alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং খাতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

রেজাউল করিম খোকন

: বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

ব্যাংকগুলো যদি এখন থেকে সেভাবে নিজেদের যোগ্য এবং প্রস্তুত করে তুলতে না পারে তাহলে আগামী দিনগুলোতে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে ব্যর্থ হবে তারা। বর্তমানে ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা খাতে প্রচলিত লেনদেনব্যবস্থায় প্রযুক্তির হাত ধরে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। নগদ লেনদেনের বদলে ডিজিটাল পেমেন্টব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিক হারে আকৃষ্ট হয়েছে। করোনার সময় বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের সুবিধার জন্য চালু করেছিল অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বীমাযুক্ত আমানত পণ্য চালু, সহজে অনলাইনে টাকা স্থানান্তর, ঘরে বসে সহজে দ্রুত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে কেনাকাটাসহ বিশেষ কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে।

করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো শিখেছে কিভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করা যায়। করোনাকালীন সময়ে ব্যাংকগুলো তাদের বোর্ড মিটিংসহ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করেছে। এরপরও অনেক ক্ষেত্রে সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে ভার্চুয়ালি বোর্ড মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করার কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।

মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছে গ্রাম, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। এছাড়া ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথসহ দিনদিন ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটেছে। করোনাকালে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জয়জয়কার লক্ষ্য করা গেছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন যাবতীয় আর্থিক লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। সরকার অসহায় মানুষকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমসাময়িক সংস্করণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত নানা বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষজ্ঞ। এ বিপ্লব রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম, কম্পিউটিং, ব্যায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, সম্পূর্ণ স্বচালিত যানবাহন ও উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। এর ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের চিন্তা জগতে পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর গতি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করছে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমি কন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপস ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তির উদ্ভাবন নিয়ে হয়েছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এ সময়ে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধ শিল্প ও ব্যায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ এ শিল্পবিপ্লবের ফল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি- ৪.০০ হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্রব্য উৎপাদনের ও সেবা প্রদানে বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। শুধু যান্ত্রিক কৌশল নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চতর পর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিক্স ও কম্পিউটারের উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার এ বিপ্লবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এতে উৎপাদনের জন্য মানুষের যন্ত্র চালানোর পরিবর্তে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল কার্য সম্পাদন করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। চিকিৎসায়, যোগাযোগে, উৎপাদনে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনেও দৃশ্যমান প্রভাব অধিকতর জোরদার হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থাপনার অবারিত সুযোগ তৈরির আশা জাগিয়েই চলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মঘণ্টা হ্রাস এ প্রযুক্তির সহজতর সক্ষমতা। তবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত ঘাটতির কারণে উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নয়নশীলের পথে উত্তরণের দেশগুলো নানা জটিলতা ও বেকারত্বের মতো সমস্যায় পড়তে পারে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এ সময়কালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এই প্রযুক্তির সঙ্গে খাপখাওয়াতে ব্যর্থতায় বেকার হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গতি লক্ষ্য করা গেলেও বিশ্ব প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে ও বেকারত্ব হ্রাস, বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করতে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন পথ চলায় ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়কালে এ খাতের প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নে গ্রাহকদের প্রযুক্তির সঙ্গে সুপরিচিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ। উন্নত ব্যাংকিং সেবা ও ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য শিক্ষিত ও জনশক্তি তৈরি করাও চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রসার লাভ করলে শ্রমশক্তির চাহিদা যে হ্রাস পাবে শুধু তা নয় বরং অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বর্তমানে বিদ্যমান পেশাগুলোতে চাহিদা দ্রুত কমে আসবে। অন্য দিকে উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন এমন পেশায় চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ের গতি ও খেলাপি গ্রাহকদের থেকে অর্থ আদায়ের জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তি বৈষম্য দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে, অক্ষসমতা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এ জন্য আমাদের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তির আদলে তৈরি করতে হবে। অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে জটিলতা দূর ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক সেবা খাতে প্রযুক্তির হাত ধরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেনদেন করতে এখন ব্যাংকে সশরীরে না গিয়ে ঘরে বসে স্মার্টফোনেই কাজ করা যায়। বর্তমানে চালু হচ্ছে ওপেন ব্যাংকিং অর্থাৎ অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই)। ভোক্তারা একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে (ডিএলটি) ব্লক চেইন নেটওয়ার্ক ভোক্তাদের কাছে আস্থা ও স্বচ্ছতা তৈরি করেছে। তবে ব্যাংকিং পরিষেবায় উন্নতি করতেও ভোক্তাদের আরো দ্রুত সেবা দিতে এবং এ খাতের দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে, ঋণ আদায়ের গতি ফিরিয়ে আনতে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে সঠিক ডকুমেন্টেশন, ফেইক ডকুমেন্ট ডিটেক্ট এবং ডকুমেন্টস প্রিজারভেশনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি বাড়ানো উচিত। আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করতে হবে। নামজারি, রেজিস্ট্রেশন, খাজনা প্রদান ইত্যাদির ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করা উচিত, যার ফলে ব্যাংক বিনিয়োগ ও মর্গেজকৃত সম্পত্তি সার্চিং ও যাচাই-বাছাইয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন সম্ভাবনার বিপরীতে ব্যাংকিং খাতে টানা ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। পাসওয়ার্ড হ্যাকিং, এটিএম বুথ থেকে অর্থ চুরি রোধসহ দেশীয়- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফান্ড হস্তান্তরের বিষয়গুলো গুরুত্বসহ দেখা উচিত।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং খাতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

রেজাউল করিম খোকন

বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

ব্যাংকগুলো যদি এখন থেকে সেভাবে নিজেদের যোগ্য এবং প্রস্তুত করে তুলতে না পারে তাহলে আগামী দিনগুলোতে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে ব্যর্থ হবে তারা। বর্তমানে ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা খাতে প্রচলিত লেনদেনব্যবস্থায় প্রযুক্তির হাত ধরে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। নগদ লেনদেনের বদলে ডিজিটাল পেমেন্টব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিক হারে আকৃষ্ট হয়েছে। করোনার সময় বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের সুবিধার জন্য চালু করেছিল অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বীমাযুক্ত আমানত পণ্য চালু, সহজে অনলাইনে টাকা স্থানান্তর, ঘরে বসে সহজে দ্রুত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে কেনাকাটাসহ বিশেষ কিছু নতুন পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে।

করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো শিখেছে কিভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চুয়াল মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করা যায়। করোনাকালীন সময়ে ব্যাংকগুলো তাদের বোর্ড মিটিংসহ বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সম্পন্ন করেছে। এরপরও অনেক ক্ষেত্রে সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে ভার্চুয়ালি বোর্ড মিটিং, ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স ইত্যাদি সম্পন্ন করার কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যয় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।

মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছে গ্রাম, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায়। এছাড়া ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথসহ দিনদিন ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটেছে। করোনাকালে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জয়জয়কার লক্ষ্য করা গেছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন যাবতীয় আর্থিক লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। সরকার অসহায় মানুষকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমসাময়িক সংস্করণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত নানা বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষজ্ঞ। এ বিপ্লব রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম, কম্পিউটিং, ব্যায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, সম্পূর্ণ স্বচালিত যানবাহন ও উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। এর ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের চিন্তা জগতে পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর গতি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করছে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমি কন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপস ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তির উদ্ভাবন নিয়ে হয়েছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এ সময়ে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধ শিল্প ও ব্যায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ এ শিল্পবিপ্লবের ফল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি- ৪.০০ হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্রব্য উৎপাদনের ও সেবা প্রদানে বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। শুধু যান্ত্রিক কৌশল নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চতর পর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিক্স ও কম্পিউটারের উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার এ বিপ্লবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এতে উৎপাদনের জন্য মানুষের যন্ত্র চালানোর পরিবর্তে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল কার্য সম্পাদন করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। চিকিৎসায়, যোগাযোগে, উৎপাদনে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনেও দৃশ্যমান প্রভাব অধিকতর জোরদার হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থাপনার অবারিত সুযোগ তৈরির আশা জাগিয়েই চলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মঘণ্টা হ্রাস এ প্রযুক্তির সহজতর সক্ষমতা। তবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত ঘাটতির কারণে উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নয়নশীলের পথে উত্তরণের দেশগুলো নানা জটিলতা ও বেকারত্বের মতো সমস্যায় পড়তে পারে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এ সময়কালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এই প্রযুক্তির সঙ্গে খাপখাওয়াতে ব্যর্থতায় বেকার হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গতি লক্ষ্য করা গেলেও বিশ্ব প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে ও বেকারত্ব হ্রাস, বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করতে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন পথ চলায় ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়কালে এ খাতের প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নে গ্রাহকদের প্রযুক্তির সঙ্গে সুপরিচিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ। উন্নত ব্যাংকিং সেবা ও ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য শিক্ষিত ও জনশক্তি তৈরি করাও চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রসার লাভ করলে শ্রমশক্তির চাহিদা যে হ্রাস পাবে শুধু তা নয় বরং অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বর্তমানে বিদ্যমান পেশাগুলোতে চাহিদা দ্রুত কমে আসবে। অন্য দিকে উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন এমন পেশায় চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ের গতি ও খেলাপি গ্রাহকদের থেকে অর্থ আদায়ের জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তি বৈষম্য দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে, অক্ষসমতা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এ জন্য আমাদের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তির আদলে তৈরি করতে হবে। অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে জটিলতা দূর ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক সেবা খাতে প্রযুক্তির হাত ধরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেনদেন করতে এখন ব্যাংকে সশরীরে না গিয়ে ঘরে বসে স্মার্টফোনেই কাজ করা যায়। বর্তমানে চালু হচ্ছে ওপেন ব্যাংকিং অর্থাৎ অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই)। ভোক্তারা একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে (ডিএলটি) ব্লক চেইন নেটওয়ার্ক ভোক্তাদের কাছে আস্থা ও স্বচ্ছতা তৈরি করেছে। তবে ব্যাংকিং পরিষেবায় উন্নতি করতেও ভোক্তাদের আরো দ্রুত সেবা দিতে এবং এ খাতের দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে, ঋণ আদায়ের গতি ফিরিয়ে আনতে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে সঠিক ডকুমেন্টেশন, ফেইক ডকুমেন্ট ডিটেক্ট এবং ডকুমেন্টস প্রিজারভেশনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি বাড়ানো উচিত। আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করতে হবে। নামজারি, রেজিস্ট্রেশন, খাজনা প্রদান ইত্যাদির ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করা উচিত, যার ফলে ব্যাংক বিনিয়োগ ও মর্গেজকৃত সম্পত্তি সার্চিং ও যাচাই-বাছাইয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন সম্ভাবনার বিপরীতে ব্যাংকিং খাতে টানা ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। পাসওয়ার্ড হ্যাকিং, এটিএম বুথ থেকে অর্থ চুরি রোধসহ দেশীয়- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফান্ড হস্তান্তরের বিষয়গুলো গুরুত্বসহ দেখা উচিত।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top