alt

opinion » post-editorial

সংসদ সদস্য হওয়ার আকাক্সক্ষা

মোহাম্মদ আবু নোমান

: শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

‘ইয়ে তো স্রেফ ট্রেইলার থা, পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। জামিনে কারাগার থেকে বেরোনোর পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে ইতোমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। ইতঃপূর্বে মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যিনি কথায় কথায় নীতিকথা, দেশের কল্যাণের কথা, স্বাধীনতার ইতিহাস শোনাতেন। কিন্তু হায়! আজ তিনি নিজেই ইতিহাস। কল্যাণ পার্টির নেতা হিসেবে নিজের কল্যাণই আগে বেছে নিলেন। এরশাদ আমলে জনৈক নেতা জ্বালাময়ী ভাষণের পরদিনই এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষমতার লোভ এমন যে, সারাজীবনের অর্জন, নীতিকথা যেখানে মূল্যহীন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে মনোনয়ন কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান।

বলছিলাম, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। চমক চলছে, নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশে নানামুখী চমক দেখা যাবে। এ পর্যন্ত যতোুকু ঘটেছে তা মাইনর! অপেক্ষা করুন, আরও অনেক চমক আসছে! মনোনয়ন কেবল যদি রাজনীতিবিদরা কিনতেন, তা হলে সেটাকে ‘উৎসব’ বা ‘ধুম’ বলা যেত। আমরা মনে করি, মনোনয়নের বিষয়টিই চূড়ান্ত নয়। সর্বশেষ দলীয় সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। ১৪ দলের শরিক, জাতীয় পার্টি, এমনকি অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, এমএল, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট নবগঠিত যুক্তফ্রন্টসহ আরও দলের জন্যও আসন ছাড়তে হবে। জোটের কারণে দলের বাইরের অনেককেও হয়তো নৌকা প্রতীক দিতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কাঠামোর পিকচার কী হবে, তা দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, উকিল আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান তাদের তো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই সেরকম অরাজনৈতিক সেলিব্রিট, অভিনয়, গান থেকে ক্রিকেট তারকা ও নানান শৈলীর কলাবিদ স্টারদের তুমুলভাবে নির্বাচনী মাঠে ঘনঘটা লক্ষ্যণীয়। এমপি হওয়ার দৌড়ে শামিল হতে তারা রীতিমতো ভিমরি খেয়ে পড়ছেন। জনগণ যে তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে তাও নয়।

প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান কী কার কাছে

নেতা, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত, সবাই সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার, শান্তি রক্ষায় ত্যাগী নেতা আছে কতজন এমনতর সুযোগ পাওয়ার কারণেই গড়ে উঠেছে, সিন্ডিকেটধারী কারবারি, ভেজাল কারবারি, টাকা পাচারকারী ও দেশে স্বৈরতান্ত্রিকতার মজবুত কাঠামো। সর্বশেষ যতো অপরাধই করুক ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিলে নিমিষে পাপমুক্ত! রাজনীতি করার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির, রাজনীতিতে নীতি আদর্শ, নৈতিকতা না থাকার কারণে, গণতন্ত্রহীনতার কল্যাণে যদু, মধু, কদু, সব মাকাল ফলরা হয় খবরের শিরোনাম, বনে যায় ১৮ কোটি মানুষের আইন প্রণেতা!

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আতি, পাতি, সিকি সব নেতারা এমপি হতে চায়।’ সবাই ধরে নিচ্ছেন নৌকা প্রতীক পেলেই এমপি হওয়া নিশ্চিত। তাই মূল পরিশ্রমটা হলো নৌকা প্রতীক নিশ্চিত করা। একটি নাটক রয়েছে ‘বাবা আমি মন্ত্রী হব’। কারণ, একবার এমপি, মন্ত্রী হতে পারলেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। এমনকি কয়েক প্রজšে§র আখের গোছানো সারা।

মেঘ যেমন আলোকে সরিয়ে দেয়, কালো টাকা যেমন সাদা টাকাকে সরিয়ে দেয়, এভাবে যদি অন্য শ্রেণী-পেশার মানুষেরা এসে এমপি হয়, তাহলে যারা ফুল টাইম রাজনীতি করেন, দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাবেন তাদের কী হবে যার যা করার, কিংবা যার যে যোগ্যতা আছে, তার সেটা করাই ভালো। রাজনীতিবিদদের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও সেবার ইতিহাস থাকতে হবে। দেশের নন্দিত, আলোচিত, সমালোচিত তারকারা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান কী কার কাছে

আমাদের এ সাব-কন্টিনেন্টে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রারম্ভটা হয়েছে যাদের হাত ধরে, তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সময়ের জন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই মুখ্যত রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতিবিদরা তো ৪০-৫০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে এসে থাকেন। অন্যদের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে যেকোনো কাজের একটি প্রোসেস থাকে। প্রথমে জমি তৈরি, এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ, নিড়ানি, কোপানি। এরপর জমিতে ফসল ধরলে ঘরে তোলা যায়। রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই উচিত নয় কী

ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট, সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রিটিদের পদচারণা কয়েক দশক ধরেই বেড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বাংলাদেশেও বহুগুণ বেড়েছে। যদিও পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান পার্টি তৈরী করে রাজনীতিতে এসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড় করানো হয়েছে যে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না বলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চিন্তা থাকে না। এসব দেখলে মনে হয় রাজনীতি আর এখন আর রাজনীতি নেই! উড়ে এসে জুড়ে বসা আর কি! একজন ৩০-৪০ বছর দল করেও নমিনেশন পাবে না, আর ভিন্ন পেশার একজন হুট করে এসে নমিনেশন পেয়ে যাবে। আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারলেই হলো। এটা যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্য দেউলিয়াপনা! কোনো গণতান্ত্রিক দল থেকে এটা প্রত?্যাশিত নয়। দল ও দেশের চেয়ে যদি ব?্যক্তি বড় হয়, তবে সে দলের ভবিষ?্যৎ অন্ধকার।

এখন কে কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল, চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতা-কর্মীরাও তাদের প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকুক আর না-ই থাকুক, যে কেউই সংসদ-সদস্য হতে চান।

[লেখক : প্রাবান্ধিক ]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

সংসদ সদস্য হওয়ার আকাক্সক্ষা

মোহাম্মদ আবু নোমান

শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩

‘ইয়ে তো স্রেফ ট্রেইলার থা, পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। জামিনে কারাগার থেকে বেরোনোর পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ঝালকাঠি-১ আসনে ইতোমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। ইতঃপূর্বে মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যিনি কথায় কথায় নীতিকথা, দেশের কল্যাণের কথা, স্বাধীনতার ইতিহাস শোনাতেন। কিন্তু হায়! আজ তিনি নিজেই ইতিহাস। কল্যাণ পার্টির নেতা হিসেবে নিজের কল্যাণই আগে বেছে নিলেন। এরশাদ আমলে জনৈক নেতা জ্বালাময়ী ভাষণের পরদিনই এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষমতার লোভ এমন যে, সারাজীবনের অর্জন, নীতিকথা যেখানে মূল্যহীন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে মনোনয়ন কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান।

বলছিলাম, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। চমক চলছে, নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশে নানামুখী চমক দেখা যাবে। এ পর্যন্ত যতোুকু ঘটেছে তা মাইনর! অপেক্ষা করুন, আরও অনেক চমক আসছে! মনোনয়ন কেবল যদি রাজনীতিবিদরা কিনতেন, তা হলে সেটাকে ‘উৎসব’ বা ‘ধুম’ বলা যেত। আমরা মনে করি, মনোনয়নের বিষয়টিই চূড়ান্ত নয়। সর্বশেষ দলীয় সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। ১৪ দলের শরিক, জাতীয় পার্টি, এমনকি অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, এমএল, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট নবগঠিত যুক্তফ্রন্টসহ আরও দলের জন্যও আসন ছাড়তে হবে। জোটের কারণে দলের বাইরের অনেককেও হয়তো নৌকা প্রতীক দিতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কাঠামোর পিকচার কী হবে, তা দেখতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, উকিল আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান তাদের তো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাদের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই সেরকম অরাজনৈতিক সেলিব্রিট, অভিনয়, গান থেকে ক্রিকেট তারকা ও নানান শৈলীর কলাবিদ স্টারদের তুমুলভাবে নির্বাচনী মাঠে ঘনঘটা লক্ষ্যণীয়। এমপি হওয়ার দৌড়ে শামিল হতে তারা রীতিমতো ভিমরি খেয়ে পড়ছেন। জনগণ যে তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে তাও নয়।

প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান কী কার কাছে

নেতা, চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত, সবাই সুযোগ সন্ধানী। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার, শান্তি রক্ষায় ত্যাগী নেতা আছে কতজন এমনতর সুযোগ পাওয়ার কারণেই গড়ে উঠেছে, সিন্ডিকেটধারী কারবারি, ভেজাল কারবারি, টাকা পাচারকারী ও দেশে স্বৈরতান্ত্রিকতার মজবুত কাঠামো। সর্বশেষ যতো অপরাধই করুক ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিলে নিমিষে পাপমুক্ত! রাজনীতি করার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির, রাজনীতিতে নীতি আদর্শ, নৈতিকতা না থাকার কারণে, গণতন্ত্রহীনতার কল্যাণে যদু, মধু, কদু, সব মাকাল ফলরা হয় খবরের শিরোনাম, বনে যায় ১৮ কোটি মানুষের আইন প্রণেতা!

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আতি, পাতি, সিকি সব নেতারা এমপি হতে চায়।’ সবাই ধরে নিচ্ছেন নৌকা প্রতীক পেলেই এমপি হওয়া নিশ্চিত। তাই মূল পরিশ্রমটা হলো নৌকা প্রতীক নিশ্চিত করা। একটি নাটক রয়েছে ‘বাবা আমি মন্ত্রী হব’। কারণ, একবার এমপি, মন্ত্রী হতে পারলেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। এমনকি কয়েক প্রজšে§র আখের গোছানো সারা।

মেঘ যেমন আলোকে সরিয়ে দেয়, কালো টাকা যেমন সাদা টাকাকে সরিয়ে দেয়, এভাবে যদি অন্য শ্রেণী-পেশার মানুষেরা এসে এমপি হয়, তাহলে যারা ফুল টাইম রাজনীতি করেন, দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাবেন তাদের কী হবে যার যা করার, কিংবা যার যে যোগ্যতা আছে, তার সেটা করাই ভালো। রাজনীতিবিদদের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও সেবার ইতিহাস থাকতে হবে। দেশের নন্দিত, আলোচিত, সমালোচিত তারকারা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। প্রশ্ন হলো, জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে হলে কি এমপি হতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গভীর রোগবালাই বাসা বেঁধেছে, এর সমাধান কী কার কাছে

আমাদের এ সাব-কন্টিনেন্টে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রারম্ভটা হয়েছে যাদের হাত ধরে, তাদের সবাই পূর্ণাঙ্গ সময়ের জন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সবাই মুখ্যত রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতিবিদরা তো ৪০-৫০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটা পর্যায়ে এসে থাকেন। অন্যদের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে যেকোনো কাজের একটি প্রোসেস থাকে। প্রথমে জমি তৈরি, এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ, নিড়ানি, কোপানি। এরপর জমিতে ফসল ধরলে ঘরে তোলা যায়। রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই উচিত নয় কী

ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট, সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রিটিদের পদচারণা কয়েক দশক ধরেই বেড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বাংলাদেশেও বহুগুণ বেড়েছে। যদিও পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান পার্টি তৈরী করে রাজনীতিতে এসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড় করানো হয়েছে যে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না বলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চিন্তা থাকে না। এসব দেখলে মনে হয় রাজনীতি আর এখন আর রাজনীতি নেই! উড়ে এসে জুড়ে বসা আর কি! একজন ৩০-৪০ বছর দল করেও নমিনেশন পাবে না, আর ভিন্ন পেশার একজন হুট করে এসে নমিনেশন পেয়ে যাবে। আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারলেই হলো। এটা যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্য দেউলিয়াপনা! কোনো গণতান্ত্রিক দল থেকে এটা প্রত?্যাশিত নয়। দল ও দেশের চেয়ে যদি ব?্যক্তি বড় হয়, তবে সে দলের ভবিষ?্যৎ অন্ধকার।

এখন কে কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল, চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতা-কর্মীরাও তাদের প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকুক আর না-ই থাকুক, যে কেউই সংসদ-সদস্য হতে চান।

[লেখক : প্রাবান্ধিক ]

back to top