alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

: বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩

পরিবেশের চরম বিপর্যয়ে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মাঝেমধ্যে হঠাৎ এসে লন্ডভন্ড করে দেয় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা। হামুন, মোখা, সিত্রাং, সিডরের মতো নানা নাম নিয়ে এরা এসে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। গত ২৭ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে ৮ জনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আগে ২৪ অক্টোবর রাতে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ আঘাত হানার কক্সবাজারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বিগত দিনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বেশ কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। ১৯৭০, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৩ সালে ১৬ মে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। মহাসেনের আঘাতে বরগুনা, পটুয়াখালি, ভোলা, পিরোজপুরসহ বরিশালের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কৃষিজমি তলিয়ে যায়। বহু কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে পড়ে। ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালীতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে ফসলহানি, চিংড়ি প্রকল্প নষ্ট ও কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ২০০৮ সালের ‘নার্গিসে’ এক লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরে’ সতর্কতার পূর্বাভাস প্রদান এবং মোকাবিলার প্রস্তুতির অভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার জলোচ্ছ্বাসে ৭০ হাজার ঘরবাড়িসহ বিশাল একটি অংশ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মৃত্যুবরণ করেন অনেক মানুষ। গাছপালা, পশুপাখিসহ মানুষের জানমালের অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। বিশেষভাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অমূল্য সম্পদ বিশাল বনাঞ্চল।

সিডরে সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে। বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাধাগ্রস্ত হয় দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি।

বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছে মানুষ আজ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। অথচ এ বিপন্ন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। একসময় সারাবিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রচুর গাছপালা ও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে বনাঞ্চলের পরিমাণ। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শুরু হয় নগর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্প কারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় গাছপালা। ক্রমশ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।

বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছে মানুষ আজ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। অথচ এ বিপন্ন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পশুপাখি হত্যার মতো জীববৈচিত্র্যবিনাশী কাজকর্ম আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে

দেশে বর্তমানে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পশুপাখি হত্যার মতো জীববৈচিত্র্যবিনাশী কাজকর্ম আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্র্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বৃক্ষনিধনসহ অন্যান্য কারণে জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন, বন্যা ও খরার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। উত্তাপ বৃদ্ধির ফলে হিমবাহের গলনে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি পলি জমে সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে যাবে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট আয়তনের ১৫.৮ শতাংশ স্থল ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সুস্বাদু পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে, বাড়ছে লবণাক্ততা। ঋতুচক্র পরিবর্তনের কারণে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালিজুড়ে অবস্থিত বিশাল সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এসব প্রাণী ছাড়া সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালার ভূমিকা অপরিসীম। উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাস আর্দ্র থাকে। বনভূমি পানি প্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশকে রক্ষা করে। বনাঞ্চল, বিশেষ করে, ঝড়-ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে।

দেশে কোনো সরকারি বনভূমি থেকে গাছ কাটা যাবে না, এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যে সব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারবে না। দেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বৃক্ষ কর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রতিটি দেশে বনাঞ্চল বৃদ্ধির লক্ষ্যে ’ন্যাশনাল ফরেস্ট্রি অ্যাকশন প্রোগ্রাম’ তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে। তাতে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বনজ সম্পদ রক্ষা, বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘ফরেস্ট্রি মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূমির ২০ শতাংশ বনায়নের আওতায় আনার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বৃক্ষহীন অথচ বনভূমি হিসাবে চিহ্নিত ৭ লাখ ৫৮ হাজার একর জমিতে নতুন গাছ লাগানো উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি বিশেষ করে উপকূলীয় বনায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে শুরু করে পতিত জমি, নদী ও রাস্তার পাড়ে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো দরকার। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। সরকারি বনাঞ্চলের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপকূলীয় বনভূমি রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করবে। পুরনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের বনভূমিকে আশাব্যাঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা গেলে তা পরিবেশ সুরক্ষায় সুফল বয়ে আনবে। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা আজও মানুষের সম্ভব হয়নি। তবে দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মানুষের চেষ্টায় যে কমিয়ে আনা সম্ভব তাতে সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিককালে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতির কারণে দুর্যোগকালে তুলনামূলক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারের বাইরে বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার সম্ভাবনা দেখা দিলেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষকে সতর্ক করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা দরকার। আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গত মানুষের জন্য সুপেয় পানি ও খাবারের ব্যবস্থা, বিশেষ করে শিশুখাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগে আহত মানুষের জন্য ওষুধসহ উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে এবং দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখলে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

শীতকালীন জীবন: সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও সহমর্মিতা

অ্যালগরিদমের রাজনীতি

চারদিকে আতঙ্ক আর শঙ্কা

অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

দিপু দাস হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাস

ভোগের দৃশ্যপট: ঢাকায় আধুনিকতা কেন কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য?

স্বর্ণের মোহ ও মানবিক দ্বন্দ্ব

ভালোবাসার দেহধারণ: বড়দিনের তাৎপর্য

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

বিনা-ভাড়ার ট্রেনযাত্রা

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া

ছবি

নামে ইসলামী, কাজে আবু জাহেল!

জলবায়ু পরিবর্তন: স্বাস্থ্যঝুঁকি

ছবি

অস্থির পেঁয়াজের বাজার: আমদানি কি সত্যিই সমাধান?

মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ: সংকটাক্রান্ত পরিবার ও সামাজিক রূপান্তর

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩

পরিবেশের চরম বিপর্যয়ে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মাঝেমধ্যে হঠাৎ এসে লন্ডভন্ড করে দেয় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা। হামুন, মোখা, সিত্রাং, সিডরের মতো নানা নাম নিয়ে এরা এসে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। গত ২৭ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে ৮ জনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আগে ২৪ অক্টোবর রাতে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ আঘাত হানার কক্সবাজারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বিগত দিনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বেশ কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। ১৯৭০, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৩ সালে ১৬ মে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। মহাসেনের আঘাতে বরগুনা, পটুয়াখালি, ভোলা, পিরোজপুরসহ বরিশালের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কৃষিজমি তলিয়ে যায়। বহু কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে পড়ে। ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালীতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে ফসলহানি, চিংড়ি প্রকল্প নষ্ট ও কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ২০০৮ সালের ‘নার্গিসে’ এক লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরে’ সতর্কতার পূর্বাভাস প্রদান এবং মোকাবিলার প্রস্তুতির অভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার জলোচ্ছ্বাসে ৭০ হাজার ঘরবাড়িসহ বিশাল একটি অংশ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মৃত্যুবরণ করেন অনেক মানুষ। গাছপালা, পশুপাখিসহ মানুষের জানমালের অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। বিশেষভাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অমূল্য সম্পদ বিশাল বনাঞ্চল।

সিডরে সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে। বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাধাগ্রস্ত হয় দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি।

বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছে মানুষ আজ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। অথচ এ বিপন্ন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। একসময় সারাবিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রচুর গাছপালা ও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে বনাঞ্চলের পরিমাণ। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শুরু হয় নগর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্প কারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় গাছপালা। ক্রমশ বনভূমি উজাড় হতে থাকে।

বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছে মানুষ আজ অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। অথচ এ বিপন্ন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পশুপাখি হত্যার মতো জীববৈচিত্র্যবিনাশী কাজকর্ম আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে

দেশে বর্তমানে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পশুপাখি হত্যার মতো জীববৈচিত্র্যবিনাশী কাজকর্ম আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্র্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বৃক্ষনিধনসহ অন্যান্য কারণে জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন, বন্যা ও খরার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। উত্তাপ বৃদ্ধির ফলে হিমবাহের গলনে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি পলি জমে সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে যাবে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট আয়তনের ১৫.৮ শতাংশ স্থল ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সুস্বাদু পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে, বাড়ছে লবণাক্ততা। ঋতুচক্র পরিবর্তনের কারণে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালিজুড়ে অবস্থিত বিশাল সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এসব প্রাণী ছাড়া সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালার ভূমিকা অপরিসীম। উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাস আর্দ্র থাকে। বনভূমি পানি প্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশকে রক্ষা করে। বনাঞ্চল, বিশেষ করে, ঝড়-ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে।

দেশে কোনো সরকারি বনভূমি থেকে গাছ কাটা যাবে না, এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যে সব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারবে না। দেশে জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বৃক্ষ কর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রতিটি দেশে বনাঞ্চল বৃদ্ধির লক্ষ্যে ’ন্যাশনাল ফরেস্ট্রি অ্যাকশন প্রোগ্রাম’ তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে। তাতে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বনজ সম্পদ রক্ষা, বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘ফরেস্ট্রি মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূমির ২০ শতাংশ বনায়নের আওতায় আনার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বৃক্ষহীন অথচ বনভূমি হিসাবে চিহ্নিত ৭ লাখ ৫৮ হাজার একর জমিতে নতুন গাছ লাগানো উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি বিশেষ করে উপকূলীয় বনায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে শুরু করে পতিত জমি, নদী ও রাস্তার পাড়ে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো দরকার। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। সরকারি বনাঞ্চলের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপকূলীয় বনভূমি রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করবে। পুরনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের বনভূমিকে আশাব্যাঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা গেলে তা পরিবেশ সুরক্ষায় সুফল বয়ে আনবে। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা আজও মানুষের সম্ভব হয়নি। তবে দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মানুষের চেষ্টায় যে কমিয়ে আনা সম্ভব তাতে সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিককালে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতির কারণে দুর্যোগকালে তুলনামূলক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারের বাইরে বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার সম্ভাবনা দেখা দিলেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষকে সতর্ক করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা দরকার। আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গত মানুষের জন্য সুপেয় পানি ও খাবারের ব্যবস্থা, বিশেষ করে শিশুখাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগে আহত মানুষের জন্য ওষুধসহ উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে এবং দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখলে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

back to top