alt

তামাকের ক্ষতি হ্রাস: বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে যে নীতি

: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (ডব্লিউএইচও) দুই জন সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলোকে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারকে, জনস্বাস্থ্যের মূল কৌশল হিসেবে ‘টোব্যাকোহার্মরিডাকশন (টিএইচআর)’ বা তামাক ক্ষতি হ্রাসনীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে ২০৬০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১০ কোটির ও বেশি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তাদের এই আহ্বান এসেছে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ব্যডব্লিউএইচ ও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকোকন্ট্রোল (এফসটিসি) কপ-১১ বৈঠকের আগে, যেখানে প্রতিনিধি দল ভবিষ্যতের তামাকনীতির দিক নির্দেশনা পর্যালোচনা করবেন। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন, নিকোটিন পাউচের মতো নিরাপদ বিকল্প পণ্য ধূমপান জনিত মৃত্যুহার কমাতে প্রমাণিত ভাবে কার্যকর একটি পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এরজন্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সঠিক নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করা।

চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমদানিনীতি আদেশ ২০২১–২০২৪ এ সংশোধন এনেছে। এই সংশোধনের মাধ্যমে প্রচলিত তামাকজাত পণ্যের নিরাপদ বিকল্প, যেমনই-সিগারেট ও ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে দেশে ক্ষতি হ্রাসে সহায়ক পণ্যের প্রবেশাধিকার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশ বৈজ্ঞানিকভাবে এই ধরনের পণ্যকে ধূমপায়ীদের ধীরে ধীরে প্রচলিত সিগারেট থেকে দূরে রাখার কার্যকর উপায় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর ১৩.১% ধূমপান করেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ধূমপান বিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, নিরাপদ বিকল্প পণ্যের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হলে দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে, এবং এটি সেই বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যনীতির পরিপন্থী, যেখানে নিষেধাজ্ঞার বদলে নিয়ন্ত্রণেরও পর জোর দেওয়া হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সনদের বিভিন্ন স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দেশীয় তামাক নিয়ন্ত্রণনীতিতে অযথা প্রভাব বিস্তার করছে।

ব্লুম বার্গ ফিলান থ্রপিসতাদের সহযোগী সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রিকিডস (সিটিএফকে) ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস-এর মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে নীতিগত প্রচারণা কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। এই দুটি সংস্থার নাম জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণসেল (এনটিসিসি)-এর ওয়েব সাইটে অংশীদার প্রতিষ্ঠান হিসেবেও তালিকাভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের বিদেশি সহযোগিতা মূলক কার্যক্রম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ফিলিপাইন ও পাকিস্তানসহ একাধিক দেশের সরকার এই সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বাহ্যিক তহবিল ও প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার অভিযোগ তুলেছে।

এর পর থেকে এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা থেকে সরে এসে আরও ভারসাম্য পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া নিরাপদ নিকোটিন পণ্যগুলোকে মান নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণের আওতায় এনেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার ঐতিহাসিক ‘কন্ট্রোল অব স্মোকিং প্রোডাক্টস অ্যাক্ট ২০২৪’ প্রচলিত তামাক এবং বিকল্প নিকোটিন পণ্য উভয়ের জন্য একটি সমন্বিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। এই আইনে পণ্য নিবন্ধন, সঠিক লেবেলিং, বিজ্ঞাপন সীমাবদ্ধতা, এবং নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো তরুণদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, একই সঙ্গে প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপায়ীদের জন্য বৈজ্ঞানিক ভাবে যাচাই করা ক্ষতি-হ্রাসের বিকল্প পণ্য ব্যবহারের সুযোগ রাখা। এই পদক্ষেপটি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় বাস্তব মুখী তামাক নিয়ন্ত্রণের এক সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ভোক্তা অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করেছে।

অন্যদিকে, সৌদিআরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও ধূমপান কমানোর লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সৌদিআরবের ‘বাদায়েল’ উদ্যোগ, যা সৌদিভিশন ২০৩০–এর অংশ হিসেবে কোয়ালিটি অব লাইফ প্রোগ্রামের আওতায় চালু করা হয়। বাদায়েল প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হলো ধূমপায়ীদের ধীরে ধীরে প্রচলিত সিগারেট ছেড়ে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ নিকোটিন বিকল্পে স্থানান্তর করতে সহায়তাকরা। প্রাথমিকভাবে ২০৩২ সালের মধ্যে এক মিলিয়ন ধূমপায়ীকে ধূমপানমুক্ত করতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও, এই লক্ষ্য এখন ২০২৬ সালের মধ্যেই অর্জনের পথে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো, সরকারি সহায়তায় জনসচেতন তাকার্যক্রম এবং বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশ গ্রহণ এই তিনটি উপাদান বাদায়েলের সফলতার মূল কারণ। এটি প্রমাণ করেছে যে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সঠিক নিয়ন্ত্রণই তামাক ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর ও টেকসই সমাধান দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও, বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউরোপীয়ক মিশনের তথ্য অনুযায়ী, সুইডেন তার ধূমপানের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে, যা তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম দেশ হিসেবে ‘ধূমপানমুক্তদেশ’ হওয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছে। গবেষকরা এই সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন নিকোটিন পাউচের মতো নিরাপদ নিকোটিন বিকল্পের ব্যাপক ব্যবহারকে, যা শুধু ধূমপানের হারই কমায়নি, বরং ইউরোপে ক্যানসারের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছে।

এমন কি যুক্তরাষ্ট্রেও, যেখানে ব্লুমবার্গফিলানথ্রপিস ও এর সহযোগী এনজিওগুলো অবস্থিত, সেখানকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিকোটিন পণ্যের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নভিত্তিক নিয়ন্ত্রক নীতি অনুসরণ করে। এই নীতিতে পণ্যগুলোকে ঝুঁকি ও ক্ষতি হ্রাসের দিক থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা ও অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্বনীতি মালা ও বিদেশে এসব সংস্থার প্রচারিত অবস্থানের মধ্যে একটি স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে, যা অনেকের মধ্যে নীতিগত সামঞ্জস্য ও প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

সুইডেন, মালয়েশিয়া ও সৌদিআরবের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, স্বচ্ছতা ও জনসচেতনতার ভিত্তিতে গঠিত নিয়ন্ত্রণনীতি বাস্তবসম্মতভাবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ইতিবাচক ফল দিতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হলে, তা জাতীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে, প্রমাণভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করবে, এবং দেশকে তার ‘তামাকমুক্তবাংলাদেশ’ লক্ষ্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

ছবি

ডায়াবেটিস: ঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ছবি

শিক্ষার হাল-হাকিকত : পরীক্ষার ফলই কি মূল উদ্দেশ্য?

নতুন বাংলাদেশে নারীর পথচলা : অগ্রগতি নাকি পশ্চাদপদতা?

ছবি

কপ-৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ : বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

কপ-৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ: বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং : বুদ্ধিমানরাও প্রতারিত হন!

ছবি

আশা ছিল সরকার আলোচনার জায়গা তৈরি করবে: মাহিন সুলতান

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস

মানুষের অমরত্বের সন্ধানে

বইমেলা ফেব্রুয়ারিতেই চাই

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক আমাদের জীবন: আত্মশুদ্ধি, মৈত্রী ও ত্যাগের মহিমা

ছবি

অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভশক্তির জাগরণ

রামু ট্র্যাজেডি: এক যুগ পরেও বিচারের দেখা মেলেনি

ছবি

নারীবিরোধী সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে: ফওজিয়া মোসলেম

ছবি

বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’: সততার এক মর্মান্তিক দলিল

নারীর নিরাপত্তা : সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

নারীর নিরাপত্তা : সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

প্রাথমিক শিক্ষা : এবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে

ছবি

বদরুদ্দীন উমর : কণ্ঠহীন সময়ের অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর

চীনের তিব্বত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প : আচরণগত অর্থনীতির আলোকে ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ

বর্ষায় সাপের উপদ্রব ও আমাদের করণীয়

মুল্যস্ফীতি: বাংলাদেশের বাজারে কি একে বশে আনা সম্ভব?

মানসিক স্বাস্থ্য : একটি মানবিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন

এ অবহেলার শেষ কোথায়?

কালো জাদুর কুসংস্কার : এক অন্ধকার হত্যাযজ্ঞের মুখোশ

ভোক্তা সচেতনতাই নিরাপদ খাদ্যের মূল চাবিকাঠি

ছবি

মোগল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা : এক হারানো সম্ভাবনার খোঁজে

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

tab

তামাকের ক্ষতি হ্রাস: বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে যে নীতি

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (ডব্লিউএইচও) দুই জন সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলোকে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারকে, জনস্বাস্থ্যের মূল কৌশল হিসেবে ‘টোব্যাকোহার্মরিডাকশন (টিএইচআর)’ বা তামাক ক্ষতি হ্রাসনীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে ২০৬০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১০ কোটির ও বেশি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তাদের এই আহ্বান এসেছে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ব্যডব্লিউএইচ ও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকোকন্ট্রোল (এফসটিসি) কপ-১১ বৈঠকের আগে, যেখানে প্রতিনিধি দল ভবিষ্যতের তামাকনীতির দিক নির্দেশনা পর্যালোচনা করবেন। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন, নিকোটিন পাউচের মতো নিরাপদ বিকল্প পণ্য ধূমপান জনিত মৃত্যুহার কমাতে প্রমাণিত ভাবে কার্যকর একটি পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এরজন্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সঠিক নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করা।

চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমদানিনীতি আদেশ ২০২১–২০২৪ এ সংশোধন এনেছে। এই সংশোধনের মাধ্যমে প্রচলিত তামাকজাত পণ্যের নিরাপদ বিকল্প, যেমনই-সিগারেট ও ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ইএনডিএস) এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে দেশে ক্ষতি হ্রাসে সহায়ক পণ্যের প্রবেশাধিকার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশ বৈজ্ঞানিকভাবে এই ধরনের পণ্যকে ধূমপায়ীদের ধীরে ধীরে প্রচলিত সিগারেট থেকে দূরে রাখার কার্যকর উপায় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর ১৩.১% ধূমপান করেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ধূমপান বিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, নিরাপদ বিকল্প পণ্যের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হলে দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে, এবং এটি সেই বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যনীতির পরিপন্থী, যেখানে নিষেধাজ্ঞার বদলে নিয়ন্ত্রণেরও পর জোর দেওয়া হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সনদের বিভিন্ন স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দেশীয় তামাক নিয়ন্ত্রণনীতিতে অযথা প্রভাব বিস্তার করছে।

ব্লুম বার্গ ফিলান থ্রপিসতাদের সহযোগী সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রিকিডস (সিটিএফকে) ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস-এর মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে নীতিগত প্রচারণা কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। এই দুটি সংস্থার নাম জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণসেল (এনটিসিসি)-এর ওয়েব সাইটে অংশীদার প্রতিষ্ঠান হিসেবেও তালিকাভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের বিদেশি সহযোগিতা মূলক কার্যক্রম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ফিলিপাইন ও পাকিস্তানসহ একাধিক দেশের সরকার এই সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বাহ্যিক তহবিল ও প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করার অভিযোগ তুলেছে।

এর পর থেকে এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা থেকে সরে এসে আরও ভারসাম্য পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া নিরাপদ নিকোটিন পণ্যগুলোকে মান নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণের আওতায় এনেছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার ঐতিহাসিক ‘কন্ট্রোল অব স্মোকিং প্রোডাক্টস অ্যাক্ট ২০২৪’ প্রচলিত তামাক এবং বিকল্প নিকোটিন পণ্য উভয়ের জন্য একটি সমন্বিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। এই আইনে পণ্য নিবন্ধন, সঠিক লেবেলিং, বিজ্ঞাপন সীমাবদ্ধতা, এবং নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো তরুণদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, একই সঙ্গে প্রাপ্ত বয়স্ক ধূমপায়ীদের জন্য বৈজ্ঞানিক ভাবে যাচাই করা ক্ষতি-হ্রাসের বিকল্প পণ্য ব্যবহারের সুযোগ রাখা। এই পদক্ষেপটি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় বাস্তব মুখী তামাক নিয়ন্ত্রণের এক সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ভোক্তা অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করেছে।

অন্যদিকে, সৌদিআরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও ধূমপান কমানোর লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সৌদিআরবের ‘বাদায়েল’ উদ্যোগ, যা সৌদিভিশন ২০৩০–এর অংশ হিসেবে কোয়ালিটি অব লাইফ প্রোগ্রামের আওতায় চালু করা হয়। বাদায়েল প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হলো ধূমপায়ীদের ধীরে ধীরে প্রচলিত সিগারেট ছেড়ে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ নিকোটিন বিকল্পে স্থানান্তর করতে সহায়তাকরা। প্রাথমিকভাবে ২০৩২ সালের মধ্যে এক মিলিয়ন ধূমপায়ীকে ধূমপানমুক্ত করতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও, এই লক্ষ্য এখন ২০২৬ সালের মধ্যেই অর্জনের পথে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো, সরকারি সহায়তায় জনসচেতন তাকার্যক্রম এবং বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশ গ্রহণ এই তিনটি উপাদান বাদায়েলের সফলতার মূল কারণ। এটি প্রমাণ করেছে যে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সঠিক নিয়ন্ত্রণই তামাক ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর ও টেকসই সমাধান দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও, বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউরোপীয়ক মিশনের তথ্য অনুযায়ী, সুইডেন তার ধূমপানের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে, যা তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম দেশ হিসেবে ‘ধূমপানমুক্তদেশ’ হওয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছে। গবেষকরা এই সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন নিকোটিন পাউচের মতো নিরাপদ নিকোটিন বিকল্পের ব্যাপক ব্যবহারকে, যা শুধু ধূমপানের হারই কমায়নি, বরং ইউরোপে ক্যানসারের সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছে।

এমন কি যুক্তরাষ্ট্রেও, যেখানে ব্লুমবার্গফিলানথ্রপিস ও এর সহযোগী এনজিওগুলো অবস্থিত, সেখানকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিকোটিন পণ্যের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নভিত্তিক নিয়ন্ত্রক নীতি অনুসরণ করে। এই নীতিতে পণ্যগুলোকে ঝুঁকি ও ক্ষতি হ্রাসের দিক থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা ও অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্বনীতি মালা ও বিদেশে এসব সংস্থার প্রচারিত অবস্থানের মধ্যে একটি স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে, যা অনেকের মধ্যে নীতিগত সামঞ্জস্য ও প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

সুইডেন, মালয়েশিয়া ও সৌদিআরবের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, স্বচ্ছতা ও জনসচেতনতার ভিত্তিতে গঠিত নিয়ন্ত্রণনীতি বাস্তবসম্মতভাবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ইতিবাচক ফল দিতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হলে, তা জাতীয় নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে, প্রমাণভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করবে, এবং দেশকে তার ‘তামাকমুক্তবাংলাদেশ’ লক্ষ্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

back to top