সাদেকুর রহমান
৫ নভেম্বর, ২০২৩
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসতান্ডব শুরু করে। দখলদার বাহিনী পরবর্তী নয় মাস ধরেই স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধন অব্যাহত রাখে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকারের পরও তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদে তাদের অপকর্ম করে যাচ্ছিল। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে- এমন তথ্যই প্রতিষ্ঠিত। তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে সাম্প্রতিককালের কোন কোন গবেষক মনে করেন। শুধু তা-ই নয়, নয় মাসে হত্যা ছাড়াও ছয় লাখেরও বেশি নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এছাড়া দেশজুড়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা কত ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত যে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটেছে তারও প্রকৃত হিসাব নেই। তবে এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশই ঘটেছে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের সহায়তায়। এক রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও পাকিস্তানিদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে হত্যাকান্ড ঘটানো।
দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে নভেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়, নানা সীমাবদ্ধতায় সেগুলোর অনেক গণহত্যা ও গণকবর বা বধ্যভূমি আজো আবিষ্কৃত হয়নি। যেগুলো সম্পর্কে জানা যায় সেগুলো মোটেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ও শেকড়সন্ধানীদের জন্য একাত্তরের নভেম্বর মাসে এ দেশীয় এজেন্টদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যার খন্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হলো।
ধুনট গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর বগুড়ার ধুনট উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে ২৮ জন নিরীহ বাঙালিকে। এদিন স্থানীয় রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে ২৮ জনকে আটকের পর শহরে একত্রিত করে শত্রুসেনারা। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে রাতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ধুনট থানা ভবনের প্রায় ২০০ গজ পূর্বদিকে পশ্চিম ভরনশাহী গ্রামে পাশাপাশি দুটি গণকবরে তাদের সমাধিস্থ করা হয়। এদিন শহীদদের মধ্যে, ধুনট উপজেলার ভরনশাহী গ্রামের জহির উদ্দিন, কান্তনগর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান, মাজবাড়ি গ্রামের একই পরিবারের ফরহাদ আলী ও পর্বত আলী, জিল্লুর রহমান, চাঁন্দারপাড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ, শিয়ালী গ্রামের নুরুল ইসলামের পরিচয় জানা যায়। গণকবরে লেখা রয়েছে শহীদদের নামের তালিকা। তবে একই সময় পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটের আঘাতে শহীদ হয়েছেন নাম না জানা আরও ২১ বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাদের অনেকের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
কবুলপুর গণহত্যা : মুক্তিযুদ্ধকালে নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭নং উইংয়ের সদর দপ্তর। তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মান্দা থানাধীন (বর্তমানে উপজেলা) যে কটি বধ্যভূমি রয়েছে কবুলপুরের গুপ্তির পুকুর পাড়ের বধ্যভূমি অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর ভাঁরশো ইউনিয়নের কবুলপুর গ্রামে গুপ্তির পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী চারজনকে গুলি করে হত্যা করে। তারা লাশগুলো একই কবরে পুঁতে রাখে। এটি ‘কবুলপুর গণহত্যা’ নামে পরিচিত।
পার-বোয়ালিয়া গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় বিহারি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পার-বোয়ালিয়া এবং খাগড়কুড়ি এ দুই গ্রামের অর্ধশতাধিক নিরীহ বাঙালিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।
সেদিন পাকিস্তানি হানাদার, বিহারি সম্প্রদায়, রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর সমন্বয়ে নওগাঁ ও সান্তাহার থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ রচনা করে। জয় বাংলা হাট ও পার-বোয়ালিয়া গ্রাম আক্রমণ করে বেশ কিছু বেসামরিক নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম-পরিচয় জানা যায় তারা হলেন- জগদেব প্রসাদ (পিতা- রাম প্রসাদ), ঝাড়ু মন্ডল (পিতা- বাড়– মন্ডল), দিলবর রহমান দিলু (পিতা- বাবু মন্ডল), মেহের শাহ (পিতা- লিফুজা শাহ), হজিবর রহমান (পিতা- ফ্যালানা সরদার), আজবুল সরদার (পিতা- মাদারী সরদার), ছামছুল বাটু (পিতা- অহির স্বর্ণকার), কাদির সরদার (পিতা- বাজু সরদার), আসাদুল (পিতা- মফিজ সরদার), মজব সাহা (পিতা- কুশাই সাহা), করিম উদ্দিন (পিতা- খুদি মন্ডল), দিবর সরদার (পিতা- বাবু সরদার), ইশরদ মন্ডল (পিতা- কিসমত মন্ডল) ও মেহের আলী সাহা (পিতা- লিপুচা সাহা)। এছাড়া আহত হন যথাক্রমে উজির শাহ (পিতা- গছির শাহ), জসমত সখিদার (পিতা- অজ্ঞাত) ও শফির স্বর্ণকার (পিতা- বাদল স্বর্ণকার)। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান সদ্য ভারতফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক বিশিষ্ট সমাজ সেবক ডা. হাসান আলী। তাদের সবার বাড়িই পার-বোয়ালিয়া গ্রাম।
পার-বোয়ালিয়া আক্রান্তের সংবাদ পেয়ে জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি আক্রমণ রচনা করেন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্থায়ী এ যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার ও একজন মিলিশিয়া পুলিশ নিহত হন। যুদ্ধ শেষে গ্রামবাসী রাজাকারসহ মিলিশিয়া পুলিশের লাশ গ্রামের বাঁশঝাড়ে পুঁতে দেয়। বিগত ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল নওগাঁ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার এস. এম. সিরাজুল ইসলামের প্রচেষ্টায় নওগাঁর জেলা প্রশাসক আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩ জন শহীদের নামফলক উন্মোচন করেন।
পার-বোয়ালিয়া যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরাস্ত হলে ক্ষোভে-দুঃখে হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী খাগরকুড়ি গ্রামের নিরীহ জনগণের ওপর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন ও ব্যাপক হত্যাকা- সংঘটিত হয়। হানাদার বাহিনী পুলিন মন্ডল (পিতা- গানা মন্ডল)-কে ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারে, মোহাম্মাদ মন্ডল (পিতা- শুজা মন্ডল)-কে গুলি করে ও গুলজার বিবি (স্বামী- মঙ্গলা মন্ডল)-কে কুড়ালি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে এবং বাদেশ আলী (পিতা- রমজান আলী মন্ডল) ও মদের আলী মন্ডল (পিতা- ওহির মন্ডল)-কে গলা কেটে হত্যা করে।
এছাড়া সূর্যাস্তের আগে হানাদার বাহিনী খাগরকুড়ি গ্রামের খাতেযান বিবি (স্বামী- বাদেশ আলী মন্ডল), ফাতেমা বিবি (স্বামী- শুকুর আলী মন্ডল), করিম মন্ডল (পিতা- খুদা মন্ডল), মান্নান (পিতা- বাদেশ মন্ডল), গুলিজান (স্বামী- মংলা মন্ডল), আছিরন (স্বামী- ময়েন মন্ডল), জসমত (পিতা - অজ্ঞাত), আলিম প্রামানিক (পিতা- অজ্ঞাত); এনায়েতপুর গ্রামের অনোয়ার (পিতা- অহির ড্রাইভার), আমেনা বেওয়া (স্বামী- মফিজ উদ্দিন), ফয়জান (স্বামী- হাফিজ উদ্দিন), বুলমুন বেওয়া (স্বামী- চুনাই ফকির), তছির উদ্দিন (পিতা- হাফেজ উদ্দিন); বোয়ালিয়া গ্রামের মেহের আলী মন্ডল (পিতা - মটু মন্ডল), মোজাম উদ্দিন (পিতা- বাদেশ আলী), বাদেশ সরদার (পিতা- আলী সরদার), চয়েন উদ্দিন (পিতা- আজু মন্ডল), মফিজ প্রামানিক (পিতা- ভোলা প্রামানিক), যাদব সরদার (পিতা- অজ্ঞাত), কাবিল সরদার (পিতা- অজ্ঞাত); বর্শিপুর গ্রামের এব্রাহিম (পিতা- রিয়াজ উদ্দন), আহম্মদ আলী (পিতা- খাদ্দু মন্ডল), কাদের সরদার (পিতা- নিয়ামত সরদার), অছির মন্ডল (পিতা- আরবুল্যা) এবং বোয়ালিয়া উত্তরপাড়ার মোহাম্মাদ আলী মন্ডল (পিতা- মধু মন্ডল), জামাল উদ্দিন (পিতা- ছায়ের মন্ডল) ও মোবার আলী (পিতা - কবেজ মন্ডল)-কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ব্যাপক ধ্বংসতা-ব চালিয়ে হানাদার বাহিনী অবশেষে সান্তাহারের উদ্দেশে গ্রাম ত্যাগ করে।
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]
(চলবে)
সাদেকুর রহমান
বুধবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৩
৫ নভেম্বর, ২০২৩
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসতান্ডব শুরু করে। দখলদার বাহিনী পরবর্তী নয় মাস ধরেই স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধন অব্যাহত রাখে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকারের পরও তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদে তাদের অপকর্ম করে যাচ্ছিল। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে- এমন তথ্যই প্রতিষ্ঠিত। তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে সাম্প্রতিককালের কোন কোন গবেষক মনে করেন। শুধু তা-ই নয়, নয় মাসে হত্যা ছাড়াও ছয় লাখেরও বেশি নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এছাড়া দেশজুড়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা কত ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কত যে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটেছে তারও প্রকৃত হিসাব নেই। তবে এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশই ঘটেছে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের সহায়তায়। এক রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও পাকিস্তানিদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে হত্যাকান্ড ঘটানো।
দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে নভেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়, নানা সীমাবদ্ধতায় সেগুলোর অনেক গণহত্যা ও গণকবর বা বধ্যভূমি আজো আবিষ্কৃত হয়নি। যেগুলো সম্পর্কে জানা যায় সেগুলো মোটেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ও শেকড়সন্ধানীদের জন্য একাত্তরের নভেম্বর মাসে এ দেশীয় এজেন্টদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যার খন্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হলো।
ধুনট গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর বগুড়ার ধুনট উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে ২৮ জন নিরীহ বাঙালিকে। এদিন স্থানীয় রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে ২৮ জনকে আটকের পর শহরে একত্রিত করে শত্রুসেনারা। এরপর তাদের ওপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে রাতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ধুনট থানা ভবনের প্রায় ২০০ গজ পূর্বদিকে পশ্চিম ভরনশাহী গ্রামে পাশাপাশি দুটি গণকবরে তাদের সমাধিস্থ করা হয়। এদিন শহীদদের মধ্যে, ধুনট উপজেলার ভরনশাহী গ্রামের জহির উদ্দিন, কান্তনগর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান, মাজবাড়ি গ্রামের একই পরিবারের ফরহাদ আলী ও পর্বত আলী, জিল্লুর রহমান, চাঁন্দারপাড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ, শিয়ালী গ্রামের নুরুল ইসলামের পরিচয় জানা যায়। গণকবরে লেখা রয়েছে শহীদদের নামের তালিকা। তবে একই সময় পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটের আঘাতে শহীদ হয়েছেন নাম না জানা আরও ২১ বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাদের অনেকের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
কবুলপুর গণহত্যা : মুক্তিযুদ্ধকালে নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭নং উইংয়ের সদর দপ্তর। তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মান্দা থানাধীন (বর্তমানে উপজেলা) যে কটি বধ্যভূমি রয়েছে কবুলপুরের গুপ্তির পুকুর পাড়ের বধ্যভূমি অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর ভাঁরশো ইউনিয়নের কবুলপুর গ্রামে গুপ্তির পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী চারজনকে গুলি করে হত্যা করে। তারা লাশগুলো একই কবরে পুঁতে রাখে। এটি ‘কবুলপুর গণহত্যা’ নামে পরিচিত।
পার-বোয়ালিয়া গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় বিহারি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পার-বোয়ালিয়া এবং খাগড়কুড়ি এ দুই গ্রামের অর্ধশতাধিক নিরীহ বাঙালিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।
সেদিন পাকিস্তানি হানাদার, বিহারি সম্প্রদায়, রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর সমন্বয়ে নওগাঁ ও সান্তাহার থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ রচনা করে। জয় বাংলা হাট ও পার-বোয়ালিয়া গ্রাম আক্রমণ করে বেশ কিছু বেসামরিক নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম-পরিচয় জানা যায় তারা হলেন- জগদেব প্রসাদ (পিতা- রাম প্রসাদ), ঝাড়ু মন্ডল (পিতা- বাড়– মন্ডল), দিলবর রহমান দিলু (পিতা- বাবু মন্ডল), মেহের শাহ (পিতা- লিফুজা শাহ), হজিবর রহমান (পিতা- ফ্যালানা সরদার), আজবুল সরদার (পিতা- মাদারী সরদার), ছামছুল বাটু (পিতা- অহির স্বর্ণকার), কাদির সরদার (পিতা- বাজু সরদার), আসাদুল (পিতা- মফিজ সরদার), মজব সাহা (পিতা- কুশাই সাহা), করিম উদ্দিন (পিতা- খুদি মন্ডল), দিবর সরদার (পিতা- বাবু সরদার), ইশরদ মন্ডল (পিতা- কিসমত মন্ডল) ও মেহের আলী সাহা (পিতা- লিপুচা সাহা)। এছাড়া আহত হন যথাক্রমে উজির শাহ (পিতা- গছির শাহ), জসমত সখিদার (পিতা- অজ্ঞাত) ও শফির স্বর্ণকার (পিতা- বাদল স্বর্ণকার)। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান সদ্য ভারতফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক বিশিষ্ট সমাজ সেবক ডা. হাসান আলী। তাদের সবার বাড়িই পার-বোয়ালিয়া গ্রাম।
পার-বোয়ালিয়া আক্রান্তের সংবাদ পেয়ে জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি আক্রমণ রচনা করেন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্থায়ী এ যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার ও একজন মিলিশিয়া পুলিশ নিহত হন। যুদ্ধ শেষে গ্রামবাসী রাজাকারসহ মিলিশিয়া পুলিশের লাশ গ্রামের বাঁশঝাড়ে পুঁতে দেয়। বিগত ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল নওগাঁ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার এস. এম. সিরাজুল ইসলামের প্রচেষ্টায় নওগাঁর জেলা প্রশাসক আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩ জন শহীদের নামফলক উন্মোচন করেন।
পার-বোয়ালিয়া যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরাস্ত হলে ক্ষোভে-দুঃখে হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী খাগরকুড়ি গ্রামের নিরীহ জনগণের ওপর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন ও ব্যাপক হত্যাকা- সংঘটিত হয়। হানাদার বাহিনী পুলিন মন্ডল (পিতা- গানা মন্ডল)-কে ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারে, মোহাম্মাদ মন্ডল (পিতা- শুজা মন্ডল)-কে গুলি করে ও গুলজার বিবি (স্বামী- মঙ্গলা মন্ডল)-কে কুড়ালি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে এবং বাদেশ আলী (পিতা- রমজান আলী মন্ডল) ও মদের আলী মন্ডল (পিতা- ওহির মন্ডল)-কে গলা কেটে হত্যা করে।
এছাড়া সূর্যাস্তের আগে হানাদার বাহিনী খাগরকুড়ি গ্রামের খাতেযান বিবি (স্বামী- বাদেশ আলী মন্ডল), ফাতেমা বিবি (স্বামী- শুকুর আলী মন্ডল), করিম মন্ডল (পিতা- খুদা মন্ডল), মান্নান (পিতা- বাদেশ মন্ডল), গুলিজান (স্বামী- মংলা মন্ডল), আছিরন (স্বামী- ময়েন মন্ডল), জসমত (পিতা - অজ্ঞাত), আলিম প্রামানিক (পিতা- অজ্ঞাত); এনায়েতপুর গ্রামের অনোয়ার (পিতা- অহির ড্রাইভার), আমেনা বেওয়া (স্বামী- মফিজ উদ্দিন), ফয়জান (স্বামী- হাফিজ উদ্দিন), বুলমুন বেওয়া (স্বামী- চুনাই ফকির), তছির উদ্দিন (পিতা- হাফেজ উদ্দিন); বোয়ালিয়া গ্রামের মেহের আলী মন্ডল (পিতা - মটু মন্ডল), মোজাম উদ্দিন (পিতা- বাদেশ আলী), বাদেশ সরদার (পিতা- আলী সরদার), চয়েন উদ্দিন (পিতা- আজু মন্ডল), মফিজ প্রামানিক (পিতা- ভোলা প্রামানিক), যাদব সরদার (পিতা- অজ্ঞাত), কাবিল সরদার (পিতা- অজ্ঞাত); বর্শিপুর গ্রামের এব্রাহিম (পিতা- রিয়াজ উদ্দন), আহম্মদ আলী (পিতা- খাদ্দু মন্ডল), কাদের সরদার (পিতা- নিয়ামত সরদার), অছির মন্ডল (পিতা- আরবুল্যা) এবং বোয়ালিয়া উত্তরপাড়ার মোহাম্মাদ আলী মন্ডল (পিতা- মধু মন্ডল), জামাল উদ্দিন (পিতা- ছায়ের মন্ডল) ও মোবার আলী (পিতা - কবেজ মন্ডল)-কে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ব্যাপক ধ্বংসতা-ব চালিয়ে হানাদার বাহিনী অবশেষে সান্তাহারের উদ্দেশে গ্রাম ত্যাগ করে।
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]
(চলবে)