সাদেকুর রহমান
১৯৭১ সালের আগস্টের প্রায় প্রতিটি দিন ছিল রক্তাক্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পঁচিশে মার্চ কালরাতে যে গণহত্যার সূচনা হয়, তা আগস্টে এসে সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়। এ মাসে ক্রমাগতভাবে গণহত্যা ঘটে ময়মনসিংহ, শেরপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, সুনামগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, ফেনী, নোয়াখালী, খুলনাসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায়। সেই সব গণহত্যায় প্রাণ হারানো নাম জানা-না জানা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
১৯৭১ সালের ২ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, ১৯৭১ সালের গণহত্যা ছিল পোল্যান্ডে নাৎসিদের চাইতেও ভয়াবহ।
যদিও পাকিস্তান দাবি করে, তাদের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার অধিকার ছিল। ১৯৭১ সালের নৃশংসতা ও রক্তপাতের জন্য ভারতের সঙ্গে থাকা বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দায়ী ছিল।
এমনকি একাত্তরের ৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে বলে যে প্রচারণা চলছে তা জঘন্য মিথ্যা। সেখানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্রসংখ্যক সশস্ত্র বিদ্রোহী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাদের উৎখাত করার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিদ্রোহীদের দমন করতে অনেক সময় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হয়। পৃথিবীতে এরকম অনেক নজির আছে।’
ওই সময়ে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালিদের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনকালে ভয়ংকর বর্বরতার চিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন। তার সে পর্যবেক্ষণ-অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ‘আফটার ভিজিটিং রিফিউজি ইন ইন্ডিয়া কেনেডি হিটস পাকিস্তান জেনোসাইড’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে- যাতে কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে অভিযুক্ত না করে উপায় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। একই তারিখে আরও কয়েকটি মার্কিন সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যাকে নিয়ে একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু সেদিন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকেই সমর্থন করে গেছে, এমনকি বাঙালি নিধনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান যে কী ভয়াবহ তা বুঝতে পারলেও ক্ষমতার দম্ভ তাদের অন্ধ করে রেখেছিল।
মুক্তাগাছা গণহত্যা :
হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের সব ঘটনার কথা মনে করে আজও শিহরিত হয়ে ওঠে ময়মনসিংহবাসী। একাত্তরের ২ আগস্ট মুক্তাগাছার গণহত্যা দখলদার পাকিস্তানিদের বর্বরতার আরেক স্বাক্ষর হয়ে আছে। বড়গ্রাম ইউনিয়নের মানকোন গ্রামসহ ১০টি গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদররা নিরস্ত্র ও নিরাপরাধ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়ে গুলি করে প্রায় চারশ লোককে হত্যা করে। শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও মানুষের ধনসম্পদ লুটপাট করে।
নকসী গণহত্যা :
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছোট গ্রাম নকসী। সীমান্তপারের গ্রাম হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চোখ ছিল সব সময়। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট নকসীর বিওপিতে (সীমান্ত চৌকি) বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। সেদিন নকসী রক্তাক্ত হয়ে ওঠে হানাদারদের বর্বরতায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তা করে রাজাকার-আল বদর।
বাগোয়ান গণহত্যা :
চুয়াডাঙ্গা ৮ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ। একাত্তরের ৩ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহের পার্শ্ববর্তী বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের জগন্নাথপুর গ্রামের দাফন করা হয়, যা এখন ‘আট কবর’ নামে পরিচিত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয় চুয়াডাঙ্গাকে। প্রথমেই চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাকিস্তানি সেনারা এ সিদ্ধান্ত জেনে ফেললে চুয়াডাঙ্গার ওপর পরিকল্পিতভাবে অত্যাচার বাড়ানো হয়। পরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট গেরিলা কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী জয়পুর শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান নেন। এ সময় পাকিস্তান মুসলিম লীগের দালাল কুবাদ খাঁ পরিকল্পিত প্রতারণার ফাঁদ পাতে। তিনি জয়পুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীকে খবর দেন যে, রাজাকারেরা নাটুদা, জগন্নাথপুর ও এর আশপাশের জমি থকে পাকা ধান কেটে নিয়ে গেছে। দেশপ্রেমের টানে যুবকদের রক্ত টগবগ করে ওঠে। রাজাকার ও খানসেনাদের শায়েস্তা করতে মুক্তিযোদ্ধার দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাগোয়ান এলাকায়। এ সুযোগে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আটকা পড়ে বেশ কয়েকজন। আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে তারা হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অবশ্য এ সম্মুখযুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যও হতাহত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে রাজাকারেরা ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে পাশাপাশি দুটি গর্ত করে কবর দেয়। পরবর্তীতে এর নামকরণ হয় ‘আট কবর’। আটজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন- হাসান জামান, গোকুলখালি, চুয়াডাঙ্গা; খালেদ সাইফুদ্দিন তারেক, পোড়াদহ, কুষ্টিয়া; রওশন আলম, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা; আলাউল ইসলাম খোকন, চুয়াডাঙ্গা শহর; আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা শহর; রবিউল ইসলাম, মোমিনপুর, চুয়াডাঙ্গা; কিয়ামুদ্দিন, আলমডাঙ্গা ও আফাজ উদ্দিন চন্দ্রবাস, দামুড়হুদা। বর্তমানে এটি একটি সরকারিভাবে সংরক্ষিত স্থান। এখানে একটি মুক্তমঞ্চ আছে। আছে সুরম্য মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা।
অটোয়ারি গণহত্যা :
পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরেরা পঞ্চগড়ে ৪ আগস্ট আটোয়ারিতে গণহত্যা চালায়। এ উপজেলার ধামোর ইউনিয়ন থেকে ২০-২৫ নিরীহ মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডাঙ্গিরহাট পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে। নির্মম অত্যাচারের পর তাদের হত্যা করা হয়।
ধোপাখালী গণহত্যা :
৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানার ধোপাখালি সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন শহীদ হন।
রামনাথ হাট গণহত্যা :
মুক্তিযুদ্ধকালে ৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথ হাটের গণহত্যা সংঘটিত হয়। নিষ্ঠুর পন্থায় গ্রামবাসীকে তুলে নেয়া হয় এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় শিশু ও কিশোরদের। দুদিন ধরে চলা এ বর্বরতায় নিহতদের কবর দেয়া হয় স্থানীয় নুরুল ইসলামের বাড়িতে।
ধামইরহাট গণহত্যা :
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার দুটি বধ্যভূমি রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট কুলফতপুর গ্রামে মাঠে কৃষি কাজ করার সময় ১৮ জনকে এবং পরে কুলফতপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ১৪ জনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। অপরদিকে উপজেলার পাগলা দেওয়ান গ্রামে প্রাপ্ত একটি গণকবরে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলিসহ হাড় পাওয়া গেছে।
সেনবাগে গণহত্যা :
নোয়াখালী সদর থেকে উত্তরর্প্বূ দিকে সেনবাগ উপজেলা অবস্থিত। সেনবাগ উপজেলার সেনবাগ থানা ছিল মিলিশিয়া ও পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা সেনবাগ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ও গ্রামে অপারেশন পরিচালনা করত। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্পটি আক্রমণের পরিকল্পনা মোতাবেক করেন। গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ও গ্রুপ কমান্ডার জয়নালের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পটি আক্রমণ করেন। কিন্তু শত্রুসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে না পেরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এতে কয়েকজন দখলদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হওয়ায় এই আক্রমণের প্রতিশোধস্বরূপ খানসেনারা ১৫ ও ১৬ আগস্ট সেনবাগ থানার আশপাশের মুক্তিযোদ্ধাদের আটটি বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগসহ চারিন্দ্রোন গ্রামের মো. ইলিয়াছকে গুলি করে হত্যা করে এবং বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নির্যাতনের শিকার হন।
দুর্গাপুর গণহত্যা :
নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুরে শুধু নামাজে জানাজায় অংশ নেয়ার ‘অপরাধে’ হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচার গণহত্যা চালায়। ১৬ আগস্ট এখানকার সোমেশ্বরী নদীপাড়ে খানসেনাদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় নিরীহ গ্রামবাসীর শরীর। তারপর ভাসিয়ে দেয়া হয় তাদের লাশ সোমেশ্বরী নদীতে।
মাকালকান্দি গণহত্যা :
একাত্তরের ১৮ আগস্ট ঘটে আরেক হত্যাতান্ডব চলে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত মাকালকান্দি রক্তাক্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে এ হত্যাকান্ড চলে স্থানীয় পুলিশ ও রাজাকার সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামবাসীদের একসঙ্গে দাঁড় করায় এবং সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। বাকিদের যত্রতত্র খুন করা হয়।
সকাল বেলা গ্রামের চন্ডি মন্দিরে মনসা পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দারা। পাকিস্তানি বাহিনী নৌকাযোগে এসে রাজাকারদের সহায়তায় হঠাৎ করে হামলা চালায়। এ সময় পূজারত নারী-পুরুষকে চন্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে একই পরিবারের ১১ জনসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তবে এ পর্যন্ত মাত্র ৭৮ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আরো কমপক্ষে শতাধিক মারা যান। এরপর হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ভাটি বাংলার শিক্ষাদীক্ষা, খাদ্যভান্ডারে সমৃদ্ধশালী গ্রাম মাকালকান্দি থেকে লুটে নেয় কোটি টাকার সম্পদ। ঘরবাড়িতে ধরিয়ে দেয় আগুন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা এ ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সহচর অনেক রাজাকারদের নাম এখনো ভুলতে পারেনি। সেই কলঙ্কিত ঘটনার পর জনমানবশূন্য মাকালকান্দির শত শত হেক্টর জমি দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের চাপে আবার কেউ কেউ সস্তা দামে বিক্রি করে দেশ ছেড়ে দেশান্তর হন।
বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ভাটি অঞ্চলে দ্বীপের মতো অবস্থান মাকালকান্দি গ্রামটির। যে পরিবারের ১১ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা। সেই পরিবারের একজন হলেন গোপাল রঞ্জন চৌধুরী (৪৫)। তিনি বলেন, নিহতদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। এ সময় মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তিন মাসের শিশু পুত্র কানুকে গুলি করে হত্যার পর হাওরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
এ সময় শিশুটির মা মিনতি রানী চৌধুরীকে পাকিস্তানিরা গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। তারপরও সে সময় মিনতি পাকিস্তানি ও রাজাকারদের বলেন, আমার ছেলেকে তোমরা মেরে ফেলেছে, এখন আমাকেও মেরে ফেল। কিন্তু তারা তাকে আর মারেনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী করুণা সিন্ধু চৌধুরী (৬০) জানান, তিনি বাড়িতেই ছিলেন। গোলাগুলির সময় আত্মরক্ষা করেন এবং কয়েক ঘণ্টা পর বাড়িতে ফিরে দেখেন শুধু লাশ আর লাশ। তিনি জানান, তার বাবা, মা, ভাই, বোন, ভাতিজাসহ তার পরিবারের ৬ জনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের পর বেঁচে যাওয়া নারী-পুরুষ ভারতে পাড়ি জমান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা এসে দেখতে পান চন্ডি মন্দির ও এর আশপাশে অসংখ্য কঙ্কাল। এগুলো সৎকার করা হয়নি। পরে তারা গ্রামের পাশে একটি জায়গায় গণকবর দিয়ে রাখেন। হত্যাতান্ডবের পরদিন থেকে চলে গণলুটপাট। এ গণলুটপাটে অংশ নেয় স্থানীয় বেশকিছু রাজাকার।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপসচিব শেখ ফজলে এলাহি বাচ্চুর উদ্যোগে মাকালকান্দি গ্রামের লুট হওয়া কিছু মালামাল উদ্ধার করে বেঁচে থাকা লোকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর ২০০৮ সালে ১৮ আগস্ট এ গ্রামে গণহত্যা দিবসে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
গ্রামের হরিপদ চৌধুরী জানান, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন তরনী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুর চান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, প্রভাসিনী বালা দাশ, চিত্রাঙ্গ বালা দাশ, সোহাগী বালা দাশ প্রমুখ। তিনি জানান, এ দিন অন্যদের সঙ্গে তার মা,বাবা, ভাই বোনসহ ৭ জনকে পৈশাচিকভাবে গুলি করে মেরে ফেলে শত্রুবাহিনী।
কৃপেশ চৌধুরী গোপাল জানান, সেদিন তার বয়স ছিল ৫ বছর। সে সময় হানাদারেরা তার মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৯ সদস্যকে হত্যা করে। তিনি আক্ষেপ করে জানান, স্বাধীনতার এত বছর পরও শহীদ পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি তাদেরকে।
(চলবে)
সাদেকুর রহমান
বুধবার, ০২ আগস্ট ২০২৩
১৯৭১ সালের আগস্টের প্রায় প্রতিটি দিন ছিল রক্তাক্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পঁচিশে মার্চ কালরাতে যে গণহত্যার সূচনা হয়, তা আগস্টে এসে সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়। এ মাসে ক্রমাগতভাবে গণহত্যা ঘটে ময়মনসিংহ, শেরপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, সুনামগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, ফেনী, নোয়াখালী, খুলনাসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায়। সেই সব গণহত্যায় প্রাণ হারানো নাম জানা-না জানা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
১৯৭১ সালের ২ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, ১৯৭১ সালের গণহত্যা ছিল পোল্যান্ডে নাৎসিদের চাইতেও ভয়াবহ।
যদিও পাকিস্তান দাবি করে, তাদের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার অধিকার ছিল। ১৯৭১ সালের নৃশংসতা ও রক্তপাতের জন্য ভারতের সঙ্গে থাকা বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দায়ী ছিল।
এমনকি একাত্তরের ৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে বলে যে প্রচারণা চলছে তা জঘন্য মিথ্যা। সেখানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্রসংখ্যক সশস্ত্র বিদ্রোহী সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাদের উৎখাত করার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিদ্রোহীদের দমন করতে অনেক সময় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হয়। পৃথিবীতে এরকম অনেক নজির আছে।’
ওই সময়ে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালিদের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনকালে ভয়ংকর বর্বরতার চিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন। তার সে পর্যবেক্ষণ-অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ‘আফটার ভিজিটিং রিফিউজি ইন ইন্ডিয়া কেনেডি হিটস পাকিস্তান জেনোসাইড’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে- যাতে কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে অভিযুক্ত না করে উপায় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। একই তারিখে আরও কয়েকটি মার্কিন সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যাকে নিয়ে একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু সেদিন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকেই সমর্থন করে গেছে, এমনকি বাঙালি নিধনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান যে কী ভয়াবহ তা বুঝতে পারলেও ক্ষমতার দম্ভ তাদের অন্ধ করে রেখেছিল।
মুক্তাগাছা গণহত্যা :
হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের সব ঘটনার কথা মনে করে আজও শিহরিত হয়ে ওঠে ময়মনসিংহবাসী। একাত্তরের ২ আগস্ট মুক্তাগাছার গণহত্যা দখলদার পাকিস্তানিদের বর্বরতার আরেক স্বাক্ষর হয়ে আছে। বড়গ্রাম ইউনিয়নের মানকোন গ্রামসহ ১০টি গ্রামে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদররা নিরস্ত্র ও নিরাপরাধ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়ে গুলি করে প্রায় চারশ লোককে হত্যা করে। শত শত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও মানুষের ধনসম্পদ লুটপাট করে।
নকসী গণহত্যা :
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছোট গ্রাম নকসী। সীমান্তপারের গ্রাম হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চোখ ছিল সব সময়। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট নকসীর বিওপিতে (সীমান্ত চৌকি) বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। সেদিন নকসী রক্তাক্ত হয়ে ওঠে হানাদারদের বর্বরতায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তা করে রাজাকার-আল বদর।
বাগোয়ান গণহত্যা :
চুয়াডাঙ্গা ৮ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ। একাত্তরের ৩ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহের পার্শ্ববর্তী বাগোয়ান গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের জগন্নাথপুর গ্রামের দাফন করা হয়, যা এখন ‘আট কবর’ নামে পরিচিত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার বলা হয় চুয়াডাঙ্গাকে। প্রথমেই চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাকিস্তানি সেনারা এ সিদ্ধান্ত জেনে ফেললে চুয়াডাঙ্গার ওপর পরিকল্পিতভাবে অত্যাচার বাড়ানো হয়। পরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট গেরিলা কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী জয়পুর শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান নেন। এ সময় পাকিস্তান মুসলিম লীগের দালাল কুবাদ খাঁ পরিকল্পিত প্রতারণার ফাঁদ পাতে। তিনি জয়পুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীকে খবর দেন যে, রাজাকারেরা নাটুদা, জগন্নাথপুর ও এর আশপাশের জমি থকে পাকা ধান কেটে নিয়ে গেছে। দেশপ্রেমের টানে যুবকদের রক্ত টগবগ করে ওঠে। রাজাকার ও খানসেনাদের শায়েস্তা করতে মুক্তিযোদ্ধার দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাগোয়ান এলাকায়। এ সুযোগে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আটকা পড়ে বেশ কয়েকজন। আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে তারা হত্যা করে। বেশ কয়েকজন আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অবশ্য এ সম্মুখযুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যও হতাহত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে রাজাকারেরা ৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে পাশাপাশি দুটি গর্ত করে কবর দেয়। পরবর্তীতে এর নামকরণ হয় ‘আট কবর’। আটজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন- হাসান জামান, গোকুলখালি, চুয়াডাঙ্গা; খালেদ সাইফুদ্দিন তারেক, পোড়াদহ, কুষ্টিয়া; রওশন আলম, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা; আলাউল ইসলাম খোকন, চুয়াডাঙ্গা শহর; আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা শহর; রবিউল ইসলাম, মোমিনপুর, চুয়াডাঙ্গা; কিয়ামুদ্দিন, আলমডাঙ্গা ও আফাজ উদ্দিন চন্দ্রবাস, দামুড়হুদা। বর্তমানে এটি একটি সরকারিভাবে সংরক্ষিত স্থান। এখানে একটি মুক্তমঞ্চ আছে। আছে সুরম্য মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা।
অটোয়ারি গণহত্যা :
পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরেরা পঞ্চগড়ে ৪ আগস্ট আটোয়ারিতে গণহত্যা চালায়। এ উপজেলার ধামোর ইউনিয়ন থেকে ২০-২৫ নিরীহ মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডাঙ্গিরহাট পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে। নির্মম অত্যাচারের পর তাদের হত্যা করা হয়।
ধোপাখালী গণহত্যা :
৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানার ধোপাখালি সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাঁচজন শহীদ হন।
রামনাথ হাট গণহত্যা :
মুক্তিযুদ্ধকালে ৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথ হাটের গণহত্যা সংঘটিত হয়। নিষ্ঠুর পন্থায় গ্রামবাসীকে তুলে নেয়া হয় এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় শিশু ও কিশোরদের। দুদিন ধরে চলা এ বর্বরতায় নিহতদের কবর দেয়া হয় স্থানীয় নুরুল ইসলামের বাড়িতে।
ধামইরহাট গণহত্যা :
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার দুটি বধ্যভূমি রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট কুলফতপুর গ্রামে মাঠে কৃষি কাজ করার সময় ১৮ জনকে এবং পরে কুলফতপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের ১৪ জনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। অপরদিকে উপজেলার পাগলা দেওয়ান গ্রামে প্রাপ্ত একটি গণকবরে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলিসহ হাড় পাওয়া গেছে।
সেনবাগে গণহত্যা :
নোয়াখালী সদর থেকে উত্তরর্প্বূ দিকে সেনবাগ উপজেলা অবস্থিত। সেনবাগ উপজেলার সেনবাগ থানা ছিল মিলিশিয়া ও পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা সেনবাগ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ও গ্রামে অপারেশন পরিচালনা করত। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্পটি আক্রমণের পরিকল্পনা মোতাবেক করেন। গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ও গ্রুপ কমান্ডার জয়নালের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পটি আক্রমণ করেন। কিন্তু শত্রুসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে না পেরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এতে কয়েকজন দখলদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হওয়ায় এই আক্রমণের প্রতিশোধস্বরূপ খানসেনারা ১৫ ও ১৬ আগস্ট সেনবাগ থানার আশপাশের মুক্তিযোদ্ধাদের আটটি বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগসহ চারিন্দ্রোন গ্রামের মো. ইলিয়াছকে গুলি করে হত্যা করে এবং বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নির্যাতনের শিকার হন।
দুর্গাপুর গণহত্যা :
নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুরে শুধু নামাজে জানাজায় অংশ নেয়ার ‘অপরাধে’ হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচার গণহত্যা চালায়। ১৬ আগস্ট এখানকার সোমেশ্বরী নদীপাড়ে খানসেনাদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় নিরীহ গ্রামবাসীর শরীর। তারপর ভাসিয়ে দেয়া হয় তাদের লাশ সোমেশ্বরী নদীতে।
মাকালকান্দি গণহত্যা :
একাত্তরের ১৮ আগস্ট ঘটে আরেক হত্যাতান্ডব চলে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত মাকালকান্দি রক্তাক্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে এ হত্যাকান্ড চলে স্থানীয় পুলিশ ও রাজাকার সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামবাসীদের একসঙ্গে দাঁড় করায় এবং সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। বাকিদের যত্রতত্র খুন করা হয়।
সকাল বেলা গ্রামের চন্ডি মন্দিরে মনসা পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দারা। পাকিস্তানি বাহিনী নৌকাযোগে এসে রাজাকারদের সহায়তায় হঠাৎ করে হামলা চালায়। এ সময় পূজারত নারী-পুরুষকে চন্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে একই পরিবারের ১১ জনসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তবে এ পর্যন্ত মাত্র ৭৮ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আরো কমপক্ষে শতাধিক মারা যান। এরপর হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ভাটি বাংলার শিক্ষাদীক্ষা, খাদ্যভান্ডারে সমৃদ্ধশালী গ্রাম মাকালকান্দি থেকে লুটে নেয় কোটি টাকার সম্পদ। ঘরবাড়িতে ধরিয়ে দেয় আগুন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা এ ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সহচর অনেক রাজাকারদের নাম এখনো ভুলতে পারেনি। সেই কলঙ্কিত ঘটনার পর জনমানবশূন্য মাকালকান্দির শত শত হেক্টর জমি দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের চাপে আবার কেউ কেউ সস্তা দামে বিক্রি করে দেশ ছেড়ে দেশান্তর হন।
বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ভাটি অঞ্চলে দ্বীপের মতো অবস্থান মাকালকান্দি গ্রামটির। যে পরিবারের ১১ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা। সেই পরিবারের একজন হলেন গোপাল রঞ্জন চৌধুরী (৪৫)। তিনি বলেন, নিহতদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। এ সময় মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তিন মাসের শিশু পুত্র কানুকে গুলি করে হত্যার পর হাওরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
এ সময় শিশুটির মা মিনতি রানী চৌধুরীকে পাকিস্তানিরা গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। তারপরও সে সময় মিনতি পাকিস্তানি ও রাজাকারদের বলেন, আমার ছেলেকে তোমরা মেরে ফেলেছে, এখন আমাকেও মেরে ফেল। কিন্তু তারা তাকে আর মারেনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী করুণা সিন্ধু চৌধুরী (৬০) জানান, তিনি বাড়িতেই ছিলেন। গোলাগুলির সময় আত্মরক্ষা করেন এবং কয়েক ঘণ্টা পর বাড়িতে ফিরে দেখেন শুধু লাশ আর লাশ। তিনি জানান, তার বাবা, মা, ভাই, বোন, ভাতিজাসহ তার পরিবারের ৬ জনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের পর বেঁচে যাওয়া নারী-পুরুষ ভারতে পাড়ি জমান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা এসে দেখতে পান চন্ডি মন্দির ও এর আশপাশে অসংখ্য কঙ্কাল। এগুলো সৎকার করা হয়নি। পরে তারা গ্রামের পাশে একটি জায়গায় গণকবর দিয়ে রাখেন। হত্যাতান্ডবের পরদিন থেকে চলে গণলুটপাট। এ গণলুটপাটে অংশ নেয় স্থানীয় বেশকিছু রাজাকার।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপসচিব শেখ ফজলে এলাহি বাচ্চুর উদ্যোগে মাকালকান্দি গ্রামের লুট হওয়া কিছু মালামাল উদ্ধার করে বেঁচে থাকা লোকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর ২০০৮ সালে ১৮ আগস্ট এ গ্রামে গণহত্যা দিবসে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
গ্রামের হরিপদ চৌধুরী জানান, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন তরনী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুর চান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, প্রভাসিনী বালা দাশ, চিত্রাঙ্গ বালা দাশ, সোহাগী বালা দাশ প্রমুখ। তিনি জানান, এ দিন অন্যদের সঙ্গে তার মা,বাবা, ভাই বোনসহ ৭ জনকে পৈশাচিকভাবে গুলি করে মেরে ফেলে শত্রুবাহিনী।
কৃপেশ চৌধুরী গোপাল জানান, সেদিন তার বয়স ছিল ৫ বছর। সে সময় হানাদারেরা তার মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৯ সদস্যকে হত্যা করে। তিনি আক্ষেপ করে জানান, স্বাধীনতার এত বছর পরও শহীদ পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি তাদেরকে।
(চলবে)