মাহরুফ চৌধুরী
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষাস্তরে ছাত্র রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যে ইতিহাস কিছুটা গৌরবোজ্জ্বল ও কিছুটা কলুষিত। বাংলা মুলুকে শুরুর দিকে ছাত্র রাজনীতি ছিল একটি ঐতিহাসিক ও শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের অংশ। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল দিকটি হলো ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রসমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা। আর ছাত্র রাজনীতির কলুষিত দিকটি হলো সহিংসতা, হলদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম করা।
সে যাই হোক, বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতি তার গৌরবময় অধ্যায় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে সংকটে রয়েছে ছাত্র রাজনীতি। দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতায় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে ছাত্রদের নেতৃত্ব দানের প্রকৃতি ও কল্যাণমুখী রাজনৈতিক চিন্তার জগতকে সংকুচিত করছে, যা তাদের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আর সে কারণেই বর্তমান বাস্তবতায় চলমান লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি দেশের সাধারণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।
ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এপ্রশ্নে সহজ সরল উত্তর কিন্তু এখন আর সহজে আমাদের মাথায় ঢুকবে না। কারণ ছাত্র রাজনীতি বললেই যে চিত্রটা আমাদের মানসপটে কিংবা চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা হলো দলীয় রাজনীতি ছত্রছায়ায় গোষ্ঠী স্বার্থের হোলিখেলা আর পেশীশক্তির প্রাবল্যে সহিংসতার কুৎসিত চিত্র। কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো সেদেশের জ্ঞান চর্চা, গবেষণা এবং জীবন ও জীবিকার জন্যে নানা কলাকৌশল শেখার কেন্দ্র। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জানা, শেখা ও চর্চার পরিধি শুধু একাডেমিক পড়াশোনার গ-িতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং একজন শিক্ষার্থীকে চিন্তাশীল, মুক্তমনা এবং সমাজসচেতন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করতে এপ্রতিষ্ঠানগুলো সবাই আয়োজন করে থাকে। রাজনীতির চর্চা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি শিক্ষার্থীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা করে সমাধানের পথে খোঁজার সুযোগ করে দেয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পরিম-লে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করা।
রাজনীতি করার এ সুযোগ শিক্ষার্থীদের চিন্তার গভীরতা এবং মতামত গঠনের স্বাধীনতা প্রদান করে, যা তাদের নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করলে কী ধরনের রাজনীতি করবে? ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল, মুক্তমনা এবং মানবিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ দেয়া। অধ্যায়নের পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত তৈরি করা, সামাজিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং জাতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই হওয়া উচিত ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে উচ্চশিক্ষাস্তরে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে দলীয় স্বার্থসিদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ছাত্রাবস্থায় কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের চিন্তাচেতনার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তারা একদিকে যেমন দলীয় মতবাদের মধ্যে আটকে যায় ও দলীয় নেতাদের সেবাদাসে পরিণত হয়, তেমনই অপরের ভিন্ন মতামতকে সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি আক্রমনাত্মক হয় ও অন্যমতের লোকজনকে ঘৃণা করতে শেখে। এই বয়সে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পুরো স্পেকট্রাম জানা, বোঝা ও শেখার সময়, কিন্তু লেজুড়বৃত্তির কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মধ্যে মুক্ত ও সৃজনশীল চিন্তা, পরমত সহিষ্ণুতা এবং মতামতের বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তি বলতে সাধারণত বুঝানো হয় যখন একজন ছাত্র বা একটি ছাত্র সংগঠন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং সেই দলের আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা ও সিধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে এবং একটা রাজনৈতিক দল ও সেই রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুগত হয়ে ওঠে। এমনকি দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ক্যাডার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাডার বলতে বোঝানো হয় এমন একদল ছাত্রকে যারা রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে, তাদের কোনো স্বাধীন চিন্তা বা নেতৃত্বের ক্ষমতা থাকে না। তারা কেবল দলীয় আদেশ পালন করতে গিয়ে তোতাপাখির মতো শেখে কিছু গৎবাঁধা বয়ান আর সেøাগান। এই অন্ধ আনুগত্য শুধু শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির ক্ষতি করে না, বরং তাদের ব্যক্তিগত নীতি-নৈতিকতারও ক্ষতি করে। তারা রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে, যেখানে তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের দলকে ক্ষমতায় নেয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখা। ফলে এ ধরনের কর্মকা- ছাত্রদের শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক আদর্শ থেকে তাদের বিচ্যুত করে এবং দেশ ও দশের কল্যাণে যে আসল রাজনীতি তার গুরুত্ব থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়।
দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্রদের নিজেদের সমস্যার কথা বলার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। তাই ছাত্র রাজনীতি যে একটি সামাজিক দায়িত্ব, সেই ভাবনা অনেকাংশে লোপ পেয়েছ। প্রকৃতপক্ষে, একটি আদর্শিক ছাত্রসংগঠন শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে এবং তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যেমন, শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হলে ছাত্ররা সেই বিষয়ে আন্দোলন গড়ে না তুলে বরং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকার কারণে আনন্দ মিছিল করে। এমন পরিস্থিতিতে তারা ছাত্র রাজনীতির মূল দায়দায়িত্ব থেকে সরে যায় এবং ছাত্রসংগঠনগুলো অনুসারী দলগুলোর রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন বা আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত নয়। বরং ছাত্র রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র হওয়া উচিত যেখানে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে জানবে, মুক্তমনে আলোচনা করবে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে শিখবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক স্বার্থ রক্ষা বা তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ এনে দেবে । এটি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে দেশ ও সমাজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে। ফলে তারা শুধু নির্দিষ্ট একটি দল বা মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে। পক্ষান্তরে, শিক্ষার্থীরা মূলত রাজনৈতিক দলের ‘মৌখিক অনুগামী’ হয়ে উঠে বলে তাদের ব্যক্তিগত চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে যায় এবং তাদের মাঝে তোষামোদির প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে দলীয় স্বার্থের প্রাধান্যে তাদের চোখে বাস্তব সমস্যার ব্যাপ্তি, কার্যকারণ ও সমাধানের উপায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতি তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে ফিরে আসা জরুরি। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পথটা হবে মুক্তচিন্তার বিকাশ ও কল্যাণমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতার উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। ছাত্ররা যাতে রাজনৈতিক ইস্যুতে মুক্ত আলোচনা করতে পারে, তাদের নিজস্ব মতামত গঠন করতে পারে এবং নানা সামাজিক ইস্যুতে দাবি তুলে নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে পারে। এটি তাদেরকে পরবর্তীতে জাতীয় নেতৃত্বে ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে। ছাত্র রাজনীতি থেকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি দূর করার মধ্য দিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সেই সংস্কৃতিতে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও সামাজিক ইস্যুতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং দেশ ও দশের কল্যাণে দায় ও দরদের ভিত্তিতে নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।
সে যাই হোক, এখন আমাদের সামনে দুটো পথ খোলাÑ একদিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির সংকীর্ণ রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অনুসরণ, অন্যদিকে মুক্তচিন্তা ও কল্যাণমুখী রাজনীতির নেতৃত্বের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা। এখন প্রশ্ন হলো, কোন পথে হাঁটবে আমাদের ছাত্রসমাজ?
ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে এবং দলীয় আনুগত্য থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা গঠনের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার জন্য একটি নৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ থাকতে হবে এবং তারা দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে। এটি করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, যাতে তারা ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার না করে, বরং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শিক্ষা এবং নেতৃত্ব গঠনে সহায়তা করে। তৃতীয়ত, ছাত্র রাজনীতি দলীয় ক্যাডার তৈরি করার পাটাতন হিসেবে নয়, বরং নেতৃত্বের গুণাবলি ও দক্ষতা অর্জন করার সূতিকাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত গঠন এবং তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে তারা দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মাথা ব্যথা হলে আমরা যেমন মাথা কেটে ফেলি না, তেমনি আমাদের ভাবতে হবে কিভাবে প্রকৃত সামষ্টিক কল্যাণের রাজনীতি করার সুযোগ রেখে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে তৈরি করা যায়। ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করতে চাইলে উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি করার একটি সঠিক পথ খোলা রাখতে হবে। এখানে মূল লক্ষ্য হবেÑ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তোলা, যা তাদের ভবিষ্যতে দেশ ও দশের উন্নয়নে কাজে আসবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, যেমন- শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর অধিকার এবং বেকারত্ব ইত্যাদি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে এবং তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের মুক্তচিন্তা ও ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মতামত গঠন করতে পারবে। এসব আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সমাজের বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের পাশাপাশি শ্রদ্ধার সঙ্গে মতানৈক্যের চর্চা করতে পারে।
ছাত্র রাজনীতি জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্র রাজনীতি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে। দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব গঠনের পথ তৈরি করতে হবে এবং তাদের মাঝে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির উদ্বোধনের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ। আমরা যদি রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষাসংস্কার প্রক্রিয়ায় সঠিক পথে হাঁটি, তবে ছাত্র রাজনীতি আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাটাতন হয়ে উঠতে পারে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষাস্তরে ছাত্র রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যে ইতিহাস কিছুটা গৌরবোজ্জ্বল ও কিছুটা কলুষিত। বাংলা মুলুকে শুরুর দিকে ছাত্র রাজনীতি ছিল একটি ঐতিহাসিক ও শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের অংশ। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল দিকটি হলো ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রসমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা। আর ছাত্র রাজনীতির কলুষিত দিকটি হলো সহিংসতা, হলদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম করা।
সে যাই হোক, বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতি তার গৌরবময় অধ্যায় থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে সংকটে রয়েছে ছাত্র রাজনীতি। দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতায় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে ছাত্রদের নেতৃত্ব দানের প্রকৃতি ও কল্যাণমুখী রাজনৈতিক চিন্তার জগতকে সংকুচিত করছে, যা তাদের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আর সে কারণেই বর্তমান বাস্তবতায় চলমান লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি দেশের সাধারণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।
ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? এপ্রশ্নে সহজ সরল উত্তর কিন্তু এখন আর সহজে আমাদের মাথায় ঢুকবে না। কারণ ছাত্র রাজনীতি বললেই যে চিত্রটা আমাদের মানসপটে কিংবা চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা হলো দলীয় রাজনীতি ছত্রছায়ায় গোষ্ঠী স্বার্থের হোলিখেলা আর পেশীশক্তির প্রাবল্যে সহিংসতার কুৎসিত চিত্র। কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো সেদেশের জ্ঞান চর্চা, গবেষণা এবং জীবন ও জীবিকার জন্যে নানা কলাকৌশল শেখার কেন্দ্র। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জানা, শেখা ও চর্চার পরিধি শুধু একাডেমিক পড়াশোনার গ-িতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং একজন শিক্ষার্থীকে চিন্তাশীল, মুক্তমনা এবং সমাজসচেতন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করতে এপ্রতিষ্ঠানগুলো সবাই আয়োজন করে থাকে। রাজনীতির চর্চা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি শিক্ষার্থীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা করে সমাধানের পথে খোঁজার সুযোগ করে দেয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পরিম-লে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করা।
রাজনীতি করার এ সুযোগ শিক্ষার্থীদের চিন্তার গভীরতা এবং মতামত গঠনের স্বাধীনতা প্রদান করে, যা তাদের নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যত নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করলে কী ধরনের রাজনীতি করবে? ছাত্র রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল, মুক্তমনা এবং মানবিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ দেয়া। অধ্যায়নের পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত তৈরি করা, সামাজিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং জাতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই হওয়া উচিত ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে উচ্চশিক্ষাস্তরে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে দলীয় স্বার্থসিদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ছাত্রাবস্থায় কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের চিন্তাচেতনার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তারা একদিকে যেমন দলীয় মতবাদের মধ্যে আটকে যায় ও দলীয় নেতাদের সেবাদাসে পরিণত হয়, তেমনই অপরের ভিন্ন মতামতকে সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি আক্রমনাত্মক হয় ও অন্যমতের লোকজনকে ঘৃণা করতে শেখে। এই বয়সে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পুরো স্পেকট্রাম জানা, বোঝা ও শেখার সময়, কিন্তু লেজুড়বৃত্তির কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মধ্যে মুক্ত ও সৃজনশীল চিন্তা, পরমত সহিষ্ণুতা এবং মতামতের বৈচিত্র্যকে শ্রদ্ধা করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তি বলতে সাধারণত বুঝানো হয় যখন একজন ছাত্র বা একটি ছাত্র সংগঠন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে এবং সেই দলের আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা ও সিধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে এবং একটা রাজনৈতিক দল ও সেই রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুগত হয়ে ওঠে। এমনকি দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ক্যাডার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাডার বলতে বোঝানো হয় এমন একদল ছাত্রকে যারা রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে, তাদের কোনো স্বাধীন চিন্তা বা নেতৃত্বের ক্ষমতা থাকে না। তারা কেবল দলীয় আদেশ পালন করতে গিয়ে তোতাপাখির মতো শেখে কিছু গৎবাঁধা বয়ান আর সেøাগান। এই অন্ধ আনুগত্য শুধু শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির ক্ষতি করে না, বরং তাদের ব্যক্তিগত নীতি-নৈতিকতারও ক্ষতি করে। তারা রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে, যেখানে তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের দলকে ক্ষমতায় নেয়া বা ক্ষমতা ধরে রাখা। ফলে এ ধরনের কর্মকা- ছাত্রদের শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক আদর্শ থেকে তাদের বিচ্যুত করে এবং দেশ ও দশের কল্যাণে যে আসল রাজনীতি তার গুরুত্ব থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়।
দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্রদের নিজেদের সমস্যার কথা বলার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। তাই ছাত্র রাজনীতি যে একটি সামাজিক দায়িত্ব, সেই ভাবনা অনেকাংশে লোপ পেয়েছ। প্রকৃতপক্ষে, একটি আদর্শিক ছাত্রসংগঠন শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে এবং তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যেমন, শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হলে ছাত্ররা সেই বিষয়ে আন্দোলন গড়ে না তুলে বরং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকার কারণে আনন্দ মিছিল করে। এমন পরিস্থিতিতে তারা ছাত্র রাজনীতির মূল দায়দায়িত্ব থেকে সরে যায় এবং ছাত্রসংগঠনগুলো অনুসারী দলগুলোর রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন বা আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত নয়। বরং ছাত্র রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র হওয়া উচিত যেখানে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে জানবে, মুক্তমনে আলোচনা করবে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে শিখবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক স্বার্থ রক্ষা বা তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ এনে দেবে । এটি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে দেশ ও সমাজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে। ফলে তারা শুধু নির্দিষ্ট একটি দল বা মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে। পক্ষান্তরে, শিক্ষার্থীরা মূলত রাজনৈতিক দলের ‘মৌখিক অনুগামী’ হয়ে উঠে বলে তাদের ব্যক্তিগত চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে যায় এবং তাদের মাঝে তোষামোদির প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে দলীয় স্বার্থের প্রাধান্যে তাদের চোখে বাস্তব সমস্যার ব্যাপ্তি, কার্যকারণ ও সমাধানের উপায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতি তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে ফিরে আসা জরুরি। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পথটা হবে মুক্তচিন্তার বিকাশ ও কল্যাণমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতার উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। ছাত্ররা যাতে রাজনৈতিক ইস্যুতে মুক্ত আলোচনা করতে পারে, তাদের নিজস্ব মতামত গঠন করতে পারে এবং নানা সামাজিক ইস্যুতে দাবি তুলে নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে পারে। এটি তাদেরকে পরবর্তীতে জাতীয় নেতৃত্বে ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে। ছাত্র রাজনীতি থেকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি দূর করার মধ্য দিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সেই সংস্কৃতিতে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও সামাজিক ইস্যুতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং দেশ ও দশের কল্যাণে দায় ও দরদের ভিত্তিতে নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।
সে যাই হোক, এখন আমাদের সামনে দুটো পথ খোলাÑ একদিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির সংকীর্ণ রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অনুসরণ, অন্যদিকে মুক্তচিন্তা ও কল্যাণমুখী রাজনীতির নেতৃত্বের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা। এখন প্রশ্ন হলো, কোন পথে হাঁটবে আমাদের ছাত্রসমাজ?
ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে এবং দলীয় আনুগত্য থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা গঠনের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার জন্য একটি নৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ থাকতে হবে এবং তারা দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে। এটি করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, যাতে তারা ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার না করে, বরং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শিক্ষা এবং নেতৃত্ব গঠনে সহায়তা করে। তৃতীয়ত, ছাত্র রাজনীতি দলীয় ক্যাডার তৈরি করার পাটাতন হিসেবে নয়, বরং নেতৃত্বের গুণাবলি ও দক্ষতা অর্জন করার সূতিকাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ইস্যুতে মতামত গঠন এবং তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে তারা দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মাথা ব্যথা হলে আমরা যেমন মাথা কেটে ফেলি না, তেমনি আমাদের ভাবতে হবে কিভাবে প্রকৃত সামষ্টিক কল্যাণের রাজনীতি করার সুযোগ রেখে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে তৈরি করা যায়। ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করতে চাইলে উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি করার একটি সঠিক পথ খোলা রাখতে হবে। এখানে মূল লক্ষ্য হবেÑ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তোলা, যা তাদের ভবিষ্যতে দেশ ও দশের উন্নয়নে কাজে আসবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, যেমন- শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর অধিকার এবং বেকারত্ব ইত্যাদি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে এবং তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের মুক্তচিন্তা ও ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মতামত গঠন করতে পারবে। এসব আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সমাজের বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের পাশাপাশি শ্রদ্ধার সঙ্গে মতানৈক্যের চর্চা করতে পারে।
ছাত্র রাজনীতি জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্র রাজনীতি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে। দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব গঠনের পথ তৈরি করতে হবে এবং তাদের মাঝে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির উদ্বোধনের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ। আমরা যদি রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষাসংস্কার প্রক্রিয়ায় সঠিক পথে হাঁটি, তবে ছাত্র রাজনীতি আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাটাতন হয়ে উঠতে পারে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]