সাঈদ চৌধুরী
কয়েকদিন আগে রাতে লক্ষীপুরে বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সাত বছরের শিশুটি পুড়ে মারা গেল! আরও দগ্ধ হলো তিনজন। কতা নৃশংস হলে মানুষ এমন হতে পারে, চিন্তা করে পাওয়া যায়! তার আগের দিন নৃশংসতার ভয়াবহ স্বাক্ষী হলাম আমরা। আমাদের প্রিয় নবীকে কে বা কারা কটুক্তি করেছে, সেই জন্য এক যুবককে পিটিয়ে পুড়ে মারা হলো সকলের সামনে। তারপর র্যাব থেকে জানানো হলো কোনো ধরণের কটুক্তির প্রমাণই পাওয়া যায়নি।
আমাদের নবী ছিলেন দয়ার সাগর। ছোটবেলা থেকেই তিনি আলামীন বা বিশ্বাসী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তারপর নবুয়াত প্রাপ্তি, সারা বিশ্বের নেতা হয়ে ওঠা এবং তার জীবন দর্শনে তিনি যে কাজের দীপ্তি ছড়িয়েছেন, সেখানে কোথাও সামান্য কঠোর হওয়ার চিহ্নও নেই।
অথচ আমরা নবীজির উম্মত দাবী করেও যা করে চলছি, সেখানে শান্তির কোনো চিহ্ন নেই যেন। যে হিন্দু যুবককে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, তার বাবা বলছিলেন সে বাটন ফোন ব্যবহার করছিল। তার চোখের অশ্রু কি পরিমাণ অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে, আপনি অনুভব করেছেন? একজন মানুষ তার সন্তানকে এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখার পর তার বাঁচাটা কত কঠিন হতে পারে!
এই হত্যাকাণ্ডে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সামাজিকভাবে আমরা কিভাবে এমন খুনি হয়ে উঠছি? কিভাবে আমাদেরও নিষ্ঠুরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো!
এই মানুষটিকে মারার সময় ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিলো, অনেক শিশু-কিশোররাও উপস্থিত ছিলেন। তারা কিভাবে শিখে যাচ্ছে হত্যার আনন্দ! বর্বর এ সময় আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবন দর্শন না শিখিয়ে আমরা যা শেখাচ্ছি, তা আমাদের কোন পথে নিয়ে যাবে?
এই হত্যায় গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়? সঠিক কারণটি খুঁজে বের করুন। শোনা যাচ্ছে লাইনম্যান প্রথমে তাকে বলেছিল যে ধর্ম অবমাননার কথা বললে তোর বিচার করা হবে-এমন কথা! প্রতিবাদী ও অধিকার আদায় করতে গেলেই এমন করতে হবে!
এত কিছু হলো, আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামে যারা ছিলেন, তাদের অবস্থান তখন কোথায় ছিলো? ভালুকা ওসির ব্যাখ্যা কিভাবে দেবেন? প্রশাসন কি এই জবাব চাইবে, কি ভালুকা থানার অফিস ইনচার্জের কাছেও?
লক্ষীপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুনের বিষয়টিও সহজ নয়। দরজা বন্ধ করে আগুন দেওয়ার ঘটনা বলা হয়েছে। দ্রুত খুঁজে বের করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করুন। তরুণ হাদির জানাযা দেখলাম আমরা, আমরা বিমর্ষ, শোকাহত! কিন্তু হাদিকে তো আমরা হারালাম। অপরাধীরা কোথায়? তাদের শাস্তি হলেও কি মহামূল্যবান এই প্রাণ আমরা পাবো? আমরা সুন্দর বাংলাদেশের কথা বলি। এভাবে দেশের মানুষ অস্থির হয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠলে আমরা কিভাবে এদেশকে স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো?
তারপর হাদির মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে হামলা, আগুনের এ দৃশ্য আমাদের আরও বেশি কাতর করে তুলেছে! ছায়ানটে, উদীচীতে হামলা হয়েছে। একাত্তর, জুলাই আমাদের যে যুদ্ধের মুখোমুখি করেছিল, তা সবইতো দেশকে নিজের মত করে পাবার উপলক্ষ তৈরীর জন্যই।
যারা ধর্মের নাম করে নৃশংসতা প্রদর্শন করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনুন। যারা কোনো ধর্মকে অবমাননা করছে, তাদের শাস্তি দিন। এ দেশ সবার।
রাজনৈতিকভাবে যারা দেশের জন্য কাজ করছে, যারা লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, তাদের নিরাপত্তা দিন। সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব সরকারের। বিভিন্ন জায়গায় অঘটনের পর বাণী নয়, বরং প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডে নিরাপত্তা বিষয়ক মিটিং করুন, মানুষকে বোঝান যে আপনারা সবাই দেশের জন্য কাজ করছেন।
সামনে নির্বাচন। এখন নিরাপত্তার জায়গাটি সুসংহত করতেই হবে। রাজনৈতিক নেতা যারা আছেন, তাদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো খোলাখুলি ভাবে আলাপ করুন। মবের মত সামাজিক অস্থিরতা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিন। আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।
[লেখক: রসায়নবিদ]