সাদেকুর রহমান
(গতকালের পর)
মুক্তিযুদ্ধকালে আশপাশের অনেক এলাকা থেকে বহু লোক আশ্রয় নিয়েছিল তেরশ্রী গ্রামে। তেরশ্রী ছিল অসহায়, নিরূপায় জনগণের মায়ের কোলের মতো নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তেরশ্রীতে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।
২১ নভেম্বর রাতের অন্ধকার শেষে ২২ তারিখের দিনের আলোর আশায় যখন রাতের শেষ প্রহর আর সোনালি সূর্য উদিত হওয়ার রক্তিম আভা পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তেমন সময়ে ঘিওর থেকে পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের সহযোগীরা আক্রমণ চালায় তেরশ্রী গ্রামে। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনপাড়ার ঘুমন্ত মানুষের ওপর। হানাদার বাহিনী যাকে যেখানে পেয়েছে, তাকে সেখানেই হত্যা করে। তেরশ্রী এলাকার উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষক জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে তার শয়নকক্ষ থেকে বের করে লেপ-কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে।
ওই দিন নিহত হওয়ার আগে সাধুচরণ দাস, যিনি হানাদার বাহিনী রাইফেল কেড়ে নিয়ে এ জুলুমের প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শতাধিক অত্যাচারী দলের কাছে তাকেও প্রাণ দিতে হয়। দুপুর বারোটা পর্যন্ত হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যাতান্ডব, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ সম্পন্ন করে ফিরে যায় ঘিওরে। লাশের গ্রামে পরিণত হয় পুরো তেরশ্রী গ্রাম। পরে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান মিলে লাশগুলোকে গণকবরের মতো সমাধিস্থ করেন।
তবে তেরশ্রী গণহত্যার সঠিক ইতিহাস আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। স্থানীয়ভাবে ৪৩ জনের মধ্যে ৩৭ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা হলেন- জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরি মাখন চন্দ্র সরকার, যাদব চন্দ্র দত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত, সাধুচরণ দাস, শ্যম লাল সূত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদীশ চন্দ্র দাস, সুধন্য চন্দ্র দাস, সুরেন্দ্র নাথ দাস, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ চন্দ্র দাস, রামচরণ সূত্রধর, রাধাবল্লভ নাগ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ চন্দ্র সূত্রধর, মো. কছিম উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, একলাছ মোল্লা, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ণ চন্দ্র সূত্রধর, শচীন্দ্রনাথ গোস্বামী, যোগেশ দত্ত, গৌড় চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, মনীন্দ্র চন্দ্র দাস, তাজু উদ্দিন, রমজান আলী, দেলবর আলী, ওয়াজ উদ্দিন, শ্যামল সূত্রধর, বিপ্লব সরকার, মহেন্দ্র নাথ দাস, শ্রীমন্ত কুমার দাস।
প্রতি বছর ২২ নভেম্বর তেরশ্রী গণহত্যা দিবসটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।
সূর্যদী গণহত্যা :
১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সূর্যদী গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪৯ নিরীহ গ্রামবাসী। সেদিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সেখানকার অন্তত ৩শ’ ঘরবাড়ি।
সকাল সাতটায় জিপ আর ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলা চালায়। গ্রামের লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী গুলি ছুড়তে থাকে। একই সময়ে গান পাউডার ছিটিয়ে গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পায় তাদের হত্যা করার জন্য ধরে এনে দাঁড় করায় স্থানীয় ধানক্ষেতের মধ্যে।
সেদিন আত্মগোপনে থাকা এ গ্রামের বাসিন্দা ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে আসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। একটু পরেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কোম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হটে যায়।
এ সময় ধানক্ষেতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেয় পকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তা। পার্শ্ববর্তী খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী পাশের একটি ধানক্ষেত থেকে ফাঁকা গুলি শুরু করেন। এ গুলির আওয়াজ পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ফেলে রেখে মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী ও সূর্যদী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানকে একটি ধানক্ষেতে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
প্রতিবছর এই দিনটিতে সূর্যদী এলাকায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
তারানগর গণহত্যা :
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নের ঘাটারচর ও ভাওয়াল এলাকায় গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী এদিন একযোগে ঘাটারচরের হত্যা করে ৫৭ জন ও ভাওয়ালের ২৯ জন মুক্তিকামী মানুষকে। পুরো ঘাটারচর ও ভাওয়াল গ্রাম হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত প্রান্তর। সেই সময় ঘাটারচরে ৩৪ জনকে গণ কবর দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদ নগর’। ভাওয়াল, ঘাটারচর, খানবাড়ি, কাঁঠালতুলি ও গুইটার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় তারা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভাওয়াল গ্রাম। সেই থেকে এলাকাবাসী ২৫ নভেম্বর ‘তারানগর গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাটারচর খেলার মাঠের দখল নিয়ে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ফয়েজ হোসেনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ চলছিল স্থানীয় গ্রামবাসীর।
রাজাকার ফয়েজ হোসেন জাল দলিলেও মাঠ দখল করতে না পেরে গ্রামবাসীদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন। এরপর তিনি ঘাটারচর গ্রামে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৭-দফা নোটিশ পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঘাটারচরের বাসিন্দা ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) সদস্য গোলাম মোস্তফা, রহমান মাতবরসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রহমান মাতবর বাড়িতে এসে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আহ্বান জানান। তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ও কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে স্থানীয় টানপাড়া মসজিদের পাশে বৈঠক করেন। বেশ কয়েকজন তরুণ তখনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য নাম লেখান।
মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠকের খবর বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরে রাজাকাররা গোপনে পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা জানান। ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে (২৫ নভেম্বর) প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বেশ কয়েকটি গানবোটে করে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ওয়াশপুর ঘাটে নামে। এরপর তারা হেঁটে নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে ঘাটারচরের প্রান্তে উপস্থিত হয়। এরপর বোরকা পরা স্থানীয় দুই রাজাকারের সহযোগিতায় রাতের মধ্যেই গোটা ঘাটারচর গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে হানাদার সেনারা।
(চলবে)
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]
সাদেকুর রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩
(গতকালের পর)
মুক্তিযুদ্ধকালে আশপাশের অনেক এলাকা থেকে বহু লোক আশ্রয় নিয়েছিল তেরশ্রী গ্রামে। তেরশ্রী ছিল অসহায়, নিরূপায় জনগণের মায়ের কোলের মতো নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তেরশ্রীতে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।
২১ নভেম্বর রাতের অন্ধকার শেষে ২২ তারিখের দিনের আলোর আশায় যখন রাতের শেষ প্রহর আর সোনালি সূর্য উদিত হওয়ার রক্তিম আভা পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তেমন সময়ে ঘিওর থেকে পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের সহযোগীরা আক্রমণ চালায় তেরশ্রী গ্রামে। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনপাড়ার ঘুমন্ত মানুষের ওপর। হানাদার বাহিনী যাকে যেখানে পেয়েছে, তাকে সেখানেই হত্যা করে। তেরশ্রী এলাকার উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষক জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে তার শয়নকক্ষ থেকে বের করে লেপ-কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে।
ওই দিন নিহত হওয়ার আগে সাধুচরণ দাস, যিনি হানাদার বাহিনী রাইফেল কেড়ে নিয়ে এ জুলুমের প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শতাধিক অত্যাচারী দলের কাছে তাকেও প্রাণ দিতে হয়। দুপুর বারোটা পর্যন্ত হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যাতান্ডব, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ সম্পন্ন করে ফিরে যায় ঘিওরে। লাশের গ্রামে পরিণত হয় পুরো তেরশ্রী গ্রাম। পরে স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান মিলে লাশগুলোকে গণকবরের মতো সমাধিস্থ করেন।
তবে তেরশ্রী গণহত্যার সঠিক ইতিহাস আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। স্থানীয়ভাবে ৪৩ জনের মধ্যে ৩৭ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তারা হলেন- জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরি মাখন চন্দ্র সরকার, যাদব চন্দ্র দত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত, সাধুচরণ দাস, শ্যম লাল সূত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদীশ চন্দ্র দাস, সুধন্য চন্দ্র দাস, সুরেন্দ্র নাথ দাস, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ চন্দ্র দাস, রামচরণ সূত্রধর, রাধাবল্লভ নাগ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ চন্দ্র সূত্রধর, মো. কছিম উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, একলাছ মোল্লা, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ণ চন্দ্র সূত্রধর, শচীন্দ্রনাথ গোস্বামী, যোগেশ দত্ত, গৌড় চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, মনীন্দ্র চন্দ্র দাস, তাজু উদ্দিন, রমজান আলী, দেলবর আলী, ওয়াজ উদ্দিন, শ্যামল সূত্রধর, বিপ্লব সরকার, মহেন্দ্র নাথ দাস, শ্রীমন্ত কুমার দাস।
প্রতি বছর ২২ নভেম্বর তেরশ্রী গণহত্যা দিবসটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।
সূর্যদী গণহত্যা :
১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সূর্যদী গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪৯ নিরীহ গ্রামবাসী। সেদিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সেখানকার অন্তত ৩শ’ ঘরবাড়ি।
সকাল সাতটায় জিপ আর ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলা চালায়। গ্রামের লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী গুলি ছুড়তে থাকে। একই সময়ে গান পাউডার ছিটিয়ে গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পায় তাদের হত্যা করার জন্য ধরে এনে দাঁড় করায় স্থানীয় ধানক্ষেতের মধ্যে।
সেদিন আত্মগোপনে থাকা এ গ্রামের বাসিন্দা ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে আসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। একটু পরেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কোম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হটে যায়।
এ সময় ধানক্ষেতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেয় পকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তা। পার্শ্ববর্তী খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী পাশের একটি ধানক্ষেত থেকে ফাঁকা গুলি শুরু করেন। এ গুলির আওয়াজ পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ফেলে রেখে মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী ও সূর্যদী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানকে একটি ধানক্ষেতে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
প্রতিবছর এই দিনটিতে সূর্যদী এলাকায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
তারানগর গণহত্যা :
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নের ঘাটারচর ও ভাওয়াল এলাকায় গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী এদিন একযোগে ঘাটারচরের হত্যা করে ৫৭ জন ও ভাওয়ালের ২৯ জন মুক্তিকামী মানুষকে। পুরো ঘাটারচর ও ভাওয়াল গ্রাম হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত প্রান্তর। সেই সময় ঘাটারচরে ৩৪ জনকে গণ কবর দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদ নগর’। ভাওয়াল, ঘাটারচর, খানবাড়ি, কাঁঠালতুলি ও গুইটার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় তারা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভাওয়াল গ্রাম। সেই থেকে এলাকাবাসী ২৫ নভেম্বর ‘তারানগর গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাটারচর খেলার মাঠের দখল নিয়ে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ফয়েজ হোসেনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ চলছিল স্থানীয় গ্রামবাসীর।
রাজাকার ফয়েজ হোসেন জাল দলিলেও মাঠ দখল করতে না পেরে গ্রামবাসীদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন। এরপর তিনি ঘাটারচর গ্রামে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৭-দফা নোটিশ পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঘাটারচরের বাসিন্দা ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) সদস্য গোলাম মোস্তফা, রহমান মাতবরসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রহমান মাতবর বাড়িতে এসে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আহ্বান জানান। তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ও কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে স্থানীয় টানপাড়া মসজিদের পাশে বৈঠক করেন। বেশ কয়েকজন তরুণ তখনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য নাম লেখান।
মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠকের খবর বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরে রাজাকাররা গোপনে পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা জানান। ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে (২৫ নভেম্বর) প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বেশ কয়েকটি গানবোটে করে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ওয়াশপুর ঘাটে নামে। এরপর তারা হেঁটে নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে ঘাটারচরের প্রান্তে উপস্থিত হয়। এরপর বোরকা পরা স্থানীয় দুই রাজাকারের সহযোগিতায় রাতের মধ্যেই গোটা ঘাটারচর গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে হানাদার সেনারা।
(চলবে)
[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]