alt

opinion » post-editorial

একজীবনে অনেক বছর বেঁচে থেকেও নিজেকে চেনা হয়ে ওঠে না

লতিফা নিলুফার পাপড়ি

: শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

কবিগুরুর কথা, ‘কেশে আমার পাক ধরেছে বটে, তাহার পানে নজর কেন এত?’ সত্যি তা-ই। বয়স, শরীরের বয়স তো সংখ্যা বৈ কিছু নয়। মন বুড়ো না হলেই হলো।

শরীর মনে সুস্থ থাকা বড়ই কাম্য সবার জন্য। বয়স যতই হোক, বয়সের বারান্দায় রোদ্দুর পড়বে, আর এক কাপ চা হাতে পত্রিকা পড়তেই হবে পা দুটো নাচিয়ে নাচিয়ে সেই রোদ গায়ে মেখে।

বুড়ো হব, জীবনে নানা পরিবর্তন ঘটবে। প্রিয়জন হারাতে হবে, চাকরি শেষে অবসরে যেতে হবে, সন্তানেরা যাবে দূরে, নিজ নিজ ঘরে, কর্মস্থলে, শরীরও বুড়ো হবে; তবু মানিয়ে নিতে হবে সবকিছু ভালো থাকার জন্য।

পেরিয়ে যাবে ষাট, সত্তর, আশি...। সত্তরের মুখে ছাই দিয়ে এগিয়ে যাব। একেক বয়সে এক একভাবে নিজেকে আবিষ্কার করব। নতুন জিনিস পাব উপভোগের জন্য, পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াব, শরীরকে রাখব সচল ও সক্রিয়, বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা জমাব।

বুড়ো হলে মনে জাগে শঙ্কা-ভয়, তা কেন হবে? মনকে শক্ত করে এগিয়ে যাব। ‘আমরা করব জয়’ এই মন্ত্রে উজ্জীবীত থাকতে হবে। বুড়ো হওয়া মানে রুগ্ন হওয়া নয়। এমন অনেক বুড়ো আছেন, যারা ভীষণ দুরন্ত। স্বাস্থ্যকর আহার, ব্যায়াম, চাপ মোকাবিলা করে চলেন। এমন ঈর্ষণীয় বুড়ো হওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়।

বুড়ো হলে সবারই ভুলো মন হয়। কোনো কোনো বিষয় ভুলে গেলেই সেটা বয়সের কারণে হচ্ছে না ভেবে নিজেকে তরুণ ভাবুন। দেখবেন আপনার ভুলোমন অনেকটায় স্মরণ করতে পারছে। আপনি নিজেও উদ্যোম পাবেন।

বয়সী এক টগবগে নারী ইলা রানী দত্ত। সেদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের প্রাইমারি স্কুলের ২০১৯ সালের করা বর্ণমালার চার্ট মলিন হয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম চার্ট নতুন ভাবে আবার কাকে দিয়ে করাব? কাউকে দায়িত্ব দেয়ার আগেই হঠাৎ দেখি সেদিন আমার সহকর্মী মুনমুন দত্ত একটি বর্ণমালার চার্ট এনে আমাকে দেখালো। বলল, ‘বাসায় আমি যেই বর্ণমালার চার্ট করতে হাত দেই, আমার শাশুড়ি মা বললেন তিনি লিখে দিবেন।’ আসলে মুনমুনের হয়তো নিজের ভেতরে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল শাশুড়ির হাতে বর্ণমালা লেখানো। কাজ হয়ে গেল।

আশি বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলা ইলা রানী দত্ত অনায়াসে লিখে দিলেন বাংলা বর্ণমালা। কী সুন্দর! যা আজকাল বর্ণ লিখার সবাই মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি অবলম্বন করেও লেখানো যায় না। মুনমুনের মুখে শুনেছি তার প্রাজ্ঞতার কথা। তার জ্ঞানের কথা। তিনি এখনো বাড়ির সবার জন্য জলখাবার, পিঠাপুলি, ম-ামিঠাই সব বানাতে পারেন।

অনেক কৃতজ্ঞতা ইলা রানী দত্ত। অনেক ভালো থাকুন। আসলে আপনি প্রমাণ করে দিলেন জীবনীশক্তি থাকলে বয়স কোনো বিষয় নয়। এই প্রসঙ্গ ধরেই আমি সবার জন্য জীবনীশক্তি নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরছি।

জীবন মানেই এখন এক অন্তহীন মাঠে দৌড় প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার এক কঠিন লড়াই। সংগ্রামময় জীবনে টিকে থাকার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন হুট করেই পৃথিবী থেকে চলে যাই আমরা। জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে আমরা কতভাবে সময় পার করি। কতকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কখনো পড়াশোনা নিয়ে, কখনো চাকরি নিয়ে, কখনোবা সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে। এতকিছুর ভিড়ে নিজেকে দেয়ার মতো সময় আমাদের প্রায় কারোই হয়ে ওঠে না। অথচ আমরা নিজেরাই তো আমাদের সবচেয়ে আপন। তাই না? তাহলে কেন নিজেদের প্রতি এই অবহেলা? একবার ভেবে দেখুন তো, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন কিছু সময়ের জন্য নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন? শুধু নিজেকে সময় দিয়েছেন? অধিকাংশ মানুষের উত্তর হবে-না।

প্রকৃতি যেমন তার ওপর বিরূপ আচরন করার জন্য প্রতিশোধ নেয়, আমাদের শরীরও অবহেলা সহ্য করতে করতে একসময় চরম প্রতিশোধ নেয়। নিজেকে সময় না দিলে শরীর-মন দুটোর ওপরই খুব খারাপ প্রভাব পড়ে।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার শরীরটাই আপনার বেঁচে থাকার একমাত্র উৎস? নাহ্, ভাবেননি। এত ব্যস্ততার ভেতর, নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কই? তাই তো! কিন্তু একদিন এই শরীরটাই যখন আপনাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে, তখন আর সচেতন হবার সময় থাকবে না। একটি গবেষণাপত্র পড়ে জানলাম, যারা হার্টঅ্যাট্যাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যায়, তাদের বেশির ভাগ মৃত্যুর কারন অতিরিক্ত ব্যস্ততা আর মানসিক চাপ। যার ফলে, মানুষ যে কোনো সময় যে কোনো বয়সে মারা যেতে পারে।

বিগত কয়েক বছরে এভাবে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল তুলনামূলক কম, কেবলমাত্র তারা ব্যস্ততা আর মানসিক চাপের শিকার হয়েছেন, যার পরিণতি অকাল মৃত্যু! ঠিক সময়ে সচেতনতার অভাবে শরীরের আরো অনেক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। এটা তো গেল শারিরীক দিক।

মানসিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যস্ততার কারনে। চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ব্যস্ততায় সময় কাটাতে কাটাতে জীবন একঘেয়ে হয়ে পড়ে, বৈচিত্রহীন মনে হয় সবকিছু। মাঝেমাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সবাই সুখী আমি ছাড়া। আর ব্যস্ততা এমন একটা জাল, যেখানে একবার আটকা পড়লে, সে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

সবাই একবার নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন বা একটা সকাল অথবা একটা বিকেল নিজেকে আলাদা করে সময় দিন, যে সময়টুকুতে কোনো চিন্তাভাবনা থাকবে না।

আর্থিক চিন্তা থাকবে না, ক্যারিয়ারের চিন্তা থাকবে না, লাভ লোকসানের চিন্তা থাকবে না; একদম মুক্ত মনে ঘুরে বেড়ান সেই সময়টুকু। জীবনে টিকে থাকতে গেলে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। যদিও একটি প্রবাদ আছে ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সেই ‘ভাবনা-চিন্তা’ আপনার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য যেনো গ্রাস না করে, নির্ঘুম রাতের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। সেই ভাবনাকে পোষবেন? না, ত্যাগ করবেন?

আমি বলি, মনোজগতে আলাদা একটা জানালা তৈরি করুন। যে জানালা দিয়ে সমস্ত ভাবনা-চিন্তাগুলোকে দখিন হাওয়ার মতো বের করে দিতে পারবেন। তাহলে দেখবেন, কতটা স্বস্তির জীবন নিয়ে বাঁচা যায়।

নিজেকে সময় দেয়ার এবং নিজেকে শারিরীক ও মানসিকভাবে ভালো রাখার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে, নিজের যা ভালো লাগবে তা করা। যেমন, কারো ঘুরতে ভালো লাগে। সে মাঝে মাঝে ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারে দূরে কোথাও, যেতে পারে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। কারো হয়তো ঘরে একান্তে সময় কাটাতে ভালো লাগে। অথচ সেই সময়টুকু বের করা যায় না। আপনাকে অবশ্যই নিজের জন্য সময় বের করে নিতে হবে।

নিজেকে সময় দিলে শরীরের প্রতিা কোষে আনন্দ আর ভালোলাগার অনুরণন হবে, যা অনেক বেশি জীবনীশক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক। আর এই জীবনীশক্তিকে পুঁজি করেই নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়া যায়, বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় ভালো থাকার আরো অনেকগুলো দিন।

কেউ কেউ মুভি দেখতে ভালোবাসে, ছবি আঁকতে ভালোবাসে, একা একা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে ভালোবাসে। প্রত্যেকের ভালো লাগার ওপর কেন্দ্র করে নিজেকে কিছুটা অবসর সময় দেয়া উচিত।

খুব গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত, আমার আসলে কী চাই, কেন চাই, কী পেলে আমার আত্মতৃপ্তিবোধ হবে। আরো খেয়াল রাখতে হবে, আমার চাওয়াগুলো অন্য কারো ক্ষতির কারন হবে না তো? এভাবে নিজের বোধ জাগ্রত করে, নিজের চাওয়াগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে হবে, অন্তত নিজের জীবনকে ভালো রাখার জন্য।

একজীবনে অনেক বছর বেঁচে থেকেও নিজেকে চেনা হয়ে ওঠে না। খুব কমসংখ্যক মানুষই প্রকৃত অর্থে নিজেকে চিনতে পারে। এর একমাত্র কারণ নিজেকে সময় না দেয়া। নিজেকে সময় না দিলে, কিভাবে বুঝবেন আপনার কি চাই, আপনি কেমন ধরনের মানুষ কিংবা আপনার ভেতর মুখোশের আড়ালে অন্য কোনো রূপ লুকিয়ে আছে কিনা!

নিজেকে না চিনে, না জেনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে; ভাবতেই খুব আফসোস হচ্ছে না? মানবজনম কি আর বারবার আসে। এই এক জীবনে যদি নিজেকে চিনতে না পারেন, আর কোনোদিন চেনার সুযোগ হবে না। এই আফসোসটা যাতে কোনোদিন না হয়, সেজন্য অনেক ব্যস্ততার ভিড়েও নিজের জন্য খুব যতেœ নিয়মিত একটু সময় বের করুন। দেখবেন বেঁচে থাকা মানেই সংগ্রাম নয়, ভালো থাকাও বেঁচে থাকার একটা অনেক বড় অংশ। আবার বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলে ভালো থাকব না, এটাও কোনো কথা হতে পারে না। বেঁচে থাকলে ভালোও থাকতে হয়। আমি বলি, বেঁচে থাকার অপর নামটাই হলো ভালো থাকাও।

তাই তো বলছি, বয়স যতই হোক, নিজেকে ভালবাসুন, নিজেকে সময় দিন, সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করুন; অন্তত এই যান্ত্রিকতার যুগে নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে, নিজেকে সময় দেয়া খুব প্রয়োজন।

[লেখক : প্রধান শিক্ষক, গিয়াসনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌলভীবাজার]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

একজীবনে অনেক বছর বেঁচে থেকেও নিজেকে চেনা হয়ে ওঠে না

লতিফা নিলুফার পাপড়ি

শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

কবিগুরুর কথা, ‘কেশে আমার পাক ধরেছে বটে, তাহার পানে নজর কেন এত?’ সত্যি তা-ই। বয়স, শরীরের বয়স তো সংখ্যা বৈ কিছু নয়। মন বুড়ো না হলেই হলো।

শরীর মনে সুস্থ থাকা বড়ই কাম্য সবার জন্য। বয়স যতই হোক, বয়সের বারান্দায় রোদ্দুর পড়বে, আর এক কাপ চা হাতে পত্রিকা পড়তেই হবে পা দুটো নাচিয়ে নাচিয়ে সেই রোদ গায়ে মেখে।

বুড়ো হব, জীবনে নানা পরিবর্তন ঘটবে। প্রিয়জন হারাতে হবে, চাকরি শেষে অবসরে যেতে হবে, সন্তানেরা যাবে দূরে, নিজ নিজ ঘরে, কর্মস্থলে, শরীরও বুড়ো হবে; তবু মানিয়ে নিতে হবে সবকিছু ভালো থাকার জন্য।

পেরিয়ে যাবে ষাট, সত্তর, আশি...। সত্তরের মুখে ছাই দিয়ে এগিয়ে যাব। একেক বয়সে এক একভাবে নিজেকে আবিষ্কার করব। নতুন জিনিস পাব উপভোগের জন্য, পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াব, শরীরকে রাখব সচল ও সক্রিয়, বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা জমাব।

বুড়ো হলে মনে জাগে শঙ্কা-ভয়, তা কেন হবে? মনকে শক্ত করে এগিয়ে যাব। ‘আমরা করব জয়’ এই মন্ত্রে উজ্জীবীত থাকতে হবে। বুড়ো হওয়া মানে রুগ্ন হওয়া নয়। এমন অনেক বুড়ো আছেন, যারা ভীষণ দুরন্ত। স্বাস্থ্যকর আহার, ব্যায়াম, চাপ মোকাবিলা করে চলেন। এমন ঈর্ষণীয় বুড়ো হওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়।

বুড়ো হলে সবারই ভুলো মন হয়। কোনো কোনো বিষয় ভুলে গেলেই সেটা বয়সের কারণে হচ্ছে না ভেবে নিজেকে তরুণ ভাবুন। দেখবেন আপনার ভুলোমন অনেকটায় স্মরণ করতে পারছে। আপনি নিজেও উদ্যোম পাবেন।

বয়সী এক টগবগে নারী ইলা রানী দত্ত। সেদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের প্রাইমারি স্কুলের ২০১৯ সালের করা বর্ণমালার চার্ট মলিন হয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম চার্ট নতুন ভাবে আবার কাকে দিয়ে করাব? কাউকে দায়িত্ব দেয়ার আগেই হঠাৎ দেখি সেদিন আমার সহকর্মী মুনমুন দত্ত একটি বর্ণমালার চার্ট এনে আমাকে দেখালো। বলল, ‘বাসায় আমি যেই বর্ণমালার চার্ট করতে হাত দেই, আমার শাশুড়ি মা বললেন তিনি লিখে দিবেন।’ আসলে মুনমুনের হয়তো নিজের ভেতরে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল শাশুড়ির হাতে বর্ণমালা লেখানো। কাজ হয়ে গেল।

আশি বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলা ইলা রানী দত্ত অনায়াসে লিখে দিলেন বাংলা বর্ণমালা। কী সুন্দর! যা আজকাল বর্ণ লিখার সবাই মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি অবলম্বন করেও লেখানো যায় না। মুনমুনের মুখে শুনেছি তার প্রাজ্ঞতার কথা। তার জ্ঞানের কথা। তিনি এখনো বাড়ির সবার জন্য জলখাবার, পিঠাপুলি, ম-ামিঠাই সব বানাতে পারেন।

অনেক কৃতজ্ঞতা ইলা রানী দত্ত। অনেক ভালো থাকুন। আসলে আপনি প্রমাণ করে দিলেন জীবনীশক্তি থাকলে বয়স কোনো বিষয় নয়। এই প্রসঙ্গ ধরেই আমি সবার জন্য জীবনীশক্তি নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরছি।

জীবন মানেই এখন এক অন্তহীন মাঠে দৌড় প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার এক কঠিন লড়াই। সংগ্রামময় জীবনে টিকে থাকার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন হুট করেই পৃথিবী থেকে চলে যাই আমরা। জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে আমরা কতভাবে সময় পার করি। কতকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কখনো পড়াশোনা নিয়ে, কখনো চাকরি নিয়ে, কখনোবা সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে। এতকিছুর ভিড়ে নিজেকে দেয়ার মতো সময় আমাদের প্রায় কারোই হয়ে ওঠে না। অথচ আমরা নিজেরাই তো আমাদের সবচেয়ে আপন। তাই না? তাহলে কেন নিজেদের প্রতি এই অবহেলা? একবার ভেবে দেখুন তো, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন কিছু সময়ের জন্য নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন? শুধু নিজেকে সময় দিয়েছেন? অধিকাংশ মানুষের উত্তর হবে-না।

প্রকৃতি যেমন তার ওপর বিরূপ আচরন করার জন্য প্রতিশোধ নেয়, আমাদের শরীরও অবহেলা সহ্য করতে করতে একসময় চরম প্রতিশোধ নেয়। নিজেকে সময় না দিলে শরীর-মন দুটোর ওপরই খুব খারাপ প্রভাব পড়ে।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার শরীরটাই আপনার বেঁচে থাকার একমাত্র উৎস? নাহ্, ভাবেননি। এত ব্যস্ততার ভেতর, নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কই? তাই তো! কিন্তু একদিন এই শরীরটাই যখন আপনাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে, তখন আর সচেতন হবার সময় থাকবে না। একটি গবেষণাপত্র পড়ে জানলাম, যারা হার্টঅ্যাট্যাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যায়, তাদের বেশির ভাগ মৃত্যুর কারন অতিরিক্ত ব্যস্ততা আর মানসিক চাপ। যার ফলে, মানুষ যে কোনো সময় যে কোনো বয়সে মারা যেতে পারে।

বিগত কয়েক বছরে এভাবে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল তুলনামূলক কম, কেবলমাত্র তারা ব্যস্ততা আর মানসিক চাপের শিকার হয়েছেন, যার পরিণতি অকাল মৃত্যু! ঠিক সময়ে সচেতনতার অভাবে শরীরের আরো অনেক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। এটা তো গেল শারিরীক দিক।

মানসিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যস্ততার কারনে। চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ব্যস্ততায় সময় কাটাতে কাটাতে জীবন একঘেয়ে হয়ে পড়ে, বৈচিত্রহীন মনে হয় সবকিছু। মাঝেমাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সবাই সুখী আমি ছাড়া। আর ব্যস্ততা এমন একটা জাল, যেখানে একবার আটকা পড়লে, সে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

সবাই একবার নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন বা একটা সকাল অথবা একটা বিকেল নিজেকে আলাদা করে সময় দিন, যে সময়টুকুতে কোনো চিন্তাভাবনা থাকবে না।

আর্থিক চিন্তা থাকবে না, ক্যারিয়ারের চিন্তা থাকবে না, লাভ লোকসানের চিন্তা থাকবে না; একদম মুক্ত মনে ঘুরে বেড়ান সেই সময়টুকু। জীবনে টিকে থাকতে গেলে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। যদিও একটি প্রবাদ আছে ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সেই ‘ভাবনা-চিন্তা’ আপনার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য যেনো গ্রাস না করে, নির্ঘুম রাতের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। সেই ভাবনাকে পোষবেন? না, ত্যাগ করবেন?

আমি বলি, মনোজগতে আলাদা একটা জানালা তৈরি করুন। যে জানালা দিয়ে সমস্ত ভাবনা-চিন্তাগুলোকে দখিন হাওয়ার মতো বের করে দিতে পারবেন। তাহলে দেখবেন, কতটা স্বস্তির জীবন নিয়ে বাঁচা যায়।

নিজেকে সময় দেয়ার এবং নিজেকে শারিরীক ও মানসিকভাবে ভালো রাখার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে, নিজের যা ভালো লাগবে তা করা। যেমন, কারো ঘুরতে ভালো লাগে। সে মাঝে মাঝে ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারে দূরে কোথাও, যেতে পারে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। কারো হয়তো ঘরে একান্তে সময় কাটাতে ভালো লাগে। অথচ সেই সময়টুকু বের করা যায় না। আপনাকে অবশ্যই নিজের জন্য সময় বের করে নিতে হবে।

নিজেকে সময় দিলে শরীরের প্রতিা কোষে আনন্দ আর ভালোলাগার অনুরণন হবে, যা অনেক বেশি জীবনীশক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক। আর এই জীবনীশক্তিকে পুঁজি করেই নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়া যায়, বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় ভালো থাকার আরো অনেকগুলো দিন।

কেউ কেউ মুভি দেখতে ভালোবাসে, ছবি আঁকতে ভালোবাসে, একা একা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে ভালোবাসে। প্রত্যেকের ভালো লাগার ওপর কেন্দ্র করে নিজেকে কিছুটা অবসর সময় দেয়া উচিত।

খুব গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত, আমার আসলে কী চাই, কেন চাই, কী পেলে আমার আত্মতৃপ্তিবোধ হবে। আরো খেয়াল রাখতে হবে, আমার চাওয়াগুলো অন্য কারো ক্ষতির কারন হবে না তো? এভাবে নিজের বোধ জাগ্রত করে, নিজের চাওয়াগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে হবে, অন্তত নিজের জীবনকে ভালো রাখার জন্য।

একজীবনে অনেক বছর বেঁচে থেকেও নিজেকে চেনা হয়ে ওঠে না। খুব কমসংখ্যক মানুষই প্রকৃত অর্থে নিজেকে চিনতে পারে। এর একমাত্র কারণ নিজেকে সময় না দেয়া। নিজেকে সময় না দিলে, কিভাবে বুঝবেন আপনার কি চাই, আপনি কেমন ধরনের মানুষ কিংবা আপনার ভেতর মুখোশের আড়ালে অন্য কোনো রূপ লুকিয়ে আছে কিনা!

নিজেকে না চিনে, না জেনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে; ভাবতেই খুব আফসোস হচ্ছে না? মানবজনম কি আর বারবার আসে। এই এক জীবনে যদি নিজেকে চিনতে না পারেন, আর কোনোদিন চেনার সুযোগ হবে না। এই আফসোসটা যাতে কোনোদিন না হয়, সেজন্য অনেক ব্যস্ততার ভিড়েও নিজের জন্য খুব যতেœ নিয়মিত একটু সময় বের করুন। দেখবেন বেঁচে থাকা মানেই সংগ্রাম নয়, ভালো থাকাও বেঁচে থাকার একটা অনেক বড় অংশ। আবার বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলে ভালো থাকব না, এটাও কোনো কথা হতে পারে না। বেঁচে থাকলে ভালোও থাকতে হয়। আমি বলি, বেঁচে থাকার অপর নামটাই হলো ভালো থাকাও।

তাই তো বলছি, বয়স যতই হোক, নিজেকে ভালবাসুন, নিজেকে সময় দিন, সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করুন; অন্তত এই যান্ত্রিকতার যুগে নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে, নিজেকে সময় দেয়া খুব প্রয়োজন।

[লেখক : প্রধান শিক্ষক, গিয়াসনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মৌলভীবাজার]

back to top