মাছুম বিল্লাহ
জাতিকে নিরক্ষরতামুক্ত করার নিমিত্তে বিভিন্ন সময়ে সরকারকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সরকার বিভিন্ন পদপেক্ষ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার ফসল হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৫২ বছরও অতিক্রম করেছে অথচ সরকারি হিসাবে দেশে এখনও ২৪ শতাংশ মানুষকে আমরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে পারিনি। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। তাছাড়া আধুনিক এই প্রযুক্তি, ফোরজি আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে সাক্ষরতার কি সংজ্ঞা হবে সেটিও কার্যকরভাবে ভাবা হয়নি। যদিও উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোর একটি কার্যকরী গবেষণা সেল থাকা দরকার ছিল যেখান থেকে বর্তমানকালে সাক্ষরতা কি, কত শতাংশ সেই সাক্ষরতা অর্জন করেছে, কিভাবে সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্যভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার ও প্রকাশের আশা আমরা এই ব্যুরোর কাছে করতে পারি।
কিন্তু এই ব্যুরো এসবের ধারে কাছে না গিয়ে সেই সরকারি নিয়মে শুনশান অফিসে সরকারি প্রটোকল আর গ্রেড নিয়ে চিন্তা আর বড় বড় এসি রুমে বসে খোশগল্প আর কলম পেষা নিয়ে সময় কাটানোই যেন কাজ। বস্তি, অবহেলিত জনপদ, হাওর, বাঁওড় আর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যারা অক্ষরের ধারণা এখনো নিতে পারেনি তাদের কাছে যাওয়ার কোন কৌশল বা উপায় এই ব্যুরোর নেই। এখানে সাক্ষরতা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি বিষযে বিশেষায়িত কোন শিক্ষক ও গবেষক নেই। তারা সবাই কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাহলে কিভাবে আমরা আশা করব যে, এই ব্যুরোর মাধ্যমে দেশের সাক্ষরতার হার বাড়বে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পুরনো অর্গানোগ্রামে পদের সংখ্যা ৩৭৮। প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তার পদ ১৭টি। ব্যুরোর অধীনে ৬৪টি জেলা কার্যালয় আছে। সেখানে সর্বোচ্চ পদ সহকারী পরিচালক। সেসব কার্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৯২ জন। এই বিশাল বহরকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পালন করতে প্রতি মাসে নাকি সোয়া কোটি টাকা ব্যয় হয়। এই সোয়া কোটি টাকার আউটপুট কী?
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সাধারণত প্রকল্প বা কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষরতা বাড়ানোর কাজ করে থাকে। এসব প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের কাজ করেন ব্যুরোর কর্মকর্তা কর্মচারীরা। সর্বশেষ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও তা এ বছরের জুনে শেষ করে দেয়া হয়। ফলে এখন তাদের তেমন কোন কাজ নেই শুধুমাত্র দিবস পালন করা ছাড়া। দিবস পালন করার জন্য অর্থাৎ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানকিতার জন্য একটি ব্যুরো লালন পালন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটি নিয়ে চিন্তা করার সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করেছে যেখানে এবারো ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব সেই অনেকদিন থেকেই। এটি কি কারণে বা কেন হচ্ছে তার সন্তোষজনক কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বা এতদিন ব্যুরো যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তা এর খরচের সঙ্গে মানানসই নয় অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় সে অনুযায়ী আইটপুট নেই। তবে প্রশাসন ক্যাডারের দুই বা তার অধিক কর্মকর্তার পাদয়ন ঠিক নিয়মিতই হচ্ছে, হচ্ছে না কাজের কোন অগ্রগতি বা যে উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে ব্যুরো।
এই ব্যুরো বাজেট বরাদ্দও দিতে পারে না, সেটির জন্য নির্ভর করতে হয় ডিপিইর ওপর। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর সরাসরি অবদান এই ব্যুরো কতটা রাখে বা রাখতে পারছে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। ব্যুরো সমস্ত কাজই বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করায়। বেসরকারি সংস্থাগুলোর একদিকে যেমন রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে কাজ করার দক্ষতা ও কৌশল, টেকনিক ও অভিজ্ঞতা তেমনি রয়েছে উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর এসব কিছুই নেই। তাদের আছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী হিসেবে হামবরা ভাব আর এনজিও গুলোর ওপর খবরদারি। এনজিওর অর্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর উপঢৌকন গ্রহণ করা। বাংলাদেশের সাক্ষরতা দূরীকরণে এনজিওগুলো যে ভূমিকা রেখেছে সেটি দেশ মনে হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে তার স্বীকৃতি দিতে চায় না।
কিন্তু এনজিওগুলোই মূলত নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও দারিদ্রদূরীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে এবং এনজিওর এই দুর্দিনেও তা রেখে চলেছে। ছোট বড় সব এনজিওই দেশের অসহায় ও নিপিড়ীত মানুষের জন্য প্রকৃত অর্থে কাজ করে এবং করছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোতে মহাপরিচালক হিসেবে যারা আসেন তারা কাজের গভীরে ঢুকতে ঢুকতে তাদের হয় রিটায়ারমেন্টের সময় এসে যায় না হয় তারা মন্ত্রণালয়ে ফেরত যান। আর ভেতের যারা আছেন তাদের অধিকাংশের দক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে তেমনি রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। এদের নেই কোন প্রশিক্ষন, মানুষের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয় তাও এখানকার অনেকেই জানেননা। এনজিওতে যারা চাকরি করেন তাদের দেশে বিদেশে বহু প্রশিক্ষণ নিতে হয়, অতএব তারা অনেক স্মার্ট।
অথচ সরকারি হওয়ার সুবাদে উপানুষ্ঠানিক ব্যুরেরা লোকজন নিজেদের মনে করেন তারা দেশের জন্য বোধ হয় অনেক কিছুই করে ফেলেছেন। অথচ আউটপুট তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। কাজেই এই শে^তহস্তি পালনের আর কোন প্রয়োজন আছে কিনা তা রাষ্ট্রকে ভাবার উপযুক্ত সময় এসেছে। ছোট এনজিওগুলোকে কাজ পাইয়ে দেয়ার পর শুরু হয় মেহমানদারীর পালা। বু্যুরোর কর্মকর্তারা বড় মেহমান হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এনজিওদের মাথার ওপর বসে ঘুরে বেড়ান। এখানে শিক্ষার বিশেষায়িত কোন কর্মকর্তা নেই, আছেন কলম পেষা আর চ্ছোর দখল করা কর্মকর্তা। তারা সাক্ষরতা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় যা এনজিওগুলো সার্থকভাবে ডিল করে তাদের তদারকি কিভাবে করবেন?
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বিলুপ্ত করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো করা হয়; যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন করতে পারেনি তাদের জন্য কাজ, শিক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করাই এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ কিন্তু এ কাজগুলো হচ্ছে না কেন?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেমন রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী সেই একই ক্যাডারের দুই-তিনজন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতেও রয়েছেন। তারপরও কেন আমরা শুনছি যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর বর্তমান রুগ্ন দশা। এটিআমরা বুঝতে পারি না। আগের জেলা পর্যায়ের সহকারী পরিচালকগন বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল সেগুলো মনিটরিং করতেন। মাঠপর্যায়ে এখন কোন কাজ নেই, সার্ভে নেই। কোন প্রকল্প নেই। তাই তারা এখন শুধু বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন যদিও তাদের এ ধরনের কাজের জন্য কোন ফান্ড নেই। বর্তমানে এই হচ্ছে তাদের কাজ।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কাজকে বেগবান করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির অর্গানোগ্রামের আকার বাড়ানো হয়েছে। উপজলো পর্যায়েও ব্যুরোর অফিস খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একজন কর্মকর্তা, একজন অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও একজন অফিস সহায়কের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপজেলা কর্মকর্তা নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের কাছে চাহিদার কথা জানানো হলেও তা ঝুলে আছে। গত জুনে ২৬৫ জন অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ৪৪২ জন অফিস সহায়ক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও তা স্থগিত রয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। তারপর প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে কিন্তু নিরক্ষরতা দূর হয়নি। সরকার দাবি করছে দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ, তবে বেসরকারি হিসাবে এটি আরও কম হবে। অর্থাৎ সরকারি হিসাব ধরলে এখনো ২৪ শতাংশ জনসংখ্যা নিরক্ষর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে ২০১৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯, ২০১৯ সালে ৭৪ দশমিক ৭, ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর মূল দায়িত্ব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর।
তাদের একমাত্র প্রকল্প ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের’ (৬৪ জেলার) মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত হলেও অজ্ঞাত কারণে তা শেষ করে দেয়া হয় এ বছরের জুনে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির ( পিইডিপি-৪) সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫-এর আওতায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বিদ্যালয় বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পিইডিপি-৩ থেকে আগত এক লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে। বাকি ৯ লাখের প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২৫ হাজার ৭১২টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের পাঠদান করা হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর দায়িত্ব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরনের মতো প্রধান কাজ হলেও এই প্রতিষ্ঠান দ্বারা তা পুরোটা আশা করা যায় না। প্রথমত, নিরক্ষর জনসংখ্যা থাকে প্রত্যন্ত গ্রামে, হাওর ও পাহাড়ি এলাকায় আর সিটিতে থাকে বস্তিতে।
কিন্তু এসব স্থানের জন্য তাদের আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। উপজেলা পর্যায়ে তাদের এখনো কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। তাদের পুরোটাই নির্ভর করতে হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর। বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর তাদের খবরদারি এবং অযথা ভ্রমণ, কিছু পাওয়ার আশা ইত্যাদি দেখে মনে হয় এদের দ্বারা এই মহান দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে দূরত্ব প্রকৃত অর্থে যদি দূর করা না হয়, পেশাগত দক্ষতা ও পেশাগত আচরণে যদি প্রকৃত পরিবর্তন না আনা যায়, তাহলে রাষ্ট্র তার বড় বড় শে^তহস্তিগুলোকে পালন করবে রাষ্ট্রেরই অর্থ খরচ করে; কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হবে না।
[লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]
মাছুম বিল্লাহ
বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জাতিকে নিরক্ষরতামুক্ত করার নিমিত্তে বিভিন্ন সময়ে সরকারকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সরকার বিভিন্ন পদপেক্ষ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার ফসল হচ্ছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৫২ বছরও অতিক্রম করেছে অথচ সরকারি হিসাবে দেশে এখনও ২৪ শতাংশ মানুষকে আমরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে পারিনি। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। তাছাড়া আধুনিক এই প্রযুক্তি, ফোরজি আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে সাক্ষরতার কি সংজ্ঞা হবে সেটিও কার্যকরভাবে ভাবা হয়নি। যদিও উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোর একটি কার্যকরী গবেষণা সেল থাকা দরকার ছিল যেখান থেকে বর্তমানকালে সাক্ষরতা কি, কত শতাংশ সেই সাক্ষরতা অর্জন করেছে, কিভাবে সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্যভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার ও প্রকাশের আশা আমরা এই ব্যুরোর কাছে করতে পারি।
কিন্তু এই ব্যুরো এসবের ধারে কাছে না গিয়ে সেই সরকারি নিয়মে শুনশান অফিসে সরকারি প্রটোকল আর গ্রেড নিয়ে চিন্তা আর বড় বড় এসি রুমে বসে খোশগল্প আর কলম পেষা নিয়ে সময় কাটানোই যেন কাজ। বস্তি, অবহেলিত জনপদ, হাওর, বাঁওড় আর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যারা অক্ষরের ধারণা এখনো নিতে পারেনি তাদের কাছে যাওয়ার কোন কৌশল বা উপায় এই ব্যুরোর নেই। এখানে সাক্ষরতা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি বিষযে বিশেষায়িত কোন শিক্ষক ও গবেষক নেই। তারা সবাই কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাহলে কিভাবে আমরা আশা করব যে, এই ব্যুরোর মাধ্যমে দেশের সাক্ষরতার হার বাড়বে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পুরনো অর্গানোগ্রামে পদের সংখ্যা ৩৭৮। প্রধান কার্যালয়ে বর্তমানে ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তার পদ ১৭টি। ব্যুরোর অধীনে ৬৪টি জেলা কার্যালয় আছে। সেখানে সর্বোচ্চ পদ সহকারী পরিচালক। সেসব কার্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৯২ জন। এই বিশাল বহরকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে পালন করতে প্রতি মাসে নাকি সোয়া কোটি টাকা ব্যয় হয়। এই সোয়া কোটি টাকার আউটপুট কী?
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সাধারণত প্রকল্প বা কর্মসূচির মাধ্যমে সাক্ষরতা বাড়ানোর কাজ করে থাকে। এসব প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের কাজ করেন ব্যুরোর কর্মকর্তা কর্মচারীরা। সর্বশেষ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত থাকা সত্ত্বেও তা এ বছরের জুনে শেষ করে দেয়া হয়। ফলে এখন তাদের তেমন কোন কাজ নেই শুধুমাত্র দিবস পালন করা ছাড়া। দিবস পালন করার জন্য অর্থাৎ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানকিতার জন্য একটি ব্যুরো লালন পালন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটি নিয়ে চিন্তা করার সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করেছে যেখানে এবারো ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব সেই অনেকদিন থেকেই। এটি কি কারণে বা কেন হচ্ছে তার সন্তোষজনক কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বা এতদিন ব্যুরো যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তা এর খরচের সঙ্গে মানানসই নয় অর্থাৎ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় সে অনুযায়ী আইটপুট নেই। তবে প্রশাসন ক্যাডারের দুই বা তার অধিক কর্মকর্তার পাদয়ন ঠিক নিয়মিতই হচ্ছে, হচ্ছে না কাজের কোন অগ্রগতি বা যে উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে ব্যুরো।
এই ব্যুরো বাজেট বরাদ্দও দিতে পারে না, সেটির জন্য নির্ভর করতে হয় ডিপিইর ওপর। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর সরাসরি অবদান এই ব্যুরো কতটা রাখে বা রাখতে পারছে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। ব্যুরো সমস্ত কাজই বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে করায়। বেসরকারি সংস্থাগুলোর একদিকে যেমন রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে কাজ করার দক্ষতা ও কৌশল, টেকনিক ও অভিজ্ঞতা তেমনি রয়েছে উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত জনবল কাঠামো। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর এসব কিছুই নেই। তাদের আছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী হিসেবে হামবরা ভাব আর এনজিও গুলোর ওপর খবরদারি। এনজিওর অর্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর উপঢৌকন গ্রহণ করা। বাংলাদেশের সাক্ষরতা দূরীকরণে এনজিওগুলো যে ভূমিকা রেখেছে সেটি দেশ মনে হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে তার স্বীকৃতি দিতে চায় না।
কিন্তু এনজিওগুলোই মূলত নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও দারিদ্রদূরীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে এবং এনজিওর এই দুর্দিনেও তা রেখে চলেছে। ছোট বড় সব এনজিওই দেশের অসহায় ও নিপিড়ীত মানুষের জন্য প্রকৃত অর্থে কাজ করে এবং করছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যুরোতে মহাপরিচালক হিসেবে যারা আসেন তারা কাজের গভীরে ঢুকতে ঢুকতে তাদের হয় রিটায়ারমেন্টের সময় এসে যায় না হয় তারা মন্ত্রণালয়ে ফেরত যান। আর ভেতের যারা আছেন তাদের অধিকাংশের দক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে তেমনি রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। এদের নেই কোন প্রশিক্ষন, মানুষের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয় তাও এখানকার অনেকেই জানেননা। এনজিওতে যারা চাকরি করেন তাদের দেশে বিদেশে বহু প্রশিক্ষণ নিতে হয়, অতএব তারা অনেক স্মার্ট।
অথচ সরকারি হওয়ার সুবাদে উপানুষ্ঠানিক ব্যুরেরা লোকজন নিজেদের মনে করেন তারা দেশের জন্য বোধ হয় অনেক কিছুই করে ফেলেছেন। অথচ আউটপুট তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। কাজেই এই শে^তহস্তি পালনের আর কোন প্রয়োজন আছে কিনা তা রাষ্ট্রকে ভাবার উপযুক্ত সময় এসেছে। ছোট এনজিওগুলোকে কাজ পাইয়ে দেয়ার পর শুরু হয় মেহমানদারীর পালা। বু্যুরোর কর্মকর্তারা বড় মেহমান হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এনজিওদের মাথার ওপর বসে ঘুরে বেড়ান। এখানে শিক্ষার বিশেষায়িত কোন কর্মকর্তা নেই, আছেন কলম পেষা আর চ্ছোর দখল করা কর্মকর্তা। তারা সাক্ষরতা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় যা এনজিওগুলো সার্থকভাবে ডিল করে তাদের তদারকি কিভাবে করবেন?
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে বিলুপ্ত করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো করা হয়; যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন করতে পারেনি তাদের জন্য কাজ, শিক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করাই এ প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ কিন্তু এ কাজগুলো হচ্ছে না কেন?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেমন রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী সেই একই ক্যাডারের দুই-তিনজন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতেও রয়েছেন। তারপরও কেন আমরা শুনছি যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর বর্তমান রুগ্ন দশা। এটিআমরা বুঝতে পারি না। আগের জেলা পর্যায়ের সহকারী পরিচালকগন বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল সেগুলো মনিটরিং করতেন। মাঠপর্যায়ে এখন কোন কাজ নেই, সার্ভে নেই। কোন প্রকল্প নেই। তাই তারা এখন শুধু বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন যদিও তাদের এ ধরনের কাজের জন্য কোন ফান্ড নেই। বর্তমানে এই হচ্ছে তাদের কাজ।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কাজকে বেগবান করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির অর্গানোগ্রামের আকার বাড়ানো হয়েছে। উপজলো পর্যায়েও ব্যুরোর অফিস খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় একজন কর্মকর্তা, একজন অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও একজন অফিস সহায়কের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপজেলা কর্মকর্তা নিয়োগে সরকারি কর্মকমিশনের কাছে চাহিদার কথা জানানো হলেও তা ঝুলে আছে। গত জুনে ২৬৫ জন অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ৪৪২ জন অফিস সহায়ক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও তা স্থগিত রয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। তারপর প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে কিন্তু নিরক্ষরতা দূর হয়নি। সরকার দাবি করছে দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ, তবে বেসরকারি হিসাবে এটি আরও কম হবে। অর্থাৎ সরকারি হিসাব ধরলে এখনো ২৪ শতাংশ জনসংখ্যা নিরক্ষর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে ২০১৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯, ২০১৯ সালে ৭৪ দশমিক ৭, ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বাড়ানোর মূল দায়িত্ব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর।
তাদের একমাত্র প্রকল্প ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের’ (৬৪ জেলার) মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত হলেও অজ্ঞাত কারণে তা শেষ করে দেয়া হয় এ বছরের জুনে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির ( পিইডিপি-৪) সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫-এর আওতায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বিদ্যালয় বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পিইডিপি-৩ থেকে আগত এক লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে। বাকি ৯ লাখের প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ২৫ হাজার ৭১২টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের পাঠদান করা হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর দায়িত্ব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরনের মতো প্রধান কাজ হলেও এই প্রতিষ্ঠান দ্বারা তা পুরোটা আশা করা যায় না। প্রথমত, নিরক্ষর জনসংখ্যা থাকে প্রত্যন্ত গ্রামে, হাওর ও পাহাড়ি এলাকায় আর সিটিতে থাকে বস্তিতে।
কিন্তু এসব স্থানের জন্য তাদের আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। উপজেলা পর্যায়ে তাদের এখনো কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। তাদের পুরোটাই নির্ভর করতে হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর। বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর তাদের খবরদারি এবং অযথা ভ্রমণ, কিছু পাওয়ার আশা ইত্যাদি দেখে মনে হয় এদের দ্বারা এই মহান দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে দূরত্ব প্রকৃত অর্থে যদি দূর করা না হয়, পেশাগত দক্ষতা ও পেশাগত আচরণে যদি প্রকৃত পরিবর্তন না আনা যায়, তাহলে রাষ্ট্র তার বড় বড় শে^তহস্তিগুলোকে পালন করবে রাষ্ট্রেরই অর্থ খরচ করে; কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হবে না।
[লেখক : প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ]