রহমান মৃধা
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কর্মীর মধ্যে পার্থক্য নেই। তাদের কাছে কোনো কাজের জন্য গেলেই দিতে হয় সালামি বা ঘুষ। চাকরিতে প্রমোশনের দরকার হলে বসকে খুশি করতে হবে; বদলি হওয়ার দরকার হলে বসকে তেল দিতে হবে। অনেকেই বসের কাছে কিছু আশা না থাকলেও নিজ থেকে কিছু নিয়ে হাজির হয়।
এমন একটা গল্প শোনা যায় যে, একবার একজন ইলিশ মাছ নিয়ে বসকে বলেছিলেন, এ মাছ তার নিজের পুকুরের। এখন ঘুষ, সালামি বা নিজ থেকে কাউকে কিছু দেয়ার এ ধরনের রেওয়াজ বাংলাদেশে আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কারো সম্পদ বা অর্থ হরণ না করে বরং বিনিময় করে, তাকে ঘুষ বলা হয় না। পাম্পপট্টি মারা বা তেল দেয়া-এগুলোও কিন্তু আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত। আমরা তেল মেরে, ঘুষ দিয়ে বা পাম্পপট্টি মেরে আমাদের কার্য সাধন করতে ওস্তাদ।
আজ একটি ঘটনা চোখে পড়ল। সেটা দেখার পর এক বাল্যবন্ধুকে ফোন করলাম। বন্ধু আমার, বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রাজ্জাক। বন্ধু বড় মাপের অধ্যাপক বটে তবে রসিকতা করতে কখনও কৃপণতা করে না। তাকে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, বল তো বন্ধু কি কারণ থাকতে পারে বাঙালিদের এত তেল মারার পেছনে? ওমা, সে দিব্যি আমাকে তেলের বর্ণনা থেকে শুরু করে তেল মারার গুণাগুণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানাল। শুধু কি তাই? হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তেলের ওপর লেখা আমাকে ধরিয়ে দিল, যার অংশবিশেষ এমন; তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কত বুঝিয়াছিলেন। তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কীসে পারে? বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে। যে সর্বশক্তিমান তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না। তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।
প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না, হাজার গুণ থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না। তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না। পূর্বেই বলা হয়েছে, যে তৈল দিতে পারে, সে সর্বশক্তিমান, কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে, সময় আছে, কৌশল আছে। কে যে তৈল দিবার পাত্র নয়, তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দেবার পাত্র। তৈল এমন জিনিস নয় যে, নষ্ট হয়। একবার দিয়ে রাখিলে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ফল ফলিবে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয়। কৌশল পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেরূপেই হোক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দেওয়ার কৌশল আছে। যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লাখ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।
তৈল সবাই দিয়ে থাকেন কিন্তু কেউই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার। এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমতো লেকচার পাওয়া যায় না। শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।
ছোটবেলায় সাগরিকা ছবি দেখেছিলাম ঢাকার পিলখানা সিনেমা হলে। তখন কেদার দাকে তার এক বন্ধু, যার নাম মনে নেই, বলেছিল নিজের চরকায় তেল দিতে। তখন কেদার দা উত্তরে বলেছিল, যতটুকু মনে পড়ে, ‘যার তেল দেবার অভ্যাস তার কাছে নিজ আর পর বলে কিছু নেই, চর্কা পেলেই তেল দেয়।’ সে বহু বছর আগের কথা, তবে তেল দেয়া নিয়ে এত সুন্দর করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন তা আমার জানা ছিল না।
আমি আমার জীবনে এত সুন্দরভাবে বিষয়টি নিয়ে কখনও ভাবিনি। ভেবেছিলাম তেলের ওপর অনেক কিছু লিখব যেমন তেলের গুরুত্ব, তেলের ব্যবহার এবং এর উপকারিতা আমার মতো করে। কিন্তু তেল এমন এক বস্তু যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এটি পানির সঙ্গে মেশে না; অথচ জৈব দ্রাবকের সঙ্গে মিশে যায়। তেলে উচ্চমাত্রার কার্বন এবং হাইড্রোজেন রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকারের তেল, যেমন : উদ্ভিজ তেল, ওষুধি তেল এবং অপরিহার্য উদ্বায়ী তেল, প্রদত্ত সাধারণ সংজ্ঞার অন্তুর্ভুক্ত। সব ধরনের তেলই আদিতে জৈব পদার্থ থেকে উৎসরিত। বিশেষ করে সরিষার তেল পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্মগ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিকার্সিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যান্সারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার থেকে সুরক্ষাও করে। তবে সেটা শতভাগ ভেজালমুক্ত হতে হবে।
উপরের বর্ণনায় যতটুকু জানলাম তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তেলের গুরুত্ব আমাদের জীবনে এত বেশি আগে আমার জানা ছিল না। তবে এতটুকু বলতে চাই তা হলো, ভেজাল সরিষার তেল কি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে? মোটেও তা নয়। দোকানের খোলা সরিষার তেলে ভেজাল মিশ্রিত থাকে, যা ব্যবহার করলে নানা রকম অসুখ-বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খাঁটি সরিষার তেল কেনার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। তাছাড়া অতিরিক্ত তেল শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
শিক্ষণীয় বা ভালো কিছু থেকে যখন আমরা নতুন কিছু শিখি সেটাকে আমরা নানাভাবে প্রয়োগ করি। অতএব তেলের গুণাগুণ এবং তার ব্যবহার বা তেল মারা অভ্যাসটা সেভাবেই আমাদের আচরণে ঢুকেছে। শিক্ষককে খুশি করতে আমরা সালাম করি, আদব কায়দা বা মার্জিত ভাষা ব্যবহার করি, প্রতিদিন আল্লাহকে খুশি করতে ভালো কাজ করি। সব কিছুই মূলত তেল মারার মধ্যেই কিন্তু পড়ে। বন্ধুর কথায় যুক্তি দেখে আমি তার সঙ্গে তর্কে না গিয়ে নিজেও একটু তেল মেরে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে আলোচনা শেষ করলাম।
তবে আমাদের কথার শেষের দিকে আমরা দুইজনই কেন যেন একমত হলাম-সেটা হলো বেশি তেল খাওয়া, ব্যবহার করা, এমনকি বেশি তেল মারা ভালো না। এই সারমর্মে উপনীত হবার পর আমার মাথায় নতুন চিন্তা মাথায় ঢুকল! দেশপ্রেমিক হতে হলে নিজের চরকায় তেল দিতে হবে। সে আবার কী? পরের পিছে না লেগে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজটুকু সৎভাবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে করাই হলো দেশপ্রেম। পাশাপাশি সমাজে বা দেশে যার যা দায়িত্ব তাকে সেটা করতে দেয়াও দেশপ্রেম।
একজন শিক্ষার্থীর জন্যে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হচ্ছে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করা। নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলা। যে শিক্ষার্থী আলস্যে সময় কাটায় না, ফেসবুক ও চ্যাটিংয়ে সময় না দিয়ে নিজের লেখাপড়ার জন্যে পর্যাপ্ত সময় দেয় এবং নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, সে সত্যিকার অর্থেই দেশের কল্যাণে কাজ করছে। কারণ ছাত্রজীবনে সে যদি নিজেকে বড় কাজের জন্যে তৈরি করতে পারে, তাহলে পরবর্তীতে সে তার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজের চরকায় তেল দিচ্ছে এবং দিব্যি ভালো করছে। কারণ একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও তথ্যে সমৃদ্ধ করা, লক্ষ্য সুস্পষ্ট করে দেয়া, লক্ষ্য অর্জনে মেধার বিকাশ ঘটানো, মূল্যবোধ জাগ্রত করা। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব কখনো শিক্ষার্থীকে পঙ্গু করে দেয়া না। তাই শিক্ষকরা যদি আন্তরিকভাবে সৎ থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সেটিই তার দেশপ্রেম। অতএব নিজের চরকায় তেল দিতে হবে।
একজন সরকারি চাকরিজীবী হচ্ছেন জনগণের সেবক। তার চিন্তা থাকবে কোনো রকম হয়রানি পেরেশানি ছাড়াই ফাইল ছেড়ে দেওয়া বা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা। যে চাকরিজীবী কর্মস্থলে সময়মতো যান এবং পুরো কর্মঘণ্টা আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, সেটিই তার দেশপ্রেম। যে কাজটি পাঁচ মিনিটে করে দিতে পারেন, সেটি পাঁচ দিন ফেলে না রেখে যদি পাঁচ মিনিটেই করে দেন, তাহলে সেটিও আপনার দেশপ্রেমের নমুনা। যিনি রাস্তা নির্মাণ করছেন তার দায়িত্ব হলো ভালো উপকরণ দিয়ে টেকসই রাস্তা নির্মাণ করা, যাতে অল্পদিনে রাস্তায় ফাটল না ধরে। আপনি যদি রাস্তা ঝাড়– দেন, সেটাই যদি সবচেয়ে সুন্দর ও আন্তরিকভাবে করেন, তবে আপনি একজন দেশপ্রেমিক। আপনি গৃহিণী হলে আন্তরিকতা নিয়ে যদি সন্তানদের লালন-পালন করেন, পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে খাদ্য তৈরির ব্যবস্থা করেন, তবে তাও আপনার দেশপ্রেমের নমুনা। এর মানেও হলো, নিজের চরকায় তেল দিতে হবে।
আপনি যদি গাড়ি চালান, কীভাবে নিয়ম ফাঁকি দেয়া যায় তা নয়, বরং আপনাকে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে হবে এটাও কিন্তু দেশপ্রেম। যে ব্যবসায়ী জনগণের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ভেজাল পণ্য বিক্রি থেকে বিরত থাকছেন, তিনিও দেশপ্রেমিক। যে চিকিৎসক আন্তরিকভাবে সেবা দেন রোগীকে, তিনিও দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। যে চিকিৎসক রোগীকে বাড়তি টেস্ট করতে দেন না এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া বাড়তি ওষুধ লেখেন না, সেটিও তার দেশপ্রেম। মানে নিজের চরকায় তেল মারা।
দেশের সম্পদ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতাও দেশপ্রেমের অংশ। দেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির যেন কোনো অপচয় না হয় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা কল ছেড়ে দাঁত ব্রাশ করতে থাকি, বিদ্যুৎ বাতি জ্বালিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাই, প্রয়োজনের বেশি গ্যাস ব্যবহার করি এসব কাজ কিন্তু দেশপ্রেমের অভাব নির্দেশ করে। নিজ দায়িত্বে সচেতনতার মাধ্যমে এই অপচয় রোধ করাই হবে দেশপ্রেমের পরিচায়ক।
দেশপ্রেম শুধু বড় কাজে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজে এর প্রকাশ ঘটে। যখন একজন মানুষ সঠিকভাবে তার কাজ সম্পাদন করে, তার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকে, তখনই সে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত হতে পারে।
দেশপ্রেমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবেশ রক্ষা। আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদেরই। বৃক্ষরোপণ করা, প্লাস্টিকের অপচয় রোধ করা, বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা এসব ছোট ছোট কাজও দেশপ্রেমের অংশ।
আসলে, দেশপ্রেমের অর্থ শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়; বরং নিজের কর্মক্ষেত্র, দায়িত্ব এবং চারপাশের প্রতিটি বিষয়ে আন্তরিকতা, সততা এবং সচেতনতা প্রদর্শন করা। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবে দেশও শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে।
অতএব, আসুন আমরা সবাই নিজের চর্কায় তেল মারার অভ্যাস গড়ে তুলি, নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি, এবং এভাবেই আমাদের প্রিয় দেশকে আরও উন্নত, সুন্দর এবং শক্তিশালী করে তুলি।
[ লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন ]
রহমান মৃধা
শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কর্মীর মধ্যে পার্থক্য নেই। তাদের কাছে কোনো কাজের জন্য গেলেই দিতে হয় সালামি বা ঘুষ। চাকরিতে প্রমোশনের দরকার হলে বসকে খুশি করতে হবে; বদলি হওয়ার দরকার হলে বসকে তেল দিতে হবে। অনেকেই বসের কাছে কিছু আশা না থাকলেও নিজ থেকে কিছু নিয়ে হাজির হয়।
এমন একটা গল্প শোনা যায় যে, একবার একজন ইলিশ মাছ নিয়ে বসকে বলেছিলেন, এ মাছ তার নিজের পুকুরের। এখন ঘুষ, সালামি বা নিজ থেকে কাউকে কিছু দেয়ার এ ধরনের রেওয়াজ বাংলাদেশে আগে যেমন ছিল, এখনো আছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কারো সম্পদ বা অর্থ হরণ না করে বরং বিনিময় করে, তাকে ঘুষ বলা হয় না। পাম্পপট্টি মারা বা তেল দেয়া-এগুলোও কিন্তু আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত। আমরা তেল মেরে, ঘুষ দিয়ে বা পাম্পপট্টি মেরে আমাদের কার্য সাধন করতে ওস্তাদ।
আজ একটি ঘটনা চোখে পড়ল। সেটা দেখার পর এক বাল্যবন্ধুকে ফোন করলাম। বন্ধু আমার, বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রাজ্জাক। বন্ধু বড় মাপের অধ্যাপক বটে তবে রসিকতা করতে কখনও কৃপণতা করে না। তাকে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, বল তো বন্ধু কি কারণ থাকতে পারে বাঙালিদের এত তেল মারার পেছনে? ওমা, সে দিব্যি আমাকে তেলের বর্ণনা থেকে শুরু করে তেল মারার গুণাগুণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানাল। শুধু কি তাই? হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তেলের ওপর লেখা আমাকে ধরিয়ে দিল, যার অংশবিশেষ এমন; তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কত বুঝিয়াছিলেন। তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কীসে পারে? বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে। যে সর্বশক্তিমান তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না। তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।
প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না, হাজার গুণ থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না। তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না। পূর্বেই বলা হয়েছে, যে তৈল দিতে পারে, সে সর্বশক্তিমান, কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে, সময় আছে, কৌশল আছে। কে যে তৈল দিবার পাত্র নয়, তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাটসাহেব পর্যন্ত তৈল দেবার পাত্র। তৈল এমন জিনিস নয় যে, নষ্ট হয়। একবার দিয়ে রাখিলে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ফল ফলিবে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয়। কৌশল পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেরূপেই হোক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দেওয়ার কৌশল আছে। যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আরও মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লাখ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।
তৈল সবাই দিয়ে থাকেন কিন্তু কেউই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার। এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমতো লেকচার পাওয়া যায় না। শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।
ছোটবেলায় সাগরিকা ছবি দেখেছিলাম ঢাকার পিলখানা সিনেমা হলে। তখন কেদার দাকে তার এক বন্ধু, যার নাম মনে নেই, বলেছিল নিজের চরকায় তেল দিতে। তখন কেদার দা উত্তরে বলেছিল, যতটুকু মনে পড়ে, ‘যার তেল দেবার অভ্যাস তার কাছে নিজ আর পর বলে কিছু নেই, চর্কা পেলেই তেল দেয়।’ সে বহু বছর আগের কথা, তবে তেল দেয়া নিয়ে এত সুন্দর করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন তা আমার জানা ছিল না।
আমি আমার জীবনে এত সুন্দরভাবে বিষয়টি নিয়ে কখনও ভাবিনি। ভেবেছিলাম তেলের ওপর অনেক কিছু লিখব যেমন তেলের গুরুত্ব, তেলের ব্যবহার এবং এর উপকারিতা আমার মতো করে। কিন্তু তেল এমন এক বস্তু যা সাধারণ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এটি পানির সঙ্গে মেশে না; অথচ জৈব দ্রাবকের সঙ্গে মিশে যায়। তেলে উচ্চমাত্রার কার্বন এবং হাইড্রোজেন রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকারের তেল, যেমন : উদ্ভিজ তেল, ওষুধি তেল এবং অপরিহার্য উদ্বায়ী তেল, প্রদত্ত সাধারণ সংজ্ঞার অন্তুর্ভুক্ত। সব ধরনের তেলই আদিতে জৈব পদার্থ থেকে উৎসরিত। বিশেষ করে সরিষার তেল পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্মগ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিকার্সিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যান্সারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার থেকে সুরক্ষাও করে। তবে সেটা শতভাগ ভেজালমুক্ত হতে হবে।
উপরের বর্ণনায় যতটুকু জানলাম তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তেলের গুরুত্ব আমাদের জীবনে এত বেশি আগে আমার জানা ছিল না। তবে এতটুকু বলতে চাই তা হলো, ভেজাল সরিষার তেল কি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে? মোটেও তা নয়। দোকানের খোলা সরিষার তেলে ভেজাল মিশ্রিত থাকে, যা ব্যবহার করলে নানা রকম অসুখ-বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খাঁটি সরিষার তেল কেনার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। তাছাড়া অতিরিক্ত তেল শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
শিক্ষণীয় বা ভালো কিছু থেকে যখন আমরা নতুন কিছু শিখি সেটাকে আমরা নানাভাবে প্রয়োগ করি। অতএব তেলের গুণাগুণ এবং তার ব্যবহার বা তেল মারা অভ্যাসটা সেভাবেই আমাদের আচরণে ঢুকেছে। শিক্ষককে খুশি করতে আমরা সালাম করি, আদব কায়দা বা মার্জিত ভাষা ব্যবহার করি, প্রতিদিন আল্লাহকে খুশি করতে ভালো কাজ করি। সব কিছুই মূলত তেল মারার মধ্যেই কিন্তু পড়ে। বন্ধুর কথায় যুক্তি দেখে আমি তার সঙ্গে তর্কে না গিয়ে নিজেও একটু তেল মেরে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে আলোচনা শেষ করলাম।
তবে আমাদের কথার শেষের দিকে আমরা দুইজনই কেন যেন একমত হলাম-সেটা হলো বেশি তেল খাওয়া, ব্যবহার করা, এমনকি বেশি তেল মারা ভালো না। এই সারমর্মে উপনীত হবার পর আমার মাথায় নতুন চিন্তা মাথায় ঢুকল! দেশপ্রেমিক হতে হলে নিজের চরকায় তেল দিতে হবে। সে আবার কী? পরের পিছে না লেগে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজটুকু সৎভাবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে করাই হলো দেশপ্রেম। পাশাপাশি সমাজে বা দেশে যার যা দায়িত্ব তাকে সেটা করতে দেয়াও দেশপ্রেম।
একজন শিক্ষার্থীর জন্যে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হচ্ছে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করা। নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলা। যে শিক্ষার্থী আলস্যে সময় কাটায় না, ফেসবুক ও চ্যাটিংয়ে সময় না দিয়ে নিজের লেখাপড়ার জন্যে পর্যাপ্ত সময় দেয় এবং নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, সে সত্যিকার অর্থেই দেশের কল্যাণে কাজ করছে। কারণ ছাত্রজীবনে সে যদি নিজেকে বড় কাজের জন্যে তৈরি করতে পারে, তাহলে পরবর্তীতে সে তার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজের চরকায় তেল দিচ্ছে এবং দিব্যি ভালো করছে। কারণ একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও তথ্যে সমৃদ্ধ করা, লক্ষ্য সুস্পষ্ট করে দেয়া, লক্ষ্য অর্জনে মেধার বিকাশ ঘটানো, মূল্যবোধ জাগ্রত করা। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব কখনো শিক্ষার্থীকে পঙ্গু করে দেয়া না। তাই শিক্ষকরা যদি আন্তরিকভাবে সৎ থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সেটিই তার দেশপ্রেম। অতএব নিজের চরকায় তেল দিতে হবে।
একজন সরকারি চাকরিজীবী হচ্ছেন জনগণের সেবক। তার চিন্তা থাকবে কোনো রকম হয়রানি পেরেশানি ছাড়াই ফাইল ছেড়ে দেওয়া বা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা। যে চাকরিজীবী কর্মস্থলে সময়মতো যান এবং পুরো কর্মঘণ্টা আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, সেটিই তার দেশপ্রেম। যে কাজটি পাঁচ মিনিটে করে দিতে পারেন, সেটি পাঁচ দিন ফেলে না রেখে যদি পাঁচ মিনিটেই করে দেন, তাহলে সেটিও আপনার দেশপ্রেমের নমুনা। যিনি রাস্তা নির্মাণ করছেন তার দায়িত্ব হলো ভালো উপকরণ দিয়ে টেকসই রাস্তা নির্মাণ করা, যাতে অল্পদিনে রাস্তায় ফাটল না ধরে। আপনি যদি রাস্তা ঝাড়– দেন, সেটাই যদি সবচেয়ে সুন্দর ও আন্তরিকভাবে করেন, তবে আপনি একজন দেশপ্রেমিক। আপনি গৃহিণী হলে আন্তরিকতা নিয়ে যদি সন্তানদের লালন-পালন করেন, পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে খাদ্য তৈরির ব্যবস্থা করেন, তবে তাও আপনার দেশপ্রেমের নমুনা। এর মানেও হলো, নিজের চরকায় তেল দিতে হবে।
আপনি যদি গাড়ি চালান, কীভাবে নিয়ম ফাঁকি দেয়া যায় তা নয়, বরং আপনাকে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে হবে এটাও কিন্তু দেশপ্রেম। যে ব্যবসায়ী জনগণের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ভেজাল পণ্য বিক্রি থেকে বিরত থাকছেন, তিনিও দেশপ্রেমিক। যে চিকিৎসক আন্তরিকভাবে সেবা দেন রোগীকে, তিনিও দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। যে চিকিৎসক রোগীকে বাড়তি টেস্ট করতে দেন না এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া বাড়তি ওষুধ লেখেন না, সেটিও তার দেশপ্রেম। মানে নিজের চরকায় তেল মারা।
দেশের সম্পদ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতাও দেশপ্রেমের অংশ। দেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির যেন কোনো অপচয় না হয় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা কল ছেড়ে দাঁত ব্রাশ করতে থাকি, বিদ্যুৎ বাতি জ্বালিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাই, প্রয়োজনের বেশি গ্যাস ব্যবহার করি এসব কাজ কিন্তু দেশপ্রেমের অভাব নির্দেশ করে। নিজ দায়িত্বে সচেতনতার মাধ্যমে এই অপচয় রোধ করাই হবে দেশপ্রেমের পরিচায়ক।
দেশপ্রেম শুধু বড় কাজে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজে এর প্রকাশ ঘটে। যখন একজন মানুষ সঠিকভাবে তার কাজ সম্পাদন করে, তার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকে, তখনই সে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত হতে পারে।
দেশপ্রেমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবেশ রক্ষা। আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদেরই। বৃক্ষরোপণ করা, প্লাস্টিকের অপচয় রোধ করা, বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা এসব ছোট ছোট কাজও দেশপ্রেমের অংশ।
আসলে, দেশপ্রেমের অর্থ শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়; বরং নিজের কর্মক্ষেত্র, দায়িত্ব এবং চারপাশের প্রতিটি বিষয়ে আন্তরিকতা, সততা এবং সচেতনতা প্রদর্শন করা। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবে দেশও শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে।
অতএব, আসুন আমরা সবাই নিজের চর্কায় তেল মারার অভ্যাস গড়ে তুলি, নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি, এবং এভাবেই আমাদের প্রিয় দেশকে আরও উন্নত, সুন্দর এবং শক্তিশালী করে তুলি।
[ লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন ]