alt

opinion » post-editorial

মুজিব কি কেবলই ছবি

আনোয়ারুল হক

: মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও দেশ এবং দেশ পরিচালকরা অস্থিরতার মধ্যেই আছে। গত ১০ নভেম্বর এবারের আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত জনাব মাহফুজ আলম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন। তিনি মাথার ওপর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের ছবিটি রেখে শপথ নেন এবং শপথ শেষে নামিয়ে ফেলেন। একে অস্থিরতা বলব না তো কি বলব! আবার ওই ছবিবিহীন স্থানে দাঁড়িয়ে বিজয়ের ভঙ্গিতে নিজের ছবিসহ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে বিতর্কের অবতারণা করেছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিক মাসুদ কামাল কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করার পর পরই সংবিধান লংঘন করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এর পরের দিন আর একটি স্ট্যাটাস দিয়ে মাহফুজ বলেন, ‘ছবিটি কর্মকর্তারা নামিয়েছেন’।

তবে দুটি স্ট্যাটাসেই তিনি আরো এমন সব বিষয় অবতারণা করেছেন, যা তার পূর্বে দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে যায় না। তিনি পূর্বে বলেছিলেনÑ ‘২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ১৯৭১ সালে উন্মেষ ঘটা জাতির বাসনা পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের পূর্বপুরুষের লড়াই এবং লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে বাসনা ছিল, সেটা আমরা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ পেলাম।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না’। (সূত্রঃ প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকার)

১৯৭১ সালে জাতির স্বাধীন ভূখ- গঠনের যে বাসনা এবং সাম্য, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা তা রূপায়নে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কে, সেটাও তো জনাব মাহফুজ আলমের অজানা নয়। একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যে কোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।’

কিন্তু এখন তিনি বলছেন, কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে শেখের ছবি নামানো হয়েছে। এ কেমন কথা! স্কুলে ছাত্রছাত্রী অসদাচরণ করলে যেমন অভিভাবকে ডেকে পাঠানো হয় তেমনি হাসিনার অপরাধের জন্য মুজিবের ছবি টেনে নামানো হলো। মাহফুজ আলম আরো বলেছেন, স্বাধীনতার পর পিতার ‘কৃত অপরাধের’ জন্য এখন কন্যা ক্ষমা চাইলে পিতাকে আবার সম্মানের আসনে বসানো হবে। কিন্তু উনি কি বোঝেন না জাতীয় সম্পদেও যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন নাÑ তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই।

মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস দেখে আমার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ছে। শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রসঙ্গে শাহবাজ শরীফ বলেন, ‘যিনি খারাপ কাজ করবেন তা ফের তার ওপরই আসবে। শেখ মুজিবুর রহমান এই অবিভক্ত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছিলেন। যিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি অবশেষে তার করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন।’

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মনযাতনা দেখে আমার মনে হয়েছে শেখ দেয়ালের ছবিতে না থাকলেও আমাদের সঙ্গে এই বাংলাদেশেই আছেন। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেননা তিনিই আমাদের স্বাধীনতার নেতা। অবশ্যই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একদিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ অবস্থা, দলীয় লোকজনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যদিকে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে দেশের কিছু এলাকায় সশস্ত্র লড়াই, ঈদ জামাতে গুলি করে জনপ্রতিনিধি হত্যা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে হরতালের ডাক ইত্যাদি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি কতটুকু প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, গণতন্ত্রের পরিসর কতটুকু সংকুচিত করেছেনÑ সেসব নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে...।

এবারের আন্দোলনের ছাত্র নেতারা প্রায়শই বলে থাকেন, তারা এখনও ‘ট্রমাটাইজড’। মুজিবের ছবি নামানো এবং সেটাকে কেন্দ্র করে পোস্ট দেখে মনে হয় তারা আসলেই ‘ট্রমাটাইজড’। কেউ কেউ তো গত ১০০ দিনে নাকি ১০০ ঘণ্টাও ঘুমাইতে পারেন নাই। ট্রমাটাইজড অবস্থা কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টি করে। তাই তারা দ্রুত ট্রমা ও অস্থিরতা থেকে বের হয়ে আসুন। শেখ হাসিনাও কিন্তু ট্রমাটাইজড ছিলেন! সে বিষয়ে আরেক দিন লেখার ইচ্ছা আছে।

বর্তমান সরকারে বহুমুখী ভাবধারার মানুষের সমন্বয় হয়েছে। কিন্তু যারা চালিকা শক্তি হিসেবে পেছনে আছেন মাঝে মাঝে মনে হয় কতৃত্ববাদী হাসিনা বা আওয়ামী দুঃশাসন অপেক্ষা ’৭১ বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের আক্রোশ বেশি। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। তাই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মুজিবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন! আর এই সুযোগ শেখ হাসিনা করে দিয়ে গেছেন সবখানেই মুজিবের ছবি, সব মোড়েই মুজিবের ভাস্কর্য, সব প্রতিষ্ঠান স্থাপনা মুজিবের নামে, সবকিছুই মুজিবময় করার বিরক্তিকর ও স্বেচ্ছাচারী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

এবারের আন্দোলনের এই স্বপ্নীল উত্তরণের জননী শেখ হাসিনা, তার ভয়ংকর নোংরা দীর্ঘস্থায়ী কর্তৃত্ববাদ। মাহফুজ আলমদের সবচেয়ে বেশি ঋণী থাকা উচিত শেখ হাসিনার কাছে। এখানে জামায়াত-শিবির এমনকি বিএনপিও স্বনামে, নিজ পরিচয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পায় না। এখানে সফলতা পেতে হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের জমিন লাগে, জাতীয় পতাকার লাল সূর্য কপালে ধারণ করা লাগে, ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ কণ্ঠে তুলে নিতে লাগে!

আবার এসব দেখে দেশবাসীও নিশ্চিন্ত হয় যে আশার সব জায়গাগুলো এখনো জীবিত আছে। কঠিনেরে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রূপকথার গল্পের চেয়েও উজ্জ্বল এক সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখা এই দলকে এখন তার নিজের দেশের মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাকা-ের দায় নিতে হচ্ছে। এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগের রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। তারপরেও আন্দোলনের সামনের কাতারে থাকা নেতারা কিসের ভয়ে এত অস্থির!

মাহফুজ আলম দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন প্রক্রিয়া, ভবিষ্যৎ সরকার সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ আলোচনা ও প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্ক না করে সে সব বিষয়ে অধিক মনযোগ দিয়ে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তোরণের পন্থা বের করতে পারলে এবারের আন্দোলনের সাফল্য স্থায়ী রূপ পাবে।

[লেখক : সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী]

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

tab

opinion » post-editorial

মুজিব কি কেবলই ছবি

আনোয়ারুল হক

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও দেশ এবং দেশ পরিচালকরা অস্থিরতার মধ্যেই আছে। গত ১০ নভেম্বর এবারের আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত জনাব মাহফুজ আলম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন। তিনি মাথার ওপর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের ছবিটি রেখে শপথ নেন এবং শপথ শেষে নামিয়ে ফেলেন। একে অস্থিরতা বলব না তো কি বলব! আবার ওই ছবিবিহীন স্থানে দাঁড়িয়ে বিজয়ের ভঙ্গিতে নিজের ছবিসহ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে বিতর্কের অবতারণা করেছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিক মাসুদ কামাল কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করার পর পরই সংবিধান লংঘন করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এর পরের দিন আর একটি স্ট্যাটাস দিয়ে মাহফুজ বলেন, ‘ছবিটি কর্মকর্তারা নামিয়েছেন’।

তবে দুটি স্ট্যাটাসেই তিনি আরো এমন সব বিষয় অবতারণা করেছেন, যা তার পূর্বে দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে যায় না। তিনি পূর্বে বলেছিলেনÑ ‘২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ১৯৭১ সালে উন্মেষ ঘটা জাতির বাসনা পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের পূর্বপুরুষের লড়াই এবং লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে বাসনা ছিল, সেটা আমরা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ পেলাম।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না’। (সূত্রঃ প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকার)

১৯৭১ সালে জাতির স্বাধীন ভূখ- গঠনের যে বাসনা এবং সাম্য, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা তা রূপায়নে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কে, সেটাও তো জনাব মাহফুজ আলমের অজানা নয়। একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যে কোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।’

কিন্তু এখন তিনি বলছেন, কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে শেখের ছবি নামানো হয়েছে। এ কেমন কথা! স্কুলে ছাত্রছাত্রী অসদাচরণ করলে যেমন অভিভাবকে ডেকে পাঠানো হয় তেমনি হাসিনার অপরাধের জন্য মুজিবের ছবি টেনে নামানো হলো। মাহফুজ আলম আরো বলেছেন, স্বাধীনতার পর পিতার ‘কৃত অপরাধের’ জন্য এখন কন্যা ক্ষমা চাইলে পিতাকে আবার সম্মানের আসনে বসানো হবে। কিন্তু উনি কি বোঝেন না জাতীয় সম্পদেও যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন নাÑ তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই।

মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস দেখে আমার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ছে। শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রসঙ্গে শাহবাজ শরীফ বলেন, ‘যিনি খারাপ কাজ করবেন তা ফের তার ওপরই আসবে। শেখ মুজিবুর রহমান এই অবিভক্ত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছিলেন। যিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি অবশেষে তার করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন।’

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মনযাতনা দেখে আমার মনে হয়েছে শেখ দেয়ালের ছবিতে না থাকলেও আমাদের সঙ্গে এই বাংলাদেশেই আছেন। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেননা তিনিই আমাদের স্বাধীনতার নেতা। অবশ্যই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একদিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ অবস্থা, দলীয় লোকজনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যদিকে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে দেশের কিছু এলাকায় সশস্ত্র লড়াই, ঈদ জামাতে গুলি করে জনপ্রতিনিধি হত্যা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে হরতালের ডাক ইত্যাদি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি কতটুকু প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, গণতন্ত্রের পরিসর কতটুকু সংকুচিত করেছেনÑ সেসব নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে...।

এবারের আন্দোলনের ছাত্র নেতারা প্রায়শই বলে থাকেন, তারা এখনও ‘ট্রমাটাইজড’। মুজিবের ছবি নামানো এবং সেটাকে কেন্দ্র করে পোস্ট দেখে মনে হয় তারা আসলেই ‘ট্রমাটাইজড’। কেউ কেউ তো গত ১০০ দিনে নাকি ১০০ ঘণ্টাও ঘুমাইতে পারেন নাই। ট্রমাটাইজড অবস্থা কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টি করে। তাই তারা দ্রুত ট্রমা ও অস্থিরতা থেকে বের হয়ে আসুন। শেখ হাসিনাও কিন্তু ট্রমাটাইজড ছিলেন! সে বিষয়ে আরেক দিন লেখার ইচ্ছা আছে।

বর্তমান সরকারে বহুমুখী ভাবধারার মানুষের সমন্বয় হয়েছে। কিন্তু যারা চালিকা শক্তি হিসেবে পেছনে আছেন মাঝে মাঝে মনে হয় কতৃত্ববাদী হাসিনা বা আওয়ামী দুঃশাসন অপেক্ষা ’৭১ বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের আক্রোশ বেশি। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। তাই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মুজিবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন! আর এই সুযোগ শেখ হাসিনা করে দিয়ে গেছেন সবখানেই মুজিবের ছবি, সব মোড়েই মুজিবের ভাস্কর্য, সব প্রতিষ্ঠান স্থাপনা মুজিবের নামে, সবকিছুই মুজিবময় করার বিরক্তিকর ও স্বেচ্ছাচারী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

এবারের আন্দোলনের এই স্বপ্নীল উত্তরণের জননী শেখ হাসিনা, তার ভয়ংকর নোংরা দীর্ঘস্থায়ী কর্তৃত্ববাদ। মাহফুজ আলমদের সবচেয়ে বেশি ঋণী থাকা উচিত শেখ হাসিনার কাছে। এখানে জামায়াত-শিবির এমনকি বিএনপিও স্বনামে, নিজ পরিচয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পায় না। এখানে সফলতা পেতে হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের জমিন লাগে, জাতীয় পতাকার লাল সূর্য কপালে ধারণ করা লাগে, ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ কণ্ঠে তুলে নিতে লাগে!

আবার এসব দেখে দেশবাসীও নিশ্চিন্ত হয় যে আশার সব জায়গাগুলো এখনো জীবিত আছে। কঠিনেরে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রূপকথার গল্পের চেয়েও উজ্জ্বল এক সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখা এই দলকে এখন তার নিজের দেশের মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাকা-ের দায় নিতে হচ্ছে। এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগের রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। তারপরেও আন্দোলনের সামনের কাতারে থাকা নেতারা কিসের ভয়ে এত অস্থির!

মাহফুজ আলম দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন প্রক্রিয়া, ভবিষ্যৎ সরকার সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরত্বপূর্ণ আলোচনা ও প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্ক না করে সে সব বিষয়ে অধিক মনযোগ দিয়ে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তোরণের পন্থা বের করতে পারলে এবারের আন্দোলনের সাফল্য স্থায়ী রূপ পাবে।

[লেখক : সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী]

back to top