্রীদের সেবা দেন- টিকেট চেকারদের জোড়াজুড়ি নাই। বুড়া দাদি ‘বাজান, আরেক দিন টিকেট নিয়েন, আওজকা পান খাইন’- বলে টিটির দিকে পান বাড়িয়ে ধরেন।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]