alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

২৬ অক্টোবর, ২০২৪। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়ে ইসরায়েলের শতাধিক বিমান তিন দফায় ইরানের রাজধানী তেহরান ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুটি প্রদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই হামলা পহেলা অক্টোবরে ইরানি হামলার প্রতিশোধ। হামলার প্রথম দফায় সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তী দুটি দফায় বিনা প্রতিরোধে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালানো হয়। এই হামলায় ইসরায়েল শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানাকে টার্গেট করেছে, আমেরিকার নিষেধ থাকায় ইরানের পারমাণবিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনায় আক্রমণ করেনি। ইসরায়েল তাদের এই হামলার নাম দিয়েছে ‘অনুতাপের দিন’।

পহেলা অক্টোবর ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় দুশো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল; ইসরায়েলের বক্তব্য মোতাবেক দুয়েকটি ছাঙা প্রায় সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলছে তাদের নিক্ষিপ্ত ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের কথা কিছুটা সত্য; সত্য না হলে ইসরায়েল তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ যোগ করত না। শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা যুদ্ধবিমান ধ্বংসের জন্য ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ অভেদ্য হিসেবে বিবেচ্য ছিল। আয়রন ডোম ছাড়াও ইসরায়েল বহু আগে থেকেই আমেরিকার পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত বিবেচিত না হওয়ায় ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্রের সংযোজন করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল। এর মধ্যে আবার ২৬ অক্টোবরের হামলায় ইরানের বিদ্যমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সিস্টেম বিকল করে দেয়া হয়েছে মর্মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ইরান বলছে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে পেরেছে। কিন্তু ইরানের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ইসরায়েলের একটি বিমানও ইরান ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়নি। ইরান তাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে বলেই সম্ভবত তাদের সামরিক বাজেট তিনগুণ বাড়নোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই বিশাল সামরিক বাজেট দিয়েও ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ ইসরায়েল নিজেরা যে অস্ত্র তৈরি করে তা অনেক সময় আমেরিকার অস্ত্রের চেয়েও বিধ্বংসী। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরায়েল রাশিয়ার টি-৭২ ট্যাঙ্ক তাদের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যেভাবে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল তা দেখে রাশিয়া এবং আমেরিকা বিস্মিত। ইরান আবার আক্রমণ চালালে ইসরায়েল এমন সর্বনাশা অস্ত্র ব্যবহার করবে যা তারা আগে কখনো ব্যবহার করেনিÑ কথাটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর।

ইসরায়েলের নিজস্ব শক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তি। ফ্রান্স মাঝে মাঝে অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা হুমকির পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চুপ হয়ে যান। আমেরিকা এবং ইউরোপ শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে না, ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য তাদের যুদ্ধজাহাজ সর্বক্ষণ সাগরে টহল দিয়ে বেড়ায়। এসব যুদ্ধজাহাজ ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে, ইয়েমেনের হুতিদের শায়েস্তা করে। আমেরিকা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলের ওপর কাউকে বিজয়ী হতে দেয়া হবে না। এজন্যই ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে পরাজিত মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়’। আমেরিকার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু ইসরায়েল-নীতির কোন পরিবর্তন হয় না।

ইসরায়েলের পক্ষে কে কতটুকু নিবেদিত তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কামালা হ্যারিসের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশায় ডেমোক্রেট দলের কামালা হ্যারিস মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতির কথা বলে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বিগত এক বছর ধরে একই কথা বলে আসছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের কট্টর সমর্থকÑ ইসরায়েলকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে তার কথাবার্তায় কোন রাখঢাক নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দম্ভোক্তি হচ্ছে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে হামাস ইসরায়েলকে আক্রমণের সাহসই করত না। এজন্যই ইসরায়েল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় কামনা করছে। জো বাইডেন মুখে মুখে যুদ্ধবিরতির কথা বললেও তিনি চান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধ্বংস হয়ে যাক।

অবশ্য শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিনাশ চায় এবং চায় বলেই জর্ডান ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করে, মিশর হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৮ সনে সম্পাদিত ক্যাম্পডেভিড চুক্তিই মিশরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলের আরেক প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া অভ্যন্তরীণ সিভিল ওয়ারে বিধ্বস্ত। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চাণক্যনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য মুসলিম দেশগুলো নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত। তাদের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয়, গাজা, পশ্চিম তীর বা লেবাননে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না, কোন শিশু মারা যাচ্ছে না, যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার কোন ঘাটতি নেই।

কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল এবং ইরানের ছায়াযুদ্ধ চলছে। ইরানের যেসব ব্যক্তি ইসরায়েলের জন্য হুমকি প্রতিপন্ন হয় তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের অনেক বিজ্ঞানীকে মোসাদ হত্যা করেছে, হত্যা করেছে ইরানের অভ্যন্তরে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে। শুধু গুপ্ত হত্যা নয়, প্রকাশ্যে বিমান হামলা চালিয়েও ইরানের লোকদের হত্যা করছে ইসরায়েল। চলতি বছরের পহেলা এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সাত কর্মকর্তা নিহত হয়। ইরান তিনশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ে পাল্টা আক্রমণ করে ১৩ এপ্রিল। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য আগত ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে ইরানের মাটিতেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। দুইশ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান এই হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে গত অক্টাবরের ১ তারিখে। ইসরায়েল কিছুদিন অপেক্ষা ২৬ তারিখেই পাল্টা আক্রমণ করল।

১৯৭৯ সনে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে শুধু সমর্থন করছে না, ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্যও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির বক্তব্য কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে। তিনি আগের মতো তাৎক্ষণিক পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা না বলেননি। তবে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের হামলার পাল্টা পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইরানকে মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার নির্দেশনা অনুযায়ী ইসরায়েলের এবারের হামলা ছিল সীমিত; তারা ইরানের তেল ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা করেনি। মজুত তেল, তেল খনি ও তেল সরবরাহের পাইপ লাইনে আক্রমণ হলে বিশ্ব আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ত। ইরানের কি উচিত হবে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির পরামর্শ অনুযায়ী ইসরায়েলের হামলাকে ‘অবহেলা বা অতিরঞ্জিত’ না করে পাল্টা হামলার ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়া?

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

২৬ অক্টোবর, ২০২৪। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়ে ইসরায়েলের শতাধিক বিমান তিন দফায় ইরানের রাজধানী তেহরান ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুটি প্রদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই হামলা পহেলা অক্টোবরে ইরানি হামলার প্রতিশোধ। হামলার প্রথম দফায় সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তী দুটি দফায় বিনা প্রতিরোধে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালানো হয়। এই হামলায় ইসরায়েল শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানাকে টার্গেট করেছে, আমেরিকার নিষেধ থাকায় ইরানের পারমাণবিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনায় আক্রমণ করেনি। ইসরায়েল তাদের এই হামলার নাম দিয়েছে ‘অনুতাপের দিন’।

পহেলা অক্টোবর ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় দুশো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল; ইসরায়েলের বক্তব্য মোতাবেক দুয়েকটি ছাঙা প্রায় সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলছে তাদের নিক্ষিপ্ত ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের কথা কিছুটা সত্য; সত্য না হলে ইসরায়েল তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ যোগ করত না। শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা যুদ্ধবিমান ধ্বংসের জন্য ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ অভেদ্য হিসেবে বিবেচ্য ছিল। আয়রন ডোম ছাড়াও ইসরায়েল বহু আগে থেকেই আমেরিকার পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত বিবেচিত না হওয়ায় ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্রের সংযোজন করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল। এর মধ্যে আবার ২৬ অক্টোবরের হামলায় ইরানের বিদ্যমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সিস্টেম বিকল করে দেয়া হয়েছে মর্মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ইরান বলছে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে পেরেছে। কিন্তু ইরানের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ইসরায়েলের একটি বিমানও ইরান ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়নি। ইরান তাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে বলেই সম্ভবত তাদের সামরিক বাজেট তিনগুণ বাড়নোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই বিশাল সামরিক বাজেট দিয়েও ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ ইসরায়েল নিজেরা যে অস্ত্র তৈরি করে তা অনেক সময় আমেরিকার অস্ত্রের চেয়েও বিধ্বংসী। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরায়েল রাশিয়ার টি-৭২ ট্যাঙ্ক তাদের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যেভাবে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল তা দেখে রাশিয়া এবং আমেরিকা বিস্মিত। ইরান আবার আক্রমণ চালালে ইসরায়েল এমন সর্বনাশা অস্ত্র ব্যবহার করবে যা তারা আগে কখনো ব্যবহার করেনিÑ কথাটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর।

ইসরায়েলের নিজস্ব শক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তি। ফ্রান্স মাঝে মাঝে অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা হুমকির পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চুপ হয়ে যান। আমেরিকা এবং ইউরোপ শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে না, ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য তাদের যুদ্ধজাহাজ সর্বক্ষণ সাগরে টহল দিয়ে বেড়ায়। এসব যুদ্ধজাহাজ ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে, ইয়েমেনের হুতিদের শায়েস্তা করে। আমেরিকা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলের ওপর কাউকে বিজয়ী হতে দেয়া হবে না। এজন্যই ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে পরাজিত মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়’। আমেরিকার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, কিন্তু ইসরায়েল-নীতির কোন পরিবর্তন হয় না।

ইসরায়েলের পক্ষে কে কতটুকু নিবেদিত তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কামালা হ্যারিসের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশায় ডেমোক্রেট দলের কামালা হ্যারিস মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতির কথা বলে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বিগত এক বছর ধরে একই কথা বলে আসছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের কট্টর সমর্থকÑ ইসরায়েলকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে তার কথাবার্তায় কোন রাখঢাক নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দম্ভোক্তি হচ্ছে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে হামাস ইসরায়েলকে আক্রমণের সাহসই করত না। এজন্যই ইসরায়েল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় কামনা করছে। জো বাইডেন মুখে মুখে যুদ্ধবিরতির কথা বললেও তিনি চান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধ্বংস হয়ে যাক।

অবশ্য শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিনাশ চায় এবং চায় বলেই জর্ডান ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করে, মিশর হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৮ সনে সম্পাদিত ক্যাম্পডেভিড চুক্তিই মিশরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলের আরেক প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া অভ্যন্তরীণ সিভিল ওয়ারে বিধ্বস্ত। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চাণক্যনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য মুসলিম দেশগুলো নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত। তাদের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয়, গাজা, পশ্চিম তীর বা লেবাননে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না, কোন শিশু মারা যাচ্ছে না, যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার কোন ঘাটতি নেই।

কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল এবং ইরানের ছায়াযুদ্ধ চলছে। ইরানের যেসব ব্যক্তি ইসরায়েলের জন্য হুমকি প্রতিপন্ন হয় তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের অনেক বিজ্ঞানীকে মোসাদ হত্যা করেছে, হত্যা করেছে ইরানের অভ্যন্তরে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে। শুধু গুপ্ত হত্যা নয়, প্রকাশ্যে বিমান হামলা চালিয়েও ইরানের লোকদের হত্যা করছে ইসরায়েল। চলতি বছরের পহেলা এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সাত কর্মকর্তা নিহত হয়। ইরান তিনশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ে পাল্টা আক্রমণ করে ১৩ এপ্রিল। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য আগত ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে ইরানের মাটিতেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। দুইশ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান এই হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে গত অক্টাবরের ১ তারিখে। ইসরায়েল কিছুদিন অপেক্ষা ২৬ তারিখেই পাল্টা আক্রমণ করল।

১৯৭৯ সনে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে শুধু সমর্থন করছে না, ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্যও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির বক্তব্য কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে। তিনি আগের মতো তাৎক্ষণিক পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা না বলেননি। তবে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের হামলার পাল্টা পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইরানকে মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার নির্দেশনা অনুযায়ী ইসরায়েলের এবারের হামলা ছিল সীমিত; তারা ইরানের তেল ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা করেনি। মজুত তেল, তেল খনি ও তেল সরবরাহের পাইপ লাইনে আক্রমণ হলে বিশ্ব আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ত। ইরানের কি উচিত হবে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির পরামর্শ অনুযায়ী ইসরায়েলের হামলাকে ‘অবহেলা বা অতিরঞ্জিত’ না করে পাল্টা হামলার ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়া?

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]

back to top