অরূপরতন চৌধুরী
যাদের ডায়াবেটিস নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে
১৪ নভেম্বর ‘বিশ্বে ডায়াবেটিস দিবস’। ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে দিবসটি ঘোষণা করে। ১৪ নভেম্বর সার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এর জন্মদিন। চার্লস বেস্টের সাথে যৌথভাবে তিনি ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। ইনসুলিনের আবিষ্কার ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়, তাই তার জন্মদিনকেই এই দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের বিরাট একটা অংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি। কাজের খাতিরে একজন মানুষ কর্মস্থলেই বেশি সময় কাটান। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ কর্মস্থলে সচেতনত না থাকলে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং উৎপাদনশীলতাও কমে যায়
১৯৯১ সাল হতে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগী অতিদ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে ফলে, বিষয়টি বৈশ্বিক উদ্বেগে পরিণত হয়। কিন্তু, এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা ছিলো না। ডায়াবেটিস মূলত, রক্তের শর্করা সম্পর্কিত একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপাকীয় রোগ। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা এবং যথাযথ নিয়মাবলী মানা না হলে প্রাণঘাতি হয়ে ওঠে। চিকিৎসা না নেওয়া হলে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু ও অন্য যে কেনা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস প্রচার, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে নীতি ও কর্মপরিকল্পনা জোরদার করার লক্ষ্যে বর্তমানে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
২০২৫ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রতিপাদ্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ডায়াবেটিস রোগীদের বিরাট একটা অংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি। কাজের খাতিরে একজন মানুষ কর্মস্থলেই বেশি সময় কাটান। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ কর্মস্থলে সচেতনত না থাকলে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং উৎপাদনশীলতাও কমে যায়। অর্থাৎ কর্মস্থলে অভ্যাসগত জীবনচক্র ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ, কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হয়। এছাড়া মানসিক চাপ, খাবারে অনিয়ম এবং ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড গ্রহণ ইত্যাদি কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। তাই কর্মস্থলে স্বাস্থ্যকর জীবনধারার নিয়মাবলী চর্চ্চা প্রয়োজন। একই সাথে কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা যেমন: রক্তে শর্করার মাত্রা, ওজন পরিমাপ ও রক্তচাপ পরীক্ষার সুযোগ রাখা এবং কর্মস্থলে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বাস্থ্যবান কর্মীই প্রতিষ্ঠান ও দেশের উৎপাদনশীলতায় চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখছে।
বর্তমানে অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ডায়াবেটিস’ এবং শারীরিক অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে রোগটি। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বেশি। ২০২৪ সালের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে ৮০ কোটির বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ, এর আগের বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিলো, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪২ কোটি। অর্থাৎ- সাম্প্রতিক সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে! আইডিএফ অনুমান করে যে, বিশ্বে ৫৩.৭ কোটি লোকের ডায়াবেটিস রয়েছে। প্রতি দশজনে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং যেটা ২০৩০ সাল নাগাদ ৬৪৩ মিলিয়ন ছাড়াবে! ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৭ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিস এর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিস এর কারণে, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯% ছিলো।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে, যার বড় কারণ অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যারা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েও বিষয়টি জানেই না। তবে, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) বলছে, বাংলাদেশে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের জানা যায়, দেশে ডায়াবেটিস রোগীর ২-৩ শতাংশের (প্রায় ৪ লাখ) বয়স ১৬ বছরের কম, যাদের বেশির ভাগই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উদ্বেগের বিষয় হলো, পুরো বিশ্বে অল্পবয়সীদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার সবচেয়ে বেশি! সামাগ্রীকভাবে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছ। এর বড় কারণ হলো, অস্বাস্থ্যকর জীবন যাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস। এছাড়াও ভেজাল খাদ্য, পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় উপাদানে অরিতিক্ত দূষণও সমস্যা প্রকট করে তুলছে। তবে অল্পবয়সীদের মধ্যে ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, কোমলপানীয় এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে যা ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগের বড় কারণ। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়া শহুরে জীবন মূলত, খাঁচায় বন্দি জীবন। পর্যাপ্ত পাবলিক প্লেস যেমন: মাঠ, পার্ক, উদ্যান ইত্যাদি না থাকায় জনগণ বাসাবন্দি হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিশুরা খেলাধূলা ও শারিরীক কসরত না করতে পারায় মুটিয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ যেমন: ধূমপান, জর্দা, গুলা তামাকপাতা সেবন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে তৈরি করা একটি নতুন গবেষণা কাজ মতামত দিয়েছে যে, ধূমপান ছেড়ে দিলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৩০-৪০% পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। ধূমপান ত্যাগ করা কেবল টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিই হ্রাস করে না, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনেও অনেক সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিসের জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস করে। গবেষণা প্রমান করে যে, ধূমপান রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। ধূমপান ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, কিডনি জটিলতা এবং অন্ধত্বের ঝুঁকিও বাড়ায়।
ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক: ধূমপায়ীদের যদি ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস না থাকে তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হতে পারে। প্রথম ২ বছর এটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধূমপান টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর একটি কারণ, প্রকৃতপক্ষে, যারা সিগারেট পান করেন তাদের ধূমপান না করা লোকদের তুলনায় টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা ৩০%-৪০% বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন, তাদের ইনসুলিন ডোজ বা মাত্রা কার্যকর করতে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা বেশি। একজন ধূমপায়ী যত বেশি সিগারেট পান করবেন, তার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তত বেশি। যে ধরনের ডায়াবেটিস থাকুক না কেন, ধূমপান বা তামাকজাত পণ্য (নিকোটিন) গ্রহন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা আরও জটিল করে তোলে। যদি কারো ডায়াবেটিস হয় এবং তিনি যদি ধূমপান করেন তবে ডায়াবেটিস থেকে তাঁর বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন: হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং পায়ে দুর্বল রক্ত প্রবাহ যা সংক্রমণ, আলসার এবং সম্ভাব্য পা কেটে ফেলার কারণ হতে পারে (পায়ের আঙ্গুল বা পায়ের অংশ অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে শরীরের কোনও অংশ কেটে ফেলা) তাছাড়াও রেটিনোপ্যাথি চোখের রোগ যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হাতে ও পায়ে ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ু যা অসাড়তা, ব্যথা, দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
অনেকে ইলেকট্রনিক সিগারেট (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং ইত্যাদি) তামাকপণ্যের বিকল্প ভেবে ব্যবহার করেন, যা ভুল পদক্ষেপ। ই-সিগারেট নেশাদায়ক এবং এর মধ্যেও নিকোটিনসহ ক্ষতিকারক রাসায়নিক আছে যা সিগারেটেও পাওয়া যায়। সুতরাং, এই পণ্যগুলি রক্তে শর্করাকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নিকোটিন কীভাবে রক্তে শর্করা প্রভাবিত করে ? নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা উপরে বা নীচে উঠাতে/নামাতে পারে। নিকোটিন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দেহের গ্লুকোজ ব্যবহার করার কার্যকারিতাকে পরিবর্তন করে, রক্তে চিনি যা কোষগুলিকে শক্তি দেয়। এটি অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে, এটি ডায়াবেটিসকে আরও খারাপ করতে পারে। অন্যদিকে নিকোটিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ইনসুলিন গ্রহনকারী ব্যক্তিদের জন্য মারাত্মক লো ব্লাড গ্লুকোজ (হাইপোগ্লাইসোমিয়া) সৃষ্টি করতে পারে। নিকোটিন শরীরকে আরও ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি করতে ট্রিগার করতে পারে, যা হচ্ছে ইনসুলিন প্রতিরোধের সাথে যুক্ত এক ধরনের ফ্যাট। অন্যদিকে নিকোটিন হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। যা ইনসুলিনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে যাদের ডায়াবেটিস এবং যারা ধূমপায়ী তাদর রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিনের বেশী ডোজ প্রয়োজন হয়। ধূমপায়ীদের যখন রক্তের গ্লুকোজ কয়েক বছরের জন্য নিয়মিত খুব বেশি থাকে, তখন এটি হৃদরোগ এবং কিডনি, স্নায়ু এবং চোখের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
ধূমপান এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং এবং ধূমপান সেটাকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। যেহেতু নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিস এর সাথে মুখের রোগের সম্পর্ক:
ডায়ারেটিস এর পাঁচটি জটিলতার মধ্যে মাড়ির রোগ হচ্ছে ষষ্ঠ জটিলতা। যাদের মাড়ির রোগ আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই জটিলতার মধ্যে অন্যতম লক্ষণ হলো মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, মুখে দূর্গন্ধ হওয়া. মাড়ি থেকে দাঁত আলগা হয়ে যাওয়া ও অকালে দাঁত হারিয়ে ফেলা। এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মাড়ির যত্ন করা জরুরি। যেমন: দুইবেলা সকালে নাস্তার পর ও রাতে আহারের পর দাঁত ব্রাশ করা, ডেন্টাল ফ্লস দিয়ে দুই দাঁতের ফাক থেকে খাদ্যকণা পরিস্কার করা ও জীবানুনাশক মাউথওয়াশ বা অল্প গরম লবন পানিতে মুখ কুলকুচি করা। একইসাথে প্রতি ৬ মাস অন্তর একজন রেজিষ্টার্ড ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে মুখ পরীক্ষা করা ও দাঁতের স্কেলিং করা (মাড়ি থেকে খাদ্যকণা বা ডেন্টাল প্ল্যাক পরিস্কার করা)।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ধূমপান ছেড়ে দেয়া কেন প্রয়োজন?
আপনি কতবার ধূমপান করেছেন-বা কখন ছেড়ে দিলে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। আপনি যখন ধূমপান বন্ধ করবেন সেই সময় থেকে আপনার শরীর নিজেই নিরাময় শুরু করবে। যেমন: ১২ ঘন্টার মধ্যে, আপনার রক্তে কার্বন মনোক্সাইড (সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একটি বিষাক্ত গ্যাস) স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাসের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন এবং ফুসফুস আগের চাইতে উন্নত হবে। এক বছরের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন অনেক বেশি স্বাভাবিক হবে। এক বছরের মধ্যে আপনার হৃদরোগ ঝুঁকি যারা এখনও ধূমপান করে এমন ব্যক্তির চেয়ে অর্ধেক নেমে আসবে। ধূমপান ত্যাগ করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ করতে সহায়তা করে। শরীর ধূমপানমুক্ত হওয়ার সাথে সামঞ্জস্য না হওয়া পর্যন্ত রক্তে শর্করা পরিমান ঘন ঘন পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ: ধূমপান করবেন না। কারণ, ধূমপান আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়, ওজন বেশি হলে ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক জরুরী। ঘন ঘন সিগারেট গ্রহনকারী ধূমপায়ীদের আরো ওজন বাড়তে পারে। এমনকি যদি ওজন বেশি না হয় তবুও পেটের ফ্যাট ইনসুলিন প্রতিরোধের এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ধূমপানের কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সেমন: ‘খারাপ এলডিএল’ কোলেস্টেরল বাড়তে পারে। একইভাবে ‘ভাল এইচডিএল’ কোলেস্টেরল হ্রাস পেতে পারে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ট্রাইগ্লিসারাইডগুলিও বাড়ায়। এগুলি রক্তের মধ্যে এক ধরনের চর্বি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও জীবন যাপন পরিবর্তন করতে হবে তেমনি ধূমপান ও তামাক জাতীয় সকল বস্তু জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা জীবন থেকে বর্জন করতে হবে। এভাবেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ হবে। সেই সাথে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার হলে তা সারে না। তবে, এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারলে একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এজন্য যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের ডায়াবেটিস নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। কর্মস্থলে যেখানে মানুষ তার বেশিরভাগ সময় কাটায় সেখানেও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ তন্মধ্যে- ধূমপান ছেড়ে দিতেই হবে। এবং ধূমপান ছাড়তে নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, তবে অনেক ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। আসুন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হই, কর্মস্থলসহ সর্বত্র সচেতনতা ছড়িয়ে দেই। কারণ, রোগের চিকিৎসার চাইতে প্রতিরোধ শ্রেয়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস); ভিজিটিং প্রফেসর, ডেন্টাল সার্জারী বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল; কো-অর্ডিনেটর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
অরূপরতন চৌধুরী
যাদের ডায়াবেটিস নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
১৪ নভেম্বর ‘বিশ্বে ডায়াবেটিস দিবস’। ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে দিবসটি ঘোষণা করে। ১৪ নভেম্বর সার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এর জন্মদিন। চার্লস বেস্টের সাথে যৌথভাবে তিনি ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। ইনসুলিনের আবিষ্কার ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়, তাই তার জন্মদিনকেই এই দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের বিরাট একটা অংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি। কাজের খাতিরে একজন মানুষ কর্মস্থলেই বেশি সময় কাটান। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ কর্মস্থলে সচেতনত না থাকলে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং উৎপাদনশীলতাও কমে যায়
১৯৯১ সাল হতে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগী অতিদ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে ফলে, বিষয়টি বৈশ্বিক উদ্বেগে পরিণত হয়। কিন্তু, এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা ছিলো না। ডায়াবেটিস মূলত, রক্তের শর্করা সম্পর্কিত একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপাকীয় রোগ। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা এবং যথাযথ নিয়মাবলী মানা না হলে প্রাণঘাতি হয়ে ওঠে। চিকিৎসা না নেওয়া হলে হৃৎপিণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু ও অন্য যে কেনা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস প্রচার, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে নীতি ও কর্মপরিকল্পনা জোরদার করার লক্ষ্যে বর্তমানে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
২০২৫ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রতিপাদ্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ডায়াবেটিস রোগীদের বিরাট একটা অংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি। কাজের খাতিরে একজন মানুষ কর্মস্থলেই বেশি সময় কাটান। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ কর্মস্থলে সচেতনত না থাকলে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং উৎপাদনশীলতাও কমে যায়। অর্থাৎ কর্মস্থলে অভ্যাসগত জীবনচক্র ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ, কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হয়। এছাড়া মানসিক চাপ, খাবারে অনিয়ম এবং ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড গ্রহণ ইত্যাদি কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। তাই কর্মস্থলে স্বাস্থ্যকর জীবনধারার নিয়মাবলী চর্চ্চা প্রয়োজন। একই সাথে কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা যেমন: রক্তে শর্করার মাত্রা, ওজন পরিমাপ ও রক্তচাপ পরীক্ষার সুযোগ রাখা এবং কর্মস্থলে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, স্বাস্থ্যবান কর্মীই প্রতিষ্ঠান ও দেশের উৎপাদনশীলতায় চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখছে।
বর্তমানে অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ডায়াবেটিস’ এবং শারীরিক অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে রোগটি। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বেশি। ২০২৪ সালের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে ৮০ কোটির বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ, এর আগের বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিলো, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪২ কোটি। অর্থাৎ- সাম্প্রতিক সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে! আইডিএফ অনুমান করে যে, বিশ্বে ৫৩.৭ কোটি লোকের ডায়াবেটিস রয়েছে। প্রতি দশজনে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং যেটা ২০৩০ সাল নাগাদ ৬৪৩ মিলিয়ন ছাড়াবে! ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৭ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিস এর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিস এর কারণে, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯% ছিলো।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে, যার বড় কারণ অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যারা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েও বিষয়টি জানেই না। তবে, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) বলছে, বাংলাদেশে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের জানা যায়, দেশে ডায়াবেটিস রোগীর ২-৩ শতাংশের (প্রায় ৪ লাখ) বয়স ১৬ বছরের কম, যাদের বেশির ভাগই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উদ্বেগের বিষয় হলো, পুরো বিশ্বে অল্পবয়সীদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার সবচেয়ে বেশি! সামাগ্রীকভাবে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছ। এর বড় কারণ হলো, অস্বাস্থ্যকর জীবন যাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস। এছাড়াও ভেজাল খাদ্য, পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় উপাদানে অরিতিক্ত দূষণও সমস্যা প্রকট করে তুলছে। তবে অল্পবয়সীদের মধ্যে ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, কোমলপানীয় এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে যা ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগের বড় কারণ। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়া শহুরে জীবন মূলত, খাঁচায় বন্দি জীবন। পর্যাপ্ত পাবলিক প্লেস যেমন: মাঠ, পার্ক, উদ্যান ইত্যাদি না থাকায় জনগণ বাসাবন্দি হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিশুরা খেলাধূলা ও শারিরীক কসরত না করতে পারায় মুটিয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ যেমন: ধূমপান, জর্দা, গুলা তামাকপাতা সেবন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে তৈরি করা একটি নতুন গবেষণা কাজ মতামত দিয়েছে যে, ধূমপান ছেড়ে দিলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৩০-৪০% পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। ধূমপান ত্যাগ করা কেবল টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিই হ্রাস করে না, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনেও অনেক সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিসের জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস করে। গবেষণা প্রমান করে যে, ধূমপান রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। ধূমপান ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, কিডনি জটিলতা এবং অন্ধত্বের ঝুঁকিও বাড়ায়।
ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক: ধূমপায়ীদের যদি ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস না থাকে তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হতে পারে। প্রথম ২ বছর এটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধূমপান টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর একটি কারণ, প্রকৃতপক্ষে, যারা সিগারেট পান করেন তাদের ধূমপান না করা লোকদের তুলনায় টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা ৩০%-৪০% বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন, তাদের ইনসুলিন ডোজ বা মাত্রা কার্যকর করতে সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা বেশি। একজন ধূমপায়ী যত বেশি সিগারেট পান করবেন, তার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তত বেশি। যে ধরনের ডায়াবেটিস থাকুক না কেন, ধূমপান বা তামাকজাত পণ্য (নিকোটিন) গ্রহন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা আরও জটিল করে তোলে। যদি কারো ডায়াবেটিস হয় এবং তিনি যদি ধূমপান করেন তবে ডায়াবেটিস থেকে তাঁর বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন: হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং পায়ে দুর্বল রক্ত প্রবাহ যা সংক্রমণ, আলসার এবং সম্ভাব্য পা কেটে ফেলার কারণ হতে পারে (পায়ের আঙ্গুল বা পায়ের অংশ অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে শরীরের কোনও অংশ কেটে ফেলা) তাছাড়াও রেটিনোপ্যাথি চোখের রোগ যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হাতে ও পায়ে ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ু যা অসাড়তা, ব্যথা, দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
অনেকে ইলেকট্রনিক সিগারেট (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং ইত্যাদি) তামাকপণ্যের বিকল্প ভেবে ব্যবহার করেন, যা ভুল পদক্ষেপ। ই-সিগারেট নেশাদায়ক এবং এর মধ্যেও নিকোটিনসহ ক্ষতিকারক রাসায়নিক আছে যা সিগারেটেও পাওয়া যায়। সুতরাং, এই পণ্যগুলি রক্তে শর্করাকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নিকোটিন কীভাবে রক্তে শর্করা প্রভাবিত করে ? নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা উপরে বা নীচে উঠাতে/নামাতে পারে। নিকোটিন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দেহের গ্লুকোজ ব্যবহার করার কার্যকারিতাকে পরিবর্তন করে, রক্তে চিনি যা কোষগুলিকে শক্তি দেয়। এটি অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে, এটি ডায়াবেটিসকে আরও খারাপ করতে পারে। অন্যদিকে নিকোটিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ইনসুলিন গ্রহনকারী ব্যক্তিদের জন্য মারাত্মক লো ব্লাড গ্লুকোজ (হাইপোগ্লাইসোমিয়া) সৃষ্টি করতে পারে। নিকোটিন শরীরকে আরও ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি করতে ট্রিগার করতে পারে, যা হচ্ছে ইনসুলিন প্রতিরোধের সাথে যুক্ত এক ধরনের ফ্যাট। অন্যদিকে নিকোটিন হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। যা ইনসুলিনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে যাদের ডায়াবেটিস এবং যারা ধূমপায়ী তাদর রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিনের বেশী ডোজ প্রয়োজন হয়। ধূমপায়ীদের যখন রক্তের গ্লুকোজ কয়েক বছরের জন্য নিয়মিত খুব বেশি থাকে, তখন এটি হৃদরোগ এবং কিডনি, স্নায়ু এবং চোখের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
ধূমপান এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং এবং ধূমপান সেটাকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। যেহেতু নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিস এর সাথে মুখের রোগের সম্পর্ক:
ডায়ারেটিস এর পাঁচটি জটিলতার মধ্যে মাড়ির রোগ হচ্ছে ষষ্ঠ জটিলতা। যাদের মাড়ির রোগ আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই জটিলতার মধ্যে অন্যতম লক্ষণ হলো মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, মুখে দূর্গন্ধ হওয়া. মাড়ি থেকে দাঁত আলগা হয়ে যাওয়া ও অকালে দাঁত হারিয়ে ফেলা। এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মাড়ির যত্ন করা জরুরি। যেমন: দুইবেলা সকালে নাস্তার পর ও রাতে আহারের পর দাঁত ব্রাশ করা, ডেন্টাল ফ্লস দিয়ে দুই দাঁতের ফাক থেকে খাদ্যকণা পরিস্কার করা ও জীবানুনাশক মাউথওয়াশ বা অল্প গরম লবন পানিতে মুখ কুলকুচি করা। একইসাথে প্রতি ৬ মাস অন্তর একজন রেজিষ্টার্ড ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে মুখ পরীক্ষা করা ও দাঁতের স্কেলিং করা (মাড়ি থেকে খাদ্যকণা বা ডেন্টাল প্ল্যাক পরিস্কার করা)।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ধূমপান ছেড়ে দেয়া কেন প্রয়োজন?
আপনি কতবার ধূমপান করেছেন-বা কখন ছেড়ে দিলে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। আপনি যখন ধূমপান বন্ধ করবেন সেই সময় থেকে আপনার শরীর নিজেই নিরাময় শুরু করবে। যেমন: ১২ ঘন্টার মধ্যে, আপনার রক্তে কার্বন মনোক্সাইড (সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একটি বিষাক্ত গ্যাস) স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাসের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন এবং ফুসফুস আগের চাইতে উন্নত হবে। এক বছরের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন অনেক বেশি স্বাভাবিক হবে। এক বছরের মধ্যে আপনার হৃদরোগ ঝুঁকি যারা এখনও ধূমপান করে এমন ব্যক্তির চেয়ে অর্ধেক নেমে আসবে। ধূমপান ত্যাগ করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ করতে সহায়তা করে। শরীর ধূমপানমুক্ত হওয়ার সাথে সামঞ্জস্য না হওয়া পর্যন্ত রক্তে শর্করা পরিমান ঘন ঘন পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ: ধূমপান করবেন না। কারণ, ধূমপান আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়, ওজন বেশি হলে ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক জরুরী। ঘন ঘন সিগারেট গ্রহনকারী ধূমপায়ীদের আরো ওজন বাড়তে পারে। এমনকি যদি ওজন বেশি না হয় তবুও পেটের ফ্যাট ইনসুলিন প্রতিরোধের এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ধূমপানের কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সেমন: ‘খারাপ এলডিএল’ কোলেস্টেরল বাড়তে পারে। একইভাবে ‘ভাল এইচডিএল’ কোলেস্টেরল হ্রাস পেতে পারে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ট্রাইগ্লিসারাইডগুলিও বাড়ায়। এগুলি রক্তের মধ্যে এক ধরনের চর্বি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও জীবন যাপন পরিবর্তন করতে হবে তেমনি ধূমপান ও তামাক জাতীয় সকল বস্তু জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা জীবন থেকে বর্জন করতে হবে। এভাবেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ হবে। সেই সাথে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার হলে তা সারে না। তবে, এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারলে একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এজন্য যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের ডায়াবেটিস নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। কর্মস্থলে যেখানে মানুষ তার বেশিরভাগ সময় কাটায় সেখানেও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ তন্মধ্যে- ধূমপান ছেড়ে দিতেই হবে। এবং ধূমপান ছাড়তে নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, তবে অনেক ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। আসুন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হই, কর্মস্থলসহ সর্বত্র সচেতনতা ছড়িয়ে দেই। কারণ, রোগের চিকিৎসার চাইতে প্রতিরোধ শ্রেয়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস); ভিজিটিং প্রফেসর, ডেন্টাল সার্জারী বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল; কো-অর্ডিনেটর ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট]