আহছান উল্লাহ
উচ্চশিক্ষা খাত আজ এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছে, যখন দ্রুত বদলে যাওয়া প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার, আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন আমাদের একাডেমিক নেতৃত্বকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে গ্লোবাল একাডেমিক লিডারশিপ এক্সেলেন্স প্রোগ্রাম (গ্যালেপ ২.০)-এ অংশ নেওয়া আমার পেশাগত জীবনে যেন নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
গত ৯–১২ নভেম্বর ২০২৫ মালয়েশিয়ার একেপ্ট(উচ্চশিক্ষা নেতৃত্ব একাডেমি) ও আইএসটিএসি–আইআইইউএম(ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামীক থট অ্যান্ড সিভিলাইজেশন – ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া) ক্যাম্পাসে চার দিনের এই শেখার যাত্রা আমাকে যেমন নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, তেমনি আমার নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। ২০ টি দেশের ৫০ জন একাডেমিক এই প্রোগ্রামটিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক এই লিডারশিপ এক্সেলেন্স প্রোগ্রামটি ছিল সম্পূর্ণ ফান্ডেড। ফলে নির্বাচিত অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণ ফি এবং থাকা-খাওয়ার সকল ব্যয় মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় বহন করেছে। পাশাপাশি, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমার মালয়েশিয়া যাতায়াতের ব্যয়ভার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বহন করেছে।
শুরু থেকেই আয়োজকদের আন্তরিকতা, যত্ন আর সুবিন্যস্ত আয়োজন আমাকে সত্যিই ছুঁয়ে গেছে। তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং প্রত্যেকটি সেশনের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছিল যেখানে শেখাটা কখনোই চাপের মতো লাগেনি—বরং মনে হয়েছে, আমি যেন একটি সহযোগিতাপূর্ণ পরিবারের অংশ। এই মানবিকতা ও পেশাদারিত্বের মেলবন্ধনই প্রোগ্রামটিকে আমার কাছে বিশেষ করে তুলেছে, আমার জন্য পুরো অভিজ্ঞতাটি ছিল গভীরভাবে অর্থবহ।
প্রোগ্রামের সেশনগুলোতে আমরা অংশগ্রহণকারীরা বিশ্বমানের শিক্ষাবিদদের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাদের জ্ঞানের গভীরতা ছিল অসাধারণ। প্রফেসর ড. উম্মু আতিয়া আহমাদ জাকুয়ান এবং প্রফেসর ড. শুকরান আব্দ রহমান-এর "মাইন্ড-সেটিং" সেশন মূল্যবোধভিত্তিক নেতৃত্বের ধারণার মাধ্যমে আমার চিন্তার কাঠামোকে আরও মজবুত করেছে। প্রফেসর দাতো’ এলিজাবেথ লি, প্রফেসর ড. মুশতাক আল–আতাবি, এবং প্রফেসর এমেরিটা দাতুক ড. আসমা ইসমাইল-এর মতো বক্তাদের জ্ঞানের প্রখরতা ও প্রজ্ঞা ছিল যেমন মুগ্ধ করার মতো, তেমনই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের বিশাল অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাদের ব্যক্তিগত বিনয় ও সহজলভ্যতা আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের কাছ থেকে আমি শিখেছি যে, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে উদ্ভাবন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা শুধু দক্ষতা নয়—এটি চরিত্র ও মানবিকতারও বিকাশ ঘটায়। এই জ্ঞান আমাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবিক উভয় দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে।
গ্যালেপ ২.০–এর অন্যতম শিক্ষণীয় দিক ছিল "বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং উচ্চশিক্ষার ভূমিকা" নিয়ে আলোচনা। প্রফেসর দাতুক ড. মোহদ তাজুদ্দিন মোহদ নিংগাল ও ড. গো চি লিয়ং-এর বিশ্লেষণ আমাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে যে, আধুনিক বিশ্ব যে প্রযুক্তিগত বিপ্লব, জলবায়ু সংকট ও দ্রুত পরিবর্তনশীল চাকরি বাজারের মুখোমুখি, তার মোকাবিলায় আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রস্তুত হতে হবে।
আমার লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেবল ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং জাতীয় নীতি-নির্ধারকদের জন্য থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করার সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই উপলব্ধি আমাকে দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য নতুনভাবে প্রস্তুত করেছে।
প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আয়োজিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি কর্মশালা। এই কর্মশালাগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্বের কৌশলগুলো ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগের শিক্ষা হাতে-কলমে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রফেসর ড. হারশিতা আইনি হারুনের কাছ থেকে উচ্চশিক্ষায় কৌশলগত পরিকল্পনা শেখার পর আমি এখন আমার প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্য ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর রূপকল্প তৈরি করতে প্রস্তুত। দাতো’ ড. শানমুগানাথন পালানিসামাই-এর উদ্ভাবন ও টেকসইতা নিয়ে আলোচনা ডিজিটাল রূপান্তরের প্রভাবকে আমাদের পাঠ্যক্রমে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। অন্যদিকে, ড. শরীফা ফাতিমাহ আলযাহরা-এর সমন্বিত একাডেমিক কার্যক্রমের কৌশলগুলো আন্তঃবিষয়ক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কার্যকরভাবে প্রয়োগের পথ দেখিয়েছে। এই প্রায়োগিক শিক্ষাগুলো আমার প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য।
কর্মসূচির শেষ দিকে আইএসটিএসি–আইআইইউএম ক্যাম্পাসের সাঈয়্যেদ মোহাম্মদ নকীব আল–আত্তাস লাইব্রেরি পরিদর্শন ছিল এক শান্ত ও নীরব অনুপ্রেরণা। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও জ্ঞানের ভাণ্ডার দেখে জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে, গ্যালেপ ২.০ আমাকে কৌশলগত রূপকল্প তৈরি, উদ্ভাবনে নেতৃত্ব, এবং নৈতিক ও মানবিকতাভিত্তিক নেতৃত্ব প্রদানে সমৃদ্ধ করেছে।
আমার দৃঢ় প্রত্যয় হলো—এই মূল্যবান জ্ঞান ও কৌশলকে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে প্রয়োগ করব, যাতে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ভবিষ্যতের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়।
[লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]