মাহরুফ চৌধুরী
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু শিক্ষার মানকেই নয়, বরং সমগ্র সমাজের কাঠামোকে পরিবর্তিত ও প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যক্তিক ও সামাজিক উন্নয়নের নৈতিক দায় ও পেশাগত গুরুদায়িত্বের কারণে শিক্ষকদের বলা হয়ে থাকে জাতির বিবেক। পেশাগত জীবনে শিক্ষকদের যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার কথা, তা দলীয় আনুগত্য এবং স্বার্থপর রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর ফলে একদিকে শিক্ষকদের পেশাগত মান-মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা প্রদান ও তাদের মাঝে কল্যাণমুখী জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য মূল্যবোধ গড়ে তোলা, যাতে তারা নিজস্ব মেধায় অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই শিক্ষা নামক জাতির মেরুদ-কে সচল ও শক্তিশালী রাখা এবং জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম।
শিক্ষক রাজনীতির বর্তমান যে চিত্রটা জনসাধারণের মনে অঙ্কিত, তা বিগত কয়েক দশকে অভিজ্ঞতার আলোকে মোটেও সুখপ্রদ নয়। তার পেছনে যতসব কারণই থাকুক না কেন, এটি শিক্ষার মতো সম্মানজনক পেশার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িত হওয়া, নানা অপকর্মে সম্পৃক্ততা তথা স্বার্থান্বেষী কর্মকা- এবং ক্ষমতাবানদের তোষামদি ও অপ্রয়োজনী আনুগত্য শিক্ষক সমাজের পেশাগত সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতাকে অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠার বদলে তারা হয়ে উঠছেন নৈতিক অধপতন, বৈষম্য ও বিভাজনের মূর্ত প্রতীক। ফলে শিক্ষক রাজনীতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগের লেখাগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষকতা আর দশটা পেশার মতোই একটা পেশা নয়। এই পেশার লোকজন আগামী প্রজন্মের বোধ, বুদ্ধি ও উপলব্ধির উদ্বোধনের মাধ্যমে তাদের স্বপ্ন-সারথি হয়ে একজন শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই এখানে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সরাসরি প্রভাব তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। একদিকে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া পেশাগত নীতি-নৈতিক ও আত্মসম্মানবোধের পরিপন্থি। অপরদিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতির খতিয়ান দেখলে বোঝা যায় তার ব্যাপকতা ও সেসবের কুপ্রভাবে গভীরতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের একটি বড় অংশ দলীয় রাজনীতির প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শিক্ষাদান ও গবেষণার পরিবর্তে তাদেও কর্মকান্ডের মোটা অংশজুড়েই থাকে দলীয় লেজুজবৃত্তিক রাজনীতির সম্পৃক্ত কাজকর্ম। এক সময় আমাদের দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল জ্ঞানার্জন, গবেষণা ও মুক্তচিন্তার ধারক, বাহক ও পথপ্রদর্শক, সেখানে এখন ক্ষমতার লড়াই, দলাদলি, কোন্দল এবং দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে দলীয় পরিচয় ও প্রভাব যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতে সরকার পতনের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগ ও পলায়ন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা আমাদের নৈতিক দেউলিয়াপনারও স্মারক এবং গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটা সুস্পষ্ট যে, দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক পরিবেশকে যেমন বিনষ্ট করছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করে হতাশা ও শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নানা বৈষম্যের।
নিকট অতীতে দেখা গিয়েছে যে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিরপেক্ষভাবে তাদের পেশাগত দায়দায়িত্ব তথা শিক্ষাদানের পরিবর্তে দলীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের এ ধরনের কর্মকা- শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শকেই ক্ষুণœ করেনি, বরং জাতির কাছে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধকেও কুলষিত করেছে। এক সময় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষকদের কল্যাণ ও অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কাজ করত; কিন্তু এখন শিক্ষকদের এ সংগঠনগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে দলীয় ও গোষ্ঠি স্বার্থে কাজ করছে যা সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত। ফলে শিক্ষকদের পেশাগত সংগঠন হিসেবে শিক্ষক সমাজের অধিকার আদায়ের পরিবর্তে দলীয় ক্ষমতা চর্চার পাওয়া হাউস হিসেবে কাজ করছে। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কাছে এসব সংগঠনের পেশাগত পরিচয় ম্লান হয়ে পড়েছে।
উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রথাগত শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ, যা একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গৌরবের বিষয় ছিল, সেটি এখন শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ায় পাঠদান ও গবেষণায় তারা মনোনিবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
অপরদিকে শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরি হওয়ায় একাডেমিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষক রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং তাদের যথাযথ শিক্ষার সুযোগ ও অর্জিত শিক্ষার গুণগতমান কমে যাচ্ছে। কার্যত অধ্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নাপারায় তাদের ভবিষ্যত কর্মসংস্থান গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও দক্ষতার উন্নয়ন কেন্দ্র হয়ে ওঠার পরিবর্তে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, পেশিতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবের ফল হিসেবে উচ্চশিক্ষায় যেসব নেতিবাচক বিষয়গুলো প্রকট হয়ে উঠেছে, সেগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে উচ্চশিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ক্ষমতার বলয়কে সুসংহত করতে ও শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে দলীয় ভোটার বাড়াতে শিক্ষক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া শুধু মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের জন্য বঞ্চনার কারণ হচ্ছে না, বরং সামগ্রিক শিক্ষার মানকে নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বঞ্চিত হচ্ছে সেরা শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসকদের সেবা পাওয়া থেকে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যত পেশাগত ও সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষাস্তরে গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রমাগত স্থবিরতা উচ্চশিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠদান ও দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্যনতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম কাজ। দলীয় রাজনীতিতে বেশি সময় দেওয়ায় শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক কর্মকান্ড তথা পাঠদান ও গবেষণার পাশাপাশি সৃজনশীল কার্যক্রমে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছেন না। ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার মানোন্নয়ন দূরের কথা, দেশের অভ্যন্তরীণ অত্যাবশ্যকীয় গবেষণাকর্মও স্থবির হয়ে পড়েছে। গবেষণা প্রস্তাবনাপত্রের গুণগতমানের ওপর নয়, গবেষণার অনুদানও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানসৃষ্টি ও দক্ষতার উন্নয়নের সক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
উপাচার্যসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের সন্তুষ্ট করা, যা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত তিন দশকে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নানা ঘটনা। সেসবে উঠে এসেছে দলীয় বিবেচনায় রাজনৈতিক বা পারিবারিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে বিশেষ প্রার্থীদের চাকরি দিতে নির্ধারিত নিয়মাবলি উপেক্ষা করে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে যোগ্য প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থেকে বাদ পড়ে, আর দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে অযোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষক হওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। এর ফলে শিক্ষকতায় ও প্রশাসনে পেশাদারিত্বের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বঞ্চিত প্রার্থীরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এবং সেবা দিচ্ছেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। ফলে দেশ হারাচ্ছে মেধাবীদের আর আমাদেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হারাচ্ছে যোগ্য শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসকদেরকে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা কেলেঙ্কারিতে শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকরাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অতি সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। শিক্ষকেরা যখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন শিক্ষক তার পেশাগত নিরপেক্ষতা হারান এবং অনিবার্য পরিণতি হিসেবে শিক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার হন। ফলে অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দলীয় বিভক্তি তৈরি হয়, যা তাদের পড়াশুনা, ভবিষ্যত ক্যারিয়ার গঠন এবং নৈতিকতার বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং জড়িয়ে পড়েন নানা অন্যায় অবিচারে। অপছন্দের শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করতে তাদের বাধে না। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনিয়মের অভিযোগগুলো খেয়াল করলেই অন্যায় অবিচারের মাত্রা সহজেই অনুমান করা যায়।
শিক্ষক রাজনীতির সবচেয়ে দৃশ্যমান নেতিবাচক প্রভাব হলো স্বজনপ্রীতি ও বৈষম্য যা শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ে নানাভাবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষকেরা যখন দলীয় রাজনীতিতে লিপ্ত হন ও পক্ষপাতিত্ব করেন, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভাজন ও পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা দেখা দেয়। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতার পরিবর্ততে বিরোধীদের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে ওঠে তারা, যা তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, নৈতিকতা এবং ক্যারিয়ারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের যন্ত্রে পরিণত হয়, যা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে বিপন্ন করে তুলছে।
শিক্ষক রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখা দিয়েছে নানা প্রশাসনিক সংকট, যা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন ও তার কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে দলীয় রাজনীতির ব্যাপক প্রভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুশাসনের অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। প্রশাসন যখন নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত হয়। আর বিরোধী মতামত দমনে নিপীড়কদের সহযোগী হয়ে ওঠে প্রশাসন, যা সম্পূর্ণরূপে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ও এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেশাগত নৈতিকতার পরিপন্থি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাবে, আর্থিক দুর্নীতি তথা বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনিয়মও ক্রমশ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে বার্ষিক বাজেটে গবেষণা ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে দলীয় প্রভাবে ঠিকাদারির মাধ্যমে অর্থ ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য অনাবশ্যকীয় অবকাঠামোর উন্নয়নসহ অপ্রয়োজনীয় খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনিয়ম, অন্যায়, অবিচার বা অধিকার আদায়ের ছাত্র আন্দোলন দমনে পক্ষপাতমূলক আচরণ দলীয় প্রভাবের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি নাকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের সিসিটিভির ফুটেজ সরবরাহ করতেন সরকারি গোয়েন্দাদের। আর সেসব দেখে দেখে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের দায়িত্ব ভুলে হয়ে পড়ছেন তাদের নিপীড়ক।
শিক্ষকদের দলীয় পক্ষপাতিত্ব শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ায় না, বরং শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করার মধ্য দিয়ে সমগ্র ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুইজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও অবস্থান তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হওয়ার বদলে বিভক্তি, বৈষম্য এবং দলীয় স্বার্থসিদ্ধির রঙ্গশালায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসন নীরব থাকে এসব অনৈতিক দুষ্কৃতকারী ও নিপীড়ক শিক্ষকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে।
বর্তমান পরিস্থিতে শিক্ষকদের উচিত তাদের মূল দায়িত্ব, অর্থাৎ নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের জন্যে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার পরিবেশ নিশ্চিত করা। দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখে পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখা শিক্ষকদের জন্য অত্যাবশ্যক। এটি করা না হলে উচ্চশিক্ষার মান যেমন নিম্নমুখী হতে থাকবে, তেমনি সমাজ ও জাতির ভবিষ্যতও গভীর সংকটে পড়বে। সর্বোপরি, শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব রোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন এবং শিক্ষা আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন। দলীয় প্রভাব এড়িয়ে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার সুস্পষ্ট বিধান তৈরি করা। একই সঙ্গে শিক্ষকদের সংগঠনগুলোকে পেশাগত উন্নয়নে দলীয় রাজনীতির পরিবর্তে শিক্ষার পরিবেশ ও মানোন্নয়নে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা। এখনই সময়, শিক্ষকদের তাদের পেশাগত নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে এসে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গৌরবময় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা, যাতে তারা নীতি-নৈতিকতায় দেশের মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। আর সেটা করা সম্ভব হলেই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য শিক্ষক সমাজ কারিগরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের কুশীলব হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু শিক্ষার মানকেই নয়, বরং সমগ্র সমাজের কাঠামোকে পরিবর্তিত ও প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যক্তিক ও সামাজিক উন্নয়নের নৈতিক দায় ও পেশাগত গুরুদায়িত্বের কারণে শিক্ষকদের বলা হয়ে থাকে জাতির বিবেক। পেশাগত জীবনে শিক্ষকদের যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার কথা, তা দলীয় আনুগত্য এবং স্বার্থপর রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর ফলে একদিকে শিক্ষকদের পেশাগত মান-মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা প্রদান ও তাদের মাঝে কল্যাণমুখী জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য মূল্যবোধ গড়ে তোলা, যাতে তারা নিজস্ব মেধায় অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই শিক্ষা নামক জাতির মেরুদ-কে সচল ও শক্তিশালী রাখা এবং জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম।
শিক্ষক রাজনীতির বর্তমান যে চিত্রটা জনসাধারণের মনে অঙ্কিত, তা বিগত কয়েক দশকে অভিজ্ঞতার আলোকে মোটেও সুখপ্রদ নয়। তার পেছনে যতসব কারণই থাকুক না কেন, এটি শিক্ষার মতো সম্মানজনক পেশার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িত হওয়া, নানা অপকর্মে সম্পৃক্ততা তথা স্বার্থান্বেষী কর্মকা- এবং ক্ষমতাবানদের তোষামদি ও অপ্রয়োজনী আনুগত্য শিক্ষক সমাজের পেশাগত সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতাকে অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠার বদলে তারা হয়ে উঠছেন নৈতিক অধপতন, বৈষম্য ও বিভাজনের মূর্ত প্রতীক। ফলে শিক্ষক রাজনীতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগের লেখাগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষকতা আর দশটা পেশার মতোই একটা পেশা নয়। এই পেশার লোকজন আগামী প্রজন্মের বোধ, বুদ্ধি ও উপলব্ধির উদ্বোধনের মাধ্যমে তাদের স্বপ্ন-সারথি হয়ে একজন শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই এখানে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সরাসরি প্রভাব তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। একদিকে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া পেশাগত নীতি-নৈতিক ও আত্মসম্মানবোধের পরিপন্থি। অপরদিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতির খতিয়ান দেখলে বোঝা যায় তার ব্যাপকতা ও সেসবের কুপ্রভাবে গভীরতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের একটি বড় অংশ দলীয় রাজনীতির প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শিক্ষাদান ও গবেষণার পরিবর্তে তাদেও কর্মকান্ডের মোটা অংশজুড়েই থাকে দলীয় লেজুজবৃত্তিক রাজনীতির সম্পৃক্ত কাজকর্ম। এক সময় আমাদের দেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল জ্ঞানার্জন, গবেষণা ও মুক্তচিন্তার ধারক, বাহক ও পথপ্রদর্শক, সেখানে এখন ক্ষমতার লড়াই, দলাদলি, কোন্দল এবং দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে দলীয় পরিচয় ও প্রভাব যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতে সরকার পতনের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগ ও পলায়ন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা আমাদের নৈতিক দেউলিয়াপনারও স্মারক এবং গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটা সুস্পষ্ট যে, দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক পরিবেশকে যেমন বিনষ্ট করছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করে হতাশা ও শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নানা বৈষম্যের।
নিকট অতীতে দেখা গিয়েছে যে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিরপেক্ষভাবে তাদের পেশাগত দায়দায়িত্ব তথা শিক্ষাদানের পরিবর্তে দলীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের এ ধরনের কর্মকা- শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শকেই ক্ষুণœ করেনি, বরং জাতির কাছে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধকেও কুলষিত করেছে। এক সময় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষকদের কল্যাণ ও অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কাজ করত; কিন্তু এখন শিক্ষকদের এ সংগঠনগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে দলীয় ও গোষ্ঠি স্বার্থে কাজ করছে যা সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত। ফলে শিক্ষকদের পেশাগত সংগঠন হিসেবে শিক্ষক সমাজের অধিকার আদায়ের পরিবর্তে দলীয় ক্ষমতা চর্চার পাওয়া হাউস হিসেবে কাজ করছে। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কাছে এসব সংগঠনের পেশাগত পরিচয় ম্লান হয়ে পড়েছে।
উচ্চশিক্ষাস্তরে প্রথাগত শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ, যা একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গৌরবের বিষয় ছিল, সেটি এখন শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ায় পাঠদান ও গবেষণায় তারা মনোনিবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
অপরদিকে শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরি হওয়ায় একাডেমিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষক রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং তাদের যথাযথ শিক্ষার সুযোগ ও অর্জিত শিক্ষার গুণগতমান কমে যাচ্ছে। কার্যত অধ্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নাপারায় তাদের ভবিষ্যত কর্মসংস্থান গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও দক্ষতার উন্নয়ন কেন্দ্র হয়ে ওঠার পরিবর্তে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, পেশিতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবের ফল হিসেবে উচ্চশিক্ষায় যেসব নেতিবাচক বিষয়গুলো প্রকট হয়ে উঠেছে, সেগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে উচ্চশিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ক্ষমতার বলয়কে সুসংহত করতে ও শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে দলীয় ভোটার বাড়াতে শিক্ষক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া শুধু মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের জন্য বঞ্চনার কারণ হচ্ছে না, বরং সামগ্রিক শিক্ষার মানকে নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বঞ্চিত হচ্ছে সেরা শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসকদের সেবা পাওয়া থেকে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যত পেশাগত ও সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষাস্তরে গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রমাগত স্থবিরতা উচ্চশিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠদান ও দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্যনতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম কাজ। দলীয় রাজনীতিতে বেশি সময় দেওয়ায় শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক কর্মকান্ড তথা পাঠদান ও গবেষণার পাশাপাশি সৃজনশীল কার্যক্রমে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছেন না। ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার মানোন্নয়ন দূরের কথা, দেশের অভ্যন্তরীণ অত্যাবশ্যকীয় গবেষণাকর্মও স্থবির হয়ে পড়েছে। গবেষণা প্রস্তাবনাপত্রের গুণগতমানের ওপর নয়, গবেষণার অনুদানও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানসৃষ্টি ও দক্ষতার উন্নয়নের সক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
উপাচার্যসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের সন্তুষ্ট করা, যা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত তিন দশকে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নানা ঘটনা। সেসবে উঠে এসেছে দলীয় বিবেচনায় রাজনৈতিক বা পারিবারিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে বিশেষ প্রার্থীদের চাকরি দিতে নির্ধারিত নিয়মাবলি উপেক্ষা করে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে যোগ্য প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থেকে বাদ পড়ে, আর দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে অযোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষক হওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। এর ফলে শিক্ষকতায় ও প্রশাসনে পেশাদারিত্বের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বঞ্চিত প্রার্থীরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এবং সেবা দিচ্ছেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। ফলে দেশ হারাচ্ছে মেধাবীদের আর আমাদেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হারাচ্ছে যোগ্য শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসকদেরকে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা কেলেঙ্কারিতে শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকরাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অতি সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। শিক্ষকেরা যখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন শিক্ষক তার পেশাগত নিরপেক্ষতা হারান এবং অনিবার্য পরিণতি হিসেবে শিক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার হন। ফলে অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দলীয় বিভক্তি তৈরি হয়, যা তাদের পড়াশুনা, ভবিষ্যত ক্যারিয়ার গঠন এবং নৈতিকতার বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং জড়িয়ে পড়েন নানা অন্যায় অবিচারে। অপছন্দের শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার করতে তাদের বাধে না। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনিয়মের অভিযোগগুলো খেয়াল করলেই অন্যায় অবিচারের মাত্রা সহজেই অনুমান করা যায়।
শিক্ষক রাজনীতির সবচেয়ে দৃশ্যমান নেতিবাচক প্রভাব হলো স্বজনপ্রীতি ও বৈষম্য যা শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ে নানাভাবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষকেরা যখন দলীয় রাজনীতিতে লিপ্ত হন ও পক্ষপাতিত্ব করেন, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভাজন ও পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা দেখা দেয়। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতার পরিবর্ততে বিরোধীদের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে ওঠে তারা, যা তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, নৈতিকতা এবং ক্যারিয়ারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের যন্ত্রে পরিণত হয়, যা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতকে বিপন্ন করে তুলছে।
শিক্ষক রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখা দিয়েছে নানা প্রশাসনিক সংকট, যা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন ও তার কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে দলীয় রাজনীতির ব্যাপক প্রভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুশাসনের অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। প্রশাসন যখন নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত হয়। আর বিরোধী মতামত দমনে নিপীড়কদের সহযোগী হয়ে ওঠে প্রশাসন, যা সম্পূর্ণরূপে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ও এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেশাগত নৈতিকতার পরিপন্থি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাবে, আর্থিক দুর্নীতি তথা বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনিয়মও ক্রমশ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে বার্ষিক বাজেটে গবেষণা ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে দলীয় প্রভাবে ঠিকাদারির মাধ্যমে অর্থ ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য অনাবশ্যকীয় অবকাঠামোর উন্নয়নসহ অপ্রয়োজনীয় খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনিয়ম, অন্যায়, অবিচার বা অধিকার আদায়ের ছাত্র আন্দোলন দমনে পক্ষপাতমূলক আচরণ দলীয় প্রভাবের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি নাকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের সিসিটিভির ফুটেজ সরবরাহ করতেন সরকারি গোয়েন্দাদের। আর সেসব দেখে দেখে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণেই শিক্ষক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের দায়িত্ব ভুলে হয়ে পড়ছেন তাদের নিপীড়ক।
শিক্ষকদের দলীয় পক্ষপাতিত্ব শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ায় না, বরং শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করার মধ্য দিয়ে সমগ্র ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুইজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও অবস্থান তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হওয়ার বদলে বিভক্তি, বৈষম্য এবং দলীয় স্বার্থসিদ্ধির রঙ্গশালায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসন নীরব থাকে এসব অনৈতিক দুষ্কৃতকারী ও নিপীড়ক শিক্ষকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে।
বর্তমান পরিস্থিতে শিক্ষকদের উচিত তাদের মূল দায়িত্ব, অর্থাৎ নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের জন্যে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার পরিবেশ নিশ্চিত করা। দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখে পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখা শিক্ষকদের জন্য অত্যাবশ্যক। এটি করা না হলে উচ্চশিক্ষার মান যেমন নিম্নমুখী হতে থাকবে, তেমনি সমাজ ও জাতির ভবিষ্যতও গভীর সংকটে পড়বে। সর্বোপরি, শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব রোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন এবং শিক্ষা আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন। দলীয় প্রভাব এড়িয়ে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার সুস্পষ্ট বিধান তৈরি করা। একই সঙ্গে শিক্ষকদের সংগঠনগুলোকে পেশাগত উন্নয়নে দলীয় রাজনীতির পরিবর্তে শিক্ষার পরিবেশ ও মানোন্নয়নে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা। এখনই সময়, শিক্ষকদের তাদের পেশাগত নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে এসে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গৌরবময় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা, যাতে তারা নীতি-নৈতিকতায় দেশের মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। আর সেটা করা সম্ভব হলেই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য শিক্ষক সমাজ কারিগরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের কুশীলব হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]