alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ.-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হলো। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহিম আ. ও ইসমাইল আ.। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহিম আ.-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাইল আ.-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ.-কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইল আ.-এর পবিত্র বংশ দ্বারাই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর আবির্ভাব ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ. ও হজরত ইসমাইল আ.-এর ত্যাগের ইতিহাস চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানি বাধ্যতামূলক করলেন।

ঈদুল আজহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে। যেমনÑ মিসরে একে বলা হয় ঈদুল বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, অ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর। ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়। আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছু মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা কেবল পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বোঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ করা। নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি।

ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ-নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনইবা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমন আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন-মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার।

কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন।

ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দÑ এটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসুল সা. কোরবানির তিন ভাগের একভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সঙ্গে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। মহান আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশে, তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।

এ কোরবানি কেবল যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহঙ্কারী পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সঙ্গে সঙ্গে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থি যত উপলব্ধি ও অহঙ্কার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়।

ঈদুল আজহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হজরত ইব্রাহিম আ. ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল আ.-এর এরূপ পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারিমে দেখতে পাই। সব কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা-বর্জিত ইবাদাত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কোরবানিও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরবানির সুমহান শিক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশ ঘটেছে। আদম-পুত্র হাবিলের কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।

কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আজহার নামাজে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কোরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার রয়েছে। কোরবানি মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় উৎসব নয় বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহিদি আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি

শ্লীলতা, অশ্লীলতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ.-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হলো। কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহিম আ. ও ইসমাইল আ.। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহিম আ.-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাইল আ.-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ.-কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাইল আ.-এর পবিত্র বংশ দ্বারাই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর আবির্ভাব ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ. ও হজরত ইসমাইল আ.-এর ত্যাগের ইতিহাস চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানি বাধ্যতামূলক করলেন।

ঈদুল আজহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে। যেমনÑ মিসরে একে বলা হয় ঈদুল বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, অ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর। ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কোরবানিকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়। আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছু মহান আল্লাহর দান। মহান আল্লাহর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির গুরুত্ব। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তার একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। ঈদুল আজহা কেবল পশু কোরবানি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আনন্দ প্রমোদকে বোঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ করা। নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র রবের সন্তুষ্টি।

ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ-নিষেধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি এ কথাটি সবার মুখে রটে বেড়ায় কিন্তু ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শিক্ষা এবং এর মহত্ত্বের প্রতি কজনইবা গুরুত্ব দিচ্ছি! ঈদ যেমন আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন-মানসিকতা বিসর্জন দেয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার।

কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও নাম জাহির করার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার পশু কিনে লাল ফিতা বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শিত করে থাকেন এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কম দামি দুর্বল পশু কোরবানিও অনুচিত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না বরং তাকওয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন।

ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দÑ এটি কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসুল সা. কোরবানির তিন ভাগের একভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনকি সবটা দান করাও বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ তবে গরিবদের মাঝে বিতরণের যে উদ্দেশ্য তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। শুধু পশু নয়, নিজের অন্তরের পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সঙ্গে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে। মহান আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। কারণ, একমাত্র বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহর উদ্দেশে, তার নামেই পশু কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহর সব আদেশের সামনে বিনা প্রশ্নে মাথানত করে দেয়াই হলো পূর্ণ আত্মসমর্পণের সমুজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ।

এ কোরবানি কেবল যে পশু কোরবানি নয়, তা মানুষের ভেতরের অহঙ্কারী পশুর, মানুষের ভেতরের রক্তাক্ত অমানুষের বিনাশের প্রতীকী ত্যাগ। এর সঙ্গে সঙ্গে এ বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি অন্যতম প্রয়াস এই কোরবানি। এতে ব্যক্তির দেহের ও মনের ঋণাত্মক যত ভাবনা, অমানবিক যত চেতনা, মানবিকতার পরিপন্থি যত উপলব্ধি ও অহঙ্কার এবং মানুষের মনের অন্তর্গত হিংস্র পশুত্বের যে অপচ্ছায়া তা অপসারিত হয়।

ঈদুল আজহার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা হজরত ইব্রাহিম আ. ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল আ.-এর এরূপ পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্রই পবিত্র কুরআনুল কারিমে দেখতে পাই। সব কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই ইসলামের মহান শিক্ষা। ইখলাস ছাড়া পরকালীন কোনো কাজই আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা-বর্জিত ইবাদাত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। তাই কোরবানিও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোরবানির সুমহান শিক্ষা তাকওয়াভিত্তিক জীবনযাপন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনই মুমিনের প্রকৃত সফলতা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার আমলকেই কবুল করেন, যার আমলে তাকওয়া বা খোদাভীতির সন্নিবেশ ঘটেছে। আদম-পুত্র হাবিলের কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন তাকওয়ার প্রভাবের কারণেই।

কোরবানির অন্যতম শিক্ষা দরিদ্র ও অনাথের সুখ-দুঃখে ভাগীদার হওয়া। ঈদুল আজহার নামাজে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্র-ইয়াতিমের মধ্যে কোরবানির গোশত বণ্টন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের সম্পদে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার রয়েছে। কোরবানি মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় উৎসব নয় বরং পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনও বটে। এর মাধ্যমে মুসলমান তাওহিদি আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এবং ইখলাস ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপূর্ব নজির স্থাপন করতে পারে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top