সাদেকুর রহমান
(গতকালের পর)
১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল পবিত্র শবেবরাত। সাধারন মুসলমানদের বিশ্বাস, এ রাতে আল্লাহ তাদের ভ্যাগ্যলিপি লিখে থাকেন। ওই রাতে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আবদুল হামিদ কিছু সময়ের জন্য নিজ বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু এ খবরটি রাজাকাররা পেয়ে যাওয়ায় তারা হামিদের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তাকে সুরখালী তহশীল অফিসে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। এরপর রাজাকাররা সুরখালী-সহ পার্শ্ববর্তী কল্যাণশ্রী (ছত্রবিলা), খড়িয়াল ও গাওঘরা গ্রাম থেকে আরো বেশ কয়েকজন যুবককে ধরে রাজাকার ক্যাম্পে আনা হয়। রাত গভীর হলে রাজাকাররা বন্দীদের একটি অংশকে গজালিয়া গেটের পাশে নদীর পাদে নিয়ে যায়। এরপর প্রায় মধ্যরাতের দিকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এই বন্দীদের কয়েকজনকে বারোআড়িয়া লঞ্চঘাট, সুরখালী লঞ্চঘাট এবং শরাফপুর খেয়াঘাটে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এই গণহত্যার পরদিন বেশ কিছু লাশ সুরখালী বাজারের কাছে ভেসে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রাজাকারদের ভয়ে এই লাশ স্বজনেরা দাফন-কাফন করার সাহস পায়নি। নদীতেই তাদের সলিল সমাধি ঘটে। গজালিয়া গেট গণহত্যায় ১৩ জনের বেশি নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়।
মাহমুদপুর-পানকাতা গণহত্যা : একাত্তরের ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মাহমুদপুর-পানকাতা গণহত্যা দিবস। এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল দুই শতাধিক রাজাকার-আলবদর সদস্যকে নিয়ে মাহমুদপুর গ্রামে আসে। তারা তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হাতেম আলী তালুকদারের বাড়ি হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রাম এবং আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত পাশের পানকাতা, বলিভদ্র, কেরামজানী, সয়া ও ইস্পঞ্জিরাপুর গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে আক্রমণ চালায়। তারা প্রথমে তিনজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে লুটপাট করতে থাকে।
এ সময় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানী বাজারে অবস্থান করা আবদুল কাদের সিদ্দিকী ওরফে বাঘা সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর ‘হনুমান’ কোম্পানির কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙাল তার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে পানকাতা গ্রামে পৌঁছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।
প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধের শেষপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলেও হানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে তারা থামিয়ে দিতে সমর্থ হন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত না হলেও হানাদার বাহিনীর এক সেনাসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়। এ সময় দখলদার বাহিনী প্রবল উম্মদনা ও হিংস্রতায় আশপাশের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। তারা হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতা গ্রামে নৃশংসভাবে গণহত্যা চালিয়ে এ গ্রামের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নির্মম তান্ডব শুরু করে।
তারা শতাধিক নিরীহ মানুষকে আটক করে পানকাতা মাঠের ঈদগাহ মাঠে ব্রাশফায়ার করে ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এছাড়া তারা ৫০-৬০টি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ব্যাপক লুটতরাজসহ আরও ৬০-৬৫ গ্রামবাসীকে গুরুতর আহত করে। হতাহতদের অনেকে এখনও পঙ্গুত্বকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন।
সনমান্দী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এবং জীবন বাঁচাতে ঢাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করেন। ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল এবং চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এইসব মানুষ হেঁটে তুলনামূলক নিরাপদ গ্রামের দিকে আসতে শুরু করেন। এমনি বহু মানুষ এসে আশ্রয় নেয় তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ঐতিহাসিক জনপদ সোনারগাঁওয়ের সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে।
সিরাজুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে ও তৎকালীন সনমান্দী গ্রামের সচেতন যুব সমাজের উদ্যোগে নারী ও শিশুসহ সবাই শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, পানীয়, নিরাপত্তা এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই আশ্রয় কেন্দ্রটিকে ঘিরেই গড়ে তোলা হয় সোনারগাঁওয়ের ‘সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’।
১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিলে সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সনমান্দী গ্রাম সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের উদ্দেশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের এক সভা আহ্বান করা হয়। সেদিন শুধু প্রাণের ভয়ে প্রবীণ পঞ্চায়েত প্রধানদের অনেকেই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব নিতে অপারগতা এবং অক্ষমতা প্রকাশ করেন। সেই সময় এগিয়ে আসেন অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অকুতোভয় এক সৈনিক আবুল হাসেম মোল্লা। তিনি আগে পুলিশ বাহিনীর হাবিলদার ছিলেন এবং পরে সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক হিসেবে কাজ করতেন।
গোপালগঞ্জসহ বৃহত্তর ফরিদপুর ও শরিয়তপুরের ডামুড্যায় পুলিশ বাহিনীতে হাবিলদার পদে চাকরির সূত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসা হাসেম মোল্লাকে সনমান্দী গ্রাম সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং শ্রমিক নেতা নেয়াজ আলীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর সোনারগাঁও থানার তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৭ জুন সোনারগাঁও থেকে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে সোনারগাঁও থানা কমান্ডার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ৬ আগস্ট রাতে সনমান্দী গ্রামে ফিরে আসে। সেই সময় নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বৈদ্যের বাজার থানার (পরবর্তীতে সোনারগাঁও উপজেলা নামান্তর) অন্তর্গত সনমান্দী গ্রাম ছিল প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও আদর্শ স্থান।
ভারত-ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শক্রমে সংগ্রাম পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দারের অনুমোদনক্রমে, ৬-দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সোনারগাঁও থানা সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ক সুলতান আহমেদ মোল্লা (বাদশা) ৩১ আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন থানা কমান্ডার আ. মালেক। উপদেষ্টা ছিলেন সুলতান আহমেদ মোল্লা (বাদশা) এবং কেন্দ্র প্রধান (ইনচার্জ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ মাস্টার)।
সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথম পর্যায়ে সনমান্দী গ্রামের মো. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ মাস্টার), খন্দকার আবু জাফর, মোসলেহ উদ্দিন মোল্লা, আবু সাঈদ, নুরুল ইসলাম, খালেক বিন তোরাব, বেলায়েত হোসেন, গোলাম মোস্তফা, সুরুজ মিয়া, আবুল হোসেন, ইলিয়াস, ইজ্জত আলী, বাচ্চু মিয়া (সাজালের কান্দি), আ. আজিজ, মুক্তিযোদ্ধা তাহের আলী প্রমুখ কৃতি সন্তানসহ আরো অনেকে প্রশিক্ষণ নেন।
এ সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আব্দুল মতিন, মোশারফ হোসেন, টুআইসি হাবিবুল্লাহ, রেহাজ আলী, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক (খালেক বিন তোরাব) এবং আব্দুল কাদির।
এখানে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এসএমজি চালনা এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারা, রাইফেল বা অস্ত্রহাতে ক্রলিং, গেরিলা আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি, গোপনে কীভাবে হানাদার বাহিনীর যাতায়াতের খবরাখবর আদান-প্রদান ও গোয়েন্দা নজরদারি শেখানো প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আর প্যারেড পিটি অনুষ্ঠিত হতো বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী গাছপালা পরিবেষ্টিত মফিজউদ্দিন ক্বারীর নির্জন বাগান বাড়িতে এবং দেয়ানজির ভিটা যেখানে বর্তমানে সনমান্দী হাছান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থিত ঠিক সেখানে। ২০০ জনেরও বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সময় সাজালেরকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর মিয়ার একটি মোটর সাইকেল ছিল। এই মোটর সাইকেলটিকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধারা এক স্থান থেকে অন্য স্থান যাতায়াত ও দ্রুত খবর দেয়া-নেয়ার কাজে লাগাতেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে খালেক বিন তোরাব, নুরুল ইসলাম, সুরুজ মিয়াসহ ২৭ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে সনমান্দী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চিলারবাগ, আনন্দবাজারের দক্ষিনে মেঘনা নদী তীরবর্তী রানদির খাল যুদ্ধ, লাঙ্গলবন্ধসহ সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। চিলারবাগে পর পর তিনটি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের প্রাক্কালে ১৪ আগস্ট চিলারবাগ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অ্যান্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনা বহনকারী জিপ উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী সোনারগাঁওয়ে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাস্ত, পর্যুদস্ত, হতাহত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। (চলবে)
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সাদেকুর রহমান
রোববার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
(গতকালের পর)
১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল পবিত্র শবেবরাত। সাধারন মুসলমানদের বিশ্বাস, এ রাতে আল্লাহ তাদের ভ্যাগ্যলিপি লিখে থাকেন। ওই রাতে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আবদুল হামিদ কিছু সময়ের জন্য নিজ বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু এ খবরটি রাজাকাররা পেয়ে যাওয়ায় তারা হামিদের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তাকে সুরখালী তহশীল অফিসে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। এরপর রাজাকাররা সুরখালী-সহ পার্শ্ববর্তী কল্যাণশ্রী (ছত্রবিলা), খড়িয়াল ও গাওঘরা গ্রাম থেকে আরো বেশ কয়েকজন যুবককে ধরে রাজাকার ক্যাম্পে আনা হয়। রাত গভীর হলে রাজাকাররা বন্দীদের একটি অংশকে গজালিয়া গেটের পাশে নদীর পাদে নিয়ে যায়। এরপর প্রায় মধ্যরাতের দিকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এই বন্দীদের কয়েকজনকে বারোআড়িয়া লঞ্চঘাট, সুরখালী লঞ্চঘাট এবং শরাফপুর খেয়াঘাটে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এই গণহত্যার পরদিন বেশ কিছু লাশ সুরখালী বাজারের কাছে ভেসে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রাজাকারদের ভয়ে এই লাশ স্বজনেরা দাফন-কাফন করার সাহস পায়নি। নদীতেই তাদের সলিল সমাধি ঘটে। গজালিয়া গেট গণহত্যায় ১৩ জনের বেশি নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়।
মাহমুদপুর-পানকাতা গণহত্যা : একাত্তরের ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মাহমুদপুর-পানকাতা গণহত্যা দিবস। এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল দুই শতাধিক রাজাকার-আলবদর সদস্যকে নিয়ে মাহমুদপুর গ্রামে আসে। তারা তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হাতেম আলী তালুকদারের বাড়ি হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রাম এবং আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত পাশের পানকাতা, বলিভদ্র, কেরামজানী, সয়া ও ইস্পঞ্জিরাপুর গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে আক্রমণ চালায়। তারা প্রথমে তিনজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে লুটপাট করতে থাকে।
এ সময় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানী বাজারে অবস্থান করা আবদুল কাদের সিদ্দিকী ওরফে বাঘা সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর ‘হনুমান’ কোম্পানির কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙাল তার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে পানকাতা গ্রামে পৌঁছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।
প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধের শেষপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলেও হানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে তারা থামিয়ে দিতে সমর্থ হন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত না হলেও হানাদার বাহিনীর এক সেনাসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়। এ সময় দখলদার বাহিনী প্রবল উম্মদনা ও হিংস্রতায় আশপাশের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। তারা হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতা গ্রামে নৃশংসভাবে গণহত্যা চালিয়ে এ গ্রামের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নির্মম তান্ডব শুরু করে।
তারা শতাধিক নিরীহ মানুষকে আটক করে পানকাতা মাঠের ঈদগাহ মাঠে ব্রাশফায়ার করে ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এছাড়া তারা ৫০-৬০টি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ব্যাপক লুটতরাজসহ আরও ৬০-৬৫ গ্রামবাসীকে গুরুতর আহত করে। হতাহতদের অনেকে এখনও পঙ্গুত্বকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন।
সনমান্দী গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এবং জীবন বাঁচাতে ঢাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করেন। ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল এবং চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এইসব মানুষ হেঁটে তুলনামূলক নিরাপদ গ্রামের দিকে আসতে শুরু করেন। এমনি বহু মানুষ এসে আশ্রয় নেয় তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ঐতিহাসিক জনপদ সোনারগাঁওয়ের সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে।
সিরাজুল ইসলাম মাস্টারের নেতৃত্বে ও তৎকালীন সনমান্দী গ্রামের সচেতন যুব সমাজের উদ্যোগে নারী ও শিশুসহ সবাই শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, পানীয়, নিরাপত্তা এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই আশ্রয় কেন্দ্রটিকে ঘিরেই গড়ে তোলা হয় সোনারগাঁওয়ের ‘সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’।
১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিলে সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সনমান্দী গ্রাম সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের উদ্দেশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের এক সভা আহ্বান করা হয়। সেদিন শুধু প্রাণের ভয়ে প্রবীণ পঞ্চায়েত প্রধানদের অনেকেই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব নিতে অপারগতা এবং অক্ষমতা প্রকাশ করেন। সেই সময় এগিয়ে আসেন অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অকুতোভয় এক সৈনিক আবুল হাসেম মোল্লা। তিনি আগে পুলিশ বাহিনীর হাবিলদার ছিলেন এবং পরে সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক হিসেবে কাজ করতেন।
গোপালগঞ্জসহ বৃহত্তর ফরিদপুর ও শরিয়তপুরের ডামুড্যায় পুলিশ বাহিনীতে হাবিলদার পদে চাকরির সূত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসা হাসেম মোল্লাকে সনমান্দী গ্রাম সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং শ্রমিক নেতা নেয়াজ আলীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পর সোনারগাঁও থানার তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৭ জুন সোনারগাঁও থেকে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে সোনারগাঁও থানা কমান্ডার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ৬ আগস্ট রাতে সনমান্দী গ্রামে ফিরে আসে। সেই সময় নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বৈদ্যের বাজার থানার (পরবর্তীতে সোনারগাঁও উপজেলা নামান্তর) অন্তর্গত সনমান্দী গ্রাম ছিল প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও আদর্শ স্থান।
ভারত-ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শক্রমে সংগ্রাম পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দারের অনুমোদনক্রমে, ৬-দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সোনারগাঁও থানা সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ক সুলতান আহমেদ মোল্লা (বাদশা) ৩১ আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন থানা কমান্ডার আ. মালেক। উপদেষ্টা ছিলেন সুলতান আহমেদ মোল্লা (বাদশা) এবং কেন্দ্র প্রধান (ইনচার্জ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ মাস্টার)।
সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথম পর্যায়ে সনমান্দী গ্রামের মো. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ মাস্টার), খন্দকার আবু জাফর, মোসলেহ উদ্দিন মোল্লা, আবু সাঈদ, নুরুল ইসলাম, খালেক বিন তোরাব, বেলায়েত হোসেন, গোলাম মোস্তফা, সুরুজ মিয়া, আবুল হোসেন, ইলিয়াস, ইজ্জত আলী, বাচ্চু মিয়া (সাজালের কান্দি), আ. আজিজ, মুক্তিযোদ্ধা তাহের আলী প্রমুখ কৃতি সন্তানসহ আরো অনেকে প্রশিক্ষণ নেন।
এ সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আব্দুল মতিন, মোশারফ হোসেন, টুআইসি হাবিবুল্লাহ, রেহাজ আলী, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক (খালেক বিন তোরাব) এবং আব্দুল কাদির।
এখানে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এসএমজি চালনা এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারা, রাইফেল বা অস্ত্রহাতে ক্রলিং, গেরিলা আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি, গোপনে কীভাবে হানাদার বাহিনীর যাতায়াতের খবরাখবর আদান-প্রদান ও গোয়েন্দা নজরদারি শেখানো প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সনমান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আর প্যারেড পিটি অনুষ্ঠিত হতো বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী গাছপালা পরিবেষ্টিত মফিজউদ্দিন ক্বারীর নির্জন বাগান বাড়িতে এবং দেয়ানজির ভিটা যেখানে বর্তমানে সনমান্দী হাছান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থিত ঠিক সেখানে। ২০০ জনেরও বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সময় সাজালেরকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চুর মিয়ার একটি মোটর সাইকেল ছিল। এই মোটর সাইকেলটিকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধারা এক স্থান থেকে অন্য স্থান যাতায়াত ও দ্রুত খবর দেয়া-নেয়ার কাজে লাগাতেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে খালেক বিন তোরাব, নুরুল ইসলাম, সুরুজ মিয়াসহ ২৭ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে সনমান্দী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চিলারবাগ, আনন্দবাজারের দক্ষিনে মেঘনা নদী তীরবর্তী রানদির খাল যুদ্ধ, লাঙ্গলবন্ধসহ সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। চিলারবাগে পর পর তিনটি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনের প্রাক্কালে ১৪ আগস্ট চিলারবাগ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অ্যান্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনা বহনকারী জিপ উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী সোনারগাঁওয়ে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাস্ত, পর্যুদস্ত, হতাহত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। (চলবে)