alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

জিল্লুর রহমান

: শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ প্রবাদটি গ্রাম-বাংলায় বহুল প্রচলিত প্রবাদসমূহের মধ্যে অন্যতম। শত বছর আগে মদন মোহন তর্কালঙ্কার তার শিশুশিক্ষা বইটিতে এ কথাগুলো লিখেছিলেন; যা ক্রমেই মানুষের মুখে মুখে ফিরে আসছে। মনযোগী-অমনযোগী প্রায় সব শিক্ষার্থী এবং ছোট-বড় সবাই জীবনে অন্তত একবার হলেও লাইন দুটি শুনেছে বা কাউকে শুনিয়েছে। আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি শিশুকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে একথাই বোঝানো হয় যে লেখাপড়া করলে ভালো চাকরি পাওয়া, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। অনেক টাকা কামানো কিংবা গাড়ি-বাড়ি করা এর মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং লেখা পড়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, বাড়ি-গাড়ি করা হয়ে ওঠে শিশুটির পড়ালেখার একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে বাস্তবতা বড়ই কঠিন। ঘোড়ার চল উঠে গেছে বহু আগেই। আর এখন সবাই গাড়িতে চড়তে পারে, অন্তত লোকাল বাসে চড়তে কারো লেখাপড়ার দরকার নেই। গাড়ি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের মালিক হেনরি ফোর্ডের কথা উল্লেখযোগ্য। হেনরি ফোর্ড কিন্তু অত পড়ালেখা করেননি। তিনি যে শুধু গাড়ি চড়েছেন তাই নয়, বিশাল একটা গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাও করেছেন।

মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হলো সাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন। শিক্ষাকে তুলনা করা হয় আলোর সঙ্গে। জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, মুক্ত করে অজ্ঞতার অভিশাপ হতে, মানুষকে আগামীর পথ চলতে সহায়তা করে। কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেননি এমন কেউ তো দুই বাংলায় নেই। দুজনের নামেই অসংখ্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তাদের কিন্তু তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসনদ ছিল না। অথচ এখন নজরুল রবীন্দ্রনাথের ওপর পিএইচডি করেছে বা করবে এমন লোক অগণিত আছে। আলবার্ট আইনস্টাইনও কিন্তু হাইস্কুল পাশ করতে পারেননি। আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, শেকসপিয়ার, হেনরি ফোর্ড, মার্কটোয়াইন, স্টিভ জবস এবং এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আছেন যারা তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত নন। তাদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিল না। অথচ দেখুন এদের কথা না পড়লে উচ্চশিক্ষিত হওয়া যায় না, ভালো একটা চাকরিও কপালে জোটে না।

জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, মুক্ত করে অজ্ঞতার অভিশাপ হতে, মানুষকে আগামীর পথ চলতে সহায়তা করে

বিশ্বের বড় বড় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক যারা এখনও নিজেকে বিকিয়ে দেননি তাদের হয়ত দামি গাড়ি নেই। এদের অভিজাত এলাকায় বাড়ি নেই, ফ্ল্যাটও নেই। অনেকেই আবার ভাড়া বাড়িতেও থাকেন। তবে তাদের আছে জ্ঞানের ভান্ডার, আলোর মশাল; যা যুগে যুগে আলোকিত করে এসেছে বিভিন্ন সমাজ ও জাতিকে। তারা পড়ালেখা করে ভালো লাগে বলে, এর পেছনে গাড়ি-বাড়ি করার উদ্দেশ্য নেই। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশ বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকে কেননা যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশ সরকারও জাতীয় শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করে বিভিন্ন ধরনের কৌশল সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষা ধারার সঙ্গে বয়স্ক শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমেই জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

আমরা প্রায়শ খবরে দেখি মা-ছেলে কিংবা পিতা-পুত্র একত্রে এসএসসি কিংবা স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করেছে। এগুলো এক ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক খবর। আসলে লেখাপড়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। জীবনের যেকোন সময় লেখাপড়া করা যায়। এক্ষেত্রে বয়স একটি আপেক্ষিক সংখ্যামাত্র। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো কাজে বাধা হতে পারে না বয়স। হরহামেশা এ কথাগুলো আমরা অনেককেই বলতে শুনি। তবে ইতালির জিউসেপ্পে প্যাতার্নো এ কথাকে বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তিনি ৯৮ বছর বয়সে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাকে বলা হচ্ছে ইতালির সবচেয়ে বয়স্ক শিক্ষার্থী। তাছাড়া ভারতের রাজ কুমার ভাইশ নামের এক ব্যক্তি ৯৮ বছর বয়সে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৫ সালের শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করেন। আবার শ্রীকান্ত জিচকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

কারণ তার একটি বা দুটি নয়, মোট ২০টি ডিগ্রি ছিল। তিনি ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে এই ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি এমনই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তার নামে ১৪টি ডিগ্রি ছিল। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়েছেন এবং এর পাশাপাশি তিনি অনেক স্বর্ণপদকও অর্জন করেছেন। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এ রকম হাজারও দৃষ্টান্ত আছে। বয়সের বাধা লেখাপড়া বা জ্ঞানার্জনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও যেকোন বয়সে যেকোন ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব। শুধু দরকার মনের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর প্রবল আগ্রহ। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, চোখের পর্দা খুলে সমগ্র পৃথিবীকে দেখতে পারি। কিন্তু সেটা যখন পাঠ্যপুস্তকে আর পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায় কিংবা এর পেছনে যদি টাকা কামানোই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তখন ব্যাপারটা উদ্বেগের বটে। কারণ দেশ ও জাতি গঠনে সুশিক্ষিত নাগরিকের থেকে স্বশিক্ষিত নাগরিকের গুরুত্ব বেশি।

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এরপরও এদেশে নিরক্ষরতার হার কমেনি। সব শ্রেণীর মানুষকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। শিশুদের একটি বৃহৎ অংশ নানা কারণে স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। যারা ভর্তি হয় তাদের মধ্যে অনেকেই ঝরে যায়, আর স্কুলে ফিরতে পারে না। এদের জন্যই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন। যারা স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়নি, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে নিরক্ষর রয়ে গেছে তাদের জন্যও এটি আবশ্যক। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই মূলত বয়স্কদের ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোর ও বয়স্কদের জন্য বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে বয়সের ফ্রেমে আবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন সাক্ষরতার মাধ্যমে সবাইকে শিক্ষিত করার আন্দোলনে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।

[লেখক : ব্যাংকার]

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

জিল্লুর রহমান

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ প্রবাদটি গ্রাম-বাংলায় বহুল প্রচলিত প্রবাদসমূহের মধ্যে অন্যতম। শত বছর আগে মদন মোহন তর্কালঙ্কার তার শিশুশিক্ষা বইটিতে এ কথাগুলো লিখেছিলেন; যা ক্রমেই মানুষের মুখে মুখে ফিরে আসছে। মনযোগী-অমনযোগী প্রায় সব শিক্ষার্থী এবং ছোট-বড় সবাই জীবনে অন্তত একবার হলেও লাইন দুটি শুনেছে বা কাউকে শুনিয়েছে। আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি শিশুকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে একথাই বোঝানো হয় যে লেখাপড়া করলে ভালো চাকরি পাওয়া, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। অনেক টাকা কামানো কিংবা গাড়ি-বাড়ি করা এর মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং লেখা পড়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, বাড়ি-গাড়ি করা হয়ে ওঠে শিশুটির পড়ালেখার একমাত্র উদ্দেশ্য। তবে বাস্তবতা বড়ই কঠিন। ঘোড়ার চল উঠে গেছে বহু আগেই। আর এখন সবাই গাড়িতে চড়তে পারে, অন্তত লোকাল বাসে চড়তে কারো লেখাপড়ার দরকার নেই। গাড়ি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের মালিক হেনরি ফোর্ডের কথা উল্লেখযোগ্য। হেনরি ফোর্ড কিন্তু অত পড়ালেখা করেননি। তিনি যে শুধু গাড়ি চড়েছেন তাই নয়, বিশাল একটা গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাও করেছেন।

মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হলো সাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন। শিক্ষাকে তুলনা করা হয় আলোর সঙ্গে। জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, মুক্ত করে অজ্ঞতার অভিশাপ হতে, মানুষকে আগামীর পথ চলতে সহায়তা করে। কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেননি এমন কেউ তো দুই বাংলায় নেই। দুজনের নামেই অসংখ্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তাদের কিন্তু তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসনদ ছিল না। অথচ এখন নজরুল রবীন্দ্রনাথের ওপর পিএইচডি করেছে বা করবে এমন লোক অগণিত আছে। আলবার্ট আইনস্টাইনও কিন্তু হাইস্কুল পাশ করতে পারেননি। আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, শেকসপিয়ার, হেনরি ফোর্ড, মার্কটোয়াইন, স্টিভ জবস এবং এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আছেন যারা তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত নন। তাদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিল না। অথচ দেখুন এদের কথা না পড়লে উচ্চশিক্ষিত হওয়া যায় না, ভালো একটা চাকরিও কপালে জোটে না।

জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, মুক্ত করে অজ্ঞতার অভিশাপ হতে, মানুষকে আগামীর পথ চলতে সহায়তা করে

বিশ্বের বড় বড় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক যারা এখনও নিজেকে বিকিয়ে দেননি তাদের হয়ত দামি গাড়ি নেই। এদের অভিজাত এলাকায় বাড়ি নেই, ফ্ল্যাটও নেই। অনেকেই আবার ভাড়া বাড়িতেও থাকেন। তবে তাদের আছে জ্ঞানের ভান্ডার, আলোর মশাল; যা যুগে যুগে আলোকিত করে এসেছে বিভিন্ন সমাজ ও জাতিকে। তারা পড়ালেখা করে ভালো লাগে বলে, এর পেছনে গাড়ি-বাড়ি করার উদ্দেশ্য নেই। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশ বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকে কেননা যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশ সরকারও জাতীয় শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করে বিভিন্ন ধরনের কৌশল সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষা ধারার সঙ্গে বয়স্ক শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমেই জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

আমরা প্রায়শ খবরে দেখি মা-ছেলে কিংবা পিতা-পুত্র একত্রে এসএসসি কিংবা স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করেছে। এগুলো এক ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক খবর। আসলে লেখাপড়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। জীবনের যেকোন সময় লেখাপড়া করা যায়। এক্ষেত্রে বয়স একটি আপেক্ষিক সংখ্যামাত্র। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো কাজে বাধা হতে পারে না বয়স। হরহামেশা এ কথাগুলো আমরা অনেককেই বলতে শুনি। তবে ইতালির জিউসেপ্পে প্যাতার্নো এ কথাকে বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তিনি ৯৮ বছর বয়সে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাকে বলা হচ্ছে ইতালির সবচেয়ে বয়স্ক শিক্ষার্থী। তাছাড়া ভারতের রাজ কুমার ভাইশ নামের এক ব্যক্তি ৯৮ বছর বয়সে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৫ সালের শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করেন। আবার শ্রীকান্ত জিচকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

কারণ তার একটি বা দুটি নয়, মোট ২০টি ডিগ্রি ছিল। তিনি ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে এই ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি এমনই নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তার নামে ১৪টি ডিগ্রি ছিল। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়েছেন এবং এর পাশাপাশি তিনি অনেক স্বর্ণপদকও অর্জন করেছেন। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এ রকম হাজারও দৃষ্টান্ত আছে। বয়সের বাধা লেখাপড়া বা জ্ঞানার্জনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও যেকোন বয়সে যেকোন ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব। শুধু দরকার মনের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর প্রবল আগ্রহ। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, চোখের পর্দা খুলে সমগ্র পৃথিবীকে দেখতে পারি। কিন্তু সেটা যখন পাঠ্যপুস্তকে আর পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায় কিংবা এর পেছনে যদি টাকা কামানোই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তখন ব্যাপারটা উদ্বেগের বটে। কারণ দেশ ও জাতি গঠনে সুশিক্ষিত নাগরিকের থেকে স্বশিক্ষিত নাগরিকের গুরুত্ব বেশি।

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এরপরও এদেশে নিরক্ষরতার হার কমেনি। সব শ্রেণীর মানুষকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। শিশুদের একটি বৃহৎ অংশ নানা কারণে স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। যারা ভর্তি হয় তাদের মধ্যে অনেকেই ঝরে যায়, আর স্কুলে ফিরতে পারে না। এদের জন্যই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন। যারা স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়নি, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে নিরক্ষর রয়ে গেছে তাদের জন্যও এটি আবশ্যক। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই মূলত বয়স্কদের ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোর ও বয়স্কদের জন্য বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে বয়সের ফ্রেমে আবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন সাক্ষরতার মাধ্যমে সবাইকে শিক্ষিত করার আন্দোলনে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।

[লেখক : ব্যাংকার]

back to top