মাহতাব হোসাইন মাজেদ
গ্রামগঞ্জে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা মৌসুমে সাপের উপদ্রব বাড়ে। বিশেষ করে বর্ষাকালে গর্তে পানি ঢুকে পড়ায় সাপ লোকালয়ে চলে আসে। প্রতিবছর দেশে বন্যাসহ বিভিন্ন সময় সাপের কামড়ে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। এই সমসাময়িক বিপদ মোকাবিলায় এখনই সচেতন ও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন।
বাড়ির চারপাশের গর্ত, ফাটল, দেয়ালের ফাঁক, দরজা-জানালার ছিদ্রগুলো সাপের আশ্রয়ের আদর্শ জায়গা। এসব জায়গা ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে পেশাদার মিস্ত্রি বা সেবা সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এতে বাড়ির কাঠামোও মজবুত হবে, সাপের আশ্রয়ও কমবে।
ঝোপঝাড়, লম্বা ঘাস, ভাঙা আসবাব, কাঠের স্তূপ ইত্যাদি সাপের লুকানোর জায়গা তৈরি করে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার ও ঝাড়– দেয়া অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যেসব স্থানে ময়লা জমে, সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে জমিয়ে নিয়মিত অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে।
ময়লা-আবর্জনা ইঁদুর আকৃষ্ট করে এবং ইঁদুর আকৃষ্ট করে সাপকে। গ্রামাঞ্চলে মাটি চাপা দেয়া, শহরে ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। পোষা প্রাণীর খাবারের উচ্ছিষ্টও বাইরে এলোমেলো না ফেলা ভালো।
বৃষ্টি ও আর্দ্রতা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তৈরি করে, যা সাপের জন্য উপযোগী। বাড়ির সিঁড়ি, ড্রেন, বেসমেন্ট, রান্নাঘর সব জায়গায় পানি জমে থাকা রোধ করতে হবে। পাইপলাইনের লিক, টবের নিচে জমা পানি ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা ও নিষ্কাশন জরুরি।
গাঁদা ফুল, রসুন, কৃমি কাঠ প্রাকৃতিকভাবে সাপকে দূরে রাখে। আঙিনা, বারান্দা ও বাগানে এগুলো রোপণ করলে রাসায়নিক ছাড়াই সুরক্ষা পাওয়া যায়। তবে ভারি বৃষ্টির পর এগুলোর পুনঃপ্রয়োগ দরকার হয়।
সিডারউড, দারুচিনি, লবঙ্গের তেল বা ভিনেগারের তীব্র গন্ধ সাপ সহ্য করতে পারে না। এগুলোর জলীয় দ্রবণ ঘরের আশপাশে স্প্রে করা কার্যকর। তবে বৃষ্টির পর পুনরায় ব্যবহার করতে হবে।
বাড়ির সীমানায় বাঁশ বা কাঠের ঘের দিয়ে সাপের প্রবেশ প্রতিরোধ করা যায়। জানালায় জাল লাগানো উচিত। বেড়ার নিচে কিছু অংশ মাটির নিচে পুঁতে দেয়া এবং ওপরের অংশ উঁচু করে রাখা সাপ প্রতিরোধে কার্যকর।
যাদের বাগান করার অভ্যাস আছে, তারা গাঁদা ফুল, লেমনগ্রাস, রসুন দিয়ে সাপ প্রতিরোধী বাগান করতে পারেন। নিয়মিত পরিচর্যা ও ময়লা অপসারণের মাধ্যমে এটি কার্যকর রাখা যায়।
সাপ আলো ও কম্পন এড়িয়ে চলে। বাড়ির চারপাশে আলোর ব্যবস্থা, লাইট পোস্ট বা ভাইব্রেটিং ও আল্ট্রাসনিক ডিভাইস স্থাপন করলে সাপ দূরে থাকবে। এসব যন্ত্র পরিবেশ বা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর নয়।
সাপে কামড়ালে করণীয় : রোগীকে শান্ত রাখুন এবং আশ্বস্ত করুন। উত্তেজনা বিষ ছড়াতে সাহায্য করে। রোগীকে এমনভাবে শোয়ান যাতে কামড়ের স্থান হৃদয়ের নিচে থাকে। আঁটোসাঁটো পোশাক খুলে ফেলুন। আক্রান্ত স্থানকে নড়াচড়া না করিয়ে স্থির রাখুন।
কামড়ের স্থান রক্ত পড়তে দিন, চাপ দেবেন না। সম্ভব হলে সাপের ছবি তুলুন, তবে ধরতে যাবেন না। দ্রুত হাসপাতালে যান এবং অ্যান্টিভেনম নিতে বলুন।
যা করবেন না : সাবান দিয়ে ধোয়া, কেটে রক্ত বের করা, বরফ বা ঠা-া পানি প্রয়োগ, বিদ্যুৎ শক-এগুলো একদমই নয়। সাপ মারতে গিয়ে সময় নষ্ট করা নয়। অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন খাওয়া একেবারেই নিষেধ।
বাংলাদেশে ৮০টির মতো সাপের প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭৮টি বিষধর। কিন্তু ভুল ধারণা, ওঝার চিকিৎসা ও দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে সাপের কামড়ে প্রতিবছর প্রায় ৬০০০ মানুষ মারা যান। এছাড়া, চারগুণ বেশি মানুষ শারীরিক অক্ষমতায় ভোগেন।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম বিনামূল্যে পাওয়া যায়। সময়মতো চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বাড়লে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমানো সম্ভব।
সাপ আমাদের প্রতিবেশের অংশ। কিন্তু বর্ষা ও বন্যার সময়ে সাপের উপদ্রব থেকে নিজেকে, পরিবারকে এবং আশপাশের মানুষকে রক্ষায় আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়ি পরিষ্কার রাখা, গর্ত বন্ধ করা, ময়লা অপসারণ, আলো ব্যবহার, বাগান তৈরি, প্রাকৃতিক তেল প্রয়োগ এসব ছোট ছোট অভ্যাস আমাদের বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আতঙ্ক নয়, সতর্কতা ও বিজ্ঞানসম্মত আচরণই পারে সাপে কামড়ের ভয়াবহতা ঠেকাতে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রোববার, ২৭ জুলাই ২০২৫
গ্রামগঞ্জে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা মৌসুমে সাপের উপদ্রব বাড়ে। বিশেষ করে বর্ষাকালে গর্তে পানি ঢুকে পড়ায় সাপ লোকালয়ে চলে আসে। প্রতিবছর দেশে বন্যাসহ বিভিন্ন সময় সাপের কামড়ে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন। এই সমসাময়িক বিপদ মোকাবিলায় এখনই সচেতন ও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন।
বাড়ির চারপাশের গর্ত, ফাটল, দেয়ালের ফাঁক, দরজা-জানালার ছিদ্রগুলো সাপের আশ্রয়ের আদর্শ জায়গা। এসব জায়গা ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে পেশাদার মিস্ত্রি বা সেবা সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এতে বাড়ির কাঠামোও মজবুত হবে, সাপের আশ্রয়ও কমবে।
ঝোপঝাড়, লম্বা ঘাস, ভাঙা আসবাব, কাঠের স্তূপ ইত্যাদি সাপের লুকানোর জায়গা তৈরি করে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার ও ঝাড়– দেয়া অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যেসব স্থানে ময়লা জমে, সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে জমিয়ে নিয়মিত অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে।
ময়লা-আবর্জনা ইঁদুর আকৃষ্ট করে এবং ইঁদুর আকৃষ্ট করে সাপকে। গ্রামাঞ্চলে মাটি চাপা দেয়া, শহরে ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। পোষা প্রাণীর খাবারের উচ্ছিষ্টও বাইরে এলোমেলো না ফেলা ভালো।
বৃষ্টি ও আর্দ্রতা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তৈরি করে, যা সাপের জন্য উপযোগী। বাড়ির সিঁড়ি, ড্রেন, বেসমেন্ট, রান্নাঘর সব জায়গায় পানি জমে থাকা রোধ করতে হবে। পাইপলাইনের লিক, টবের নিচে জমা পানি ইত্যাদি নিয়মিত পরীক্ষা ও নিষ্কাশন জরুরি।
গাঁদা ফুল, রসুন, কৃমি কাঠ প্রাকৃতিকভাবে সাপকে দূরে রাখে। আঙিনা, বারান্দা ও বাগানে এগুলো রোপণ করলে রাসায়নিক ছাড়াই সুরক্ষা পাওয়া যায়। তবে ভারি বৃষ্টির পর এগুলোর পুনঃপ্রয়োগ দরকার হয়।
সিডারউড, দারুচিনি, লবঙ্গের তেল বা ভিনেগারের তীব্র গন্ধ সাপ সহ্য করতে পারে না। এগুলোর জলীয় দ্রবণ ঘরের আশপাশে স্প্রে করা কার্যকর। তবে বৃষ্টির পর পুনরায় ব্যবহার করতে হবে।
বাড়ির সীমানায় বাঁশ বা কাঠের ঘের দিয়ে সাপের প্রবেশ প্রতিরোধ করা যায়। জানালায় জাল লাগানো উচিত। বেড়ার নিচে কিছু অংশ মাটির নিচে পুঁতে দেয়া এবং ওপরের অংশ উঁচু করে রাখা সাপ প্রতিরোধে কার্যকর।
যাদের বাগান করার অভ্যাস আছে, তারা গাঁদা ফুল, লেমনগ্রাস, রসুন দিয়ে সাপ প্রতিরোধী বাগান করতে পারেন। নিয়মিত পরিচর্যা ও ময়লা অপসারণের মাধ্যমে এটি কার্যকর রাখা যায়।
সাপ আলো ও কম্পন এড়িয়ে চলে। বাড়ির চারপাশে আলোর ব্যবস্থা, লাইট পোস্ট বা ভাইব্রেটিং ও আল্ট্রাসনিক ডিভাইস স্থাপন করলে সাপ দূরে থাকবে। এসব যন্ত্র পরিবেশ বা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর নয়।
সাপে কামড়ালে করণীয় : রোগীকে শান্ত রাখুন এবং আশ্বস্ত করুন। উত্তেজনা বিষ ছড়াতে সাহায্য করে। রোগীকে এমনভাবে শোয়ান যাতে কামড়ের স্থান হৃদয়ের নিচে থাকে। আঁটোসাঁটো পোশাক খুলে ফেলুন। আক্রান্ত স্থানকে নড়াচড়া না করিয়ে স্থির রাখুন।
কামড়ের স্থান রক্ত পড়তে দিন, চাপ দেবেন না। সম্ভব হলে সাপের ছবি তুলুন, তবে ধরতে যাবেন না। দ্রুত হাসপাতালে যান এবং অ্যান্টিভেনম নিতে বলুন।
যা করবেন না : সাবান দিয়ে ধোয়া, কেটে রক্ত বের করা, বরফ বা ঠা-া পানি প্রয়োগ, বিদ্যুৎ শক-এগুলো একদমই নয়। সাপ মারতে গিয়ে সময় নষ্ট করা নয়। অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন খাওয়া একেবারেই নিষেধ।
বাংলাদেশে ৮০টির মতো সাপের প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭৮টি বিষধর। কিন্তু ভুল ধারণা, ওঝার চিকিৎসা ও দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে সাপের কামড়ে প্রতিবছর প্রায় ৬০০০ মানুষ মারা যান। এছাড়া, চারগুণ বেশি মানুষ শারীরিক অক্ষমতায় ভোগেন।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম বিনামূল্যে পাওয়া যায়। সময়মতো চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বাড়লে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমানো সম্ভব।
সাপ আমাদের প্রতিবেশের অংশ। কিন্তু বর্ষা ও বন্যার সময়ে সাপের উপদ্রব থেকে নিজেকে, পরিবারকে এবং আশপাশের মানুষকে রক্ষায় আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়ি পরিষ্কার রাখা, গর্ত বন্ধ করা, ময়লা অপসারণ, আলো ব্যবহার, বাগান তৈরি, প্রাকৃতিক তেল প্রয়োগ এসব ছোট ছোট অভ্যাস আমাদের বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আতঙ্ক নয়, সতর্কতা ও বিজ্ঞানসম্মত আচরণই পারে সাপে কামড়ের ভয়াবহতা ঠেকাতে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]