নাজমুল হুদা খান
১২ মে বিশ্বের সকল নার্সদের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিন সকল নার্সদের আইকন ফ্লোরেন্স নাইটিংগলের জন্মদিন। আধুনিক নার্সিং এর প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরেন্স নাইটিংগল একজন ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ এবং সমাজসেবক। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহমর্মি সেবার মাধ্যমে তিনি নার্সিং সেবাকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রের অন্ধকারেও মোমবাতি হাতে আহত যোদ্ধাদের অবস্থা পর্যবেক্ষন ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি “Lady with the lamp” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮২০ সালের ১২ই মে জন্ম নেয়া এ মহিয়সী নারীর জন্মদিনকেই আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসেবে বেছে নেয়া হয় এবং ১৯৭৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে এ দিবসটি স্বীকৃতি লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়। আন্তর্জাতিক নার্সিং কাউন্সিল (INC) এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে Nurses: A Voice to Lead – Invest in nursing and respect rights to secure global health”. অর্থাৎ “ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্ত্বের বিকল্প নেই- বিশ্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে, নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষন করুন”।
নার্সিং সেবা যে কোন দেশের স্বাস্থ্য খ্যাতের অন্যতম অনুষঙ্গ। গত দু’বছর সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ যুদ্ধে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সামনের কাতারে থেকে লড়াই চালিয়ে গেছে নার্সগন। পাশাপাশি সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করছে দিবানিশি। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি; সংক্রামক, অসংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে দীর্ঘস্থায়ী সকল রোগের ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল, কমিউনিটি কিংবা অসুস্থের দোড় গোড়ায় পৌঁছে যারা ক্রমাগত সেবা, শুশ্রষা, রোগের প্রতিরোধ,প্রতিষেধক এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবিরাম কাজ করে যায় তারা নার্স ব্যাতিত আর কেউ নয়।
রোগীর সবচেয়ে সন্নিকটে সেবার হাত বাড়িয়ে দেয় একজন নার্স। হাসপাতাল বা কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের সকলেই নিশ্চিন্তে থাকে নার্সের হাতে সেবার দায়িত্বটি তুলে দিয়ে । দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহের ৭ দিন কিংবা মাসের ৩০ দিন রোগীর পর্যবেক্ষন, সেবা প্রদান, সমস্যা নিরুপন, শ্রেনী বিন্যাস, পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন, ঔষধ পথ্য প্রদান সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে নার্সগন।
একজন নার্স শুধু সেবা প্রদানই নয়; রোগীর সাথে যোগাযোগ সমন্বয় রোগী এবং তাদের পরিবারের সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য সচেতনতা শিক্ষা, উদ্বুদ্ধকরন, চিকিৎসা বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ , ব্যবস্থাপনা, পূনর্বাসন ইত্যাদি কর্মকান্ডে একজন ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও পালন করে থাকে। হাসপাতালের রোগীদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি রোগীর মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়েও পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় একজন নার্সকে।
হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীর অভ্যর্থনা, সার্বিক অবস্থা নিরীক্ষন, জরুরী সেবা প্রদান, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে অবগতি এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রদানসহ রোগী ও রোগীর এটেন্ডেন্ট বা আতœীয় স্বজনকে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত করার পুরো দায়িত্ব নার্সগনই পালন করে থাকে। রোগী স্থানান্তরের সময় চিকিৎসকের মাধ্যমে রেফার্ড বা স্থানান্তর আদেশের নোট লিপিবদ্ধকরন, রোগী ও তাদের স্বজনকে বিষয়টি যথাযথভাবে অবগতি, সংশ্লিষ্ট সকল স্টাফদের বিষয়টি জানানো, রোগীকে সকল রেকর্ড বা কাগজপত্র সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করাও নার্সদেরই কর্তব্য। একইভাবে রোগীকে ছাড়পত্র প্রদানের সময় চিকিৎসক কর্তৃক ছাড়পত্র নোট এবং উপদেশ প্রস্ততকরণ, রোগীর স্বজনকে চিকিৎসকের উপদেশসমূহ বুঝিয়ে দেয়া, পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করার দায়িত্বটিও পালন করে থাকে হাসপাতালের দায়িত্ব প্রাপ্ত নার্সগন।
রোগীর চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নার্সগন হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের সাথে সমন্বয় সাধন করে থাকে। বিশেষ করে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পথ্য সেকশন, প্যাথলজী, ফার্মেসী, রেডিওলজী এন্ড ইমেজিং, সমাজসেবা, লন্ড্রী এবং হাউজ কিপিং ইত্যাদি বিভাগের সাথে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে রোগীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
রোগীর যথাযথ ও উন্নতসেবা প্রদানের নিমিত্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩। আমাদের দেশে এ অনুপাত ১:০.৭৫। বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিষ্টার্ড নার্স রয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার; বর্তমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো অনুযায়ী এ সংখ্যা থাকা উচিত প্রায় ৩ লাখোর্ধ্ব। অর্থাৎ নার্সিং সেবায় জনবলের ঘাটতি শতকরা ৭০ শতাংশের উপর। রেজিষ্টার্ড নার্সদের প্রায় অর্ধেক সরকারী হাসপাতাল ও সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োযিত; তন্মধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগই শহরকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত শতকরা মাত্র ১৫ শতাংশ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই নার্সিং পেশায় নিয়োজিতদের প্রায় অধিকাংশই সমাজের অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক অংশের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আজও শুধু সাধারন মানুষ নয়; শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্রের প্রয়োজনীয়তাসমূহ ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যেভাবে গুরুত্বের সাথে প্রচার ও তুলে ধরা হয়; নার্সিং সেবা এবং নার্সদের সমস্যাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আধাঁরেই থেকে যায়। ফলে সমাজ ও মানুষের কাছে এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়না। তার ফলে সমাজের মূলধারার মানুষের নার্সিংকে পেশা হিসেবে নেয়ার মানসিকতা এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি। দেশে দক্ষ নার্সিং জনবলের ঘাটতি থাকা স্বত্ত্বেও ব্যাপকভাবে এ পেশায় অন্তর্ভূক্ত হওয়া এবং নার্সিং সেবা প্রশিক্ষনে ও প্রশিক্ষন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বেসরকারী বিনিয়োগকারীগনও লাভজনক মনে করছেনা এবং এ খাতকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা।
উপরুন্ত আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র হচ্ছে; এখনো এ পেশাকে অবহেলার চোখে দেখার প্রবনতা রয়েছে। নার্সগন সমাজে সম্মান, পদমর্যাদা, গৌরব ও কাজের পরিবেশের দিক থেকে যথাস্থানে আসীনের কিছুটা ক্ষেত্রে হলেও পিছিয়ে রয়েছে। নানা কুসংস্কার, সামাজিক মনোভাব, উৎসাহ প্রদানের অভাব, প্রশংসার ঘাটতি, আর্থিক বৈষম্য সহ নানাবিধ বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হয় তাদের। নার্সিং শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও দক্ষ প্রশিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সকল নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নার্সদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি বড় অন্তরায়।
শত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশে নার্সিং খাত দ্রুতই সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স জারীর মাধ্যমে নার্সিং সেবা , প্রশিক্ষন, প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠান খাতসমূহে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা গৃহিত হয়। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে নার্সদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিএসসি ইন নার্সিং চালু হয়। একই সময় নার্সিং অধিদপ্তর, সেবা মহাবিদ্যালয় এবং নার্সিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা এবং সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে অধিক পরিমানে নার্স অন্তর্ভূক্ত করণের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৩ সালে নার্সিং খাতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে সকল নার্সদেরকে ২য় শ্রেনীতে উন্নিতকরণ। পাশাপাশি নার্সিং এর সাথে মিডওয়াইফারী যোগ করে বাংলাদেশ নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারী কাউন্সিল (বিএনএমসি) নামকরন করা হয়। নার্সিং অধিদপ্তরকে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারী (DGNM)তে রূপান্তরিত করা হয়। সরকার নার্সিং ইন্সটিটিউটের সংখ্যা ও আসন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে নার্সিং এবং মিডওয়াইফারী পদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহন করেছে এবং অধিকাংশই বাস্তবায়িত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা খাতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রধান শর্ত, নার্সিং সেবার মান উন্নয়নের জন্য এ খাতের প্রশিক্ষনের মান বাড়ানো হবে। ভাল মানের শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানোর বিষয়টিও জরুরী। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্ধ, আইন প্রনেতাগন উচ্চবিত্ত ও দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহকে নার্সদের সামাজিক মর্যাদা, গুরুত্ব, সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, অবমূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দূরীভূতকরনে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতের সাথে সংশ্লিষ্টগনের মধ্যেই নয়; সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
নার্সিং একটি মহৎ পেশা, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ পেশাকে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন নয়, বরং নার্সিং সেবার সম্মান, মর্যাদা ও গর্বকে সমাজে তুলে ধরতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে নার্সিং খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী।
[লেখক: সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]
 
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            নাজমুল হুদা খান
বুধবার, ১১ মে ২০২২
১২ মে বিশ্বের সকল নার্সদের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিন সকল নার্সদের আইকন ফ্লোরেন্স নাইটিংগলের জন্মদিন। আধুনিক নার্সিং এর প্রতিষ্ঠাতা ফ্লোরেন্স নাইটিংগল একজন ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ এবং সমাজসেবক। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহমর্মি সেবার মাধ্যমে তিনি নার্সিং সেবাকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রের অন্ধকারেও মোমবাতি হাতে আহত যোদ্ধাদের অবস্থা পর্যবেক্ষন ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি “Lady with the lamp” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮২০ সালের ১২ই মে জন্ম নেয়া এ মহিয়সী নারীর জন্মদিনকেই আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসেবে বেছে নেয়া হয় এবং ১৯৭৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে এ দিবসটি স্বীকৃতি লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়। আন্তর্জাতিক নার্সিং কাউন্সিল (INC) এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে Nurses: A Voice to Lead – Invest in nursing and respect rights to secure global health”. অর্থাৎ “ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্ত্বের বিকল্প নেই- বিশ্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে, নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষন করুন”।
নার্সিং সেবা যে কোন দেশের স্বাস্থ্য খ্যাতের অন্যতম অনুষঙ্গ। গত দু’বছর সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ যুদ্ধে নিজেরা আক্রান্ত হয়ে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সামনের কাতারে থেকে লড়াই চালিয়ে গেছে নার্সগন। পাশাপাশি সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করছে দিবানিশি। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি; সংক্রামক, অসংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে দীর্ঘস্থায়ী সকল রোগের ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল, কমিউনিটি কিংবা অসুস্থের দোড় গোড়ায় পৌঁছে যারা ক্রমাগত সেবা, শুশ্রষা, রোগের প্রতিরোধ,প্রতিষেধক এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবিরাম কাজ করে যায় তারা নার্স ব্যাতিত আর কেউ নয়।
রোগীর সবচেয়ে সন্নিকটে সেবার হাত বাড়িয়ে দেয় একজন নার্স। হাসপাতাল বা কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের সকলেই নিশ্চিন্তে থাকে নার্সের হাতে সেবার দায়িত্বটি তুলে দিয়ে । দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহের ৭ দিন কিংবা মাসের ৩০ দিন রোগীর পর্যবেক্ষন, সেবা প্রদান, সমস্যা নিরুপন, শ্রেনী বিন্যাস, পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন, ঔষধ পথ্য প্রদান সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে নার্সগন।
একজন নার্স শুধু সেবা প্রদানই নয়; রোগীর সাথে যোগাযোগ সমন্বয় রোগী এবং তাদের পরিবারের সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য সচেতনতা শিক্ষা, উদ্বুদ্ধকরন, চিকিৎসা বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ , ব্যবস্থাপনা, পূনর্বাসন ইত্যাদি কর্মকান্ডে একজন ব্যবস্থাপকের দায়িত্বও পালন করে থাকে। হাসপাতালের রোগীদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি রোগীর মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়েও পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় একজন নার্সকে।
হাসপাতালে ভর্তির পর রোগীর অভ্যর্থনা, সার্বিক অবস্থা নিরীক্ষন, জরুরী সেবা প্রদান, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে অবগতি এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রদানসহ রোগী ও রোগীর এটেন্ডেন্ট বা আতœীয় স্বজনকে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত করার পুরো দায়িত্ব নার্সগনই পালন করে থাকে। রোগী স্থানান্তরের সময় চিকিৎসকের মাধ্যমে রেফার্ড বা স্থানান্তর আদেশের নোট লিপিবদ্ধকরন, রোগী ও তাদের স্বজনকে বিষয়টি যথাযথভাবে অবগতি, সংশ্লিষ্ট সকল স্টাফদের বিষয়টি জানানো, রোগীকে সকল রেকর্ড বা কাগজপত্র সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করাও নার্সদেরই কর্তব্য। একইভাবে রোগীকে ছাড়পত্র প্রদানের সময় চিকিৎসক কর্তৃক ছাড়পত্র নোট এবং উপদেশ প্রস্ততকরণ, রোগীর স্বজনকে চিকিৎসকের উপদেশসমূহ বুঝিয়ে দেয়া, পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করার দায়িত্বটিও পালন করে থাকে হাসপাতালের দায়িত্ব প্রাপ্ত নার্সগন।
রোগীর চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নার্সগন হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের সাথে সমন্বয় সাধন করে থাকে। বিশেষ করে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পথ্য সেকশন, প্যাথলজী, ফার্মেসী, রেডিওলজী এন্ড ইমেজিং, সমাজসেবা, লন্ড্রী এবং হাউজ কিপিং ইত্যাদি বিভাগের সাথে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে রোগীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
রোগীর যথাযথ ও উন্নতসেবা প্রদানের নিমিত্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হওয়া উচিত ১:৩। আমাদের দেশে এ অনুপাত ১:০.৭৫। বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিষ্টার্ড নার্স রয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার; বর্তমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো অনুযায়ী এ সংখ্যা থাকা উচিত প্রায় ৩ লাখোর্ধ্ব। অর্থাৎ নার্সিং সেবায় জনবলের ঘাটতি শতকরা ৭০ শতাংশের উপর। রেজিষ্টার্ড নার্সদের প্রায় অর্ধেক সরকারী হাসপাতাল ও সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োযিত; তন্মধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগই শহরকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত শতকরা মাত্র ১৫ শতাংশ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই নার্সিং পেশায় নিয়োজিতদের প্রায় অধিকাংশই সমাজের অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক অংশের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আজও শুধু সাধারন মানুষ নয়; শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্রের প্রয়োজনীয়তাসমূহ ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যেভাবে গুরুত্বের সাথে প্রচার ও তুলে ধরা হয়; নার্সিং সেবা এবং নার্সদের সমস্যাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আধাঁরেই থেকে যায়। ফলে সমাজ ও মানুষের কাছে এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়না। তার ফলে সমাজের মূলধারার মানুষের নার্সিংকে পেশা হিসেবে নেয়ার মানসিকতা এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি। দেশে দক্ষ নার্সিং জনবলের ঘাটতি থাকা স্বত্ত্বেও ব্যাপকভাবে এ পেশায় অন্তর্ভূক্ত হওয়া এবং নার্সিং সেবা প্রশিক্ষনে ও প্রশিক্ষন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বেসরকারী বিনিয়োগকারীগনও লাভজনক মনে করছেনা এবং এ খাতকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা।
উপরুন্ত আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র হচ্ছে; এখনো এ পেশাকে অবহেলার চোখে দেখার প্রবনতা রয়েছে। নার্সগন সমাজে সম্মান, পদমর্যাদা, গৌরব ও কাজের পরিবেশের দিক থেকে যথাস্থানে আসীনের কিছুটা ক্ষেত্রে হলেও পিছিয়ে রয়েছে। নানা কুসংস্কার, সামাজিক মনোভাব, উৎসাহ প্রদানের অভাব, প্রশংসার ঘাটতি, আর্থিক বৈষম্য সহ নানাবিধ বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হয় তাদের। নার্সিং শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও দক্ষ প্রশিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সকল নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নার্সদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি বড় অন্তরায়।
শত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশে নার্সিং খাত দ্রুতই সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স জারীর মাধ্যমে নার্সিং সেবা , প্রশিক্ষন, প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠান খাতসমূহে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা গৃহিত হয়। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে নার্সদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিএসসি ইন নার্সিং চালু হয়। একই সময় নার্সিং অধিদপ্তর, সেবা মহাবিদ্যালয় এবং নার্সিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা এবং সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে অধিক পরিমানে নার্স অন্তর্ভূক্ত করণের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৩ সালে নার্সিং খাতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে সকল নার্সদেরকে ২য় শ্রেনীতে উন্নিতকরণ। পাশাপাশি নার্সিং এর সাথে মিডওয়াইফারী যোগ করে বাংলাদেশ নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারী কাউন্সিল (বিএনএমসি) নামকরন করা হয়। নার্সিং অধিদপ্তরকে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারী (DGNM)তে রূপান্তরিত করা হয়। সরকার নার্সিং ইন্সটিটিউটের সংখ্যা ও আসন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো এবং স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে নার্সিং এবং মিডওয়াইফারী পদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহন করেছে এবং অধিকাংশই বাস্তবায়িত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা খাতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রধান শর্ত, নার্সিং সেবার মান উন্নয়নের জন্য এ খাতের প্রশিক্ষনের মান বাড়ানো হবে। ভাল মানের শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানোর বিষয়টিও জরুরী। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্ধ, আইন প্রনেতাগন উচ্চবিত্ত ও দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহকে নার্সদের সামাজিক মর্যাদা, গুরুত্ব, সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, অবমূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দূরীভূতকরনে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতের সাথে সংশ্লিষ্টগনের মধ্যেই নয়; সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
নার্সিং একটি মহৎ পেশা, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এ পেশাকে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন নয়, বরং নার্সিং সেবার সম্মান, মর্যাদা ও গর্বকে সমাজে তুলে ধরতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে নার্সিং খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী।
[লেখক: সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]
