alt

উপ-সম্পাদকীয়

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

মতিউর রহমান

: শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
image

বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতি একটি জটিল সমীকরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্যাপী অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে।

এই উন্নয়ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরিবেশগত দিক থেকে এর গুরুতর প্রভাব রয়েছে। দূষণ, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, যেখানে একদিকে অর্থনৈতিক লাভের জন্য ক্ষুদ্র মেয়াদি পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু ঝুঁকির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের শিল্পায়ন দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষি ও উৎপাদন শিল্পে দ্রুত উন্নতি হয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করেছে। তবে এই শিল্পের অগ্রগতির ফলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে বায়ু ও পানির মান ভয়াবহভাবে নষ্ট হচ্ছে, কারণ অনেক কলকারখানা তাদের বর্জ্য পানি এবং ক্ষতিকর গ্যাস সরাসরি নদী এবং পরিবেশে নির্গত করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে কিছু মহল এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর আইন ও নিয়মের পক্ষে থাকলেও অন্যদিকে অনেকেই মনে করেন যে, কঠোর আইন অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতি কমিয়ে দেবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করবে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নও পরিবেশগত রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের জনগণের প্রয়োজন পূরণের জন্য এবং অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রকল্প রয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বন্দর নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলো দেশের আধুনিকীকরণ এবং জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হলেও, এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় ধরনের ক্ষতি করছে। অনেক সময় প্রকল্পগুলো জলাভূমি, বনভূমি এবং কৃষিজমি দখল করে তৈরি হচ্ছে, যার ফলে বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। সমালোচকরা মনে করেন যে এসব প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা হয় না বা করলেও তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না।

অপরদিকে সমর্থকরা মনে করেন যে জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই ধরনের প্রকল্প অপরিহার্য এবং পরিবেশগত উদ্বেগকে আপাতত দ্বিতীয় স্থানে রাখা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ দেশটি সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা নিম্নভূমির একটি দেশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ক্ষয় এবং বন্যার কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে, এবং এ নিয়ে সরকার, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা চলছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য সরব রয়েছে, যেখানে তারা উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোর জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার তৈরি এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কমিউনিটিভিত্তিক পদক্ষেপ। তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, কারণ দুর্নীতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে অনেক সময় প্রকল্পগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় না।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপও বাড়ছে। ফলে নীতি-নির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কিভাবে একদিকে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করা যায় এবং অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। রাজনৈতিক বিতর্কের একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন শিল্পায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণকে আপাতত দ্বিতীয় স্থানে রাখতে হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশগত অবহেলা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

সুশীল সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলো পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ কর্মীরা এবং এনজিওগুলো প্রায়ই সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য চাপ দিয়ে থাকে, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা যায়। তারা জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করতে এবং সরকারের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা অনেক সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে বাধার সম্মুখীন হয়।

আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা বাংলাদেশে পরিবেশগত রাজনীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিবেশগত উদ্যোগগুলোতে অর্থায়ন ও সহায়তা দিয়ে আসছে, বিশেষ করে জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাপের ফলে বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচারের মতো পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এসব আন্তর্জাতিক চাপ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কীভাবে কার্যকর প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ দেশের পরিবেশগত সমস্যা অনেকটাই স্থানীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত।

সাম্প্রতিক সময়ে টেকসই উন্নয়নের ধারণা বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই উন্নয়ন ধারণাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণকে সমন্বিত করার পক্ষে কথা বলে। এই ধারণার প্রতিফলন দেখা যায় বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, যা জলবায়ু সহনশীলতা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন রাজনৈতিক ইচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এবং বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

সবকিছু বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতি মূলত দ্রুত উন্নয়ন ও টেকসই পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার লড়াই। শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কগুলো প্রমাণ করে যে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে, কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ যদি তার পরিবেশ রক্ষা করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়, তবে দেশের রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা প্রয়োজন।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

একাকিত্ব : নিজেকে আবিষ্কার ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথ

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য

বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় বাঁশকরুল সংগ্রহ

একতার অভাবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

কোন পথে জামায়াতের রাজনীতি?

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

ডিমের জারিজুরি

যোগ্য নেতৃত্ব সমাজ-সংগঠনকে এগিয়ে নেয়

ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকট

কিল মারার গোঁসাই

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হোক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

tab

উপ-সম্পাদকীয়

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

মতিউর রহমান

image

শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতি একটি জটিল সমীকরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্যাপী অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে।

এই উন্নয়ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরিবেশগত দিক থেকে এর গুরুতর প্রভাব রয়েছে। দূষণ, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, যেখানে একদিকে অর্থনৈতিক লাভের জন্য ক্ষুদ্র মেয়াদি পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু ঝুঁকির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের শিল্পায়ন দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষি ও উৎপাদন শিল্পে দ্রুত উন্নতি হয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করেছে। তবে এই শিল্পের অগ্রগতির ফলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে বায়ু ও পানির মান ভয়াবহভাবে নষ্ট হচ্ছে, কারণ অনেক কলকারখানা তাদের বর্জ্য পানি এবং ক্ষতিকর গ্যাস সরাসরি নদী এবং পরিবেশে নির্গত করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে কিছু মহল এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর আইন ও নিয়মের পক্ষে থাকলেও অন্যদিকে অনেকেই মনে করেন যে, কঠোর আইন অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতি কমিয়ে দেবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করবে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নও পরিবেশগত রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের জনগণের প্রয়োজন পূরণের জন্য এবং অর্থনীতির চাহিদা মেটাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রকল্প রয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বন্দর নির্মাণের মতো প্রকল্পগুলো দেশের আধুনিকীকরণ এবং জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হলেও, এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় ধরনের ক্ষতি করছে। অনেক সময় প্রকল্পগুলো জলাভূমি, বনভূমি এবং কৃষিজমি দখল করে তৈরি হচ্ছে, যার ফলে বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। সমালোচকরা মনে করেন যে এসব প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা হয় না বা করলেও তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না।

অপরদিকে সমর্থকরা মনে করেন যে জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই ধরনের প্রকল্প অপরিহার্য এবং পরিবেশগত উদ্বেগকে আপাতত দ্বিতীয় স্থানে রাখা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ দেশটি সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা নিম্নভূমির একটি দেশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ক্ষয় এবং বন্যার কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে, এবং এ নিয়ে সরকার, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা চলছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য সরব রয়েছে, যেখানে তারা উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোর জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার তৈরি এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কমিউনিটিভিত্তিক পদক্ষেপ। তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, কারণ দুর্নীতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে অনেক সময় প্রকল্পগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় না।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপও বাড়ছে। ফলে নীতি-নির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কিভাবে একদিকে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করা যায় এবং অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। রাজনৈতিক বিতর্কের একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন শিল্পায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণকে আপাতত দ্বিতীয় স্থানে রাখতে হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশগত অবহেলা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

সুশীল সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলো পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ কর্মীরা এবং এনজিওগুলো প্রায়ই সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য চাপ দিয়ে থাকে, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা যায়। তারা জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করতে এবং সরকারের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা অনেক সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে বাধার সম্মুখীন হয়।

আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা বাংলাদেশে পরিবেশগত রাজনীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিবেশগত উদ্যোগগুলোতে অর্থায়ন ও সহায়তা দিয়ে আসছে, বিশেষ করে জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাপের ফলে বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচারের মতো পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এসব আন্তর্জাতিক চাপ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কীভাবে কার্যকর প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ দেশের পরিবেশগত সমস্যা অনেকটাই স্থানীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত।

সাম্প্রতিক সময়ে টেকসই উন্নয়নের ধারণা বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই উন্নয়ন ধারণাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণকে সমন্বিত করার পক্ষে কথা বলে। এই ধারণার প্রতিফলন দেখা যায় বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, যা জলবায়ু সহনশীলতা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন রাজনৈতিক ইচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এবং বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

সবকিছু বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের পরিবেশগত রাজনীতি মূলত দ্রুত উন্নয়ন ও টেকসই পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার লড়াই। শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কগুলো প্রমাণ করে যে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে, কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ যদি তার পরিবেশ রক্ষা করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়, তবে দেশের রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা প্রয়োজন।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top