রুশাইদ আহমেদ
বিজ্ঞানের পরিভাষায় পানিকে অভিহিত করা হয় জীবনের প্রতিশব্দ হিসেবে। কৃষি উৎপাদন ও বনায়ন থেকে শুরু করে পশু প্রতিপালন, শিল্পক্ষেত্রে দ্রাবকরূপে ব্যবহার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনসহ দৈনন্দিন জীবনযাপনের সর্বত্র পানির সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তাই এ অমূল্য সম্পদটিকে বিশ্ববাসীর সামনে জীবনের সমার্থক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু বিশ্বখ্যাত মার্কিন পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ক স্যাটেলাইট চ্যানেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সমীক্ষা মতে, পৃথিবীর সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠের ৭০.৯% স্থানজুড়ে পানির বিস্তৃতি থাকলেও এই পানির মাত্র ৩% ব্যবহারোপযোগী মিষ্টি পানি। তবে এই তিন শতাংশের মধ্যে ৬৯% স্বাদু পানি বিশ্বের মেরু অঞ্চল ও বরফশৈলে জমাটবদ্ধ অবস্থায় এবং ৩০% ভূগর্ভে সঞ্চিত রয়েছে বলে জানা গেছে। আর অবশিষ্ট এক শতাংশ পানির প্রাপ্তিস্থান বিশ্বের দেশসমূহের নদ-নদী, খাল ও হ্রদসহ অন্যান্য জলাধার।
তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়নের প্রভাবে পানির দূষণ এবং অযাচিত অপচয়ের কারণে মানুষের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবহারযোগ্য এই পানির পরিমাণ ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে; যা বিশ্বব্যাপী নতুন জটিল সংকট ও সংঘাত সৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে ধারণা করছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ইতোমধ্যেই বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববাসী তেল সম্পদের দখল নিয়ে বেশ কয়েকটি সংঘাতের সাক্ষী হয়েছে। ১৯৩২-১৯৩৫ সালের বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ের মধ্যকার চাকো যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মিত্রশক্তির কৌশলগত তেল শোধনাগার ধ্বংস অভিযান এবং পার্ল হারবার আক্রমণ, ১৯৬৭-১৯৭০ কালপরিসরের নাইজেরীয় গৃহযুদ্ধ, ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরাক-ইরান যুদ্ধ এবং ১৯৯০-১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো বড় বড় সংঘাতগুলোর সবই গড়ে উঠেছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খনিজ তেল সম্পদকে ঘিরে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে। তেল একটি মূল্যবান অনবায়নযোগ্য খনিজ সম্পদ, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর তাই এ সম্পদের অধিকারী হতেই যে পরাশক্তিগুলোর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এর বিপরীতভাবে ভাবলে দেখা যায়, তেল পানির মতো সকল মানুষের জন্য সর্বাঙ্গীনভাবে দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু নয়। ক্রমহ্রাসমান ব্যবহারযোগ্য পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তাই বিশ্বের দেশসমূহের নীতিনির্ধারকরা সচেতন না হলে অনেক জটিল সংকটের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। কেননা জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি বাসিন্দা তাদের দেশের আন্তঃসীমান্তের পানির উৎসের ওপর নির্ভরশীল হলেও সমগ্র বিশ্বে আন্তঃদেশীয় নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এখন পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মাত্র ২৪টি রাষ্ট্র।
এসব কথা চিন্তা করে তাই আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলডিন এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বর্তমান শতাব্দীর সংঘাতসমূহ তেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে; কিন্তু আমরা যদি সুষ্ঠু পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিয়ে আমাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন না আনি, তবে পরবর্তী শতাব্দীতে আমাদের দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হবে পানি!’
পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পানি নিয়ে সচেতন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি পানির ব্যবহারে অত্যন্ত মিতব্যয়ী হওয়াও সমানভাবে জরুরি, বিশেষত আমাদের বাংলাদেশে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশে পানি সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও সাম্প্রতিককালে অত্যধিক গভীর নলকূপ স্থাপন, আবাদি জমিতে সেচ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, নানা ধরনের জলাশয় বেদখল এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে ঘটা পানির দূষণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
উপরন্তু, দেশের অনেক নাগরিকই পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী না হওয়ায় তারা অপ্রয়োজনে পানির ট্যাপগুলো ছেড়ে রাখেন, ট্যাংক উপচে পানি পড়লেও অলসতার কারণে তা দ্রুত বন্ধ করেন না এবং গোসল ও কাপড় ধোয়ার সময় প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত পানি খরচ করেন। তা ছাড়া, অনেক শহরের পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পানি সরবরাহের পাইপলাইনে ফাটল বা ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে কি-না তা নিয়মিতভাবে তদারকিও করে না। এতে করে শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ পানি অপচয় হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
পাশাপাশি তিন বছর আগেও দেশের ৬১ শতাংশের বেশি মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশনের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন (‘দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের বাইরে’, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ নভেম্বর ২০২১)। এ হার বর্তমানে কিছুটা কমলেও পূর্বে অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবস্থাপনার কারণে ইতোমধ্যে আমাদের বহু জলাশয়ের পানিই দূষিত হয়ে গেছে বলা চলে।
এছাড়া এ দেশের ৫৮টি স্বীকৃত আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টি নদীরই উৎপত্তি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দেশটিতেও ৭২% জলাধার শুকিয়ে গেছে এবং বিদ্যমান জলাশয়গুলোর অনেক অংশ বেদখল ও দূষিত হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। নিজ স্বার্থ রক্ষায় তাই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ৪৭টিরই উজানের কোনো না কোনো স্থানে বাঁধ ও ড্যাম স্থাপন করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে পানি ব্যবহারের জন্যও বেশকিছু আন্তঃসীমানার নদীর পানি অপসারণ করছে তারা। এমতাবস্থায় জলাধার বেদখল ও দূষণ বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে ব্যবহারযোগ্য পানি আরও কমে গেলে তারা আরও বেশি পরিমাণে পানি প্রত্যাহারে উদ্যত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের সেই উদ্যোগ বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত পরিমাণে পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকিকে যে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে নীলনদের পানি বণ্টন নিয়ে প্রাচীন নুবিয়া ও মিসরের অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের প্রধান পিটার গ্লিকের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষক দল ১৮১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত পানি বণ্টন নিয়ে এক হাজারের কাছাকাছি ছোট-বড় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির তথ্য তুলে ধরেছেন এক গবেষণায়। তাই সমসাময়িক পরিস্থিতিতে পানি নিয়ে জটিল সংকট এবং সংঘাতের সব সম্ভাবনা দূরীকরণে অত্যন্ত সচেতনভাবে পা ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গত বছর এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ লিখেছে, গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে নিয়ে গত ৪০ বছরে বিশ্বের বাসিন্দাদের স্বাদু পানি ব্যবহারের মাত্রা ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে মানুষ অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভের সঞ্চিত পানি উত্তোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে; যা খুবই অস্বাভাবিক।
অপরদিকে একই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এক যৌথ অনুসন্ধান শেষে জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের প্রায় সোয়া ২০০ কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ উৎস থেকে পানি পানের সুযোগ পাননি। পাশাপাশি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১১ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির অভাবে নদী-খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের অপরিশোধিত পানি পান করেছেন বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়। এতে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গড়ে পুরো পৃথিবীতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতি বছর।
তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সকল ধরনের আশু সংকট ও সংঘাত এড়াতে সুষ্ঠু পানি ব্যবহার ও পানি রাজনীতির দিকে দূরদর্শী নজর দিতে হবে। এর জন্য জনসাধারণের মধ্যে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতার বীজ যেমন বপন করতে হবে, তেমনি আন্তঃদেশীয় নদীসমূহের পানির ন্যায্য প্রাপ্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে কূটনৈতিকভাবে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতায় বিবাদমান পক্ষগুলোকে সমঝোতায় এসে সকলের জন্য ‘পানি নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনক ও বহুমুখী প্রতিভাধর বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সেই বিখ্যাত উক্তিÑ ‘যখন আমাদের কুয়া শুকিয়ে (পানিশূন্য হয়ে) যায়, তখন আমরা অনুধাবন করতে শিখি- পানির কী দাম!’
[লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]
 
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            রুশাইদ আহমেদ
শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বিজ্ঞানের পরিভাষায় পানিকে অভিহিত করা হয় জীবনের প্রতিশব্দ হিসেবে। কৃষি উৎপাদন ও বনায়ন থেকে শুরু করে পশু প্রতিপালন, শিল্পক্ষেত্রে দ্রাবকরূপে ব্যবহার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনসহ দৈনন্দিন জীবনযাপনের সর্বত্র পানির সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তাই এ অমূল্য সম্পদটিকে বিশ্ববাসীর সামনে জীবনের সমার্থক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু বিশ্বখ্যাত মার্কিন পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ক স্যাটেলাইট চ্যানেল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সমীক্ষা মতে, পৃথিবীর সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠের ৭০.৯% স্থানজুড়ে পানির বিস্তৃতি থাকলেও এই পানির মাত্র ৩% ব্যবহারোপযোগী মিষ্টি পানি। তবে এই তিন শতাংশের মধ্যে ৬৯% স্বাদু পানি বিশ্বের মেরু অঞ্চল ও বরফশৈলে জমাটবদ্ধ অবস্থায় এবং ৩০% ভূগর্ভে সঞ্চিত রয়েছে বলে জানা গেছে। আর অবশিষ্ট এক শতাংশ পানির প্রাপ্তিস্থান বিশ্বের দেশসমূহের নদ-নদী, খাল ও হ্রদসহ অন্যান্য জলাধার।
তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়নের প্রভাবে পানির দূষণ এবং অযাচিত অপচয়ের কারণে মানুষের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবহারযোগ্য এই পানির পরিমাণ ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে; যা বিশ্বব্যাপী নতুন জটিল সংকট ও সংঘাত সৃষ্টির পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে ধারণা করছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ইতোমধ্যেই বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববাসী তেল সম্পদের দখল নিয়ে বেশ কয়েকটি সংঘাতের সাক্ষী হয়েছে। ১৯৩২-১৯৩৫ সালের বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ের মধ্যকার চাকো যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মিত্রশক্তির কৌশলগত তেল শোধনাগার ধ্বংস অভিযান এবং পার্ল হারবার আক্রমণ, ১৯৬৭-১৯৭০ কালপরিসরের নাইজেরীয় গৃহযুদ্ধ, ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরাক-ইরান যুদ্ধ এবং ১৯৯০-১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো বড় বড় সংঘাতগুলোর সবই গড়ে উঠেছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খনিজ তেল সম্পদকে ঘিরে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে। তেল একটি মূল্যবান অনবায়নযোগ্য খনিজ সম্পদ, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর তাই এ সম্পদের অধিকারী হতেই যে পরাশক্তিগুলোর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এর বিপরীতভাবে ভাবলে দেখা যায়, তেল পানির মতো সকল মানুষের জন্য সর্বাঙ্গীনভাবে দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু নয়। ক্রমহ্রাসমান ব্যবহারযোগ্য পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তাই বিশ্বের দেশসমূহের নীতিনির্ধারকরা সচেতন না হলে অনেক জটিল সংকটের সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। কেননা জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি বাসিন্দা তাদের দেশের আন্তঃসীমান্তের পানির উৎসের ওপর নির্ভরশীল হলেও সমগ্র বিশ্বে আন্তঃদেশীয় নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এখন পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মাত্র ২৪টি রাষ্ট্র।
এসব কথা চিন্তা করে তাই আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলডিন এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বর্তমান শতাব্দীর সংঘাতসমূহ তেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে; কিন্তু আমরা যদি সুষ্ঠু পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিয়ে আমাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন না আনি, তবে পরবর্তী শতাব্দীতে আমাদের দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হবে পানি!’
পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পানি নিয়ে সচেতন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি পানির ব্যবহারে অত্যন্ত মিতব্যয়ী হওয়াও সমানভাবে জরুরি, বিশেষত আমাদের বাংলাদেশে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশে পানি সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও সাম্প্রতিককালে অত্যধিক গভীর নলকূপ স্থাপন, আবাদি জমিতে সেচ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, নানা ধরনের জলাশয় বেদখল এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে ঘটা পানির দূষণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
উপরন্তু, দেশের অনেক নাগরিকই পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী না হওয়ায় তারা অপ্রয়োজনে পানির ট্যাপগুলো ছেড়ে রাখেন, ট্যাংক উপচে পানি পড়লেও অলসতার কারণে তা দ্রুত বন্ধ করেন না এবং গোসল ও কাপড় ধোয়ার সময় প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত পানি খরচ করেন। তা ছাড়া, অনেক শহরের পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পানি সরবরাহের পাইপলাইনে ফাটল বা ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে কি-না তা নিয়মিতভাবে তদারকিও করে না। এতে করে শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ পানি অপচয় হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
পাশাপাশি তিন বছর আগেও দেশের ৬১ শতাংশের বেশি মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশনের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন (‘দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের বাইরে’, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ নভেম্বর ২০২১)। এ হার বর্তমানে কিছুটা কমলেও পূর্বে অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবস্থাপনার কারণে ইতোমধ্যে আমাদের বহু জলাশয়ের পানিই দূষিত হয়ে গেছে বলা চলে।
এছাড়া এ দেশের ৫৮টি স্বীকৃত আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টি নদীরই উৎপত্তি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দেশটিতেও ৭২% জলাধার শুকিয়ে গেছে এবং বিদ্যমান জলাশয়গুলোর অনেক অংশ বেদখল ও দূষিত হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। নিজ স্বার্থ রক্ষায় তাই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ৪৭টিরই উজানের কোনো না কোনো স্থানে বাঁধ ও ড্যাম স্থাপন করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে পানি ব্যবহারের জন্যও বেশকিছু আন্তঃসীমানার নদীর পানি অপসারণ করছে তারা। এমতাবস্থায় জলাধার বেদখল ও দূষণ বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে ব্যবহারযোগ্য পানি আরও কমে গেলে তারা আরও বেশি পরিমাণে পানি প্রত্যাহারে উদ্যত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের সেই উদ্যোগ বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত পরিমাণে পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকিকে যে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে নীলনদের পানি বণ্টন নিয়ে প্রাচীন নুবিয়া ও মিসরের অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের প্রধান পিটার গ্লিকের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষক দল ১৮১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত পানি বণ্টন নিয়ে এক হাজারের কাছাকাছি ছোট-বড় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির তথ্য তুলে ধরেছেন এক গবেষণায়। তাই সমসাময়িক পরিস্থিতিতে পানি নিয়ে জটিল সংকট এবং সংঘাতের সব সম্ভাবনা দূরীকরণে অত্যন্ত সচেতনভাবে পা ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গত বছর এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ লিখেছে, গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে নিয়ে গত ৪০ বছরে বিশ্বের বাসিন্দাদের স্বাদু পানি ব্যবহারের মাত্রা ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে মানুষ অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভের সঞ্চিত পানি উত্তোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে; যা খুবই অস্বাভাবিক।
অপরদিকে একই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এক যৌথ অনুসন্ধান শেষে জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের প্রায় সোয়া ২০০ কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ উৎস থেকে পানি পানের সুযোগ পাননি। পাশাপাশি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১১ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির অভাবে নদী-খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের অপরিশোধিত পানি পান করেছেন বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়। এতে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গড়ে পুরো পৃথিবীতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতি বছর।
তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সকল ধরনের আশু সংকট ও সংঘাত এড়াতে সুষ্ঠু পানি ব্যবহার ও পানি রাজনীতির দিকে দূরদর্শী নজর দিতে হবে। এর জন্য জনসাধারণের মধ্যে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতার বীজ যেমন বপন করতে হবে, তেমনি আন্তঃদেশীয় নদীসমূহের পানির ন্যায্য প্রাপ্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে কূটনৈতিকভাবে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতায় বিবাদমান পক্ষগুলোকে সমঝোতায় এসে সকলের জন্য ‘পানি নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনক ও বহুমুখী প্রতিভাধর বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের সেই বিখ্যাত উক্তিÑ ‘যখন আমাদের কুয়া শুকিয়ে (পানিশূন্য হয়ে) যায়, তখন আমরা অনুধাবন করতে শিখি- পানির কী দাম!’
[লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়]
