alt

উপ-সম্পাদকীয়

মুখপাত্রদের তৈরি নয়, ‘তলাপাত্র’দের তৈরি জোট প্রসঙ্গে

গৌতম রায়

: শনিবার, ১১ মে ২০২৪

ভারতের চলতি লোকসভা নির্বাচনের (২০২৪) তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হলো। এই তৃতীয় পর্ব ঘিরে কার্যত বলা যেতে পারে, আগামী ভারতের শাসনতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সমীকরণের একটা দিকনির্দেশকারী অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে তৃতীয় পর্বের ভোট। ভারতের শাসক, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, ভোট পর্ব শুরু হওয়ার আগে যেভাবে ৪০০ আসন অতিক্রম করার শিবাকীর্তনজুড়ে ছিল, ভোটপর্ব যতই এগোচ্ছে, তাদের সেই শিবারব একেবারে পীপিলিকার মতো মৃদুমন্থর নিঃশব্দ পদচারণায় পর্যবশিত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে গরিব-গুর্বো মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষ, তপশিলি জাতিÑ উপজাতিভুক্ত মানুষ, তারা এখন আবার বাম কংগ্রেসের যে একটা গণতান্ত্রিক আসন সমঝোতা হয়েছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে, তারা যে সম্মিলিতভাবে এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সাধারণ মানুষ সেই দিকেই ঢলতে শুরু করেছেন। এই জায়গাটি মমতা উপলব্ধি করে, তৃতীয় দফার নির্বাচনের আগে, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রচারে গিয়ে সেখানকার কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্টের সিপিআই (এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে ‘বাজপাখি’ বলে যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, তার থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, মানুষের মেজাজ, বিশেষ করে গরিব মানুষের মেজাজ, না খেতে পাওয়া মানুষের মেজাজÑ এটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কার্যত সম্পূর্ণভাবেই নিজের মানসিক স্থিরতা (যদিও সেটা কখনো ছিল কিনা এটা তর্ক-সাপেক্ষ বিষয়) সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে চলতি লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এখানকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছেন, সিপিএমের লোক দেখলে থাপ্পড় মারুন। একজন প্রশাসকের মুখে এই ধরনের ভয়ংকর প্ররোচনামূলক কথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আগে কখনো শোনেনি। আসলে বাম- কংগ্রেস একত্রিত হয়ে নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পর এই রাজ্যে সাধারণ মানুষ যেভাবে নির্বাচনী প্রচারকালে একত্রিত হয়েছে এবং নির্বাচনব্যবস্থাতে কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলের বা বিজেপির গু-ামি, ভোট লুট, ইভিএম মেশিন লুট, ভুয়া ভোটারÑ এগুলো কার্যত এই তৃতীয় দফার নির্বাচনে রুখে দিয়েছে, তাই তৃতীয় দফার যে চারটি কেন্দ্রে লোকসভার ভোট হলো; মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর, মালদা উত্তর এবং দক্ষিণ আর ভগবানগোলাত্রে বিধানসভার উপনির্বাচন, তার প্রত্যেকটিতে তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ধরে নিয়ে, এইভাবে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সরাসরি ওরা হিংসার উসকানি দিল।

বামপন্থিদের জয়যুক্ত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সমাজের গরিবগুর্বো, খেটে খাওয়া মানুষ, মুসলমান সম্প্রদায়, তপশিলি জাতি-উপজাতিসহ সমস্ত পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ বিশেষ রকমের অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন রুটি রুজি সুনিশ্চিত থাকবে বামপন্থিদের দ্বারাই। সংখ্যালঘু মুসলমানরা এ কারণেই বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছিল ধারাবাহিকভাবে যে, বামফ্রন্টের আমলে কখনো দাঙ্গা হয় না পশ্চিমবঙ্গে। দাঙ্গার পরিবেশ যদি সাম্প্রদায়িক শক্তি তৈরি করে, তাহলে প্রশাসন তার নিজের সমস্ত রকমের শক্তি প্রয়োগ করে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন, দাঙ্গাবাদের মাথা ভেঙে দেব।

এই সমস্ত পরিস্থিতি বিচার করেই আরএসএস পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ, গরিবগুর্ব মানুষ, সংখ্যালঘু মুসলমান, তপশিলি জাতি ও উপজাতি, এদের বিপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মমতাকে পরামর্শ দেয়, কাগজে-কলমে বিজেপি সঙ্গ ত্যাগ করে, নিজেকে মুসলমান সমাজের মসিহা হিসেবে তুলে ধরতে। পরামর্শ দেয় হাজি বিবির চরিত্রে অভিনয় করে, মোনাজাতের ভঙ্গিমায় ফটোশুট করে, মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করতে, যাতে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ, পিছিয়ে পড়া মানুষ, তারা বামপন্থীদের আর সমর্থন না করে।

আরএসএস খুব ভালোভাবেই জানে, তাদের উত্তর প্রদেশ, উত্তর ভারতের যে ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ সংস্কৃতি তা দিয়ে বাঙালির মন জয় করতে পারা যাবে না। তাই তারা একটা সময় যে মমতার মুখ দিয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ উচ্চারণ একটা সময়ে করত, তা নিয়ে খোদ সংসদের মধ্যে মমতা ভয়ংকর অসংসদীয় আচরণ পর্যন্ত করেছিলেন। এভাবে বাংলাদেশকে হেনস্তা করে, বাংলাদেশের হিন্দুদের, সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে একধরনের নিশ্চিন্ততার যে ধারাবাহিকতা চলে আসছিল, তাকে ব্যাহত করে।

আর তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্বেষ আর মুসলমান বিদ্বেষকে সমর্থক করে তোলে এই রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্যের পথ তাকে মসৃণ করাÑ মমতার এই সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কারিকুরি এখন মানুষের সামনে পরিষ্কার।

আজ যে ভারতের চলতি লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে, সেই সমঝোতাকে মোদিÑ মমতা ঠিক একই সুরে আক্রমণ করে চলেছেন। মোদি ঠিক যেভাবে জাতীয় স্তরে, ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারতে’র কথা বলছেন, নিজের বসংবদ শিল্পপতি আদানি, আম্বানি, যাদের হাতে তিনি কার্যত গত ১০ বছর ধরে ভারতটাকে বিক্রি করে দিয়েছেন, তাদেরকে এখন তিনি চাপিয়ে দিতে চাইছেন কংগ্রেস দলের হাতে। কারণ ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয়টা প্রকাশ্যে আসা আর এই বন্ডের সুযোগ সব থেকে বেশি বিজেপি এবং তৃণমূলের পাওয়ার ঘটনাটা প্রকাশ্যে আসাÑ একদম সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতির অত প্যাঁচ পায়জার বোঝেন না, তাদের মধ্যেও বিজেপি আর তৃণমূল সম্পর্কে তৈরি হয়েছে এক ভয়ংকর রকমের ঘৃণা।

তাই নেতাদের চাপিয়ে দেয়া কোনো জোট নয়, একেবারে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে থেকে যে দাবি উঠেছিল, সেই দাবিকে মর্যাদা দিয়ে কংগ্রেস আর বামপন্থীদের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। এটা দেখে মোদি-মমতা দুজনেই শিয়রে সংক্রান্তি অনুভব করছেন। বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নেয়া বনাম মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস বাম জোট প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের প্রচার পর্বে, এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা, দুহাতে পাকিয়ে একটা দুশো টাকার নোট সেলিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল; আমি ডিম বিক্রি করি। আজ গোটা দিনের বিক্রির টাকাটা তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি ভোটের কাজে লাগিও।

সাধারণ মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের এই আশীর্বাদ, এই ভালোবাসা, এই অপত্য স্নেহ, সেলিমসহ সমস্ত বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থীদের সংসদে যাওয়ার রাস্তাটা আরো মসৃণ করে দিচ্ছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মুখপাত্রদের তৈরি নয়, ‘তলাপাত্র’দের তৈরি জোট প্রসঙ্গে

গৌতম রায়

শনিবার, ১১ মে ২০২৪

ভারতের চলতি লোকসভা নির্বাচনের (২০২৪) তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হলো। এই তৃতীয় পর্ব ঘিরে কার্যত বলা যেতে পারে, আগামী ভারতের শাসনতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সমীকরণের একটা দিকনির্দেশকারী অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে তৃতীয় পর্বের ভোট। ভারতের শাসক, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, ভোট পর্ব শুরু হওয়ার আগে যেভাবে ৪০০ আসন অতিক্রম করার শিবাকীর্তনজুড়ে ছিল, ভোটপর্ব যতই এগোচ্ছে, তাদের সেই শিবারব একেবারে পীপিলিকার মতো মৃদুমন্থর নিঃশব্দ পদচারণায় পর্যবশিত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে গরিব-গুর্বো মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষ, তপশিলি জাতিÑ উপজাতিভুক্ত মানুষ, তারা এখন আবার বাম কংগ্রেসের যে একটা গণতান্ত্রিক আসন সমঝোতা হয়েছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে, তারা যে সম্মিলিতভাবে এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সাধারণ মানুষ সেই দিকেই ঢলতে শুরু করেছেন। এই জায়গাটি মমতা উপলব্ধি করে, তৃতীয় দফার নির্বাচনের আগে, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রচারে গিয়ে সেখানকার কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্টের সিপিআই (এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে ‘বাজপাখি’ বলে যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, তার থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, মানুষের মেজাজ, বিশেষ করে গরিব মানুষের মেজাজ, না খেতে পাওয়া মানুষের মেজাজÑ এটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কার্যত সম্পূর্ণভাবেই নিজের মানসিক স্থিরতা (যদিও সেটা কখনো ছিল কিনা এটা তর্ক-সাপেক্ষ বিষয়) সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে চলতি লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এখানকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছেন, সিপিএমের লোক দেখলে থাপ্পড় মারুন। একজন প্রশাসকের মুখে এই ধরনের ভয়ংকর প্ররোচনামূলক কথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আগে কখনো শোনেনি। আসলে বাম- কংগ্রেস একত্রিত হয়ে নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পর এই রাজ্যে সাধারণ মানুষ যেভাবে নির্বাচনী প্রচারকালে একত্রিত হয়েছে এবং নির্বাচনব্যবস্থাতে কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলের বা বিজেপির গু-ামি, ভোট লুট, ইভিএম মেশিন লুট, ভুয়া ভোটারÑ এগুলো কার্যত এই তৃতীয় দফার নির্বাচনে রুখে দিয়েছে, তাই তৃতীয় দফার যে চারটি কেন্দ্রে লোকসভার ভোট হলো; মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর, মালদা উত্তর এবং দক্ষিণ আর ভগবানগোলাত্রে বিধানসভার উপনির্বাচন, তার প্রত্যেকটিতে তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ধরে নিয়ে, এইভাবে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সরাসরি ওরা হিংসার উসকানি দিল।

বামপন্থিদের জয়যুক্ত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সমাজের গরিবগুর্বো, খেটে খাওয়া মানুষ, মুসলমান সম্প্রদায়, তপশিলি জাতি-উপজাতিসহ সমস্ত পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ বিশেষ রকমের অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন রুটি রুজি সুনিশ্চিত থাকবে বামপন্থিদের দ্বারাই। সংখ্যালঘু মুসলমানরা এ কারণেই বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছিল ধারাবাহিকভাবে যে, বামফ্রন্টের আমলে কখনো দাঙ্গা হয় না পশ্চিমবঙ্গে। দাঙ্গার পরিবেশ যদি সাম্প্রদায়িক শক্তি তৈরি করে, তাহলে প্রশাসন তার নিজের সমস্ত রকমের শক্তি প্রয়োগ করে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন, দাঙ্গাবাদের মাথা ভেঙে দেব।

এই সমস্ত পরিস্থিতি বিচার করেই আরএসএস পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ, গরিবগুর্ব মানুষ, সংখ্যালঘু মুসলমান, তপশিলি জাতি ও উপজাতি, এদের বিপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মমতাকে পরামর্শ দেয়, কাগজে-কলমে বিজেপি সঙ্গ ত্যাগ করে, নিজেকে মুসলমান সমাজের মসিহা হিসেবে তুলে ধরতে। পরামর্শ দেয় হাজি বিবির চরিত্রে অভিনয় করে, মোনাজাতের ভঙ্গিমায় ফটোশুট করে, মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করতে, যাতে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ, পিছিয়ে পড়া মানুষ, তারা বামপন্থীদের আর সমর্থন না করে।

আরএসএস খুব ভালোভাবেই জানে, তাদের উত্তর প্রদেশ, উত্তর ভারতের যে ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’ সংস্কৃতি তা দিয়ে বাঙালির মন জয় করতে পারা যাবে না। তাই তারা একটা সময় যে মমতার মুখ দিয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ উচ্চারণ একটা সময়ে করত, তা নিয়ে খোদ সংসদের মধ্যে মমতা ভয়ংকর অসংসদীয় আচরণ পর্যন্ত করেছিলেন। এভাবে বাংলাদেশকে হেনস্তা করে, বাংলাদেশের হিন্দুদের, সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে একধরনের নিশ্চিন্ততার যে ধারাবাহিকতা চলে আসছিল, তাকে ব্যাহত করে।

আর তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্বেষ আর মুসলমান বিদ্বেষকে সমর্থক করে তোলে এই রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্যের পথ তাকে মসৃণ করাÑ মমতার এই সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কারিকুরি এখন মানুষের সামনে পরিষ্কার।

আজ যে ভারতের চলতি লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে, সেই সমঝোতাকে মোদিÑ মমতা ঠিক একই সুরে আক্রমণ করে চলেছেন। মোদি ঠিক যেভাবে জাতীয় স্তরে, ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারতে’র কথা বলছেন, নিজের বসংবদ শিল্পপতি আদানি, আম্বানি, যাদের হাতে তিনি কার্যত গত ১০ বছর ধরে ভারতটাকে বিক্রি করে দিয়েছেন, তাদেরকে এখন তিনি চাপিয়ে দিতে চাইছেন কংগ্রেস দলের হাতে। কারণ ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয়টা প্রকাশ্যে আসা আর এই বন্ডের সুযোগ সব থেকে বেশি বিজেপি এবং তৃণমূলের পাওয়ার ঘটনাটা প্রকাশ্যে আসাÑ একদম সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতির অত প্যাঁচ পায়জার বোঝেন না, তাদের মধ্যেও বিজেপি আর তৃণমূল সম্পর্কে তৈরি হয়েছে এক ভয়ংকর রকমের ঘৃণা।

তাই নেতাদের চাপিয়ে দেয়া কোনো জোট নয়, একেবারে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে থেকে যে দাবি উঠেছিল, সেই দাবিকে মর্যাদা দিয়ে কংগ্রেস আর বামপন্থীদের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছে। এটা দেখে মোদি-মমতা দুজনেই শিয়রে সংক্রান্তি অনুভব করছেন। বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নেয়া বনাম মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস বাম জোট প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের প্রচার পর্বে, এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা, দুহাতে পাকিয়ে একটা দুশো টাকার নোট সেলিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল; আমি ডিম বিক্রি করি। আজ গোটা দিনের বিক্রির টাকাটা তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি ভোটের কাজে লাগিও।

সাধারণ মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের এই আশীর্বাদ, এই ভালোবাসা, এই অপত্য স্নেহ, সেলিমসহ সমস্ত বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থীদের সংসদে যাওয়ার রাস্তাটা আরো মসৃণ করে দিচ্ছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top