শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
পৃথিবীতে কত বছর আগে মানুষের উদ্ভব হয়? এই প্রশ্নটির উত্তর নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। তবে নৃতাত্ত্বিকদের মতে, হোমো গনের অস্থিত্ব প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে, এই বিষয়টি হোমো হ্যাবিলিস ( প্রজাতির) উপস্থিতি দ্ধারা প্রমানিত হয়। যেখানে শরীর বৃত্তিয় মানুষের আভির্ভাব প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে হয়েছিল, এই বিষয়টিা নানা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে প্রমানিত হয়। পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্নে মানুষের কোন ধর্ম ছিল না। তাই সেই সময় ছিল না কোন জাত পাত ধর্মের বিভেদ। মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বাস করত। তারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতি ও হিং¯্র জীবজন্তুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেচে থাকত।
তাই বেচে থাকাটাই ছিল এক সংগ্রাম। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে বেচে থাকার জন্য একে অপরের প্রতি ছিল নির্ভরশীল। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাক্তিগত ভাবে বস্ত বা সম্পদ ভোগ করার ব্যবস্থাটা ছিল না। তাই পারস্পরিক বিরোধের বিষয়টা ছিল খুবই কম। ধরণি কে মানুষ তাদের ঈশ্বর বা শ্রষ্ট্রা মনে করত। তার কারণ ধরণি তে জন্ম নেয় শস্যদানা গাছপালাসহ আহার্য দ্রবাদি, যা দিয়ে মানুষ তার ক্ষুধা নিবারন করেন। অপরদিকে নারীই মাত্র আরেকটি মানুষ সৃষ্টি করতে তাই নারীকে সম্মান দেয়া হত ধরণি সমতুল্য। তখনকার সমাজে নারীরাই দেবী হিসাবে গণ্য হতো। তাছাড়া আদিকালে মানুষ প্রকৃতির নানা শক্তিকে তারা দেবতা মনে করত। যেমন ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, বন্যা, খরা ঘটানোর জন্য যে প্রভাবকগুলো কাজ করত সেই প্রভাবকগুলোকে তারা মনে করত দেবতা। তাই এই শক্তির আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে উপাসনা করত প্রভাবক সমূহকে। বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প, আগুন এই শক্তিগুলোকে মানুষ ভাবত দেবতা এরা ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার একটি রূপ।
আদিবাসী শব্দটির অর্থ বা সঙ্গাটির নানা রূপ বা ধরন রয়েছে। মোদ্দা কথা পৃথিবীর আদি অধিবাসী যারা তারাই আদিবাসী। এটা সার্বজনীন সত্য। তবে পৃথিবীতে ধর্ম গুলোর প্রচারের পর আদি সংস্কৃতিতে ঘটেছে নানা ধরনের পরির্বতন। পরির্বতনের ধারায় আদি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম পালনের প্রথাগত বিষয় গুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম গুলোর উৎপত্তি স্থলের সংস্কৃতি ও প্রথা। এভাবেই পরির্বতন হয়েছে সংস্কৃতির নানা প্রথা ও উৎসব গুলোর। আর আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও প্রথার হয়েছে পরির্বতন।
মানুষ ছিল যাযাবর। পশু শিকার করে তারা ক্ষুধা নিবারণ করত। তাই পশু শিকারের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াত। মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তুলে, যখন মানুষ কৃষি কাজ শুরু করে। অর্থাৎ মানুষ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি কাজের মাধ্যমে নিজেদের আবাস গড়ে তুলে। তাই বলা যায় যে, সভ্যতার বিকাশের ধারার শুরু হয় কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পশু শিকার করে মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটায় কৃষি আবাদ। কৃষি আবাদ শুরু হওয়ার পর মানুষ গড়ে সমাজ কেন্দ্রিক কিছু প্রথা ও ব্যবস্থা যা তাদের জীবন যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময়টায় ধর্ম বলতে যা বোঝা যায়, তা ছিল প্রকৃতি পুজা অর্থাৎ প্রকৃতির থেকে অধিক শস্য আহরণ করার জন্য প্রকৃতিকে তুষ্ট করার উপাসনা। এই উপাসনাগুলোর সূত্রপাত ঘটে বিভিন্ন গোত্র বা সমাজের ভেতর।
সমাজ ও গোত্র ভেদে নিয়ম ও আরাধনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। ধীরে ধীরে সমাজকেন্দ্রিক সৃষ্ট প্রথাগুলোই হয়ে যায় ধর্ম। কৃষি উৎপাদনের ফলনকে কেন্দ্র করে মানুষ আরাধনা করত। তার কারণ হলো যে উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষ ক্ষুধা নিবারণ করে, সেই ধরনের উৎপাদনের সফল বা অধিকতার ফলনের আশায় পূজা-অর্চনা করত মানুষ। তাই দেখা যায়, মানুষের ধর্মীয় আরাধনাটা ছিল কৃষির উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। কৃষি উর্বতা কেন্দ্রিক ধর্মধারায় নারী ও ধরিত্রী সমার্থক বলে গন্য করা হত। উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় যে আরাধনাটার উদ্ভব হয় তাহলো আম্বুবাচী। এই আম্বুবাচীটাই হয়ে উঠে ধর্মীয় উৎসবে। আম্বুবার্চী মানুষের ধর্মীয় উপসনা ও উৎসবের রূপ নেয়। আম্বুবাচীর ধারণা সৃষ্টি হয় নারীর শারিরিক পরির্বতনের সঙ্গে প্রকৃতির পরির্বতনের রূপ এর সামঞ্জস্য রেখে।
গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর যখন বর্ষার আগমনে প্রকৃতি সিক্ত হয় এবং নবরূপে বীজধারনের যোগ্য হয়ে উঠে সেই সময়কে বলা হয় আম্বুবাচী। নতুন বর্ষায় জলে ভূমি সিক্ত হয়ে উঠে, আর এই সময়টাকে পৃথিবীকে ঋতুমতী নারীর রূপ হিসাবে গণ্য করা হয়। এই নিয়মটা মেনে আদিম কৃষি ব্যবস্থার সংস্কৃতির প্রধান উৎসব আম্বুবাচী পার্বণ। ঋতুর ঠিক পরবর্তী দিনগুলো যেমন নারীর সন্তান ধারনের জন্য সক্ষম বলে মনে করা হয়, ঠিক তেমনি আম্বুবাচী পার্বণের পরবর্তী সময়টাকে ফসল ফলানোর শ্রেয়কাল বলে মনে করা হয়েছিল। উড়িষ্যা রাজ্যে এই পার্বণটিকে পরিষ্কার ভাবে রাজ্যউৎসব হিসাবে ধরা হয়। আসামের কামাখ্যার মন্দিরে এই উপলক্ষ্যে দেবীর ঋতুকাল সমাগত বলে মনে করে প্রতি বছর উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। এই পার্বণ পালিত হয় প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত। নারীদের ঋতুস্্রাবের সময়কাল সাধাণনত তিন দিন ধরা হয়। তাই এই তিন দিন ধরত্রীরও ঋতুকাল হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছিল কৃষকেরা। শাস্ত্রমতে নারীর ঋতুকালে পুরুষ সঙ্গ নিষিদ্ধ। তাই ধরণির ঋতুবতী সময় তিন দিন (৭ আষাঢ় থেকে ১০ আষাঢ়) ধরত্রীতে বীজ বোনা, লাঙ্গলচাষ করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
ভাষাবিদের মতে পুরুষবাচক শব্দ লিঙ্গ থেকে কৃষিযন্ত্র লাঙ্গল শব্দটির উৎপত্তি। তাই ঐ সময় লাঙ্গল দিয়ে ভূমি কর্ষণ করা হত না। ঋতু কালের সংযম পালনের মধ্য দিয়ে উপবাস বা অরন্ধন প্রথাটি চালু হয়। বিধবাদের ক্ষেত্রে সংযম প্রথাটির চালু হয় এই সামাজিক মানসিকতা থেকেই। পরবর্তীতে ধর্মজাজকরা বিধবাদের উর্বরতাকে উৎপাদনক্ষম যাতে না হয়ে সেই জন্য নানা ধরনের উপবাসের ব্যবস্থা করেন। যেমন বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি অভিব্যক্তি হলো একাদশীর উপবাস। তবে বিধবার সংযম ও একাদশীতে উপবাস এর সঙ্গে অতীতের আম্বুবাচী পার্বণের পালন করা হতো কি না, তার সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নাই।
প্রাচীনকালে ফসল উঠার সময়ে কতক গুলি কৃষি উৎপাদন কেন্দ্রিক উৎসব পালন করা হত। এখনো পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতু উৎসব ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। এই পার্বনের রীতি এবং উপাচার গুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় ইতুকে মাতৃরূপে গণ্য করা হয়। ইতু পূজার বিষয় বস্তুতে দেখা যায়, ঘটের গায়ে পুতলী আঁকা এবং ভেতরে শস্যধানা ও তৃণগুচ্ছ। এটা মাতৃ প্রতীক আর প্রতিকী শস্য ক্ষেত্র। নৃতাত্ত্বিক জেমস ফ্লেজার সারা পৃথিবীর শস্য উৎসবকে একই ধরনের দেখেছেন। তাই তিনি শস্য উৎসবের নাম দিয়েছেন গার্ডেন অব অ্যাডোনিস।
বাংলা জনপদে কার্তিক সংক্রান্তি থেকে শুরু করে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি রোববার এই ইতি পুজো করা হয়। কারণ এই সময়টা ধরণি শস্য ভরাক্রান্ত। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে ফসল ঘরে উঠার পর ইতুর ঘট ভাসিয়ে দেয়ার রীতি, এই পার্বণটিকেও মাতৃকারূপে সূচিত করে। তবে এই পার্বনটিতেই নবান্ন উৎসব পালিত হয়। নবান্ন উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা তিথি নেই। জমির ফসল গোলাজাত করার যে কোন সময় এই উৎসব পালন করা যায়।
পঞ্জিকার মতে শুভ সময় দেখে নারীরা নবান্ন মাখেন। অর্থাৎ নবান্নের খাবার তৈরি করেন। এই সময়টায় নারীদের মাঝে দেবীগুণটির প্রভাব থাকে। তাই খাদ্যগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। এর জন্যই নারীরা শুচি¯িœগ্ধ হওয়াটা জরুরি। তাই নারীরা ¯œান করে পবিত্র হয়ে তারা খাদ্য তৈরি করেন। বিশেষ বিশেষ শারীরিক অবস্থায় দেবী পবিত্রতা আরোপ করবার কারণে নবান্ন স্পর্শ করার বিষয়ে ধর্মীয় সংস্কার রয়েছে। অশুচি অবস্থ্য় নবান্নের খাবার র্ষ্পশ করাটা পাপ। অন্য কেউ তুলে মুখে দিলে তা গ্রহন করতে বাধা নেই, এক্ষেত্রে শারীরিক শুচিতা অশুচিতা কোন বিষয় না।
নবান্নের পাওয়া চাল থেকে খাদ্য তৈরী করা হয়। বিভিন্ন টোটেম ভাবনা মতে পূর্বপুরুষেরা কাক হয়ে ঐ সময় ধরণীতে আসে। তাই নবান্নের ধান, নতুন গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরি খাবার রন্ধন শেষে কাকদেরকে দেয়া হয়। পূর্ব পুরুষের আতœা নবান্নের খাবার গ্রহণ করে গেলে বাকি খাদ্যটা প্রসাদরূপে গণ্য করা হয়ে থাকে। এখানে মূল ব্যাপারটা হলো দেবতার প্রসাদ ও দেব কল্পটি নবান্নের ভুল ভাবনা। এই ধরনের সংস্কারটা সত্যিই দুর্লভ। পিতৃ শ্রাদ্ধের বিষয়টি ছাড়া বাকি সব প্রথাগুলো নারী কর্তৃক পালনীয়। নবান্নের মাধ্যমে যে পিতৃশ্রাদ্ধ হয় তাতে কোন পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। তাই এখন যে নবান্নের শ্রাদ্ধ সচরাচর হয়ে থাকে তাতে কোন পুরোহিত থাকে না।
মহালয়ার তর্পণের সঙ্গে নবান্নের ভাব সাযুজ্য খুজে পাওয়া যায়। নবান্নের সঙ্গে আরেকটি পার্বণ হতে দেখা যায় তা হলো পৌষ সংক্রান্তি। তবে জমি থেকে ফসল ঘরে তোলার সময় উৎসব পালনের রেওয়াজটি সারা বিশ্বে প্রচলিত। কারণ পৃথিবীর সভ্যতার বিকাশ কৃষি আবাদের মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই উৎসবটি পালন করে আসছে। বাংলা জনপদের সমতলের আধিবাসী হল সাঁওতাল। সাওতাল আধিবাসীরা নবান্নকে বলেন লবান। সাঁওতাতালরা নবান্নান উৎসবটি পালন করেন প্রতি বছর ১৭ নভেম্বর। দিনটি কার্তিক মাসের শেষ দিকের। সাঁওতালী পঞ্জিকা মতে এই দিনটি পালন করা হয়। তা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে নানা ধরনের আধিবাসী রয়েছেন । তাদের পঞ্জিকামতে নবান্ন এবং আম্বুবাচী উৎসব পালন করা হয়। তবে এই উপমহাদেশের পঞ্জিকা গুলো সৌর পঞ্জিকা। সৌরমতে পঞ্জিকা গুলোর দিনক্ষণ গননা করা হয়। সেই জন্য এর একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা থাকলেও পঞ্জিকার সময়গত পার্থকটা তেমন নেই বলেই চলে।
তবে আব্রাহামীয় ধর্ম গুলোর প্রচলন শুরু হয় প্রায় তিন হাজার বছর আগে। বর্তমানে আব্রাহামীয় তিনটি ধর্ম সারা বিশ্বের বৃহৎ জনগােষ্ঠি পালন করে আসছে। ধর্ম তিনটি হলো, ইহুদি, খৃষ্টান এবং ইসলাম। আব্রাহামীয় ধর্মের প্রচলনটা শুরু হয় মূলত সভ্যতার আধুনিকালেই। যদিও আব্রাহামীয় ধর্মগুলো সামন্তবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে তবে তারা পরোক্ষভাবে ধর্মের বাতাবরণে রাজ্যর কর্তৃত্ব কায়েমের লক্ষে ধর্মযাজকরা ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। তারা সামাজিক কিছু প্রথা চালু করেন যা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের সংস্কৃতি হিসাবে রূপ পায়। এই প্রথাগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষকে সামাজিক জীবন প্রণালির দিক নির্দেশনা দেয়া হয়।
আব্রাহামীয় ধর্মের আবির্ভাবের আগে বিশ্বে প্রায় টোটেম আরাধনা হতো। আর এই টোটেমের সংখ্যা কত ছিল তা বলা যায় না। প্রায় লক্ষাধিক ধর্মের পালনের মধ্য দিয়ে নানা টোটেমের আরাধনা করত মানুষ। তাই গোত্র , গোষ্ঠি কেন্দ্রীক মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা গুলোর ভিন্নতা দেখা যায়। আব্রাহামীয় ধর্ম গুলোর প্রচারের ফলে গোত্র, কৌম ও গোষ্ঠীর মাঝে ঐক্য বা মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়। ফলে বিশাল এলাকা বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোত্রগুলো একত্রিত হয় যায় ধর্ম পালনের ঐক্যতায়। তবে এই ধর্মগুলো নারীর সেই মহাশক্তিটাকে বিশেষ আমলে নেয়নি তাই এখানে নারীর আরাধনাটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এভাবেই নারী সমাজের মূলকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে সরে যায়। বর্তমানে প্রায় অর্ধেকের মতো মানুষ এখনও সনাতন (প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস) ধর্ম পালন করে আসছে। এখানে সনাতন ধর্ম বলতে শুধু হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের বোঝানো হয়নি।
সনাতনী ধর্ম ভাবনার ও প্রথার হয়েছে নানা সংস্কার। মানবজাতির উদ্ভবকাল থেকে আজ অবধি ধর্মগুলোতে এসেছে নানা ধরনের বিবর্তন। বির্বতনের ফলে যে পরির্বতনগুলোর হয়েছে তা অনেকটাই সুপ্তভাবে যাকে বলা যায় স্লো পয়জনিংয়ের মতো। তবে আব্রাহামীয় ধর্ম তিনটিতে গোড়ামির প্রভাবটা অন্য ধর্মের চেয়ে একটু বেশি। এই ধর্ম তিনটির প্রচারক ও ধর্ম পালনকারীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। ফলে এই ধর্মের মানুষগুলোর মানসিকতায় মৌলবাদটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর উৎপত্তি মূলত আরব অঞ্চলে। আব্রাহামীয় ধর্মের প্রচারকরা পৃথিবীদের বিভিন্ন অঞ্চলের আরব অঞ্চলের রীতিনীতি, প্রথার ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়। মানুষ সনাতন মানে আদি ধর্মীয় ব্যবস্থা থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার করণে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়। গোত্র ভিত্তিক সৃষ্ট সংস্কৃতি বা প্রথাগুলোর হয় নানা ধরনের পরির্বতন। নব ধর্মে দিক্ষীত মানুষগুলো অধিকতর পুণ্যের মোহে তার শেকড়ের নিয়ম বা প্রথাগুলো আর মানতে চায় না। ধর্মযাজকরা পরকালের মোহে তাদেরকে আবিষ্ট করে তোলে।
ধর্ম প্রচারকরা বলতে থকেন যে, ধর্মান্তরিত হয়ে যারা নব দীক্ষা গ্রহণ করেছে তারা যদি নিজস্ব সংস্কৃতিা পালন করেন তা হবে তাদের জন্য পাপ কাজ। এই পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। ফলে টোটেম থেকে নব ধর্মের দীক্ষিতরা ধর্মীয় সংস্কৃতিা পালন করতে শুরু করে। তার প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বা আহরিত মুল সংস্কৃতিা থেকে সে সরে যায়। ধর্মের বাতাবরণে অনুপ্রবেশ ঘটে ভিন দেশীয় সংস্কৃতির। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির এভাবেই প্রবাহমান নদীটির ধারাটি ক্ষীনকার হয়ে যায়। এত শত কিছুর পরও মানুষের মনে থেকে যায় আদি সংস্কৃতির কথা। আজ থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের উপস্থিতি অর্থ্যাৎ দ্ধিপদ মানুষের বসবাস ছিল এই উপমহাদেশে। তার প্রমান পাওয়া যায় নৃত্বাত্বিক ভদ্দার এর মতে। মুরজানি এট আলে এতদ সর্ম্পকীত ভারত বর্ষে মানুষের অভিপ্রায়ন নিয়ে তিনটি মতামত দেন। তা হলো, এক. কৃষ্টির ৮০০০ থেকে ৯০০০ বছর আগে মানুষের অভিপ্রায়ন ঘটে, দুই. কৃষির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপীয়দের অভিপ্রায়ন ঘটে যা ৪৬০০ বছর আগে, তিন. ৩০০০ থেকে ৪০০০ বছর আগে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের অভিপ্রায়ন হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষের অভিপ্রায়ণের ফলে ভারত বর্ষের সংস্কৃতির ধারাটি নানা ভাবে পরির্বতিত হয়েছে। আধুনিক দুর্গাপুজা, ঈদ উৎসবসহ কিছু উৎসব যোগ হয়েছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে। ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটেছে পৃথীবির সবচেয়ে বেশি মানুষের সংমিশ্রণ। তাই জন্ম হয়েছে নতুন নতুন জাতির। পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ হিসাবে ভারতীয় উপমহাদের পরিচিত। তাই বলা হয়ে থাকে যা নাই ভূ ভারতে তা নাই এ জগতে। ভারতীয় উপমহাদেশটি বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নামে পরিচিত। এই উপমহাদেশে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান অবস্থিত।
উল্লেখযোগ্য প্রতœতাত্ত্বিক নথির অভাবের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসরত সাঁওতাল আদিবাসীদের জন্মভূমি নিশ্চিত করা যায় না। তবে ভাষাবিদ পল সিডওয়েলের মতে, অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা সম্ভবত প্রায় তিন থেকে চার হাজার বছর আগে ইন্দোচীন থেকে ওড়িষ্যা উপকূলে এসেছিল। অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসতি গড়ে তোলে, এরা স্থানীয় ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। সেই সময় মু-া ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। আর্যদের আগমনসহ প্রাচীন ভারতে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষের আগমন ঘটে । শেষ পর্যায়ে আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ঘটে মুসলিমদের আগমন। এ রকম নানা জাতি এসে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে সংস্কৃতিতে ঘটে নানা পরির্বতন। প্রচলন ঘটে নতুন নতুন সংস্কৃতির ধারা ও প্রথার। একমাত্র এই অঞ্চলের আদিবাসীরাই ধরে রেখেছে হাজার হাজার বছরের পুরোনো কিছু উৎসব।
বর্তমানে সমতলের আদিবাসীরা সাঁওতাল নামেই পরিচিত। এদেরকেই ধরে নেয়া হয় এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন আদি মানুষ। পাহাড়ের আধিবাসীদের আগমেন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়। সঁওতালদের সংস্কৃতিগত ধারাটির এখনও অপরিবর্তিত তবে শিশনারীর কারণে এরা নতুন সংস্কৃতির আবরণে বেষ্টিত হচ্ছে। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে কোনো ব্যাক্তি গোষ্ঠির বা ধর্মের মানুষ তা শনাক্তকরণের জন্য একমাত্র চিহ্ন ছিল উল্কি। এই উল্কি দেখেই তার গোত্র, জাত বা গোষ্ঠী নির্ণয় করা হতো। সাধারণত শরীরে উল্কির স্থান ছিল হাতের তালু, হাতের এপিঠ ওপিঠ, বুক, কপাল এমনকি গাল। শরীরে উল্কি হিসাবে আঁকা হতো লতাপাতা, পশুপাখি, সূর্য, চাঁদ, তারা প্রভৃতি। উল্কি আঁকার পূর্বে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি দেয়ার নিয়ম ছিল। অপদেবতার কোপানলে পরে উল্কির স্থানে যেন ঘা না হয়ে যায় সেই লক্ষ্যেও পূজা দেয়া হতো। প্রাচীনকালে বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্রগুলোর ছিল নানাবিধ ভাষা এবং কিছু কিছু গোত্রের ছিল হরফ। যা এখন রয়েছে আদিবাসীদের মাঝে। যা দিয়ে তারা সাহিত্য চর্চা করত। কালের বিবর্তনে এইসব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি হারাতে শুরু করেছে। তবে ভারত সরকার আদিবাসী ভাষা রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০০৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতের সংবিধানের ৯২তম সংশোধনীর দ্বারা সাঁওতালী চারটি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই চারটি ভাষা হলো, বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলী ও সাঁওতালি। সারা বিশ্বের সাঁওতাল ভাষাভাষীদের কাছে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২২ ডিসেম্বরকে সাঁওতালরা ভাষাদিবস হিসাবে পালন করে।
যদিও বর্তমানে আব্রাহামীয় খৃষ্টান ধর্মের খৃষ্টান মিশনগুলো সাঁওতালদের ধর্মান্তরিত করছে তারপরও এদের মাঝে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারার প্রথা ও উৎসব পালনের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। সাঁওতালদের রয়েছে নানা ধরনের শাখা প্রশাখা, এই শাখা প্রশাখা গুলোর কৃষ্টি কালচারের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। সাঁওতালদের মাঝ থেকে জীবন জীবিকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পেশায় গমন করায় সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন গোষ্ঠির। তাই সাঁওতালদের এই অঞ্চলের আদিবাসী বলে গণ্য করা হয়। সাঁওতালদের যে শাখাটি বাশের কাজে পারদর্শী হয়ে উঠে যে নতুন শাখার জন্ম দেয় তা হলো মাহালী। বাশের কাজ করা সাঁওতালরাই মাহালী নামে পরিচিত। মাহালি জনজাতির মানুষও বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত. প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব টোটেম অর্থাৎ উপাস্য দেবতা রয়েছে।
মাহালীদের বর্তমানে ১৩টি গোত্র ও টোটেম আছে, তারা হলো বাক্সে ( লাল নটের শাক) বেসরা (বাজ পাখি) হাঁদা (বুনো হাঁস) হেমব্রম (বাদাম) কিস্কু (মাছরাঙা), মা-ি (নীল চক্র নামে নীল পাখি) মুর্মু (শোল মাছ) সোরেন টুডু (মেঠো ইঁদুর), ছোরে (গিরগিটি), সামাহ (এক প্রকার ঘাস) পাহিরি (গোল কুমড়া) খাগড়া (ডোম কাক)। আবার এই তেরোটি গোত্রের প্রতিটির উপগোত্র রয়েছে। এই উপগোত্রগুলোকে খুট বলা হয়। মাহালীদের মাঝে সমজাতির মধ্যে ও গোত্রগুলোর মধ্যে বিবাহের প্রচলন আছে তবে বহু বিবাহের প্রচলন নেই। মাহালিদের নিজস্ব সামাজিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আছে। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মীয় উৎসব পালনসহ সামাজিক রীতিনীতি। মাহালীরা জীবজন্তু ও উদ্ভিদের পূজা করে আসছে। তবে গোত্রভিত্তিক পূজার আচরণিক ব্যবস্থাটি ভিন্ন হয়। মাহালীদের গৃহ দেবতা ওরাক বোঙা। গোত্র ভিত্তিতে ওরাক বোঙার উপাসনা পদ্ধদ্ধিতে রয়েছে ভিন্নতা। তবে দেবতার উদ্দেশ্যে মোরগ উৎসর্গ করে থাকে সবাই। গোত্রের ভিত্তিতে তারা ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের মোরগ দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়। তবে মাহালীদের মূল দেবতা হলো বন পাহাড়ি দেও ও মনসা দেবী।
সাঁওতালদের রীতিনীতি ও ধর্ম পালনের রয়েছে বিভিন্নতা । সাঁওতালদের ভাষায় তাদের দেবতা বোঙা। বোঙা দেবতাটি মাহালীদেরও। সাঁওতালরা প্রধান দেবতা হিসাবে চান্দোবোঙাকে (সুর্যদেব) মনে করে। ফসল উৎসবে প্রাচীনকালে ও বর্তমানে ইতু পূজা করা হয়। ইতু মানে রবি, রবির আরেক নাম সুর্য। যেহেতু সাঁওতালরা কৃষিজীবি তাই তারা প্রাচীন রীতি অনুসারে চান্দোবোঙাকে পুজা করে। সাঁওতাল জনজাতির মাঝে বহু প্রাচীন উৎসব পালনের প্রথা গুলো পরিলক্ষিত হয়। এদের অন্য দেবতা হল মারাং বুরু। সাঁওতালদের মাঝে ঋতু ভিত্তিক উৎসব পালনের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। বাংলা জনপদ ছয় ঋতুর অঞ্চল। প্রতিটি ঋতুতে এই অঞ্চলের প্রকৃতির পরির্বতন হয়। তাই এখানে প্রতিটি ঋতুতে নতুন নতুন ফুল,ফসল ফল জন্মায়। সাওতাওতালরা ভূমিপুত্র তাই ভূমি থেকে উৎপান্ন দ্রবাদি গ্রহণের সময় দেবতাকে এঁরা স্মরন করে। সাঁওতালদের ধর্ম ধারণা মতে মারাং বুরু মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। সাঁওতালদের গৃহদেবতা আবেগে বোংগা। সাওতালরা বিভিন্ন পূজা পার্বণে আনন্দে মেতে উঠে। সাঁওতালরে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির নিবিড় সর্ম্পক।
শীতের শেষে বসন্তে যখন ফুল ফুটে তখন তারা বাহা উৎসব পালন করে। বাহা উৎসব পালন না করে সাঁওতাল মেয়েদের খোপায় ফুল পরার নিয়ম নেই। সাওতালদের বার্ষিক উৎসবের নাম সোহরাই। প্রকৃতির ঋতু বদলের সঙ্গে এরা সাকরাত উৎসব পালন করে থাকে। সাওতালি ভাষা চর্চা ও বিকাশের গ্রন্থে পাওয়া যায়, সাওতাল জাতির মধ্যে প্রচলিত ধর্ম সর্ম্পকে। পরিমল হেমব্রম রচিত গ্রন্থটিতে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, সাঁওতাল জাতির মধ্যে মোট ১১টি ধর্ম রয়েছে, সেগুলো হলো সারি ধরম, সারনা ধরম, বাহা ধরম, খেওয়াড় ধরম , জাহের ধরম, মারাংবুরং ধরম, হাঁড়ি ধরম, চাঁদোবোঙা ধরম, যুগ ডাহার ধরম, সাধু ধরম এবং আদিবাসী ধরম। সাওতালদের কোন মন্দির বা উপসনালয় নেই। সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সোহরাই। সোহরাই উৎসবটি বাংলা পৌষ মাসে উদযাপিত হয়। অগ্রায়হনে ফসল গোলাজাত করার পর ঈশ্বরের সন্তুষ্টির পালন এবং আগামীতে অধিক ফসল ও পশুসম্পদ পাবার আশায় এই উৎসবটি সাঁওতালরা পালন করে থাকে।
খৃষ্টান মিশনারি আগ্রাসনের ফলে সাঁওতালদের ধর্মীয়, সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করছে পশ্চিমা ধারা। তাই ধারণা করা হচ্ছে এই জনপদের সর্বশেষ যে সংস্কৃতি ধারাটি সাঁওতালার লালন করে আসছিল তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গত এক হাজার বছর ধরে বাংলা জনপদে আগমন ঘটেছে নানা ধরনের ধর্মের, এই ধর্মগুলোর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিতে মিশে কিছু সংস্কৃতির প্রথা, যা এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও শস্য উৎপাদনের বিষয়ে সামঞ্জস্যহীন। আবহাওয়াগত কারণে এখানকার নারীরা শাড়ি পরত, নারীরা হিজাব পড়ত না। বর্তমানে ধর্মীয় কারণে হিজাব পোশাক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হতে চলছে। দেখা যায় কারণে অকারণে পরির্বতন হয় সংস্কৃতির তবে মূল পরির্বতন ঘটে ধর্মীয় প্রভাবের ফলে। তাই এই বিষয়গুলোকে লক্ষ রেখে মূল সংস্কৃতির ধরাটাকে বজায় রাখা উচিত। একটি অঞ্চলের সংস্কৃতি হলো ঐ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। একে রক্ষা করা সবাইর নৈতিক দায়িত্ব।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী ]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
পৃথিবীতে কত বছর আগে মানুষের উদ্ভব হয়? এই প্রশ্নটির উত্তর নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। তবে নৃতাত্ত্বিকদের মতে, হোমো গনের অস্থিত্ব প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে, এই বিষয়টি হোমো হ্যাবিলিস ( প্রজাতির) উপস্থিতি দ্ধারা প্রমানিত হয়। যেখানে শরীর বৃত্তিয় মানুষের আভির্ভাব প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে হয়েছিল, এই বিষয়টিা নানা তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে প্রমানিত হয়। পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্নে মানুষের কোন ধর্ম ছিল না। তাই সেই সময় ছিল না কোন জাত পাত ধর্মের বিভেদ। মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বাস করত। তারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতি ও হিং¯্র জীবজন্তুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেচে থাকত।
তাই বেচে থাকাটাই ছিল এক সংগ্রাম। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে বেচে থাকার জন্য একে অপরের প্রতি ছিল নির্ভরশীল। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাক্তিগত ভাবে বস্ত বা সম্পদ ভোগ করার ব্যবস্থাটা ছিল না। তাই পারস্পরিক বিরোধের বিষয়টা ছিল খুবই কম। ধরণি কে মানুষ তাদের ঈশ্বর বা শ্রষ্ট্রা মনে করত। তার কারণ ধরণি তে জন্ম নেয় শস্যদানা গাছপালাসহ আহার্য দ্রবাদি, যা দিয়ে মানুষ তার ক্ষুধা নিবারন করেন। অপরদিকে নারীই মাত্র আরেকটি মানুষ সৃষ্টি করতে তাই নারীকে সম্মান দেয়া হত ধরণি সমতুল্য। তখনকার সমাজে নারীরাই দেবী হিসাবে গণ্য হতো। তাছাড়া আদিকালে মানুষ প্রকৃতির নানা শক্তিকে তারা দেবতা মনে করত। যেমন ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, বন্যা, খরা ঘটানোর জন্য যে প্রভাবকগুলো কাজ করত সেই প্রভাবকগুলোকে তারা মনে করত দেবতা। তাই এই শক্তির আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে উপাসনা করত প্রভাবক সমূহকে। বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প, আগুন এই শক্তিগুলোকে মানুষ ভাবত দেবতা এরা ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার একটি রূপ।
আদিবাসী শব্দটির অর্থ বা সঙ্গাটির নানা রূপ বা ধরন রয়েছে। মোদ্দা কথা পৃথিবীর আদি অধিবাসী যারা তারাই আদিবাসী। এটা সার্বজনীন সত্য। তবে পৃথিবীতে ধর্ম গুলোর প্রচারের পর আদি সংস্কৃতিতে ঘটেছে নানা ধরনের পরির্বতন। পরির্বতনের ধারায় আদি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম পালনের প্রথাগত বিষয় গুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম গুলোর উৎপত্তি স্থলের সংস্কৃতি ও প্রথা। এভাবেই পরির্বতন হয়েছে সংস্কৃতির নানা প্রথা ও উৎসব গুলোর। আর আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও প্রথার হয়েছে পরির্বতন।
মানুষ ছিল যাযাবর। পশু শিকার করে তারা ক্ষুধা নিবারণ করত। তাই পশু শিকারের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াত। মানুষ স্থায়ী বসতি গড়ে তুলে, যখন মানুষ কৃষি কাজ শুরু করে। অর্থাৎ মানুষ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি কাজের মাধ্যমে নিজেদের আবাস গড়ে তুলে। তাই বলা যায় যে, সভ্যতার বিকাশের ধারার শুরু হয় কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পশু শিকার করে মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটায় কৃষি আবাদ। কৃষি আবাদ শুরু হওয়ার পর মানুষ গড়ে সমাজ কেন্দ্রিক কিছু প্রথা ও ব্যবস্থা যা তাদের জীবন যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময়টায় ধর্ম বলতে যা বোঝা যায়, তা ছিল প্রকৃতি পুজা অর্থাৎ প্রকৃতির থেকে অধিক শস্য আহরণ করার জন্য প্রকৃতিকে তুষ্ট করার উপাসনা। এই উপাসনাগুলোর সূত্রপাত ঘটে বিভিন্ন গোত্র বা সমাজের ভেতর।
সমাজ ও গোত্র ভেদে নিয়ম ও আরাধনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। ধীরে ধীরে সমাজকেন্দ্রিক সৃষ্ট প্রথাগুলোই হয়ে যায় ধর্ম। কৃষি উৎপাদনের ফলনকে কেন্দ্র করে মানুষ আরাধনা করত। তার কারণ হলো যে উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষ ক্ষুধা নিবারণ করে, সেই ধরনের উৎপাদনের সফল বা অধিকতার ফলনের আশায় পূজা-অর্চনা করত মানুষ। তাই দেখা যায়, মানুষের ধর্মীয় আরাধনাটা ছিল কৃষির উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। কৃষি উর্বতা কেন্দ্রিক ধর্মধারায় নারী ও ধরিত্রী সমার্থক বলে গন্য করা হত। উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় যে আরাধনাটার উদ্ভব হয় তাহলো আম্বুবাচী। এই আম্বুবাচীটাই হয়ে উঠে ধর্মীয় উৎসবে। আম্বুবার্চী মানুষের ধর্মীয় উপসনা ও উৎসবের রূপ নেয়। আম্বুবাচীর ধারণা সৃষ্টি হয় নারীর শারিরিক পরির্বতনের সঙ্গে প্রকৃতির পরির্বতনের রূপ এর সামঞ্জস্য রেখে।
গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের পর যখন বর্ষার আগমনে প্রকৃতি সিক্ত হয় এবং নবরূপে বীজধারনের যোগ্য হয়ে উঠে সেই সময়কে বলা হয় আম্বুবাচী। নতুন বর্ষায় জলে ভূমি সিক্ত হয়ে উঠে, আর এই সময়টাকে পৃথিবীকে ঋতুমতী নারীর রূপ হিসাবে গণ্য করা হয়। এই নিয়মটা মেনে আদিম কৃষি ব্যবস্থার সংস্কৃতির প্রধান উৎসব আম্বুবাচী পার্বণ। ঋতুর ঠিক পরবর্তী দিনগুলো যেমন নারীর সন্তান ধারনের জন্য সক্ষম বলে মনে করা হয়, ঠিক তেমনি আম্বুবাচী পার্বণের পরবর্তী সময়টাকে ফসল ফলানোর শ্রেয়কাল বলে মনে করা হয়েছিল। উড়িষ্যা রাজ্যে এই পার্বণটিকে পরিষ্কার ভাবে রাজ্যউৎসব হিসাবে ধরা হয়। আসামের কামাখ্যার মন্দিরে এই উপলক্ষ্যে দেবীর ঋতুকাল সমাগত বলে মনে করে প্রতি বছর উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। এই পার্বণ পালিত হয় প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত। নারীদের ঋতুস্্রাবের সময়কাল সাধাণনত তিন দিন ধরা হয়। তাই এই তিন দিন ধরত্রীরও ঋতুকাল হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছিল কৃষকেরা। শাস্ত্রমতে নারীর ঋতুকালে পুরুষ সঙ্গ নিষিদ্ধ। তাই ধরণির ঋতুবতী সময় তিন দিন (৭ আষাঢ় থেকে ১০ আষাঢ়) ধরত্রীতে বীজ বোনা, লাঙ্গলচাষ করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
ভাষাবিদের মতে পুরুষবাচক শব্দ লিঙ্গ থেকে কৃষিযন্ত্র লাঙ্গল শব্দটির উৎপত্তি। তাই ঐ সময় লাঙ্গল দিয়ে ভূমি কর্ষণ করা হত না। ঋতু কালের সংযম পালনের মধ্য দিয়ে উপবাস বা অরন্ধন প্রথাটি চালু হয়। বিধবাদের ক্ষেত্রে সংযম প্রথাটির চালু হয় এই সামাজিক মানসিকতা থেকেই। পরবর্তীতে ধর্মজাজকরা বিধবাদের উর্বরতাকে উৎপাদনক্ষম যাতে না হয়ে সেই জন্য নানা ধরনের উপবাসের ব্যবস্থা করেন। যেমন বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি অভিব্যক্তি হলো একাদশীর উপবাস। তবে বিধবার সংযম ও একাদশীতে উপবাস এর সঙ্গে অতীতের আম্বুবাচী পার্বণের পালন করা হতো কি না, তার সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নাই।
প্রাচীনকালে ফসল উঠার সময়ে কতক গুলি কৃষি উৎপাদন কেন্দ্রিক উৎসব পালন করা হত। এখনো পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতু উৎসব ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। এই পার্বনের রীতি এবং উপাচার গুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় ইতুকে মাতৃরূপে গণ্য করা হয়। ইতু পূজার বিষয় বস্তুতে দেখা যায়, ঘটের গায়ে পুতলী আঁকা এবং ভেতরে শস্যধানা ও তৃণগুচ্ছ। এটা মাতৃ প্রতীক আর প্রতিকী শস্য ক্ষেত্র। নৃতাত্ত্বিক জেমস ফ্লেজার সারা পৃথিবীর শস্য উৎসবকে একই ধরনের দেখেছেন। তাই তিনি শস্য উৎসবের নাম দিয়েছেন গার্ডেন অব অ্যাডোনিস।
বাংলা জনপদে কার্তিক সংক্রান্তি থেকে শুরু করে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি রোববার এই ইতি পুজো করা হয়। কারণ এই সময়টা ধরণি শস্য ভরাক্রান্ত। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে ফসল ঘরে উঠার পর ইতুর ঘট ভাসিয়ে দেয়ার রীতি, এই পার্বণটিকেও মাতৃকারূপে সূচিত করে। তবে এই পার্বনটিতেই নবান্ন উৎসব পালিত হয়। নবান্ন উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা তিথি নেই। জমির ফসল গোলাজাত করার যে কোন সময় এই উৎসব পালন করা যায়।
পঞ্জিকার মতে শুভ সময় দেখে নারীরা নবান্ন মাখেন। অর্থাৎ নবান্নের খাবার তৈরি করেন। এই সময়টায় নারীদের মাঝে দেবীগুণটির প্রভাব থাকে। তাই খাদ্যগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। এর জন্যই নারীরা শুচি¯িœগ্ধ হওয়াটা জরুরি। তাই নারীরা ¯œান করে পবিত্র হয়ে তারা খাদ্য তৈরি করেন। বিশেষ বিশেষ শারীরিক অবস্থায় দেবী পবিত্রতা আরোপ করবার কারণে নবান্ন স্পর্শ করার বিষয়ে ধর্মীয় সংস্কার রয়েছে। অশুচি অবস্থ্য় নবান্নের খাবার র্ষ্পশ করাটা পাপ। অন্য কেউ তুলে মুখে দিলে তা গ্রহন করতে বাধা নেই, এক্ষেত্রে শারীরিক শুচিতা অশুচিতা কোন বিষয় না।
নবান্নের পাওয়া চাল থেকে খাদ্য তৈরী করা হয়। বিভিন্ন টোটেম ভাবনা মতে পূর্বপুরুষেরা কাক হয়ে ঐ সময় ধরণীতে আসে। তাই নবান্নের ধান, নতুন গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরি খাবার রন্ধন শেষে কাকদেরকে দেয়া হয়। পূর্ব পুরুষের আতœা নবান্নের খাবার গ্রহণ করে গেলে বাকি খাদ্যটা প্রসাদরূপে গণ্য করা হয়ে থাকে। এখানে মূল ব্যাপারটা হলো দেবতার প্রসাদ ও দেব কল্পটি নবান্নের ভুল ভাবনা। এই ধরনের সংস্কারটা সত্যিই দুর্লভ। পিতৃ শ্রাদ্ধের বিষয়টি ছাড়া বাকি সব প্রথাগুলো নারী কর্তৃক পালনীয়। নবান্নের মাধ্যমে যে পিতৃশ্রাদ্ধ হয় তাতে কোন পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। তাই এখন যে নবান্নের শ্রাদ্ধ সচরাচর হয়ে থাকে তাতে কোন পুরোহিত থাকে না।
মহালয়ার তর্পণের সঙ্গে নবান্নের ভাব সাযুজ্য খুজে পাওয়া যায়। নবান্নের সঙ্গে আরেকটি পার্বণ হতে দেখা যায় তা হলো পৌষ সংক্রান্তি। তবে জমি থেকে ফসল ঘরে তোলার সময় উৎসব পালনের রেওয়াজটি সারা বিশ্বে প্রচলিত। কারণ পৃথিবীর সভ্যতার বিকাশ কৃষি আবাদের মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই উৎসবটি পালন করে আসছে। বাংলা জনপদের সমতলের আধিবাসী হল সাঁওতাল। সাওতাল আধিবাসীরা নবান্নকে বলেন লবান। সাঁওতাতালরা নবান্নান উৎসবটি পালন করেন প্রতি বছর ১৭ নভেম্বর। দিনটি কার্তিক মাসের শেষ দিকের। সাঁওতালী পঞ্জিকা মতে এই দিনটি পালন করা হয়। তা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে নানা ধরনের আধিবাসী রয়েছেন । তাদের পঞ্জিকামতে নবান্ন এবং আম্বুবাচী উৎসব পালন করা হয়। তবে এই উপমহাদেশের পঞ্জিকা গুলো সৌর পঞ্জিকা। সৌরমতে পঞ্জিকা গুলোর দিনক্ষণ গননা করা হয়। সেই জন্য এর একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন পঞ্জিকা থাকলেও পঞ্জিকার সময়গত পার্থকটা তেমন নেই বলেই চলে।
তবে আব্রাহামীয় ধর্ম গুলোর প্রচলন শুরু হয় প্রায় তিন হাজার বছর আগে। বর্তমানে আব্রাহামীয় তিনটি ধর্ম সারা বিশ্বের বৃহৎ জনগােষ্ঠি পালন করে আসছে। ধর্ম তিনটি হলো, ইহুদি, খৃষ্টান এবং ইসলাম। আব্রাহামীয় ধর্মের প্রচলনটা শুরু হয় মূলত সভ্যতার আধুনিকালেই। যদিও আব্রাহামীয় ধর্মগুলো সামন্তবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে তবে তারা পরোক্ষভাবে ধর্মের বাতাবরণে রাজ্যর কর্তৃত্ব কায়েমের লক্ষে ধর্মযাজকরা ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। তারা সামাজিক কিছু প্রথা চালু করেন যা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের সংস্কৃতি হিসাবে রূপ পায়। এই প্রথাগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষকে সামাজিক জীবন প্রণালির দিক নির্দেশনা দেয়া হয়।
আব্রাহামীয় ধর্মের আবির্ভাবের আগে বিশ্বে প্রায় টোটেম আরাধনা হতো। আর এই টোটেমের সংখ্যা কত ছিল তা বলা যায় না। প্রায় লক্ষাধিক ধর্মের পালনের মধ্য দিয়ে নানা টোটেমের আরাধনা করত মানুষ। তাই গোত্র , গোষ্ঠি কেন্দ্রীক মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা গুলোর ভিন্নতা দেখা যায়। আব্রাহামীয় ধর্ম গুলোর প্রচারের ফলে গোত্র, কৌম ও গোষ্ঠীর মাঝে ঐক্য বা মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়। ফলে বিশাল এলাকা বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোত্রগুলো একত্রিত হয় যায় ধর্ম পালনের ঐক্যতায়। তবে এই ধর্মগুলো নারীর সেই মহাশক্তিটাকে বিশেষ আমলে নেয়নি তাই এখানে নারীর আরাধনাটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এভাবেই নারী সমাজের মূলকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে সরে যায়। বর্তমানে প্রায় অর্ধেকের মতো মানুষ এখনও সনাতন (প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস) ধর্ম পালন করে আসছে। এখানে সনাতন ধর্ম বলতে শুধু হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের বোঝানো হয়নি।
সনাতনী ধর্ম ভাবনার ও প্রথার হয়েছে নানা সংস্কার। মানবজাতির উদ্ভবকাল থেকে আজ অবধি ধর্মগুলোতে এসেছে নানা ধরনের বিবর্তন। বির্বতনের ফলে যে পরির্বতনগুলোর হয়েছে তা অনেকটাই সুপ্তভাবে যাকে বলা যায় স্লো পয়জনিংয়ের মতো। তবে আব্রাহামীয় ধর্ম তিনটিতে গোড়ামির প্রভাবটা অন্য ধর্মের চেয়ে একটু বেশি। এই ধর্ম তিনটির প্রচারক ও ধর্ম পালনকারীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। ফলে এই ধর্মের মানুষগুলোর মানসিকতায় মৌলবাদটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর উৎপত্তি মূলত আরব অঞ্চলে। আব্রাহামীয় ধর্মের প্রচারকরা পৃথিবীদের বিভিন্ন অঞ্চলের আরব অঞ্চলের রীতিনীতি, প্রথার ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়। মানুষ সনাতন মানে আদি ধর্মীয় ব্যবস্থা থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার করণে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়। গোত্র ভিত্তিক সৃষ্ট সংস্কৃতি বা প্রথাগুলোর হয় নানা ধরনের পরির্বতন। নব ধর্মে দিক্ষীত মানুষগুলো অধিকতর পুণ্যের মোহে তার শেকড়ের নিয়ম বা প্রথাগুলো আর মানতে চায় না। ধর্মযাজকরা পরকালের মোহে তাদেরকে আবিষ্ট করে তোলে।
ধর্ম প্রচারকরা বলতে থকেন যে, ধর্মান্তরিত হয়ে যারা নব দীক্ষা গ্রহণ করেছে তারা যদি নিজস্ব সংস্কৃতিা পালন করেন তা হবে তাদের জন্য পাপ কাজ। এই পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। ফলে টোটেম থেকে নব ধর্মের দীক্ষিতরা ধর্মীয় সংস্কৃতিা পালন করতে শুরু করে। তার প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত বা আহরিত মুল সংস্কৃতিা থেকে সে সরে যায়। ধর্মের বাতাবরণে অনুপ্রবেশ ঘটে ভিন দেশীয় সংস্কৃতির। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির এভাবেই প্রবাহমান নদীটির ধারাটি ক্ষীনকার হয়ে যায়। এত শত কিছুর পরও মানুষের মনে থেকে যায় আদি সংস্কৃতির কথা। আজ থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের উপস্থিতি অর্থ্যাৎ দ্ধিপদ মানুষের বসবাস ছিল এই উপমহাদেশে। তার প্রমান পাওয়া যায় নৃত্বাত্বিক ভদ্দার এর মতে। মুরজানি এট আলে এতদ সর্ম্পকীত ভারত বর্ষে মানুষের অভিপ্রায়ন নিয়ে তিনটি মতামত দেন। তা হলো, এক. কৃষ্টির ৮০০০ থেকে ৯০০০ বছর আগে মানুষের অভিপ্রায়ন ঘটে, দুই. কৃষির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপীয়দের অভিপ্রায়ন ঘটে যা ৪৬০০ বছর আগে, তিন. ৩০০০ থেকে ৪০০০ বছর আগে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের অভিপ্রায়ন হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষের অভিপ্রায়ণের ফলে ভারত বর্ষের সংস্কৃতির ধারাটি নানা ভাবে পরির্বতিত হয়েছে। আধুনিক দুর্গাপুজা, ঈদ উৎসবসহ কিছু উৎসব যোগ হয়েছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে। ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটেছে পৃথীবির সবচেয়ে বেশি মানুষের সংমিশ্রণ। তাই জন্ম হয়েছে নতুন নতুন জাতির। পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ হিসাবে ভারতীয় উপমহাদের পরিচিত। তাই বলা হয়ে থাকে যা নাই ভূ ভারতে তা নাই এ জগতে। ভারতীয় উপমহাদেশটি বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নামে পরিচিত। এই উপমহাদেশে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান অবস্থিত।
উল্লেখযোগ্য প্রতœতাত্ত্বিক নথির অভাবের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসরত সাঁওতাল আদিবাসীদের জন্মভূমি নিশ্চিত করা যায় না। তবে ভাষাবিদ পল সিডওয়েলের মতে, অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা সম্ভবত প্রায় তিন থেকে চার হাজার বছর আগে ইন্দোচীন থেকে ওড়িষ্যা উপকূলে এসেছিল। অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসতি গড়ে তোলে, এরা স্থানীয় ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। সেই সময় মু-া ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। আর্যদের আগমনসহ প্রাচীন ভারতে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষের আগমন ঘটে । শেষ পর্যায়ে আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ঘটে মুসলিমদের আগমন। এ রকম নানা জাতি এসে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে সংস্কৃতিতে ঘটে নানা পরির্বতন। প্রচলন ঘটে নতুন নতুন সংস্কৃতির ধারা ও প্রথার। একমাত্র এই অঞ্চলের আদিবাসীরাই ধরে রেখেছে হাজার হাজার বছরের পুরোনো কিছু উৎসব।
বর্তমানে সমতলের আদিবাসীরা সাঁওতাল নামেই পরিচিত। এদেরকেই ধরে নেয়া হয় এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন আদি মানুষ। পাহাড়ের আধিবাসীদের আগমেন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়। সঁওতালদের সংস্কৃতিগত ধারাটির এখনও অপরিবর্তিত তবে শিশনারীর কারণে এরা নতুন সংস্কৃতির আবরণে বেষ্টিত হচ্ছে। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে কোনো ব্যাক্তি গোষ্ঠির বা ধর্মের মানুষ তা শনাক্তকরণের জন্য একমাত্র চিহ্ন ছিল উল্কি। এই উল্কি দেখেই তার গোত্র, জাত বা গোষ্ঠী নির্ণয় করা হতো। সাধারণত শরীরে উল্কির স্থান ছিল হাতের তালু, হাতের এপিঠ ওপিঠ, বুক, কপাল এমনকি গাল। শরীরে উল্কি হিসাবে আঁকা হতো লতাপাতা, পশুপাখি, সূর্য, চাঁদ, তারা প্রভৃতি। উল্কি আঁকার পূর্বে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি দেয়ার নিয়ম ছিল। অপদেবতার কোপানলে পরে উল্কির স্থানে যেন ঘা না হয়ে যায় সেই লক্ষ্যেও পূজা দেয়া হতো। প্রাচীনকালে বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্রগুলোর ছিল নানাবিধ ভাষা এবং কিছু কিছু গোত্রের ছিল হরফ। যা এখন রয়েছে আদিবাসীদের মাঝে। যা দিয়ে তারা সাহিত্য চর্চা করত। কালের বিবর্তনে এইসব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি হারাতে শুরু করেছে। তবে ভারত সরকার আদিবাসী ভাষা রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০০৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতের সংবিধানের ৯২তম সংশোধনীর দ্বারা সাঁওতালী চারটি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই চারটি ভাষা হলো, বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলী ও সাঁওতালি। সারা বিশ্বের সাঁওতাল ভাষাভাষীদের কাছে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২২ ডিসেম্বরকে সাঁওতালরা ভাষাদিবস হিসাবে পালন করে।
যদিও বর্তমানে আব্রাহামীয় খৃষ্টান ধর্মের খৃষ্টান মিশনগুলো সাঁওতালদের ধর্মান্তরিত করছে তারপরও এদের মাঝে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারার প্রথা ও উৎসব পালনের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। সাঁওতালদের রয়েছে নানা ধরনের শাখা প্রশাখা, এই শাখা প্রশাখা গুলোর কৃষ্টি কালচারের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। সাঁওতালদের মাঝ থেকে জীবন জীবিকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পেশায় গমন করায় সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন গোষ্ঠির। তাই সাঁওতালদের এই অঞ্চলের আদিবাসী বলে গণ্য করা হয়। সাঁওতালদের যে শাখাটি বাশের কাজে পারদর্শী হয়ে উঠে যে নতুন শাখার জন্ম দেয় তা হলো মাহালী। বাশের কাজ করা সাঁওতালরাই মাহালী নামে পরিচিত। মাহালি জনজাতির মানুষও বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত. প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব টোটেম অর্থাৎ উপাস্য দেবতা রয়েছে।
মাহালীদের বর্তমানে ১৩টি গোত্র ও টোটেম আছে, তারা হলো বাক্সে ( লাল নটের শাক) বেসরা (বাজ পাখি) হাঁদা (বুনো হাঁস) হেমব্রম (বাদাম) কিস্কু (মাছরাঙা), মা-ি (নীল চক্র নামে নীল পাখি) মুর্মু (শোল মাছ) সোরেন টুডু (মেঠো ইঁদুর), ছোরে (গিরগিটি), সামাহ (এক প্রকার ঘাস) পাহিরি (গোল কুমড়া) খাগড়া (ডোম কাক)। আবার এই তেরোটি গোত্রের প্রতিটির উপগোত্র রয়েছে। এই উপগোত্রগুলোকে খুট বলা হয়। মাহালীদের মাঝে সমজাতির মধ্যে ও গোত্রগুলোর মধ্যে বিবাহের প্রচলন আছে তবে বহু বিবাহের প্রচলন নেই। মাহালিদের নিজস্ব সামাজিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আছে। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মীয় উৎসব পালনসহ সামাজিক রীতিনীতি। মাহালীরা জীবজন্তু ও উদ্ভিদের পূজা করে আসছে। তবে গোত্রভিত্তিক পূজার আচরণিক ব্যবস্থাটি ভিন্ন হয়। মাহালীদের গৃহ দেবতা ওরাক বোঙা। গোত্র ভিত্তিতে ওরাক বোঙার উপাসনা পদ্ধদ্ধিতে রয়েছে ভিন্নতা। তবে দেবতার উদ্দেশ্যে মোরগ উৎসর্গ করে থাকে সবাই। গোত্রের ভিত্তিতে তারা ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের মোরগ দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়। তবে মাহালীদের মূল দেবতা হলো বন পাহাড়ি দেও ও মনসা দেবী।
সাঁওতালদের রীতিনীতি ও ধর্ম পালনের রয়েছে বিভিন্নতা । সাঁওতালদের ভাষায় তাদের দেবতা বোঙা। বোঙা দেবতাটি মাহালীদেরও। সাঁওতালরা প্রধান দেবতা হিসাবে চান্দোবোঙাকে (সুর্যদেব) মনে করে। ফসল উৎসবে প্রাচীনকালে ও বর্তমানে ইতু পূজা করা হয়। ইতু মানে রবি, রবির আরেক নাম সুর্য। যেহেতু সাঁওতালরা কৃষিজীবি তাই তারা প্রাচীন রীতি অনুসারে চান্দোবোঙাকে পুজা করে। সাঁওতাল জনজাতির মাঝে বহু প্রাচীন উৎসব পালনের প্রথা গুলো পরিলক্ষিত হয়। এদের অন্য দেবতা হল মারাং বুরু। সাঁওতালদের মাঝে ঋতু ভিত্তিক উৎসব পালনের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। বাংলা জনপদ ছয় ঋতুর অঞ্চল। প্রতিটি ঋতুতে এই অঞ্চলের প্রকৃতির পরির্বতন হয়। তাই এখানে প্রতিটি ঋতুতে নতুন নতুন ফুল,ফসল ফল জন্মায়। সাওতাওতালরা ভূমিপুত্র তাই ভূমি থেকে উৎপান্ন দ্রবাদি গ্রহণের সময় দেবতাকে এঁরা স্মরন করে। সাঁওতালদের ধর্ম ধারণা মতে মারাং বুরু মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। সাঁওতালদের গৃহদেবতা আবেগে বোংগা। সাওতালরা বিভিন্ন পূজা পার্বণে আনন্দে মেতে উঠে। সাঁওতালরে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির নিবিড় সর্ম্পক।
শীতের শেষে বসন্তে যখন ফুল ফুটে তখন তারা বাহা উৎসব পালন করে। বাহা উৎসব পালন না করে সাঁওতাল মেয়েদের খোপায় ফুল পরার নিয়ম নেই। সাওতালদের বার্ষিক উৎসবের নাম সোহরাই। প্রকৃতির ঋতু বদলের সঙ্গে এরা সাকরাত উৎসব পালন করে থাকে। সাওতালি ভাষা চর্চা ও বিকাশের গ্রন্থে পাওয়া যায়, সাওতাল জাতির মধ্যে প্রচলিত ধর্ম সর্ম্পকে। পরিমল হেমব্রম রচিত গ্রন্থটিতে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, সাঁওতাল জাতির মধ্যে মোট ১১টি ধর্ম রয়েছে, সেগুলো হলো সারি ধরম, সারনা ধরম, বাহা ধরম, খেওয়াড় ধরম , জাহের ধরম, মারাংবুরং ধরম, হাঁড়ি ধরম, চাঁদোবোঙা ধরম, যুগ ডাহার ধরম, সাধু ধরম এবং আদিবাসী ধরম। সাওতালদের কোন মন্দির বা উপসনালয় নেই। সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সোহরাই। সোহরাই উৎসবটি বাংলা পৌষ মাসে উদযাপিত হয়। অগ্রায়হনে ফসল গোলাজাত করার পর ঈশ্বরের সন্তুষ্টির পালন এবং আগামীতে অধিক ফসল ও পশুসম্পদ পাবার আশায় এই উৎসবটি সাঁওতালরা পালন করে থাকে।
খৃষ্টান মিশনারি আগ্রাসনের ফলে সাঁওতালদের ধর্মীয়, সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করছে পশ্চিমা ধারা। তাই ধারণা করা হচ্ছে এই জনপদের সর্বশেষ যে সংস্কৃতি ধারাটি সাঁওতালার লালন করে আসছিল তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গত এক হাজার বছর ধরে বাংলা জনপদে আগমন ঘটেছে নানা ধরনের ধর্মের, এই ধর্মগুলোর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিতে মিশে কিছু সংস্কৃতির প্রথা, যা এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও শস্য উৎপাদনের বিষয়ে সামঞ্জস্যহীন। আবহাওয়াগত কারণে এখানকার নারীরা শাড়ি পরত, নারীরা হিজাব পড়ত না। বর্তমানে ধর্মীয় কারণে হিজাব পোশাক সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হতে চলছে। দেখা যায় কারণে অকারণে পরির্বতন হয় সংস্কৃতির তবে মূল পরির্বতন ঘটে ধর্মীয় প্রভাবের ফলে। তাই এই বিষয়গুলোকে লক্ষ রেখে মূল সংস্কৃতির ধরাটাকে বজায় রাখা উচিত। একটি অঞ্চলের সংস্কৃতি হলো ঐ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। একে রক্ষা করা সবাইর নৈতিক দায়িত্ব।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী ]