গাজী তারেক আজিজ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত পনেরো মাস ছিল এক অবিরাম অস্থিরতা, নাটকীয় পট পরিবর্তন এবং গভীর অনিশ্চয়তার সময়কাল। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ, সাংবিধানিক বিতর্ক, লাগাতার আন্দোলন এবং অবশেষে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা- সব মিলিয়ে এই সময়কালকে দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। দেশের আপামর জনসাধারণের মনে নির্বাচন নিয়ে যে বিপুল মাতবোল (উত্তেজনা ও আলোচনা) বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে একটিই আকাক্সক্ষা: একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, এবং সকলের অংশগ্রহণে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। দেশের জনগণ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংঘাতের কবল থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্থিতিশীল, বৈধ এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা দেখতে চায়। রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ সাপেক্ষে নির্বাচনের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও এর চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হলো।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি ছিল গত পনেরো মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল বীজ। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জন, নজিরবিহীন কম ভোটার উপস্থিতি, এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের কারণে নতুন নির্বাচিত সরকার শুরু থেকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে তার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা সংকটে পড়ে। এই নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করেছে বলে সমালোচকরা মত দেন। সরকার গঠন হলেও রাজপথে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন থামেনি। বরং, বিভিন্ন ইস্যুতে ছোট ছোট আন্দোলনগুলো এক সময় বড় আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো, এই নির্বাচনের সমালোচনা করে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই চাপ ও দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অসন্তোষের মিশেলে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল, যা শেষ পর্যন্ত এক মহাবিস্ফোরণে রূপ নেয়। যদিও বিপরীতে অবস্থান নেয়াদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাদের ভাষ্য একটা নির্বাচিত সরকাকে উৎখাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে যত দিন গড়িয়ে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংঘটিত জুলাই অভ্যুত্থান গত পনেরো মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে দ্রুত তা একটি সর্বজনীন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়, যা সরকারের পতন ঘটাতে বাধ্য করে। এই আন্দোলনের তীব্রতা, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, দেশের মানুষ বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তৎকালীন সরকারের পতন হয় এবং দেশের সংবিধানিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা ঘটে- একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার গঠিত হয় একটি অলিখিত চুক্তির ভিত্তিতে, যা ‘জুলাই সনদ’ নামে পরিচিত। এই সনদের মূল এজেন্ডা ছিল দ্রুততম সময়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করা, এবং রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করা। এই পট পরিবর্তন দেশের রাজনীতিকে রাতারাতি নতুন পথে চালিত করলেও, তা নতুন করে আরও বহু জটিলতার জন্ম দেয়। যদিও আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্রদলগুলো বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়া আন্দোলনকারীদের বয়ানকে পূঁজি করে শক্ত অবস্থান নিয়ে বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার ও এর দায় নিতে কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। যেমন পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আন্দোলনে অংশ নেয়াদের হতাহতের সংখ্যা নিয়ে। পটপরিবর্তনের ফলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সংখ্যা ও জাতিসংঘের উল্লেখিত সংখ্যার হেরফের নিয়ে বিতর্ক।
আওয়ামী লীগ যথারীতি দাবি করে আসছে জাতিসংঘের উল্লেখিত সংখ্যায় সরকার পতনের পরবর্তীতে নিহত পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমেত কিনা যা সাকুল্যে কিনা তা উল্লেখ নেই। আবার মেট্রোরেল, সচিবালয়ে বা পুলিশ হত্যার কথা অকপটে টিভি টকশোতে একজন সমন্বয়কের স্বীকারকে স্বীকারোক্তি হিসেবে দাবি করা। এতে আরেকটু সাবলীল ভাষায় বলেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি মিডিয়া ব্রিফিংয়ে দাবি করে বলেন, যেসব গুলিতে আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে তা দেশের পুলিশ বাহিনীর হাতে নেই। আর তার অব্যবহিত পরেই তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়াও জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছিল। এই উপদেষ্টা এর আগে ১/১১ সরকারেরও উপদেষ্টা ছিলেন। তাই তার কথাও অর্থবহ বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করলেও, প্রক্রিয়াটি মোটেও মসৃণ হয়নি। জুলাই সনদের শর্তাবলি বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হবে, নাকি আলাদাভাবে হবে- তা নিয়ে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে মতপার্থক্য চরমে ওঠে। বহু রাজনৈতিক দল এবং গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ববৃন্দ নির্বাচনের আগে গণহত্যার বিচার এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কারের ওপর জোর দেন। এই শর্তগুলো পূরণের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনের দিনক্ষণ বারবার পিছিয়ে যায়, যা মানুষের মনে নতুন করে সংশয় সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক মেরুকরণ এই সময়ে আরও তীব্র হয়েছে। একদিকে, আন্দোলনে বিজয়ীরা তাদের দাবি আদায়ে অনড়, অন্যদিকে, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দলের নেতারা নানা আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতায় জর্জরিত। আন্দোলন চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বহু রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রুজু হয়। বানের তীব্রতায় বাড়তে থাকে মামলা। ধারাবাহিকতায় গায়েবি মামলা ও বাণিজ্য। যা দেশজুড়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। সরকার ঘোষণা করে তদন্ত করে নিরপরাধ লোকদের বাদ দেয়া হবে। যেনতেন গ্রেফতার নয়। যদিও সে কথা কেবলি কথার কথা হিসেবে আলোচনায় রয়ে যায়। এই পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেকর্ড ৫৮৬টি মামলা রুজু হয় দেশব্যাপী। ইতোমধ্যে একটি মামলায় আইসিটি তাকে মৃত্যুদণ্ড ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও একই দণ্ডাদেশ এবং সাবেক আইজিপি মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে পাঁচ বছরের দণ্ডাদেশ প্রদান করে গত ১৭ নভেম্বর এই রায় প্রদান করেন।
রায় নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ এবং রাজনীতির মাঠ পক্ষে-বিপক্ষে সরগরম। কেউ রায়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙতে বুলডোজার নিয়ে হামলে পড়েছেন। এতে উৎসাহ পরামর্শ উদ্দীপনা হয়তো আর্থিক সহযোগিতাও দিয়েছেন প্রবাসী ডা. পিনাকী। কারণও স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত যৌথবাহিনীর সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ, পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও আক্রমণ সামাল দিতে না পেরে রমনা জোনের ডিসি মাসুদ অগত্যা দ্বারস্থ হন তথাকথিত সেই ইনফ্লুয়েন্সার পিনাকীর। পরে পিনাকীর অডিও বার্তায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তাহলে আর থাকলো কি?
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়েও সেই পিনাকীসহ বেশ কয়েকজনের নাম আন্দোলনে সমর্থন সহযোগিতা পরামর্শ অনুপ্রেরণা এই জাতীয় অনেক কথায় ফুটে ওঠায় প্রবাসী সেইসব লোক পরবর্তীতে নিজেদের অবস্থান কোথায় দেখতে চাইতে পারেন তা অনুমানেই শিউরে উঠি! হয়তো সংবিধানে তাদের নাম ওঠাতে নয়া নয়া ফন্দি আঁটেন কিনা তা নিয়েও শঙ্কিত হতে হচ্ছে। তবে না জানি ওই যে, দ্বিতীয় স্বাধীনতার ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ দাবি করে বসলেও অত্যুক্তি হবে না বোধ করি! তবে কোটার দাবি কি শেষ হয়েছে? নাকি নতুন মোড়কে ফিরে এলো? আর তা-ইতো ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদী সানন্দে বলে বলে ওঠেন, ‘আরে ৭১ এর বিরুদ্ধেই তো ২৪ ঘটানো হয়েছে’। আর তা-ই শঙ্কা আশঙ্কায় রূপ নেয়। কখন জানি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে দেশের ‘এসোসিয়েট সিটিজেন’ বানিয়ে ভোটাধিকার, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার, শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দাবি তোলে বসে, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা, জাতির জনক পরিবর্তনের দাবির মত করে।
বিরোধী শিবির বারবার অভিযোগ করে আসছে যে, এই গ্রেপ্তার ও মামলাগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের পথে বড় বাধা। তারা কর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার ছাড়া একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, হরতাল-অবরোধ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় সহিংস ঘটনা ঘটেছে, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়েও পত্রিকার পাতা ভরে ওঠে, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর পলাতক নেতাদের স্ত্রী-কন্যাদের ওপর দাবির কথা নাই-বা বলা হলো।
গত পনেরো মাসে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। বিতর্কিত নির্বাচনগুলো আয়োজনের প্রেক্ষাপটে ইসির সংস্কার এবং তার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য ছিল। বর্তমান ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার জায়গা তৈরি করতে আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। তারা ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং সীমানা পুনর্বিন্যাসের মতো কাজগুলো করলেও, বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে চাপ ছিল। নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপই অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি, গত পনেরো মাস ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া নজরে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রতিবেশী ভারত-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের আগ্রহ এবং উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দেওয়ায় তা দেশীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। তাদের অব্যাহত চাপ ও নজরদারি নিশ্চিত করেছে যে, নির্বাচন প্রক্রিয়া যেন পূর্বের মতো প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। আন্তর্জাতিক মহলের এই চাপ নিঃসন্দেহে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনে বাধ্য করেছে। তবে নির্বাচন কমিশন কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত এবং প্রতীক ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেললেও অতীত ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি এমনটা নেই। শুধু ৯৬ সালে বিএনপির একতরফা নির্বাচন ছাড়া। নির্বাচন কমিশন এবারই ব্যতিক্রম কাজ করেছে, নির্বাচনী প্রচারে পোস্টার মুদ্রণ, সাঁটানো, প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। তবে নির্বাচনে আন্তর্জাতিক এবং দেশিয় যে আগ্রহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে করে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যর্থ হলে নিকট অতীত অর্থাৎ সাবেক সিইসি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হুদার সাথে ঘটানো ঘটনার আরেকটা পুনরাবৃত্তি চাইবেন এমনটা মনে করার কোন কারণ আছে ভাবার যৌক্তিকতা বা শঙ্কা কি দেখছেন বোদ্ধামহল বা বিশ্লেষকদের কেউ?
রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর অর্থনীতিকে “গভীর গহ্বর থেকে উদ্ধার করা” অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ এবং ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার মতো বিষয়গুলো সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে তা বড় বাধা সৃষ্টি করবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে। ব্যবসায়ীরা স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য একটি বৈধ ও গণতান্ত্রিক সরকারের অপেক্ষায় আছে। দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখন বহুলাংশে নির্ভর করছে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে না এলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও আস্থা ফিরে পাবে না। যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছেন কেউ কেউ।
বর্তমানে দেশ একটি চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হলেও, এখনও সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলো গণভোট, জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণে সংশয় প্রকাশ করে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
এতদিনের রাজনৈতিক চাপা উত্তেজনার পর সাধারণ মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা হলো- একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। দেশের গণতন্ত্রের উত্তরণ, বিনিয়োগ এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন ব্যর্থ হলে কেবল গণতন্ত্রই নয়, দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও গভীর সংকটে পড়বে। তথাপিও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে চান না বলে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হলেও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করা কতা সক্ষম হবে তা-ও দেখার বিষয়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতেও একটা পক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। সেই দলে আছে গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াত ও এনসিপিসহ ছোট-বড় কয়েকটি দল। তবে সকল সরকারের সময়ের মত এবারও কিছু ‘কিংস পার্টি’র অভিযোগ রয়েছে। যারা কার্যত ডামি হিসেবে মাঠে থাকবে অনুমেয়। অবশ্য এনসিপিকেও অনেকেই কিংস পার্টির তকমা দিয়ে রেখেছেন। তবে দলটির নেতাদের অসংলগ্ন কথাবার্তাকে বাগ্মিতা বলেও অনেকের ভুল হলে সেই ভুল ভাঙতেও সময় লাগেনি। দেখা যাক ফলাফল। জনগণ কাকে রাখল আর কাকে প্রত্যাখ্যান করল! তবে জনগণের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে আরও সময় পেরোতে হবে, এটা বলতে দার্শনিক হতে হচ্ছে না। কারণ একটা রাষ্ট্রকাঠামো ফাংশন করতে একটা ইঞ্জিনের মতো সকল পার্টস সচল থাকা চাই। একটা সুস্থ সবল মানুষের মত। আদতে বরাবরই রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যারা আসীন হন, তাদের কাছে আমরা ‘ঊনমানুষ’ বটে! না হলে ৫৪ বছর পেরিয়েও স্বাধীনতা খুঁজতে হয় কেন?
গত পনেরো মাসের ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন কেবল একটি রুটিন প্রক্রিয়া নয়, এটি ক্ষমতার বৈধতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক জ্বলন্ত অগ্নিপরীক্ষা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে থাকা সীমিত সময়ে সব দল ও জনগণের আস্থা অর্জন করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের দলীয় স্বার্থ ও বিভেদ অতিক্রম করে, সম্মিলিত আকাক্সক্ষা ও জাতীয় চাওয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি, রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি বন্ধ এবং সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই নির্বাচন ব্যর্থ হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হোক, গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের রায়কে শিরোধার্য করে দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। জনগণের মাতবোলকে একটি অর্থবহ, গণতান্ত্রিক ফলাফলে রূপ দিতে পারাটাই হবে এই অস্থির যাত্রাপথের সার্থকতা। প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় অভ্যুত্থানই ক্ষমতা পরিবর্তনের নিয়ামক না হোক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]