মোহাম্মদ আবু নোমান
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি যে ‘ভুল’ ছিল, ‘জলঘোলা’ করে খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা প্রমাণ করতে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দলের ‘ইউটার্ন’ অ্যাক্টিভিটিতে বাংলার প্রবাদই সত্যি হলোÑ ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। আগামী মার্চ থেকে কয়েক ধাপে উপজেলা নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন, সংবাদমাধ্যমে এমন খবর এসেছে। কিন্তু সর্বত্র যে আলোচনা পরিলক্ষিত তা হলো, গত ২২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ এক জরুরি বৈঠক করে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দলীয়ভাবে মনোনয়ন (নৌকা প্রতীক) না দেয়ার কথা জানিয়েছে।
দেশে প্রকৃত রাজনীতি নেই, কিন্তু কোন্দলের সীমা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই মারামারি, হানাহানি, রক্তারক্তি, খুন, জখম, অঙ্গহানি। গত ৩০ বছরে দেশে যত রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ হয়েছে তার মূল ইস্যু ছিল নির্বাচন কিভাবে হবে। এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিধান থাকায় পর্যায়ক্রমে এক-দুই বছর যেতে না যেতেই একটির পর আরেকটি নির্বাচন এসে যায়। আর এতে আর্থিক, সামাজিকসহ বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের মানুষ ও দেশ। ক্ষমতাসীন দলের পছন্দই যদি হয় সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি, তখন এসব ভোটের আয়োজনে জনগণের মতামতের আদৌ কোনো প্রতিফলন ঘটে না। জাতীয় পরিসরে গণতন্ত্র কার্যকর না থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আগে নির্দলীয়ভাবে বা দলীয় মার্কা ছাড়াই হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৫ সালে তা পরিবর্তন করা হয়। আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। এখন দলীয়ভাবে দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ও ইতোপূর্বের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বা নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ পরস্পর অপজিট হিসেবে নির্বাচনী মাঠে মারমুখীভাবে সিরিয়াসলি ক্রিয়াশীল ছিল। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়ায় দেখা গেছে নৌকার যারা সমর্থক তারাও নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। রাজনীতিতে নেতাকেন্দ্রিক অন্তর্দলীয় নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় ঝগড়া-বিবাদ-দলাদলি যদি দলের নেতাদের নিজস্ব ব্যাপার হতো, তাহলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তার কুপ্রভাব পড়ছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবার থেকে সমাজের সব ক্ষেত্রে।
গত ৮ বছর ধরে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালুর পর থেকে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত এসব দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও সহিংসতা ঠেকাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না রাখার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীক দেয়ায় ভোটের সময় বিপুল প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চালু হওয়ার পর কেবল সংঘাত-প্রাণহানিই বাড়েনি; সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে স্থানীয় নির্বাচনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ঝগড়া-বিবাদ ভুলে জনগণের সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগে নানা দ্বন্দ্ব-কোন্দল দেখা দেয়। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ইতোপূর্বে দেখা গেছে, সরকারি দল করা প্রার্থীদের অনুসারীরাই সহিংসতায় শীর্ষে ছিল। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি করেছিল। সেই সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছিল, বিশ্বের সব উন্নত দেশে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। তাই বাংলাদেশেও তেমনটা হওয়া উচিত; কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়, আর এ দেশের নেতা ও কর্মীদের ক্যারেক্টর কনডাক্টও উন্নত বিশ্বের মতো নয়।
বিএনপিসহ বেশ কিছু নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে নানারকম আশঙ্কার কথা বলা হলেও কারও কথাই তখন পাত্তা না দিয়ে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করা হয়।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এর পক্ষে সাফাই গেয়ে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ হবে; কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নজিরবিহীন সহিংসতা হয়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনী সহিংসতায় প্রায় ১৫০ জন নিহত হন।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রধান, কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি’ এবং ‘নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা অনেকটা কমে গেছে’। সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই উপলব্ধির জন্য দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক যা ক্ষতি হয়েছে এবং দীর্ঘকালব্যাপী থাকবে তার দায় কে নেবে? টিআইবির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হিসাব বলছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য মোট বাজেট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা হলেও তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। প্রতি পাঁচ বছর পর ভোট আসে। আমাদের লাভ না হলেও একটা বিশাল খরচ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে ব্যয় ছিল ৭০০ কোটি, ২০১৪ সালে ৩০০ কোটি এবং ২০০৮ সালে ২০০ কোটি। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে নির্বাচনের খরচ ১০ গুণের বেশি বাড়লেও নির্বাচনের মান উন্নত না হয়ে বহুগুণে নিম্নমুখী হয়েছে। আগের নির্বাচনে, ভোটের সময়ে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ১ দিনের ভাতা দেয়া হলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের ২ দিনের সম্মানী, ম্যাজিস্ট্রেট ও সমমানের পদের কর্মকর্তাদের ৫ দিনের সম্মানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ১৩ দিনের সম্মানী দেয়া হয়। মোট নির্বাচনী বাজেটের ৫৪ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয়ের কোনো ব্যাখ্যা টিআইবি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পায়নি।
নির্বাচনী বিরোধের ফলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অনেক জেলায় এখন মুখোমুখি। এই দুপক্ষের বিরোধে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো। আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি হামলা-মামলা, মারধর, ভাঙচুরে জর্জরিত দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার পদ্ধতি অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ-আলোচনা ছাড়াই এখন শুরু হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এবং সারাদেশের উপজেলার নির্বাচনের জন্য কমিশন তোড়জোড় শুরু করেছে। এ নির্বাচনের খরচও যে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম কিছু হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। এখন ৪৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপযোগী হয়ে আছে। জুনের মধ্যে এসব উপজেলায় নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া আগামী মার্চের মধ্যে অল্প কিছু বাদে প্রায় সব উপজেলা নির্বাচন উপযোগী হবে।
নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে যে একটি উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার কথা তা এখন আর দেখা যায় না; বরং নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয়। দলীয় প্রতীকের বরাদ্দ চালু করার পর থেকে লোকাল নেতাদের জনগণের সহানুভূতি, সহযোগিতার পরিবর্তে নৌকার টিকেটের জন্য রাজধানীতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। কারণ টিকেট পাওয়া নাকি অনেক বাণিজ্যের ব্যাপার ছিল! ‘মনোনয়নবাণিজ্য’ বলে একটা আওয়াজ কারো অজানা নয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক বরাদ্দের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও উৎসাহিত করেছে। এতে নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা যে অনেকটা ভেঙে পড়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রায় সব সংঘাত হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনের জেরে এখনো অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
২০১৩ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গিয়েছিল ১৪২ জন, ২০১৮ সালে মারা গেছে ২২ জন। এতগুলো অমূল্য প্রাণ যে ঝরে গেল, কোনো হত্যার বিচার হয়েছে কী? এর দায় কার? ২০১৩ সালের অবরোধ-হরতালের সময় ডিসিসিআই হিসাব করে দেখিয়েছিল, হরতালের জন্য দৈনিক ক্ষতি হয় ২০ কোটি মার্কিন ডলার। এই হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে দুই প্রধান দলই, যখনই তারা বিরোধী দলে থাকে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
 
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            মোহাম্মদ আবু নোমান
সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি যে ‘ভুল’ ছিল, ‘জলঘোলা’ করে খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা প্রমাণ করতে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দলের ‘ইউটার্ন’ অ্যাক্টিভিটিতে বাংলার প্রবাদই সত্যি হলোÑ ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। আগামী মার্চ থেকে কয়েক ধাপে উপজেলা নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন, সংবাদমাধ্যমে এমন খবর এসেছে। কিন্তু সর্বত্র যে আলোচনা পরিলক্ষিত তা হলো, গত ২২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ এক জরুরি বৈঠক করে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দলীয়ভাবে মনোনয়ন (নৌকা প্রতীক) না দেয়ার কথা জানিয়েছে।
দেশে প্রকৃত রাজনীতি নেই, কিন্তু কোন্দলের সীমা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই মারামারি, হানাহানি, রক্তারক্তি, খুন, জখম, অঙ্গহানি। গত ৩০ বছরে দেশে যত রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ হয়েছে তার মূল ইস্যু ছিল নির্বাচন কিভাবে হবে। এর ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিধান থাকায় পর্যায়ক্রমে এক-দুই বছর যেতে না যেতেই একটির পর আরেকটি নির্বাচন এসে যায়। আর এতে আর্থিক, সামাজিকসহ বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের মানুষ ও দেশ। ক্ষমতাসীন দলের পছন্দই যদি হয় সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি, তখন এসব ভোটের আয়োজনে জনগণের মতামতের আদৌ কোনো প্রতিফলন ঘটে না। জাতীয় পরিসরে গণতন্ত্র কার্যকর না থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আগে নির্দলীয়ভাবে বা দলীয় মার্কা ছাড়াই হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৫ সালে তা পরিবর্তন করা হয়। আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। এখন দলীয়ভাবে দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ও ইতোপূর্বের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বা নৌকার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ পরস্পর অপজিট হিসেবে নির্বাচনী মাঠে মারমুখীভাবে সিরিয়াসলি ক্রিয়াশীল ছিল। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়ায় দেখা গেছে নৌকার যারা সমর্থক তারাও নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। রাজনীতিতে নেতাকেন্দ্রিক অন্তর্দলীয় নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় ঝগড়া-বিবাদ-দলাদলি যদি দলের নেতাদের নিজস্ব ব্যাপার হতো, তাহলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তার কুপ্রভাব পড়ছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবার থেকে সমাজের সব ক্ষেত্রে।
গত ৮ বছর ধরে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালুর পর থেকে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত এসব দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও সহিংসতা ঠেকাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না রাখার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীক দেয়ায় ভোটের সময় বিপুল প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চালু হওয়ার পর কেবল সংঘাত-প্রাণহানিই বাড়েনি; সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে স্থানীয় নির্বাচনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ঝগড়া-বিবাদ ভুলে জনগণের সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগে নানা দ্বন্দ্ব-কোন্দল দেখা দেয়। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ইতোপূর্বে দেখা গেছে, সরকারি দল করা প্রার্থীদের অনুসারীরাই সহিংসতায় শীর্ষে ছিল। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি করেছিল। সেই সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছিল, বিশ্বের সব উন্নত দেশে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। তাই বাংলাদেশেও তেমনটা হওয়া উচিত; কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়, আর এ দেশের নেতা ও কর্মীদের ক্যারেক্টর কনডাক্টও উন্নত বিশ্বের মতো নয়।
বিএনপিসহ বেশ কিছু নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে নানারকম আশঙ্কার কথা বলা হলেও কারও কথাই তখন পাত্তা না দিয়ে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করা হয়।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এর পক্ষে সাফাই গেয়ে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ হবে; কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নজিরবিহীন সহিংসতা হয়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনী সহিংসতায় প্রায় ১৫০ জন নিহত হন।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের প্রধান, কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি’ এবং ‘নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা অনেকটা কমে গেছে’। সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই উপলব্ধির জন্য দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক যা ক্ষতি হয়েছে এবং দীর্ঘকালব্যাপী থাকবে তার দায় কে নেবে? টিআইবির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হিসাব বলছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য মোট বাজেট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা হলেও তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। প্রতি পাঁচ বছর পর ভোট আসে। আমাদের লাভ না হলেও একটা বিশাল খরচ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে ব্যয় ছিল ৭০০ কোটি, ২০১৪ সালে ৩০০ কোটি এবং ২০০৮ সালে ২০০ কোটি। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে নির্বাচনের খরচ ১০ গুণের বেশি বাড়লেও নির্বাচনের মান উন্নত না হয়ে বহুগুণে নিম্নমুখী হয়েছে। আগের নির্বাচনে, ভোটের সময়ে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ১ দিনের ভাতা দেয়া হলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের ২ দিনের সম্মানী, ম্যাজিস্ট্রেট ও সমমানের পদের কর্মকর্তাদের ৫ দিনের সম্মানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ১৩ দিনের সম্মানী দেয়া হয়। মোট নির্বাচনী বাজেটের ৫৪ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয়ের কোনো ব্যাখ্যা টিআইবি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পায়নি।
নির্বাচনী বিরোধের ফলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অনেক জেলায় এখন মুখোমুখি। এই দুপক্ষের বিরোধে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো। আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি হামলা-মামলা, মারধর, ভাঙচুরে জর্জরিত দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার পদ্ধতি অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ-আলোচনা ছাড়াই এখন শুরু হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এবং সারাদেশের উপজেলার নির্বাচনের জন্য কমিশন তোড়জোড় শুরু করেছে। এ নির্বাচনের খরচও যে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম কিছু হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। এখন ৪৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপযোগী হয়ে আছে। জুনের মধ্যে এসব উপজেলায় নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া আগামী মার্চের মধ্যে অল্প কিছু বাদে প্রায় সব উপজেলা নির্বাচন উপযোগী হবে।
নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে যে একটি উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার কথা তা এখন আর দেখা যায় না; বরং নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয়। দলীয় প্রতীকের বরাদ্দ চালু করার পর থেকে লোকাল নেতাদের জনগণের সহানুভূতি, সহযোগিতার পরিবর্তে নৌকার টিকেটের জন্য রাজধানীতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। কারণ টিকেট পাওয়া নাকি অনেক বাণিজ্যের ব্যাপার ছিল! ‘মনোনয়নবাণিজ্য’ বলে একটা আওয়াজ কারো অজানা নয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক বরাদ্দের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও উৎসাহিত করেছে। এতে নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা যে অনেকটা ভেঙে পড়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রায় সব সংঘাত হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনের জেরে এখনো অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
২০১৩ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গিয়েছিল ১৪২ জন, ২০১৮ সালে মারা গেছে ২২ জন। এতগুলো অমূল্য প্রাণ যে ঝরে গেল, কোনো হত্যার বিচার হয়েছে কী? এর দায় কার? ২০১৩ সালের অবরোধ-হরতালের সময় ডিসিসিআই হিসাব করে দেখিয়েছিল, হরতালের জন্য দৈনিক ক্ষতি হয় ২০ কোটি মার্কিন ডলার। এই হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে দুই প্রধান দলই, যখনই তারা বিরোধী দলে থাকে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
