alt

উপ-সম্পাদকীয়





























  • download

একাত্তরের গণহত্যার খণ্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

: সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(শেষাংশ)

ধারণা করা হয়, পাকিস্তান সরকারের পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এএসএম সোলায়মানের মাধ্যমে হানাদার বাহিনী জানতে পারে সনমান্দী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের ভোরের সূর্য ওঠার আগেই সনমান্দী গ্রামকে দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর এই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন ছিল বর্ষাকাল। বড় বড় ৪০-৪৫ টি নৌকা থেকে এক যোগে সনমান্দী গ্রামের উপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ। অতর্কিত এই আক্রমণ স্বত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্ত এক সময় অপ্রতুল অস্ত্র ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদের অভাবে পাকিবাহিনীর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে।

এরপর হানাদারের বাহিনী সনমান্দী গ্রামে প্রবেশ করে। এরই মধ্যে ঝরে যায় নারী, শিশুসহ ১০টি তাজা প্রাণ। গুলিতে শহীদ হন এই দশ জন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। আত্মরক্ষার্থে শত শত গ্রামবাসী যে যার মতো দ্রুত পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ কেউ মাথার উপর কচুরিপানা দিয়ে লুকিয়ে পানিতে ভাসতে ভাসতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকেন। জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ কেউ আবার সনমান্দী কবরস্থান, কেউবা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। শত্রুবাহিনী সনমান্দী গ্রামে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। গান পাউডার দিয়ে পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৩৯টি বাড়িঘর পাকিস্তানি বাহিনীর দেয়া আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। আহত কয়েকজন এখনো শরীরে সেই সম্মুখযুদ্ধের ক্ষত ও বুলেট নিয়ে বেঁচে আছেন।

নারী, বৃদ্ধ এমনকি মায়ের কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশু পর্যন্ত সেদিনের শত্রুসেনাদের নির্মম বর্বরতা ও গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। ভয়াল ২৯ সেপ্টেম্বর এলে সনমান্দী গ্রামের আকাশ-বাতাস নির্মমতা ও নির্বিচারে গণহত্যার বেদনায় ভারি হয়ে ওঠে। স্বজন হারানো প্রিয়জনদের চোখে অশ্রু জমে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী সনমান্দী গ্রামের অধিবাসীরা হলেন- ফজলুল করিম, নুরুল ইসলাম, ছমিরউদ্দিন প্রধান, তাহেরুন নেছা, সাবিলা আক্তার, আনোয়ারুল হক, ফারুক মিয়া, মমতাজ আক্তার, আমির আলী এবং মনোয়ারা আক্তার।

সীমিত পরিসরে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ৭১ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদের উদ্যোগে ও আমন্ত্রণে ২০১০ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী সনমান্দী গ্রামের ১০ জন শহিদের নাম সম্বলিত ‘একটি শহীদ স্মৃতি ফলক’ উন্মোচন করেন। এই শহীদ স্মৃতি ফলকটি পরে সনমান্দী হাছান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে স্থাপন করা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হাতে গোনা দুই-একটি স্থানে এই ধরনের মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ২০১২ সালে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সনমান্দী গ্রামের গণহত্যা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে এবং একাধিকবার তা প্রচার করে।

কাঠেঙ্গা গণহত্যা : কাঠেঙ্গা গ্রামটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। ডুমুরিয়া উযপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলনা ও যশোর জেলার সীমান্তে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের পশ্চিম পাশে ভবদহ নামক একটি নদী বয়ে গেছে। কাঠেঙ্গার পূর্ব পাশে টোলনা গ্রাম ও দক্ষিণ পাশে চেঁচুড়ি গ্রামের অবস্থান।

কাঠেঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দুই পর্বে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই মাঠের পার্শ্ববর্তী তাগের আলী হালদারের বাড়িটি দখল করে স্থানীয় রাজাকাররা নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের ধরে এখানে এনে নির্যাতন করা হতো। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে এখানে কিছু যুবককে এনে নির্যাতন করা হয়েছিল। পরে গভীর রাতে বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। কাঠেঙ্গা গ্রামের রাজাকারদের সঙ্গে এই রাতে পার্শ্ববর্তী জামিরা বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররাও গণহত্যায় অংশ নেয়। এই গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে দরিদ্র ছবেদ আলীর একমাত্র ছেলে লুৎফর সরদারসহ চেচুড়ি গ্রামের ৭ জনের নাম জানা গেছে। কাঠেঙ্গা স্কুল মাঠে আরেকটি গণহত্যা হয় ২২ নভেম্বর। সেদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আনা ৪০ জন যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা; ১৯৭১ সালের গণহত্যা জাদুঘর, খুলনা; শেখ আবদুল জলিল, ডুমুরিয়ার ইতিহাস, আরণ্যক প্রকাশনা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ১২৮; সংগ্রামেরনোটবুক ডটকম; সাক্ষাৎকার, বিপ্লবী কামাক্ষ্যাপ্রসাদ রায় চৌধুরী (ভদ্রদিয়া, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২৭ জুলাই ২০১৪; সাক্ষাৎকার, গোলক রায় (পাতিবুনিয়া, শোভনা, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, মহারানী সরকার ও তারক সরকার (পাতিবুনিয়া সরদার বাড়ি, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, শেখ আমজাদ হোসেন (চিংড়া, ডুমুরিয়া, খুলনা), ৩০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, আতিয়ার সরদার (চেচুড়ি, ডুমুরিয়া, খুলনা), ৮ জানুয়ারি ২০১৭; ড. শামছুল কবির, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যা ও নির্যাতন: প্রসঙ্গ নোয়াখালী জেলা’, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব আর্টস, বর্ষ-৯, সংখ্যা-২, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ১০-১২; জোবাইদা নাসরীন, মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৬৫ ও ১১৬; হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, ৯ম খ-, পৃষ্ঠা ১৪৪; আবু সাঈদ, ১৯৭১ সালের ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমি, দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা, ৩ মার্চ ২০২১; মাহফুজুল ইসলাম হায়দার, ‘১৯৭১ : সোনারগাঁয়ের সনমান্দী গ্রামে সেপ্টেম্বরের গণহত্যা’, বিডিনিউজ২৪.কম আর্টস বিভাগ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮; লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, শহীদনগর গণহত্যা, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা, ৩০ মার্চ ২০১৮]

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একাত্তরের গণহত্যার খণ্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

  • download

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(শেষাংশ)

ধারণা করা হয়, পাকিস্তান সরকারের পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এএসএম সোলায়মানের মাধ্যমে হানাদার বাহিনী জানতে পারে সনমান্দী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের ভোরের সূর্য ওঠার আগেই সনমান্দী গ্রামকে দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর এই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন ছিল বর্ষাকাল। বড় বড় ৪০-৪৫ টি নৌকা থেকে এক যোগে সনমান্দী গ্রামের উপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ। অতর্কিত এই আক্রমণ স্বত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্ত এক সময় অপ্রতুল অস্ত্র ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদের অভাবে পাকিবাহিনীর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে।

এরপর হানাদারের বাহিনী সনমান্দী গ্রামে প্রবেশ করে। এরই মধ্যে ঝরে যায় নারী, শিশুসহ ১০টি তাজা প্রাণ। গুলিতে শহীদ হন এই দশ জন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। আত্মরক্ষার্থে শত শত গ্রামবাসী যে যার মতো দ্রুত পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ কেউ মাথার উপর কচুরিপানা দিয়ে লুকিয়ে পানিতে ভাসতে ভাসতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকেন। জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ কেউ আবার সনমান্দী কবরস্থান, কেউবা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। শত্রুবাহিনী সনমান্দী গ্রামে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। গান পাউডার দিয়ে পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৩৯টি বাড়িঘর পাকিস্তানি বাহিনীর দেয়া আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। আহত কয়েকজন এখনো শরীরে সেই সম্মুখযুদ্ধের ক্ষত ও বুলেট নিয়ে বেঁচে আছেন।

নারী, বৃদ্ধ এমনকি মায়ের কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশু পর্যন্ত সেদিনের শত্রুসেনাদের নির্মম বর্বরতা ও গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। ভয়াল ২৯ সেপ্টেম্বর এলে সনমান্দী গ্রামের আকাশ-বাতাস নির্মমতা ও নির্বিচারে গণহত্যার বেদনায় ভারি হয়ে ওঠে। স্বজন হারানো প্রিয়জনদের চোখে অশ্রু জমে। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী সনমান্দী গ্রামের অধিবাসীরা হলেন- ফজলুল করিম, নুরুল ইসলাম, ছমিরউদ্দিন প্রধান, তাহেরুন নেছা, সাবিলা আক্তার, আনোয়ারুল হক, ফারুক মিয়া, মমতাজ আক্তার, আমির আলী এবং মনোয়ারা আক্তার।

সীমিত পরিসরে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ৭১ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদের উদ্যোগে ও আমন্ত্রণে ২০১০ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী সনমান্দী গ্রামের ১০ জন শহিদের নাম সম্বলিত ‘একটি শহীদ স্মৃতি ফলক’ উন্মোচন করেন। এই শহীদ স্মৃতি ফলকটি পরে সনমান্দী হাছান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে স্থাপন করা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হাতে গোনা দুই-একটি স্থানে এই ধরনের মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ২০১২ সালে সনমান্দী মুক্তিযোদ্ধা উপ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সনমান্দী গ্রামের গণহত্যা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে এবং একাধিকবার তা প্রচার করে।

কাঠেঙ্গা গণহত্যা : কাঠেঙ্গা গ্রামটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। ডুমুরিয়া উযপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলনা ও যশোর জেলার সীমান্তে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের পশ্চিম পাশে ভবদহ নামক একটি নদী বয়ে গেছে। কাঠেঙ্গার পূর্ব পাশে টোলনা গ্রাম ও দক্ষিণ পাশে চেঁচুড়ি গ্রামের অবস্থান।

কাঠেঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দুই পর্বে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই মাঠের পার্শ্ববর্তী তাগের আলী হালদারের বাড়িটি দখল করে স্থানীয় রাজাকাররা নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের ধরে এখানে এনে নির্যাতন করা হতো। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে এখানে কিছু যুবককে এনে নির্যাতন করা হয়েছিল। পরে গভীর রাতে বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। কাঠেঙ্গা গ্রামের রাজাকারদের সঙ্গে এই রাতে পার্শ্ববর্তী জামিরা বাজার ক্যাম্পের রাজাকাররাও গণহত্যায় অংশ নেয়। এই গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে দরিদ্র ছবেদ আলীর একমাত্র ছেলে লুৎফর সরদারসহ চেচুড়ি গ্রামের ৭ জনের নাম জানা গেছে। কাঠেঙ্গা স্কুল মাঠে আরেকটি গণহত্যা হয় ২২ নভেম্বর। সেদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আনা ৪০ জন যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

[তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা; ১৯৭১ সালের গণহত্যা জাদুঘর, খুলনা; শেখ আবদুল জলিল, ডুমুরিয়ার ইতিহাস, আরণ্যক প্রকাশনা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ১২৮; সংগ্রামেরনোটবুক ডটকম; সাক্ষাৎকার, বিপ্লবী কামাক্ষ্যাপ্রসাদ রায় চৌধুরী (ভদ্রদিয়া, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২৭ জুলাই ২০১৪; সাক্ষাৎকার, গোলক রায় (পাতিবুনিয়া, শোভনা, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, মহারানী সরকার ও তারক সরকার (পাতিবুনিয়া সরদার বাড়ি, ডুমুরিয়া, খুলনা), ২০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, শেখ আমজাদ হোসেন (চিংড়া, ডুমুরিয়া, খুলনা), ৩০ এপ্রিল ২০১৫; সাক্ষাৎকার, আতিয়ার সরদার (চেচুড়ি, ডুমুরিয়া, খুলনা), ৮ জানুয়ারি ২০১৭; ড. শামছুল কবির, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যা ও নির্যাতন: প্রসঙ্গ নোয়াখালী জেলা’, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব আর্টস, বর্ষ-৯, সংখ্যা-২, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ১০-১২; জোবাইদা নাসরীন, মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৬৫ ও ১১৬; হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, ৯ম খ-, পৃষ্ঠা ১৪৪; আবু সাঈদ, ১৯৭১ সালের ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমি, দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা, ৩ মার্চ ২০২১; মাহফুজুল ইসলাম হায়দার, ‘১৯৭১ : সোনারগাঁয়ের সনমান্দী গ্রামে সেপ্টেম্বরের গণহত্যা’, বিডিনিউজ২৪.কম আর্টস বিভাগ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮; লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, শহীদনগর গণহত্যা, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা, ৩০ মার্চ ২০১৮]

[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

back to top