alt

opinion » post-editorial

খাদ্য কেবল নিরাপদ হলেই হবে না, পুষ্টিকরও হতে হবে

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

দেশের খাদ্যনীতি, কৃষিনীতিতে খাদ্য উৎপাদনে যত জোর দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যক্তি পর্যায়ে অভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন দরকার। এছাড়া কন্যাশিশু ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের পুষ্টিজনিত অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো এবং এর মাধ্যমে উন্নত মানবসম্পদ হিসেবে তাদের তৈরি করার ওপরও গবেষণায় জোর দেয়া প্রয়োজন, যদিও এ বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ হচ্ছে। তাই আজ আলোচনা করব পুষ্টি নিয়ে।

পুষ্টি ও খাদ্য এমন দুটি শব্দ যার ব্যবহার প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে ঘটে চলছে। জন্ম থেকে শুরু হয়ে মৃত্যু অবধি চলতে থাকে। মানুষের তিনটি মৌলিক চাহিদার একটি হলো খাদ্য। আর এই খাদ্যের মূল অংশই হলো পুষ্টি। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতের উন্নয়নে সারাবিশ্বে রোল মডেল। ১৯৭৪ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠিত হয়। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় পুষ্টি পরিষদের উদ্যোগে প্রণীত হয়েছে জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ এবং দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা। এসব আইন ও নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ ও সফল প্রয়োগের মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত হবে।’

আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশের বাসিন্দা। তাই, শুধু খাদ্য খেলেই চলে না, সময় এসেছে পরীক্ষা করে দেখার যে খাদ্যটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর কি না। কেননা যদি পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য না হয়, তাহলে এটি খাওয়ার পর বিভিন্ন রোগের স্বীকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। একই সঙ্গে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

যে খাদ্য আমরা খেয়ে থাকি সেখান থেকে আমাদের দেহ সিদ্ধান্ত নেয় এর কোনো অংশটি কী পরিমাণে গ্রহণ করা হবে। যেমনÑ আপনি জেনে থাকবেন, খাদ্য খাওয়ার পর হজম প্রক্রিয়ার পর খাদ্যটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। একটি প্রয়োজনীয় বা সারঅংশ যা শরীর গ্রহণ করে নেয়, আর অন্যটি অপ্রয়োজনীয় অংশ যা শরীর বর্জন করে।

পরিপাক তন্ত্রে হজমের পর খাদ্যের সারঅংশ দেহ শোষণ করে নেয়Ñ যা থেকে আমরা কাজ করার শক্তি পাই, দেহে নতুন টিস্যু বা কোষ তৈরি হয়, দেহের ক্ষয় পূরণ হয় ইত্যাদি। আর এর সহজ উত্তর হলো হজমের পর খাদ্যের যে সারঅংশটুকু দেহে শোষিত হয়, তাই পুষ্টি। এটি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শক্তির জোগান দেয়। এছাড়া পুষ্টির বিভিন্ন উপাদান দেহের চলমান বায়ো-কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। যার ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধসহ দৈহিক বৃদ্ধি সাধন হয়।

পুষ্টির ধারাবাহিক ধাপগুলো হচ্ছেÑ খাদ্য গ্রহণ, হজম, শোষণ, রক্তের মাধ্যমে দেহের কোষসমূহে পরিবহন, কোষে আত্তিকরণ বা বিপকীয় কাজের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, তারপর অপ্রয়োজনীয় অংশের বর্জন।

আপনি যদি ভালো পুষ্টিসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেতে পারেন, তাহলে আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। অপুষ্টিজনিত অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমাতে পারেন।

দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ও অন্যান্য দৈহিক উন্নয়নের কাজে পুষ্টির গুরত্ব অপরিসীম। পুষ্টির অভাবের কারণে আমরা অনেক রোগের স্বীকার হতে পারি যেগুলোকে পুষ্টির অভাবজনিত রোগ বা ফবভরপরবহপু ফরংবধংব নামে অভিহিত করা হয়। এসব রোগের কারণে নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতার তৈরি হয়।

বর্তমান বিশ্বের পুষ্টিবিদরা ৫টি খাদ্য গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত খাদ্যকে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য হিসাবে অভিহিত করেছেন, যা সুষম খাদ্য হিসাবেও বিবেচিত।

এই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য আমাদের পুষ্টির অভাবজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগ থেকে রেহাই দিতে পারে। ওবেসিটি, কোলেস্টেরল, হাই ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে এই পুষ্টি সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাদ্য।

পুষ্টির ছয়টি উপাদান থাকে। শরীরে এই প্রতিটি উপাদানের চাহিদা এক রকম নয়। বিভিন্ন রোগব্যাধির সংক্রমণ, শরীরের গঠন প্রকৃতি এবং দৈহিক পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে আমাদের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের চাহিদা ভিন্নরূপ হয়।

পানি দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের হারের জয়েন্টের লুব্রিকেন্টের মতো কাজে সাহয্য করে। শরীরের বর্জ অপসারণে কাজ করে।

খাদ্য হজম, শোষণ এবং পরিবহনে কাজ করে।

উপরের আলোচনা থেকে পুষ্টি উপাদানের ওপর আমরা বেশ সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা পেলাম।

তবে দেহে শক্তি বা ক্যালরি উৎপাদনের সক্ষমতা বিবেচনায় দেখা যায় যে, এই উপাদানের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট থেকে আমাদের দৈনিক ক্যালরি চাহিদার শতকরা প্রায় ৮৫% পুরা হয় এবং প্রোটিন থেকে পুরা হয় ১৫%।

পুষ্টি কত প্রকার ও কি কি?

ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস মানুষ ও জীবন্ত প্রাণির খাদ্যের মূল উপাদান, যা বেঁচে থাকার শক্তি ও পুষ্টি অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণে খেতে হয়। এদের উদাহারণ হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্য।

কার্বোহাইড্রেট হচ্ছে সুগার, স্টার্চ বা শ্বেতসার এবং ফাইবার এই জাতিয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। সুগার হল সরল বা সিম্পল কার্বোহাইড্রেট যা পাকস্থলীতে পৌঁছার পর খুব সহজেই ভেঙে গিয়ে শরীরে শোষণ হয়। এদের থেকে শক্তি খুব দ্রুত পাওয়া যায়। কিন্তু এটি খেলে ক্ষুধা থেকে যায়। পেট ভরা অনুভূতি তৈরি হয় না। বরং, সুগার খাওয়ার ফলে রক্তে এর মাত্রা বেড়ে যায়। এতে করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের ফাইবার অংশের কিছু পরিমাণ পাকস্থলিতে ভেঙে যায়, যা দেহে শোষিত হয়ে শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগে। আর এক অংশ পরিপাকতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যাক্টেরিয়া বিপাকিয় কাজে ব্যবহার করে। অবশিষ্ট অংশ দেহ পরিত্যাগ করে। স্টার্চ হলো এক প্রকার কমপ্লেক্স বা জটিল ধরনের কার্বোহাইড্রেট। ফাইবার সমৃদ্ধ স্টার্চ জাতীয় খাদ্য পাকস্থলিতে সহজে হজম হতে পারে না। ফলে দির্ঘক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুধা লাগার অনুভূতি তৈরি হয় না। ফাইবার বিশিষ্ট খাদ্য ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

প্রোটিনকে বাংলায় আমিষ জাতীয় খাদ্য বলা হয়। পুষ্টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন খুব গুরত্বপূর্ণ এক উপাদান। প্রায় ২০টি এমাইনো এসিড একটি অন্যটির সঙ্গে চেইন আকারে আবদ্ধ হয়ে প্রোটিন গঠিত হয়। যার মধ্যে ৯টি হলো প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড যা আমাদের দেহে তৈরি হতে পারে না। ফলে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাহির থেকে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে এর অভাব পূরণ করতে হয়।

কিছু কিছু ভিটামিন আমাদের দেহে শোষণ হতে হলে ফ্যাট বা চর্বির উপস্থিতি প্রয়োজন। যেমনÑ ভিটামিন এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-কে। এই ভিটামিনগুলো আমাদের দেহের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। চর্বি জাতীয় খাদ্য না খেলে এই ভিটামিনসমূহ দেহে শোষণ হতে না পারায় এদের উপকারিতা থেকে আমরা বঞ্চিত হই।

এছাড়া দেহের আরও অন্যান্য প্রয়োজনে চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে কিছু কিছু ফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আবার কিছু ফ্যাট এমন আছে যারা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ফ্যাট জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পূর্বে আমাদের ভালোভাবে জেনে নেয়া প্রয়োজনÑ কোনো ধরনের ফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসও প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান, যা দেহের স্বাভাবিক সুস্থতা ও কাজ-কর্ম সম্পাদনের জন্য অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। এই ধরনের পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ, দেহের গঠন ও বৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জাতীয় পুষ্টির অভাবে দেহে অনেক ধরনের রোগ তৈরি হয়। এদের উদাহরণ হলো ভিটামিন ও মিনারেলস।

ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি খুব স্বল্প মাত্রায় প্রয়োজন হয়। তবে স্বল্প মাত্রায় প্রয়োজন হলেও এর অভাবজনিত কারণে বড় বড় স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়। সাধারণত : সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। এজন্য দৈনিকের খাদ্য তালিকায় শাক-সবজি ও ফলমূল অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের মধ্যে মিনারেলস বা খনিজ লবণ খুব স্বল্প পরিমাণে দেহে প্রয়োজন হয়। শাক-সবজি ও ফলমূলে খনিজ লবণ পাওয়া যায়। এছাড়া বাজারে বিভিন্ন ভিটামিন-মিনারেল সপ্লিমেন্ট রয়েছে। যেখান থেকে আপনি এর অভাব পূরণ করতে পারেন।

সঠিক পুষ্টি ছাড়া আমাদের দেহ সর্বোত্তমভাবে কাজ করতে অক্ষম। পর্যাপ্ত পুষ্টি আমাদের দেহকে বাড়িয়ে তোলে এবং বৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য এটি পুষ্ট করে তোলে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাবার সুষম পরিসরের রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় সঠিক পুষ্টি সরবরাহের জন্য সঠিক উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমনÑ শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট এবং ভিটামিন এবং খনিজ ও পানি। আমরা যদি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি এবং প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করিÑ যা আমাদের শরীরকে ইমিউন/রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

খাদ্য কেবল নিরাপদ হলেই হবে না, পুষ্টিকরও হতে হবে

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

দেশের খাদ্যনীতি, কৃষিনীতিতে খাদ্য উৎপাদনে যত জোর দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেছে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যক্তি পর্যায়ে অভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন দরকার। এছাড়া কন্যাশিশু ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের পুষ্টিজনিত অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো এবং এর মাধ্যমে উন্নত মানবসম্পদ হিসেবে তাদের তৈরি করার ওপরও গবেষণায় জোর দেয়া প্রয়োজন, যদিও এ বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ হচ্ছে। তাই আজ আলোচনা করব পুষ্টি নিয়ে।

পুষ্টি ও খাদ্য এমন দুটি শব্দ যার ব্যবহার প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে ঘটে চলছে। জন্ম থেকে শুরু হয়ে মৃত্যু অবধি চলতে থাকে। মানুষের তিনটি মৌলিক চাহিদার একটি হলো খাদ্য। আর এই খাদ্যের মূল অংশই হলো পুষ্টি। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতের উন্নয়নে সারাবিশ্বে রোল মডেল। ১৯৭৪ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠিত হয়। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় পুষ্টি পরিষদের উদ্যোগে প্রণীত হয়েছে জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ এবং দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা। এসব আইন ও নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ ও সফল প্রয়োগের মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত হবে।’

আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশের বাসিন্দা। তাই, শুধু খাদ্য খেলেই চলে না, সময় এসেছে পরীক্ষা করে দেখার যে খাদ্যটি নিরাপদ ও পুষ্টিকর কি না। কেননা যদি পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য না হয়, তাহলে এটি খাওয়ার পর বিভিন্ন রোগের স্বীকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। একই সঙ্গে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

যে খাদ্য আমরা খেয়ে থাকি সেখান থেকে আমাদের দেহ সিদ্ধান্ত নেয় এর কোনো অংশটি কী পরিমাণে গ্রহণ করা হবে। যেমনÑ আপনি জেনে থাকবেন, খাদ্য খাওয়ার পর হজম প্রক্রিয়ার পর খাদ্যটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। একটি প্রয়োজনীয় বা সারঅংশ যা শরীর গ্রহণ করে নেয়, আর অন্যটি অপ্রয়োজনীয় অংশ যা শরীর বর্জন করে।

পরিপাক তন্ত্রে হজমের পর খাদ্যের সারঅংশ দেহ শোষণ করে নেয়Ñ যা থেকে আমরা কাজ করার শক্তি পাই, দেহে নতুন টিস্যু বা কোষ তৈরি হয়, দেহের ক্ষয় পূরণ হয় ইত্যাদি। আর এর সহজ উত্তর হলো হজমের পর খাদ্যের যে সারঅংশটুকু দেহে শোষিত হয়, তাই পুষ্টি। এটি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শক্তির জোগান দেয়। এছাড়া পুষ্টির বিভিন্ন উপাদান দেহের চলমান বায়ো-কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। যার ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধসহ দৈহিক বৃদ্ধি সাধন হয়।

পুষ্টির ধারাবাহিক ধাপগুলো হচ্ছেÑ খাদ্য গ্রহণ, হজম, শোষণ, রক্তের মাধ্যমে দেহের কোষসমূহে পরিবহন, কোষে আত্তিকরণ বা বিপকীয় কাজের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, তারপর অপ্রয়োজনীয় অংশের বর্জন।

আপনি যদি ভালো পুষ্টিসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেতে পারেন, তাহলে আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। অপুষ্টিজনিত অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমাতে পারেন।

দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ও অন্যান্য দৈহিক উন্নয়নের কাজে পুষ্টির গুরত্ব অপরিসীম। পুষ্টির অভাবের কারণে আমরা অনেক রোগের স্বীকার হতে পারি যেগুলোকে পুষ্টির অভাবজনিত রোগ বা ফবভরপরবহপু ফরংবধংব নামে অভিহিত করা হয়। এসব রোগের কারণে নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতার তৈরি হয়।

বর্তমান বিশ্বের পুষ্টিবিদরা ৫টি খাদ্য গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত খাদ্যকে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য হিসাবে অভিহিত করেছেন, যা সুষম খাদ্য হিসাবেও বিবেচিত।

এই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য আমাদের পুষ্টির অভাবজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগ থেকে রেহাই দিতে পারে। ওবেসিটি, কোলেস্টেরল, হাই ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে এই পুষ্টি সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাদ্য।

পুষ্টির ছয়টি উপাদান থাকে। শরীরে এই প্রতিটি উপাদানের চাহিদা এক রকম নয়। বিভিন্ন রোগব্যাধির সংক্রমণ, শরীরের গঠন প্রকৃতি এবং দৈহিক পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে আমাদের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের চাহিদা ভিন্নরূপ হয়।

পানি দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের হারের জয়েন্টের লুব্রিকেন্টের মতো কাজে সাহয্য করে। শরীরের বর্জ অপসারণে কাজ করে।

খাদ্য হজম, শোষণ এবং পরিবহনে কাজ করে।

উপরের আলোচনা থেকে পুষ্টি উপাদানের ওপর আমরা বেশ সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা পেলাম।

তবে দেহে শক্তি বা ক্যালরি উৎপাদনের সক্ষমতা বিবেচনায় দেখা যায় যে, এই উপাদানের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট থেকে আমাদের দৈনিক ক্যালরি চাহিদার শতকরা প্রায় ৮৫% পুরা হয় এবং প্রোটিন থেকে পুরা হয় ১৫%।

পুষ্টি কত প্রকার ও কি কি?

ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টস মানুষ ও জীবন্ত প্রাণির খাদ্যের মূল উপাদান, যা বেঁচে থাকার শক্তি ও পুষ্টি অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণে খেতে হয়। এদের উদাহারণ হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্য।

কার্বোহাইড্রেট হচ্ছে সুগার, স্টার্চ বা শ্বেতসার এবং ফাইবার এই জাতিয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। সুগার হল সরল বা সিম্পল কার্বোহাইড্রেট যা পাকস্থলীতে পৌঁছার পর খুব সহজেই ভেঙে গিয়ে শরীরে শোষণ হয়। এদের থেকে শক্তি খুব দ্রুত পাওয়া যায়। কিন্তু এটি খেলে ক্ষুধা থেকে যায়। পেট ভরা অনুভূতি তৈরি হয় না। বরং, সুগার খাওয়ার ফলে রক্তে এর মাত্রা বেড়ে যায়। এতে করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের ফাইবার অংশের কিছু পরিমাণ পাকস্থলিতে ভেঙে যায়, যা দেহে শোষিত হয়ে শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগে। আর এক অংশ পরিপাকতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যাক্টেরিয়া বিপাকিয় কাজে ব্যবহার করে। অবশিষ্ট অংশ দেহ পরিত্যাগ করে। স্টার্চ হলো এক প্রকার কমপ্লেক্স বা জটিল ধরনের কার্বোহাইড্রেট। ফাইবার সমৃদ্ধ স্টার্চ জাতীয় খাদ্য পাকস্থলিতে সহজে হজম হতে পারে না। ফলে দির্ঘক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুধা লাগার অনুভূতি তৈরি হয় না। ফাইবার বিশিষ্ট খাদ্য ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

প্রোটিনকে বাংলায় আমিষ জাতীয় খাদ্য বলা হয়। পুষ্টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন খুব গুরত্বপূর্ণ এক উপাদান। প্রায় ২০টি এমাইনো এসিড একটি অন্যটির সঙ্গে চেইন আকারে আবদ্ধ হয়ে প্রোটিন গঠিত হয়। যার মধ্যে ৯টি হলো প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড যা আমাদের দেহে তৈরি হতে পারে না। ফলে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাহির থেকে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে এর অভাব পূরণ করতে হয়।

কিছু কিছু ভিটামিন আমাদের দেহে শোষণ হতে হলে ফ্যাট বা চর্বির উপস্থিতি প্রয়োজন। যেমনÑ ভিটামিন এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-কে। এই ভিটামিনগুলো আমাদের দেহের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। চর্বি জাতীয় খাদ্য না খেলে এই ভিটামিনসমূহ দেহে শোষণ হতে না পারায় এদের উপকারিতা থেকে আমরা বঞ্চিত হই।

এছাড়া দেহের আরও অন্যান্য প্রয়োজনে চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে কিছু কিছু ফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আবার কিছু ফ্যাট এমন আছে যারা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ফ্যাট জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পূর্বে আমাদের ভালোভাবে জেনে নেয়া প্রয়োজনÑ কোনো ধরনের ফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসও প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান, যা দেহের স্বাভাবিক সুস্থতা ও কাজ-কর্ম সম্পাদনের জন্য অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়। এই ধরনের পুষ্টি উপাদান বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ, দেহের গঠন ও বৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জাতীয় পুষ্টির অভাবে দেহে অনেক ধরনের রোগ তৈরি হয়। এদের উদাহরণ হলো ভিটামিন ও মিনারেলস।

ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি খুব স্বল্প মাত্রায় প্রয়োজন হয়। তবে স্বল্প মাত্রায় প্রয়োজন হলেও এর অভাবজনিত কারণে বড় বড় স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়। সাধারণত : সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। এজন্য দৈনিকের খাদ্য তালিকায় শাক-সবজি ও ফলমূল অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের মধ্যে মিনারেলস বা খনিজ লবণ খুব স্বল্প পরিমাণে দেহে প্রয়োজন হয়। শাক-সবজি ও ফলমূলে খনিজ লবণ পাওয়া যায়। এছাড়া বাজারে বিভিন্ন ভিটামিন-মিনারেল সপ্লিমেন্ট রয়েছে। যেখান থেকে আপনি এর অভাব পূরণ করতে পারেন।

সঠিক পুষ্টি ছাড়া আমাদের দেহ সর্বোত্তমভাবে কাজ করতে অক্ষম। পর্যাপ্ত পুষ্টি আমাদের দেহকে বাড়িয়ে তোলে এবং বৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য এটি পুষ্ট করে তোলে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাবার সুষম পরিসরের রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় সঠিক পুষ্টি সরবরাহের জন্য সঠিক উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমনÑ শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট এবং ভিটামিন এবং খনিজ ও পানি। আমরা যদি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি এবং প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করিÑ যা আমাদের শরীরকে ইমিউন/রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

back to top