রেজাউল করিম খোকন
পৃথিবীর যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আর সব দেশেরই গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। প্রতিটি রাষ্ট্রই কৃষি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কৃষির উন্নয়ন প্রকারান্তরে কৃষকের উন্নয়ন। গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা শহরাঞ্চল থেকে ভিন্নতর হলেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়াসহ প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা গেলে তা উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সহায়ক হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে যেটি প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এখন গ্রামের পথঘাট অনেক উন্নত। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলো পাকা রাস্তার মাধ্যমে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীরা সৌরবিদ্যুতের বদৌলতে আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের গৃহভিত্তিক প্রকল্প তিন দশকের অধিক সময় আগে যাত্রা শুরু করলেও এ ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। উন্নত বাংলাদেশের পথে এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।
‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’ সেøাগানের বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক পণ্যকে মূলধারার বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। পণ্যের সঙ্গে পণ্যের কারিগরদেরও মূল্যায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। কোন গ্রাম থেকে কোন কারিগর পণ্যটি তৈরি করল; তা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে হলে পণ্য তৈরির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামে তৈরি পণ্যের কারিগর ও তৈরির স্থান চিহ্নিত করে তা দেশি-বিদেশি বাজারে পৌঁছে দেয়া হবে। পল্লী পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, বহুমুখীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমের সমাহারে জীবিকায়ন শিল্প পল্লী উন্নয়নে নবযুগের সূচনা করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লী অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এলাকাভিত্তিক সুফলভোগীদের জন্য তাদের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোসহ কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে সরকারি বেতনভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এ কথাটি সত্য যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ ও বিভিন্ন সারের আনুপাতিক ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় এমন সব সফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব।
তাছাড়া অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসঙ্গে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না। বর্তমানে আমাদের বেশ কিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। এসব পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রপ্তানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের লক্ষ্যে বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নকালে যথাযথ বরাদ্দ দিতে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বিরাট অংশ জনপ্রতিনিধি ও সরকারি ব্যক্তিরা লুণ্ঠন করায় তা কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারেনি। আর এ কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি সমভাবে কুটির শিল্প স্থাপন ও অন্যান্য শিল্প কারখানার বিকাশ সাধন করা গেলে গ্রামের মানুষ জীবিকা ও বাড়তি আয়ের অন্বেষণে হয়তো শহরমুখী হবে না।
এসএমই উদ্যোক্তাদের সক্ষম করে গড়ে তোলা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বর্তমান চাহিদার আলোকে প্রযুক্তি ব্যবহার, উদ্ভাবন, জ্ঞান বিনিময় ও বিপণন বিষয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের জন্য কর-ভ্যাটের আলাদা নীতিমালা করা প্রয়োজন। সারা বিশ্বেই অর্থনীতি এমএসএমই খাতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, কাঁচামালের স্বল্পতা প্রভৃতি সংকটের মধ্যেও এসএমই খাত আশা দেখাচ্ছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নীতি ও ব্যবসায়িক সহযোগিতা প্রয়োজন। এমএসএমই খাতের সংজ্ঞা মেনে কর ও ভ্যাট আদায় করা হয় না।
এতে উদ্যোক্তারা অসুবিধায় পড়েন। প্রান্তিক ও নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ঋণের ক্ষেত্রে বর্তমানে গ্রুপ গ্যারান্টির মতো অনেক সুবিধা রয়েছে। তবে না জানার কারণে উদ্যোক্তারা এসব সুবিধা নিতে পারেন না। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে নারী উদ্যোক্তারা সঠিক সময়ে ঋণ নিতে পারেন না। গ্রামভিত্তিক শিল্প উন্নয়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়নÑ কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিত্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন জরুরি। এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্যই কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। কৃষি খাতে আধুনিকায়নে খরচ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষি খাতে আরও বেশি হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন প্রয়োজন। উন্নত বাংলাদেশের পথে মূলধারার কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে ও তৃণমূল উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
রেজাউল করিম খোকন
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
পৃথিবীর যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আর সব দেশেরই গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। প্রতিটি রাষ্ট্রই কৃষি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কৃষির উন্নয়ন প্রকারান্তরে কৃষকের উন্নয়ন। গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা শহরাঞ্চল থেকে ভিন্নতর হলেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়াসহ প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা গেলে তা উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সহায়ক হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে যেটি প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এখন গ্রামের পথঘাট অনেক উন্নত। এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলো পাকা রাস্তার মাধ্যমে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীরা সৌরবিদ্যুতের বদৌলতে আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের গৃহভিত্তিক প্রকল্প তিন দশকের অধিক সময় আগে যাত্রা শুরু করলেও এ ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। উন্নত বাংলাদেশের পথে এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।
‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’ সেøাগানের বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক পণ্যকে মূলধারার বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। পণ্যের সঙ্গে পণ্যের কারিগরদেরও মূল্যায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। কোন গ্রাম থেকে কোন কারিগর পণ্যটি তৈরি করল; তা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে হলে পণ্য তৈরির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামে তৈরি পণ্যের কারিগর ও তৈরির স্থান চিহ্নিত করে তা দেশি-বিদেশি বাজারে পৌঁছে দেয়া হবে। পল্লী পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, বহুমুখীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমের সমাহারে জীবিকায়ন শিল্প পল্লী উন্নয়নে নবযুগের সূচনা করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লী অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এলাকাভিত্তিক সুফলভোগীদের জন্য তাদের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোসহ কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে সরকারি বেতনভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এ কথাটি সত্য যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ ও বিভিন্ন সারের আনুপাতিক ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় এমন সব সফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পন্থায় চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব।
তাছাড়া অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসঙ্গে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না। বর্তমানে আমাদের বেশ কিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। এসব পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রপ্তানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের লক্ষ্যে বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নকালে যথাযথ বরাদ্দ দিতে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বিরাট অংশ জনপ্রতিনিধি ও সরকারি ব্যক্তিরা লুণ্ঠন করায় তা কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারেনি। আর এ কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি সমভাবে কুটির শিল্প স্থাপন ও অন্যান্য শিল্প কারখানার বিকাশ সাধন করা গেলে গ্রামের মানুষ জীবিকা ও বাড়তি আয়ের অন্বেষণে হয়তো শহরমুখী হবে না।
এসএমই উদ্যোক্তাদের সক্ষম করে গড়ে তোলা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বর্তমান চাহিদার আলোকে প্রযুক্তি ব্যবহার, উদ্ভাবন, জ্ঞান বিনিময় ও বিপণন বিষয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের জন্য কর-ভ্যাটের আলাদা নীতিমালা করা প্রয়োজন। সারা বিশ্বেই অর্থনীতি এমএসএমই খাতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, কাঁচামালের স্বল্পতা প্রভৃতি সংকটের মধ্যেও এসএমই খাত আশা দেখাচ্ছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নীতি ও ব্যবসায়িক সহযোগিতা প্রয়োজন। এমএসএমই খাতের সংজ্ঞা মেনে কর ও ভ্যাট আদায় করা হয় না।
এতে উদ্যোক্তারা অসুবিধায় পড়েন। প্রান্তিক ও নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ঋণের ক্ষেত্রে বর্তমানে গ্রুপ গ্যারান্টির মতো অনেক সুবিধা রয়েছে। তবে না জানার কারণে উদ্যোক্তারা এসব সুবিধা নিতে পারেন না। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে নারী উদ্যোক্তারা সঠিক সময়ে ঋণ নিতে পারেন না। গ্রামভিত্তিক শিল্প উন্নয়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়নÑ কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিত্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন জরুরি। এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্যই কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে। কৃষি খাতে আধুনিকায়নে খরচ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষি খাতে আরও বেশি হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন প্রয়োজন। উন্নত বাংলাদেশের পথে মূলধারার কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে ও তৃণমূল উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]