alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

গৌতম রায়

: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

এপার বাংলায় বিভাগ পূর্ব যুগেও দশরথনন্দন রামকে নিয়ে তেমন কোনো আবেগ ছিল না। বিভাগ উত্তর যুগের এপার বাংলার, বাঙালি হিন্দুদের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনায় মধ্যকালীন ভারতের ভক্তি আন্দোলনের যে প্রভাব, তাকে নতুন করে সঞ্জীবিত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাছাড়াও পূর্ববঙ্গের, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ থেকে যে তরিকার উদ্ভব, সেই মতুয়া আন্দোলন, যেটি নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশীল, সেই চেতনার মধ্যেও কোনভাবেই দশরথনন্দন রামকে নিয়ে কোনোরকম বিশেষ আবেগ নেই।

বস্তুত বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈদিক চিন্তা প্রসূত যে ধর্ম, তার পাশাপাশি বৈষ্ণব বা শৈব চেতনার যে ভাবধারা, সেখানে কোথাও- দশরথনন্দন রামকে বিশেষ কোনোরকম জায়গাই রাখা হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও রামলালা ঘিরে একটি অধ্যায় আছে। সেটি তার সাধক জীবনের প্রথম পর্ব। উত্তর ভারতের কোনো সাধু দক্ষিণেশ্বরে আসেন। তার সঙ্গে ছিল সেই রামলালার ধাতব মূর্তি। যেটির সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের ছোট একটি অধ্যায়ের সংযোগ থাকলেও সেই রাম কিন্তু কখনই আরএসএস-বিজেপির যুদ্ধবাজ রাম ছিলেন না। রামলালা ছিলেন কৃষ্ণ ভক্তদের গোপালেরই মতো এক শিশু।

শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবনের যে ঘটনাবলী আমরা পাই, সেখানে কিন্তু শিশু রামেরই উপস্থিতি। আরএসএস বিজেপি যে তাদের দলীয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধবাজ রামকে উপস্থাপিত করে, সেই রামের সঙ্গে কখনো বাংলার আধ্যাত্মিক ধারার কোনো তরিকাই বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই।

ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ’৪৭ পরবর্তী সময়কাল থেকে কার্যত দশরথনন্দন রামকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে গণ্য করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মধারা পরিচালিত করে থাকে; কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে আরও বেশি করে সে শক্তিশালী করবার চেষ্টা করতেন, সেই সময়েও তিনি দশরথনন্দন রাম বা রাম নবমী ইত্যাদিকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করেননি।

আসলে শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের মন মানসিকতাকে অনেকখানি বোঝবার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি জানতেন যে, হিন্দি বলয়ে প্রচলিত কোনো ধর্মীয় উৎসব বা দেবদেবীকে যদি বাঙালি হিন্দুর মধ্যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়,সেটা বাঙালি হিন্দু কখনই মেনে নেবে না। এই রাজনৈতিক বোধের জায়গা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ,পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তারের লক্ষ্যে সব থেকে বড় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন মুসলমান বিদ্বেষ এবং মুসলমানদের সম্পর্কে সাধারণ হিন্দু, যারা সাম্প্রদায়িক নন, তাদেরও সাম্প্রদায়িক করে তোলবার প্রচেষ্টা।

পরবর্তী অনেককাল ধরেই শ্যামাপ্রসাদের এই রাজনৈতিক কৌশল বাংলার বুকে রাজনৈতিক হিন্দু ব্যক্তিত্বেরা পালন করে এসেছেন। এমনকি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে প্রথম অ কংগ্রেসি সরকার তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত এই রাম নবমীকে ঘিরে আমন্ত্রণ উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যায়নি।

রাম-নবমীকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অংশ করে তোলা হিন্দুত্ববাদী শক্তির বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অঙ্গ ছিল। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কর্মসূচি হিন্দুত্ববাদী শক্তির একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক কর্মসূচি। সেই লক্ষ্যে নিজেদের পরিচালিত করে রাষ্ট্রশক্তি দখলের দিকে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠনকে এগিয়ে দেওয়াই হল হিন্দুত্ববাদী শক্তির ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ঘিরে সমস্ত ধরনের ষড়যন্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য।

সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। বামপন্থিরা জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে আরএসএসের সংযোগ ঘিরে যথেষ্ট সাবধানে এবং ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চললেও স্বয়ং জয়প্রকাশ নারায়ন যেভাবে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে আরএসএস কে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তার ফলশ্রুতি হিসেবে দেশাই সরকারের ভিতরে আরএসএসের অবস্থান সম্ভব হয়েছিল।

এই অংশগ্রহণই রাম-নবমীকে ঘিরে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথ থেকে অনেক বেশি খুলে দিয়েছিল। ’৭৯ সাল থেকেই রাম-নবমীকে ঘিরে আরএসএসের ধ্বংসাত্মক অবস্থান শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে নিয়ে নানা ধরনের উত্তেজনা তৈরি করে, সহ-নাগরিক মুসলমান সমাজের ওপর সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং অবশ্যই শারীরিক আতঙ্কে একটা ভূগোলকে প্রলম্বিত করা।

এই ভূগোলকে প্রলম্বিত করবার কাজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণে হিন্দুত্ববাদী শক্তি শুরু করে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের খানিকটা বিপর্যয়ের পর থেকেই। অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক নীতি বিহীন সুবিধাবাদী জোটে সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান করা সত্ত্বেও এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে আরএসএস খুব একটা নজর দেয়নি। বিশেষ করে নিজেদের মস্তিষ্ক আর এস এস তাদের নানা ধরনের কর্মকা- পশ্চিমবঙ্গের বুকে ধীরে ধীরে এ সময়কালে বৃদ্ধি করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে শক্তিশালী করবার ক্ষেত্রে তখনো আরএসএস অতিমাত্রায় ভরসা করত তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি।

তৃণমূল কংগ্রেস এ সময়কালে যে ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে চলেছে তা প্রকারান্তে বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে একটা সুচারু পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ রকমের সাহায্যে সাহায্যবাহী। সেই কারণেই আরএসএস সেই সময়কালে মনে করতো, তাদের যে উত্তর ভারতের সংস্কৃতি নির্ভর রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেই কর্মসূচিগুলোকে পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় করে তোলবার ক্ষেত্র তখনো উপযুক্ত সময় আসেনি। সেই ক্ষেত্র প্রসারিত করবার জন্য এখন প্রয়োজন বামপন্থি সংস্কৃতির বিনাশ ঘটিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসের মাধ্যমে আরএসএসের সংস্কৃতিকে পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করা।

এ লক্ষ্যেই ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশীল থাকাকালীন মোহন ভাগবত, আরএসএস প্রধান, অর্থাৎ সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পরই খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কায়েম করতে শুরু করে। এই সময়কালে বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু প্রতিষ্ঠিত করাই নয়, বামফ্রন্টের বিকল্প হিসেবে তাকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে আরএসএস যেভাবে মমতাকে বা তার দলকে সাহায্য করেছে, সেটা কিন্তু ছিল নিজেদের স্বার্থে সঙ্ঘের একটা বৃহত্তর কৌশল।

আজ এই রাম-নবমী ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের যে ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক, সশস্ত্র একটা কর্মসূচি, আর তার পাল্টা হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের হনুমান জয়ন্তী, তাকে কেন্দ্র করে, ঠিক একই রকম ধ্বংসাত্মক আর সশস্ত্র কর্মসূচি তারই সলতে পাকানোর সময়। এই পরিবেশ রচনা করবার জন্যই ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বামফ্রন্টের তুলনামূলকভাবে ফলাফল খারাপ হওয়ার পর, কৌশল হিসেবে মমতা যে নিজেকে তথাকথিত ‘মুসলমান প্রেমী’ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে, সেই নীল নকশাটাও আরএসএসই মমতার উদ্দেশে তৈরি করে দিয়েছিল।

রাজ্য সরকারের লোকদেখানো ‘মুসলমান প্রীতির’ মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ণ হিন্দু এবং নিম্নবর্গীয় হিন্দু, যারা এককালে কোন না কোন কারণে অতীতের পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে চলে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে মুসলমানবিরোধী মানসিকতাকে উস্কে দেওয়াটাই ছিল লক্ষ্য। আর যে সমস্ত মানুষ বামপন্থি রাজনীতির মধ্যে থেকেও তাদের মধ্যে একটা দেশত্যাগ জনিত গোপন যন্ত্রণা আছে, সেই যন্ত্রণাকে মুসলমান বিদ্বেষে পরিণত করে, তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে টেনে আনাÑ এভাবেই হিন্দুত্বকে রাজ্যের মানুষদের একেবারে দহলিজ পেরিয়ে হেঁশেল পর্যন্ত ঠেলে দেওয়াটাই ছিল লক্ষ্য। সেদিকে নজর রেখেই আরএসএসের হাতের পুতুল হিসেবে তখন থেকে একটা লোকদেখানো মুসলমান প্রেম দেখাতে শুরু করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ঠিক আগে ২০১৩ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গকে পরিবর্তনের যে রাজনৈতিক সেøাগান ২০১১ সালের আগে তোলা হয়েছিল, সেই সেøাগানকে পর্যবসিত করা হয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক গবেষণাগারের সেøাগানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যেভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে মমতাকে মাধ্যম করে পশ্চিমবঙ্গে কর্মকা- শুরু করে আরএসএস তা থেকে এই অনুমানটাও তীব্র হয়ে ওঠে যে, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে তথাকথিত নাগরিক সমাজের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সেøাগান দেওয়া হয়েছিল, তার নীল নকশা প্রস্তুতেও কি আরএসএসের কোনো বড় রকমের ভূমিকা ছিল?

আজ হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতিকে বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে ভয়াবহ সামাজিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় যে রঘুবীর শিলা নিত্য পূজা রচনা করতেন, সেই শিলাকেও গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর, অসমাপ্ত মন্দির তৈরি করে তার মধ্যে যে পাথরের মূর্তি স্থাপন করেছে হিন্দুত্ববাদীরা তার সঙ্গে। এই পাথরের মূর্তিই হলো একমাত্র দশরথনন্দন রাম এভাবেই মন্দির ভেঙে মসজিদের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় হিন্দুত্ববাদীরা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

গৌতম রায়

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

এপার বাংলায় বিভাগ পূর্ব যুগেও দশরথনন্দন রামকে নিয়ে তেমন কোনো আবেগ ছিল না। বিভাগ উত্তর যুগের এপার বাংলার, বাঙালি হিন্দুদের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনায় মধ্যকালীন ভারতের ভক্তি আন্দোলনের যে প্রভাব, তাকে নতুন করে সঞ্জীবিত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাছাড়াও পূর্ববঙ্গের, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ থেকে যে তরিকার উদ্ভব, সেই মতুয়া আন্দোলন, যেটি নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশীল, সেই চেতনার মধ্যেও কোনভাবেই দশরথনন্দন রামকে নিয়ে কোনোরকম বিশেষ আবেগ নেই।

বস্তুত বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈদিক চিন্তা প্রসূত যে ধর্ম, তার পাশাপাশি বৈষ্ণব বা শৈব চেতনার যে ভাবধারা, সেখানে কোথাও- দশরথনন্দন রামকে বিশেষ কোনোরকম জায়গাই রাখা হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও রামলালা ঘিরে একটি অধ্যায় আছে। সেটি তার সাধক জীবনের প্রথম পর্ব। উত্তর ভারতের কোনো সাধু দক্ষিণেশ্বরে আসেন। তার সঙ্গে ছিল সেই রামলালার ধাতব মূর্তি। যেটির সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের ছোট একটি অধ্যায়ের সংযোগ থাকলেও সেই রাম কিন্তু কখনই আরএসএস-বিজেপির যুদ্ধবাজ রাম ছিলেন না। রামলালা ছিলেন কৃষ্ণ ভক্তদের গোপালেরই মতো এক শিশু।

শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবনের যে ঘটনাবলী আমরা পাই, সেখানে কিন্তু শিশু রামেরই উপস্থিতি। আরএসএস বিজেপি যে তাদের দলীয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধবাজ রামকে উপস্থাপিত করে, সেই রামের সঙ্গে কখনো বাংলার আধ্যাত্মিক ধারার কোনো তরিকাই বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই।

ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ’৪৭ পরবর্তী সময়কাল থেকে কার্যত দশরথনন্দন রামকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে গণ্য করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মধারা পরিচালিত করে থাকে; কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে আরও বেশি করে সে শক্তিশালী করবার চেষ্টা করতেন, সেই সময়েও তিনি দশরথনন্দন রাম বা রাম নবমী ইত্যাদিকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করেননি।

আসলে শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের মন মানসিকতাকে অনেকখানি বোঝবার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি জানতেন যে, হিন্দি বলয়ে প্রচলিত কোনো ধর্মীয় উৎসব বা দেবদেবীকে যদি বাঙালি হিন্দুর মধ্যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়,সেটা বাঙালি হিন্দু কখনই মেনে নেবে না। এই রাজনৈতিক বোধের জায়গা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ,পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তারের লক্ষ্যে সব থেকে বড় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন মুসলমান বিদ্বেষ এবং মুসলমানদের সম্পর্কে সাধারণ হিন্দু, যারা সাম্প্রদায়িক নন, তাদেরও সাম্প্রদায়িক করে তোলবার প্রচেষ্টা।

পরবর্তী অনেককাল ধরেই শ্যামাপ্রসাদের এই রাজনৈতিক কৌশল বাংলার বুকে রাজনৈতিক হিন্দু ব্যক্তিত্বেরা পালন করে এসেছেন। এমনকি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে প্রথম অ কংগ্রেসি সরকার তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত এই রাম নবমীকে ঘিরে আমন্ত্রণ উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যায়নি।

রাম-নবমীকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অংশ করে তোলা হিন্দুত্ববাদী শক্তির বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অঙ্গ ছিল। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কর্মসূচি হিন্দুত্ববাদী শক্তির একটি অতি প্রাচীন রাজনৈতিক কর্মসূচি। সেই লক্ষ্যে নিজেদের পরিচালিত করে রাষ্ট্রশক্তি দখলের দিকে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠনকে এগিয়ে দেওয়াই হল হিন্দুত্ববাদী শক্তির ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ঘিরে সমস্ত ধরনের ষড়যন্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য।

সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। বামপন্থিরা জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে আরএসএসের সংযোগ ঘিরে যথেষ্ট সাবধানে এবং ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চললেও স্বয়ং জয়প্রকাশ নারায়ন যেভাবে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে আরএসএস কে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তার ফলশ্রুতি হিসেবে দেশাই সরকারের ভিতরে আরএসএসের অবস্থান সম্ভব হয়েছিল।

এই অংশগ্রহণই রাম-নবমীকে ঘিরে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথ থেকে অনেক বেশি খুলে দিয়েছিল। ’৭৯ সাল থেকেই রাম-নবমীকে ঘিরে আরএসএসের ধ্বংসাত্মক অবস্থান শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে নিয়ে নানা ধরনের উত্তেজনা তৈরি করে, সহ-নাগরিক মুসলমান সমাজের ওপর সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং অবশ্যই শারীরিক আতঙ্কে একটা ভূগোলকে প্রলম্বিত করা।

এই ভূগোলকে প্রলম্বিত করবার কাজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণে হিন্দুত্ববাদী শক্তি শুরু করে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের খানিকটা বিপর্যয়ের পর থেকেই। অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক নীতি বিহীন সুবিধাবাদী জোটে সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান করা সত্ত্বেও এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে আরএসএস খুব একটা নজর দেয়নি। বিশেষ করে নিজেদের মস্তিষ্ক আর এস এস তাদের নানা ধরনের কর্মকা- পশ্চিমবঙ্গের বুকে ধীরে ধীরে এ সময়কালে বৃদ্ধি করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে শক্তিশালী করবার ক্ষেত্রে তখনো আরএসএস অতিমাত্রায় ভরসা করত তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি।

তৃণমূল কংগ্রেস এ সময়কালে যে ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে চলেছে তা প্রকারান্তে বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে একটা সুচারু পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ রকমের সাহায্যে সাহায্যবাহী। সেই কারণেই আরএসএস সেই সময়কালে মনে করতো, তাদের যে উত্তর ভারতের সংস্কৃতি নির্ভর রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেই কর্মসূচিগুলোকে পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় করে তোলবার ক্ষেত্র তখনো উপযুক্ত সময় আসেনি। সেই ক্ষেত্র প্রসারিত করবার জন্য এখন প্রয়োজন বামপন্থি সংস্কৃতির বিনাশ ঘটিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসের মাধ্যমে আরএসএসের সংস্কৃতিকে পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করা।

এ লক্ষ্যেই ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশীল থাকাকালীন মোহন ভাগবত, আরএসএস প্রধান, অর্থাৎ সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পরই খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কায়েম করতে শুরু করে। এই সময়কালে বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু প্রতিষ্ঠিত করাই নয়, বামফ্রন্টের বিকল্প হিসেবে তাকে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে আরএসএস যেভাবে মমতাকে বা তার দলকে সাহায্য করেছে, সেটা কিন্তু ছিল নিজেদের স্বার্থে সঙ্ঘের একটা বৃহত্তর কৌশল।

আজ এই রাম-নবমী ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের যে ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক, সশস্ত্র একটা কর্মসূচি, আর তার পাল্টা হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের হনুমান জয়ন্তী, তাকে কেন্দ্র করে, ঠিক একই রকম ধ্বংসাত্মক আর সশস্ত্র কর্মসূচি তারই সলতে পাকানোর সময়। এই পরিবেশ রচনা করবার জন্যই ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বামফ্রন্টের তুলনামূলকভাবে ফলাফল খারাপ হওয়ার পর, কৌশল হিসেবে মমতা যে নিজেকে তথাকথিত ‘মুসলমান প্রেমী’ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে, সেই নীল নকশাটাও আরএসএসই মমতার উদ্দেশে তৈরি করে দিয়েছিল।

রাজ্য সরকারের লোকদেখানো ‘মুসলমান প্রীতির’ মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ণ হিন্দু এবং নিম্নবর্গীয় হিন্দু, যারা এককালে কোন না কোন কারণে অতীতের পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে চলে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে মুসলমানবিরোধী মানসিকতাকে উস্কে দেওয়াটাই ছিল লক্ষ্য। আর যে সমস্ত মানুষ বামপন্থি রাজনীতির মধ্যে থেকেও তাদের মধ্যে একটা দেশত্যাগ জনিত গোপন যন্ত্রণা আছে, সেই যন্ত্রণাকে মুসলমান বিদ্বেষে পরিণত করে, তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে টেনে আনাÑ এভাবেই হিন্দুত্বকে রাজ্যের মানুষদের একেবারে দহলিজ পেরিয়ে হেঁশেল পর্যন্ত ঠেলে দেওয়াটাই ছিল লক্ষ্য। সেদিকে নজর রেখেই আরএসএসের হাতের পুতুল হিসেবে তখন থেকে একটা লোকদেখানো মুসলমান প্রেম দেখাতে শুরু করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ঠিক আগে ২০১৩ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গকে পরিবর্তনের যে রাজনৈতিক সেøাগান ২০১১ সালের আগে তোলা হয়েছিল, সেই সেøাগানকে পর্যবসিত করা হয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক গবেষণাগারের সেøাগানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যেভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে মমতাকে মাধ্যম করে পশ্চিমবঙ্গে কর্মকা- শুরু করে আরএসএস তা থেকে এই অনুমানটাও তীব্র হয়ে ওঠে যে, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে তথাকথিত নাগরিক সমাজের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সেøাগান দেওয়া হয়েছিল, তার নীল নকশা প্রস্তুতেও কি আরএসএসের কোনো বড় রকমের ভূমিকা ছিল?

আজ হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতিকে বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে ভয়াবহ সামাজিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় যে রঘুবীর শিলা নিত্য পূজা রচনা করতেন, সেই শিলাকেও গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর, অসমাপ্ত মন্দির তৈরি করে তার মধ্যে যে পাথরের মূর্তি স্থাপন করেছে হিন্দুত্ববাদীরা তার সঙ্গে। এই পাথরের মূর্তিই হলো একমাত্র দশরথনন্দন রাম এভাবেই মন্দির ভেঙে মসজিদের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় হিন্দুত্ববাদীরা।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top