alt

opinion » post-editorial

আদিবাসীদের অর্জন

মিথুশিলাক মুরমু

: বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গত ২৩ আগস্ট ছিল আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি মাইলফলক। এ দিনটিতে সাঁওতালদের মধ্যে থেকে প্রথম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি হয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু। জেলা শহরগুলোতে আদিবাসী সাঁওতাল আইনজীবীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হলেও সুপ্রিম কোর্টের বন্ধ্যত্ব ঘুচিয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু। উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর থানার জলাহার গ্রামের অধিবাসী অ্যাডভোকেট টুডু। পিতা শ্যাম টুডু এবং মা রাজোবালা মুরমুর ৭ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ প্রভাত।

আদিবাসীদের স্বাভাবিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মতোই অ্যাডভোকেট টুডুকে অতিক্রম করতে হয়েছে দারিদ্র্যতা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবহেলা এবং পদে পদে থাকা প্রতিবন্ধকতাসমূহ। মিশন স্কুলের শিক্ষক মি. টুডু সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়েছেন কিন্তু কখনো পড়া বন্ধ করেননি। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এলএলবি পাস করেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আয়কর আইনজীবী হিসেবে ঢাকা ট্যাক্সেস বারে সদস্য হোন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়ে নিম্ন আদালতে ওকালতি শুরু করেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রভাত টুডু হয়ে ওঠেন প্রথম সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আইনজীবী।

বান্দরবানের প্রেন চ্যং ¤্রাে, যিনি ফুটবলে মিনিটে ২০৮ বার পায়ের টোকা দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্বীকৃতি পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্সেস বিভাগের ছাত্র প্রেন চ্যং ¤্রাের বসতভিটা বান্দরবান উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের লামারপাড়ায়। তিনি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকে প্রথমে জেলা ও পরে বিভাগীয় দলের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন।

২৩ বছর বয়সি জাসপার লালখুমসাং বম দেশে ও বিদেশে মিক্সড মার্শাল আর্টের সাতটি আসরের শিরোপা জয় করে তাক লাগিয়েছেন। বক্সিং, কারাতে আর জুডোর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা মিক্সড মার্শাল আর্টের রিং যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য কঠিন ক্ষেত্র। এ খেলায় ক্ষিপ্রতা, শারীরিক সক্ষমতা আর কৌশলের সমন্বয় থাকতে হয় খেলোয়াড়ের। মুহূর্তের অসতর্কতায় প্রতিপক্ষের হাতে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে জাসপার লালখুমসাং বম কঠিন এই লড়াইয়ের ময়দানে পা রেখেই নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরেছেন।

বান্দরবানের কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশে তার বাড়ি। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেণ্টের ছাত্র জাসপার-এর স্বপ্ন সাধনা কেওক্রাডংকে ছাড়িয়ে যাওয়া। মিক্সড মার্শাল আট লড়াইয়ের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসরের নাম আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা ইউএফসি। এখন পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই আসরে বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় অংশ নিতে পারেননি। ২০১৭ ও ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে এমএমএর অপেশাদার পাঁচটি আসরে খেলে সেরা হয়েছেন। ২০১৯ ও ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পেশাদার দুটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন, দুটি আসরেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ইতোমধ্যেই বিদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়া কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপের ষষ্ঠ আসরে ২টি স্বর্ণপদক জয়ী হয়েছেন রুইতম ¤্রাে ও সংক্যউ মারমা। এছাড়াও ২৩টি পদক ছিনিয়ে এনেছেন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আসর থেকে। বান্দরবানের মহামুণি শিশুসদনের ছয়জন কিশোরী ও দুইজন কিশোর অংশগ্রহণ করেছিলেন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গেমসে। দুইজন স্বর্ণপদক, ৩টি রৌপ্য ১০টি ব্রোঞ্জ পেয়েছে। শিশু সদনে পড়াশোনার পাশাপাশি কারাতে শিক্ষাও প্রদান করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জ উ প্রু মারমা সাফ গেমসে দুইবার স্বর্ণপদক জয় করে এনেছিলেন।

শেরপুর নালিতাবাড়ীর চাঁকিয়ার সেন্টু হাজংয়ের নাম অত্র এলাকার কৃষকদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছে। ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা থেকেই উদ্ভাবন করেছেন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। দীর্ঘ বছর থেকেই একক প্রচেষ্টায় দেশি পাইজাম ধানের সঙ্গে ভারতীয় রঞ্জিত (পাইজাম) ধানের সংকরায়ণ করছেন। সাত বছর ধরে প্রচেষ্টায় বিআর ১১ ধানের সঙ্গে স্থানীয় জাতের চিনিশাইল ধানের সংকরায়ণ করে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভাবন করেন ‘সেন্টুশাইল’, নিজের নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে নামকরণ করেছেন। বাড়ির আঙিনায় ছোট একটি গবেষণাগার তৈরি করে বুঁদ হয়ে আছেন সেন্টু হাজং।

দীর্ঘ ১৭ বছরে উদ্ভাবন করেছেন ২৩ ধরনের নতুন ধান। সর্বশ্রেণীর কৃষক ধানগুলো চাষাবাদ করে সুফল পাচ্ছে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক গবেষণার ফলস্বরূপ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হোন সেন্টু-২১। ইতোমধ্যেই একক প্রচেষ্টায় ২৩ প্রকারের দেশি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। পাইজাম একর প্রতি ফলন হয়ে থাকে ৩৫-৪০ মণ আর সেখানে সেন্টু হাজংয়ের সেন্টু-২১ একরে ৬০-৭০ মণ। বীজতলা তৈরি থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সেন্টু-২১ উৎপাদনে সময় লাগে ১৫০ থেকে ১৫৫ দিন; আর পাইজামের সময়কাল ১৬০ দিন। পোকামাকড়ের আক্রমণও অপেক্ষাকৃত কম। ধান চাষের ক্ষেত্রে একর প্রতি ৮০ কেজি ডিএপি, ৬০ কেজি পটশা ও ৪০ কেজি ইউরিয়া সার প্রদান করতে হয়।

ধান বিজ্ঞানী সেন্টু হাজং প্রথম ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি মিডিয়ার আলোতে আলোকিত হয়ে পড়েন। সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সাতটি ধানের নাম দেয়া হলেও বাকি জাতগুলোর এখনো দেয়া হয়নি। পাইজামের সঙ্গে বিনা ৭ ধানের সংকরায়ণ করে সেন্টু হাজং যে ধান তৈরি করেছেন, তার নাম দেয়া হয়েছে সেণ্টু ১ ‘সুনালো’। দুধবিন্নির সঙ্গে মার্কাবিন্নি সংকরায়ণ করে সেন্টু ৪ ‘বিশালীবিন্নি’। তিনি চিনিশাইল, তুলসীমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে সংকরায়ণ করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। তার উদ্ভাবিত ধানগুলো কতক বাতাসে হেলে পড়ে, আর কতকগুলো পড়ে না। নালিতাবাড়ির সেন্টু হাজং ধান সংকরায়ণ করে মাটির টবে সেই ধানের বীজ রোপণ করেন। গাছ হলে সেখান থেকে মুঠি মুঠি বীজ সংরক্ষণ করেন। আমন মৌসুমে সেই বীজ ছোট ছোট আকারে খেত (প্লট) তৈরি করে চাষাবাদ করেন। এভাবে নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন চলতে থাকে।

অভাবের কারণে সেন্টু হাজং মাধ্যমিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে একটি বেসরকারি সংগঠন পাহাড়ি দরিদ্র কৃষকদের নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন শিখিয়েছিল তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। সেটাই সেন্টুর মধ্যে ঘুমন্ত উদ্ভাবক সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এরপর ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। সেন্টু হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন ও নির্বাচনে (হ্যান্ড পলিনেশন অ্যান্ড সিলেকশন) এককভাবে একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আদিবাসী রাধাবতী দেবী কলাগাছের সুতা দিয়ে ‘কলাবতী’ শাড়ি তৈরি করে সাড়া জাগিয়েছেন। বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেছে কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি উদ্যোগটি। এ বছরের জুলাই মাসে জেলা প্রশাসক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি কলাবতী শাড়ি উপহার দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কলাগাছের তন্তু থেকে মণিপুরী নক্সার এই শাড়ি তৈরি করেন তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মণিপুরী শাড়ির কারিগর হিসেবে কাজ করে আসছেন মৌলভীবাজারের রাধাবতী দেবী।

বাল্যবিবাহের শিকার রাধাবতী দেবীর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বেশি দিন, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে স্বামীকে ডিভোর্স দেন। আর বিয়ে করেননি, থেকেছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে; মৃত্যুর পর ভাইবোন, কাকিদের সঙ্গে। বলেছেন, বান্দরবানে গিয়েই প্রথম জানতে পারি কলাগাছ থেকে সুতা তৈরি করা যায়। এর আগে জীবনে কলাগাছের সুতা চোখে দেখিনি। নক্সাবিহীনভাবেই সমস্ত ভয়কে জয় করেই ১৩ হাত শাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হই, জেলা প্রশাসক তিবরীজি নিজেই নামকরণ করেন কলাবতী শাড়ি। একটি শাড়ি তৈরিতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় ব্যয় হয় কিন্তু এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে পুরো ১৫ দিন। ৬৫ বছর বয়সি রাধাবতী দেবীর স্বপ্ন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখান থেকে নতুন প্রজন্মরা শাড়ি বানানো শিখবে। নিজের অর্থায়নে কুলানো সম্ভবপর হচ্ছে না বিধায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন।

আদিবাসীদের জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, প্রতিভার বিকাশকে সম্মান জানালে সত্যিই প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীই উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আদিবাসীরা মনে করেন, দেশকে দেয়ার আমাদের কিছুই নেই; এই ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সুযোগও সৃষ্টি করা জরুরি। সরকারের প্রতিটি বিভাগই আদিবাসীদের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে ছাইয়ের মধ্যেই আগুনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব এবং সেটিই হবে আদিবাসীদের জন্য পরম পাওয়া। আসুন আদিবাসীদের সুযোগ দেই এবং তাদের প্রতি যত্নবান হই।

[লেখক কলামিস্ট]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

আদিবাসীদের অর্জন

মিথুশিলাক মুরমু

বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গত ২৩ আগস্ট ছিল আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি মাইলফলক। এ দিনটিতে সাঁওতালদের মধ্যে থেকে প্রথম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি হয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু। জেলা শহরগুলোতে আদিবাসী সাঁওতাল আইনজীবীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হলেও সুপ্রিম কোর্টের বন্ধ্যত্ব ঘুচিয়েছেন অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু। উত্তরবঙ্গের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর থানার জলাহার গ্রামের অধিবাসী অ্যাডভোকেট টুডু। পিতা শ্যাম টুডু এবং মা রাজোবালা মুরমুর ৭ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ প্রভাত।

আদিবাসীদের স্বাভাবিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মতোই অ্যাডভোকেট টুডুকে অতিক্রম করতে হয়েছে দারিদ্র্যতা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবহেলা এবং পদে পদে থাকা প্রতিবন্ধকতাসমূহ। মিশন স্কুলের শিক্ষক মি. টুডু সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়েছেন কিন্তু কখনো পড়া বন্ধ করেননি। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এলএলবি পাস করেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আয়কর আইনজীবী হিসেবে ঢাকা ট্যাক্সেস বারে সদস্য হোন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়ে নিম্ন আদালতে ওকালতি শুরু করেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রভাত টুডু হয়ে ওঠেন প্রথম সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আইনজীবী।

বান্দরবানের প্রেন চ্যং ¤্রাে, যিনি ফুটবলে মিনিটে ২০৮ বার পায়ের টোকা দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্বীকৃতি পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্সেস বিভাগের ছাত্র প্রেন চ্যং ¤্রাের বসতভিটা বান্দরবান উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের লামারপাড়ায়। তিনি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকে প্রথমে জেলা ও পরে বিভাগীয় দলের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন।

২৩ বছর বয়সি জাসপার লালখুমসাং বম দেশে ও বিদেশে মিক্সড মার্শাল আর্টের সাতটি আসরের শিরোপা জয় করে তাক লাগিয়েছেন। বক্সিং, কারাতে আর জুডোর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা মিক্সড মার্শাল আর্টের রিং যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য কঠিন ক্ষেত্র। এ খেলায় ক্ষিপ্রতা, শারীরিক সক্ষমতা আর কৌশলের সমন্বয় থাকতে হয় খেলোয়াড়ের। মুহূর্তের অসতর্কতায় প্রতিপক্ষের হাতে ধরাশায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে জাসপার লালখুমসাং বম কঠিন এই লড়াইয়ের ময়দানে পা রেখেই নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরেছেন।

বান্দরবানের কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশে তার বাড়ি। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেণ্টের ছাত্র জাসপার-এর স্বপ্ন সাধনা কেওক্রাডংকে ছাড়িয়ে যাওয়া। মিক্সড মার্শাল আট লড়াইয়ের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসরের নাম আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা ইউএফসি। এখন পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই আসরে বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় অংশ নিতে পারেননি। ২০১৭ ও ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে এমএমএর অপেশাদার পাঁচটি আসরে খেলে সেরা হয়েছেন। ২০১৯ ও ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পেশাদার দুটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন, দুটি আসরেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ইতোমধ্যেই বিদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়া কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপের ষষ্ঠ আসরে ২টি স্বর্ণপদক জয়ী হয়েছেন রুইতম ¤্রাে ও সংক্যউ মারমা। এছাড়াও ২৩টি পদক ছিনিয়ে এনেছেন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আসর থেকে। বান্দরবানের মহামুণি শিশুসদনের ছয়জন কিশোরী ও দুইজন কিশোর অংশগ্রহণ করেছিলেন ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গেমসে। দুইজন স্বর্ণপদক, ৩টি রৌপ্য ১০টি ব্রোঞ্জ পেয়েছে। শিশু সদনে পড়াশোনার পাশাপাশি কারাতে শিক্ষাও প্রদান করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জ উ প্রু মারমা সাফ গেমসে দুইবার স্বর্ণপদক জয় করে এনেছিলেন।

শেরপুর নালিতাবাড়ীর চাঁকিয়ার সেন্টু হাজংয়ের নাম অত্র এলাকার কৃষকদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছে। ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা থেকেই উদ্ভাবন করেছেন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। দীর্ঘ বছর থেকেই একক প্রচেষ্টায় দেশি পাইজাম ধানের সঙ্গে ভারতীয় রঞ্জিত (পাইজাম) ধানের সংকরায়ণ করছেন। সাত বছর ধরে প্রচেষ্টায় বিআর ১১ ধানের সঙ্গে স্থানীয় জাতের চিনিশাইল ধানের সংকরায়ণ করে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভাবন করেন ‘সেন্টুশাইল’, নিজের নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে নামকরণ করেছেন। বাড়ির আঙিনায় ছোট একটি গবেষণাগার তৈরি করে বুঁদ হয়ে আছেন সেন্টু হাজং।

দীর্ঘ ১৭ বছরে উদ্ভাবন করেছেন ২৩ ধরনের নতুন ধান। সর্বশ্রেণীর কৃষক ধানগুলো চাষাবাদ করে সুফল পাচ্ছে। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক গবেষণার ফলস্বরূপ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হোন সেন্টু-২১। ইতোমধ্যেই একক প্রচেষ্টায় ২৩ প্রকারের দেশি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। পাইজাম একর প্রতি ফলন হয়ে থাকে ৩৫-৪০ মণ আর সেখানে সেন্টু হাজংয়ের সেন্টু-২১ একরে ৬০-৭০ মণ। বীজতলা তৈরি থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সেন্টু-২১ উৎপাদনে সময় লাগে ১৫০ থেকে ১৫৫ দিন; আর পাইজামের সময়কাল ১৬০ দিন। পোকামাকড়ের আক্রমণও অপেক্ষাকৃত কম। ধান চাষের ক্ষেত্রে একর প্রতি ৮০ কেজি ডিএপি, ৬০ কেজি পটশা ও ৪০ কেজি ইউরিয়া সার প্রদান করতে হয়।

ধান বিজ্ঞানী সেন্টু হাজং প্রথম ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি মিডিয়ার আলোতে আলোকিত হয়ে পড়েন। সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সাতটি ধানের নাম দেয়া হলেও বাকি জাতগুলোর এখনো দেয়া হয়নি। পাইজামের সঙ্গে বিনা ৭ ধানের সংকরায়ণ করে সেন্টু হাজং যে ধান তৈরি করেছেন, তার নাম দেয়া হয়েছে সেণ্টু ১ ‘সুনালো’। দুধবিন্নির সঙ্গে মার্কাবিন্নি সংকরায়ণ করে সেন্টু ৪ ‘বিশালীবিন্নি’। তিনি চিনিশাইল, তুলসীমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে সংকরায়ণ করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। তার উদ্ভাবিত ধানগুলো কতক বাতাসে হেলে পড়ে, আর কতকগুলো পড়ে না। নালিতাবাড়ির সেন্টু হাজং ধান সংকরায়ণ করে মাটির টবে সেই ধানের বীজ রোপণ করেন। গাছ হলে সেখান থেকে মুঠি মুঠি বীজ সংরক্ষণ করেন। আমন মৌসুমে সেই বীজ ছোট ছোট আকারে খেত (প্লট) তৈরি করে চাষাবাদ করেন। এভাবে নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন চলতে থাকে।

অভাবের কারণে সেন্টু হাজং মাধ্যমিক পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে একটি বেসরকারি সংগঠন পাহাড়ি দরিদ্র কৃষকদের নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন শিখিয়েছিল তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। সেটাই সেন্টুর মধ্যে ঘুমন্ত উদ্ভাবক সত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এরপর ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। সেন্টু হাতের মাধ্যমে পরাগায়ন ও নির্বাচনে (হ্যান্ড পলিনেশন অ্যান্ড সিলেকশন) এককভাবে একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আদিবাসী রাধাবতী দেবী কলাগাছের সুতা দিয়ে ‘কলাবতী’ শাড়ি তৈরি করে সাড়া জাগিয়েছেন। বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেছে কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি উদ্যোগটি। এ বছরের জুলাই মাসে জেলা প্রশাসক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি কলাবতী শাড়ি উপহার দিয়েছেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কলাগাছের তন্তু থেকে মণিপুরী নক্সার এই শাড়ি তৈরি করেন তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মণিপুরী শাড়ির কারিগর হিসেবে কাজ করে আসছেন মৌলভীবাজারের রাধাবতী দেবী।

বাল্যবিবাহের শিকার রাধাবতী দেবীর স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বেশি দিন, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে স্বামীকে ডিভোর্স দেন। আর বিয়ে করেননি, থেকেছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে; মৃত্যুর পর ভাইবোন, কাকিদের সঙ্গে। বলেছেন, বান্দরবানে গিয়েই প্রথম জানতে পারি কলাগাছ থেকে সুতা তৈরি করা যায়। এর আগে জীবনে কলাগাছের সুতা চোখে দেখিনি। নক্সাবিহীনভাবেই সমস্ত ভয়কে জয় করেই ১৩ হাত শাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হই, জেলা প্রশাসক তিবরীজি নিজেই নামকরণ করেন কলাবতী শাড়ি। একটি শাড়ি তৈরিতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় ব্যয় হয় কিন্তু এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে পুরো ১৫ দিন। ৬৫ বছর বয়সি রাধাবতী দেবীর স্বপ্ন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখান থেকে নতুন প্রজন্মরা শাড়ি বানানো শিখবে। নিজের অর্থায়নে কুলানো সম্ভবপর হচ্ছে না বিধায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন।

আদিবাসীদের জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, প্রতিভার বিকাশকে সম্মান জানালে সত্যিই প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীই উৎসাহিত ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আদিবাসীরা মনে করেন, দেশকে দেয়ার আমাদের কিছুই নেই; এই ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সুযোগও সৃষ্টি করা জরুরি। সরকারের প্রতিটি বিভাগই আদিবাসীদের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে ছাইয়ের মধ্যেই আগুনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব এবং সেটিই হবে আদিবাসীদের জন্য পরম পাওয়া। আসুন আদিবাসীদের সুযোগ দেই এবং তাদের প্রতি যত্নবান হই।

[লেখক কলামিস্ট]

back to top