alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

রহমান মৃধা

: রোববার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

রাজনীতি প্রতিটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু, যা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকা উচিত। একটি আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সুশাসনের মূল হাতিয়ার। কিন্তু বাস্তবে, বাংলাদেশের রাজনীতি প্রায়শই ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার লোভ এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে।

রাজনীতি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে এবং তাদের আশীর্বাদস্বরূপ কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামতের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক। তবে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, রাজনীতি অনেক সময় ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতা দখলের চক্রে আটকে গেছে, যেখানে জনকল্যাণের চেতনা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করলেও, বাস্তবে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফলে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা রাজনৈতিক মঞ্চে অধিকার বিস্তার করেন, যা প্রকৃত যোগ্যদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করেন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট করেন। এতে করে জনকল্যাণমূলক কাজ পিছিয়ে পড়ে এবং জনসাধারণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বুঝতে হবে যে আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। কিন্তু ধীরে ধীরে, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা রাজনীতির প্রকৃত রূপকে বদলে দিয়েছে। পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে এবং প্রকৃত যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এটি ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনকল্যাণমূলক কাজ করার জন্য রাজনীতির যে উদ্দীপনা এবং আদর্শ থাকা উচিত, সেটি অনেক ক্ষেত্রে আর কার্যকর নেই। এভাবে সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ উদাহরণ হয়ে রয়েছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা নেয়া সম্ভব।

নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশগুলো সেবামূলক রাজনীতির মডেল হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এসব দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসেবায় নিবেদিত এবং জনগণের কল্যাণই তাদের প্রধান লক্ষ্য। উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডে জনগণ সরাসরি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা তাদের প্রশাসনের অংশীদারত্বকে নিশ্চিত করে এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে সুসংহত করে। এসব উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যেখানে নেতাকর্মীরা জনসেবাকে নিজেদের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, সেখানে উন্নয়ন ও শান্তির পথ উন্মুক্ত হয়। বাংলাদেশও এই পথে এগিয়ে যেতে পারে, যদি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে দূরে সরিয়ে জাতীয় স্বার্থে সংযুক্ত করা হয়।

দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। যখন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তখন তা শুধু একটি জাতির মূল্যবোধকেই গ্রাস করে না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনমানকেও বিপর্যস্ত করে। জনগণের করের অর্থ যখন ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়।

দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে যায় এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর প্রভাব গণমাধ্যম, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও পড়ে, যা একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা এবং সেবামূলক রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।

দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, ফলে আইন ও ন্যায়বিচারের মান ক্ষুণœ হয়। এর ফলে সামাজিক বিভাজন ও আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এবং গণতন্ত্রের শুদ্ধি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন, সম্মানজনক এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রাখে। যখন রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা জনগণের এই অধিকারকে খর্ব করে, তখন জনগণ শাসনের অবিচার ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশেও জনগণ সুশাসন ও স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি জানায়। জনমুক্তির জন্য অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অপরিহার্য।

বাংলাদেশে রাজনীতিকে সেবামূলক ও সৎ ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

জনগণের মধ্যে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তোলে এবং সুশাসনের দাবিতে সোচ্চার থাকে।

নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার প্রসার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি প্রতিরোধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা অনেক সময় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রশাসনিক সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ করা জরুরি।

সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব প্রশাসনিক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণের প্রতি নেতাদের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং দুর্নীতি দমন কার্যকর হবে।

একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসতে শুধু জনগণের কল্যাণেই কাজ করতে ইচ্ছুক নেতারা নির্বাচন জিততে পারে। নির্বাচনে অর্থের প্রভাব কমিয়ে সাধারণ মানুষের যোগ্য প্রতিনিধিরা যেন ক্ষমতায় আসতে পারে সেজন্য নির্বাচনী সংস্কার অপরিহার্য।

বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। জনগণের সুষ্ঠু বিচার এবং প্রশাসনিক সেবার জন্য এই দুই বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণ বিচার ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারবে।

গণমাধ্যম একটি দেশের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সরকারের ভুল পদক্ষেপ এবং সামাজিক অন্যায়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন সাংবাদিকতা জনগণের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষা করে এবং শাসকদের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।

পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি দূর করে প্রকৃত যোগ্য ও সৎ প্রার্থীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনীতি যেন শুধু একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের কোনো একটি অংশ যখন অবহেলিত হয়, তখন তা সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। যদিও নারী সমাজের অবদান আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র স্বীকৃত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। বর্ণবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতিকে আরও অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধিশালী করা সম্ভব হবে।

সেবামূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় একাধিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, জনগণকে সচেতন করতে হবে যেন তারা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সেবামূলক ভূমিকা পালনে আরও সক্রিয় হতে হবে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। চতুর্থত, জনমত প্রকাশের সুযোগ প্রদান এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে।

গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে একটি শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশে সহায়ক হতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক সংস্কারের এই ধারা আরও মজবুত হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে নাগরিকদের সচেতনতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া প্রকৃত নেতৃত্ব বেছে নেয়া যায় না। সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতার মূল্যায়ন ও বাছাইয়ের ক্ষমতা তৈরি হলে, তবেই সৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে। জনগণের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস তৈরি করতে হবে, এবং শিক্ষিত ও সচেতন সমাজই এটি করতে পারে।

জনগণ যেন একটি সুন্দর, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে, এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

জ্ঞানই শক্তি

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

সমস্যার সূতিকাগার

ছবি

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পথ কী?

ব্যাংক সংস্কার : কাটবে কি অন্ধকার?

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

রম্যগদ্য: ম্যাড় ম্যাড়ে সোনা-কাহিনী

রাষ্ট্র সংস্কারে পাঠাগার

কেন এত ধ্বংস, কেন এত মৃত্যু

জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম

উচ্চশিক্ষায় মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ

ছবি

যানজট আর্থ-সামাজিক বিড়ম্বনাকে প্রকট করে তুলছে

যাচ্ছে দিন, বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

ছবি

স্বপ্ন দেখতে তো ভুল নেই

ছবি

আহমদুল কবির : সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে

ইতিহাসের কাছে মানুষ কী চায়?

আর্থিক সংকট কতটা গভীর

আদিবাসী নেতাদের দেখে নেয়ার হুমকি

সম্পত্তিতে এতিম নাতি-নাতনির অংশ ও বাস্তবতা

দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্বের শতবর্ষ

প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বাঁচানো জরুরি

রঙ্গব্যঙ্গ : শাব্বাশ বিটিভি, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ

নবজাগরণ : সত্যিই কি জাতি জেগেছে?

গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে

ছবি

কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া

লটারিতে ভর্তি : কবে দূর হবে সরকারি স্কুলগুলোর ‘করোনা মহামারী’?

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি খুব একটা পরিবর্তন হবে কি

অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু চিন্তা

মুজিব কি কেবলই ছবি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

রহমান মৃধা

রোববার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

রাজনীতি প্রতিটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু, যা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকা উচিত। একটি আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সুশাসনের মূল হাতিয়ার। কিন্তু বাস্তবে, বাংলাদেশের রাজনীতি প্রায়শই ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার লোভ এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে।

রাজনীতি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে এবং তাদের আশীর্বাদস্বরূপ কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামতের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক। তবে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, রাজনীতি অনেক সময় ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতা দখলের চক্রে আটকে গেছে, যেখানে জনকল্যাণের চেতনা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করলেও, বাস্তবে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফলে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা রাজনৈতিক মঞ্চে অধিকার বিস্তার করেন, যা প্রকৃত যোগ্যদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করেন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট করেন। এতে করে জনকল্যাণমূলক কাজ পিছিয়ে পড়ে এবং জনসাধারণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বুঝতে হবে যে আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। কিন্তু ধীরে ধীরে, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা রাজনীতির প্রকৃত রূপকে বদলে দিয়েছে। পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে এবং প্রকৃত যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এটি ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনকল্যাণমূলক কাজ করার জন্য রাজনীতির যে উদ্দীপনা এবং আদর্শ থাকা উচিত, সেটি অনেক ক্ষেত্রে আর কার্যকর নেই। এভাবে সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ উদাহরণ হয়ে রয়েছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা নেয়া সম্ভব।

নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশগুলো সেবামূলক রাজনীতির মডেল হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এসব দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসেবায় নিবেদিত এবং জনগণের কল্যাণই তাদের প্রধান লক্ষ্য। উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডে জনগণ সরাসরি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা তাদের প্রশাসনের অংশীদারত্বকে নিশ্চিত করে এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে সুসংহত করে। এসব উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যেখানে নেতাকর্মীরা জনসেবাকে নিজেদের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, সেখানে উন্নয়ন ও শান্তির পথ উন্মুক্ত হয়। বাংলাদেশও এই পথে এগিয়ে যেতে পারে, যদি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে দূরে সরিয়ে জাতীয় স্বার্থে সংযুক্ত করা হয়।

দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। যখন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তখন তা শুধু একটি জাতির মূল্যবোধকেই গ্রাস করে না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনমানকেও বিপর্যস্ত করে। জনগণের করের অর্থ যখন ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়।

দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে যায় এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর প্রভাব গণমাধ্যম, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও পড়ে, যা একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা এবং সেবামূলক রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।

দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, ফলে আইন ও ন্যায়বিচারের মান ক্ষুণœ হয়। এর ফলে সামাজিক বিভাজন ও আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এবং গণতন্ত্রের শুদ্ধি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন, সম্মানজনক এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রাখে। যখন রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা জনগণের এই অধিকারকে খর্ব করে, তখন জনগণ শাসনের অবিচার ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশেও জনগণ সুশাসন ও স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি জানায়। জনমুক্তির জন্য অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অপরিহার্য।

বাংলাদেশে রাজনীতিকে সেবামূলক ও সৎ ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

জনগণের মধ্যে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তোলে এবং সুশাসনের দাবিতে সোচ্চার থাকে।

নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার প্রসার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি প্রতিরোধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা অনেক সময় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রশাসনিক সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ করা জরুরি।

সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব প্রশাসনিক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণের প্রতি নেতাদের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং দুর্নীতি দমন কার্যকর হবে।

একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসতে শুধু জনগণের কল্যাণেই কাজ করতে ইচ্ছুক নেতারা নির্বাচন জিততে পারে। নির্বাচনে অর্থের প্রভাব কমিয়ে সাধারণ মানুষের যোগ্য প্রতিনিধিরা যেন ক্ষমতায় আসতে পারে সেজন্য নির্বাচনী সংস্কার অপরিহার্য।

বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। জনগণের সুষ্ঠু বিচার এবং প্রশাসনিক সেবার জন্য এই দুই বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণ বিচার ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারবে।

গণমাধ্যম একটি দেশের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সরকারের ভুল পদক্ষেপ এবং সামাজিক অন্যায়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন সাংবাদিকতা জনগণের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষা করে এবং শাসকদের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।

পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি দূর করে প্রকৃত যোগ্য ও সৎ প্রার্থীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনীতি যেন শুধু একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের কোনো একটি অংশ যখন অবহেলিত হয়, তখন তা সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। যদিও নারী সমাজের অবদান আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র স্বীকৃত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। বর্ণবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতিকে আরও অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধিশালী করা সম্ভব হবে।

সেবামূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় একাধিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, জনগণকে সচেতন করতে হবে যেন তারা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সেবামূলক ভূমিকা পালনে আরও সক্রিয় হতে হবে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। চতুর্থত, জনমত প্রকাশের সুযোগ প্রদান এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে।

গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে একটি শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশে সহায়ক হতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক সংস্কারের এই ধারা আরও মজবুত হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে নাগরিকদের সচেতনতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া প্রকৃত নেতৃত্ব বেছে নেয়া যায় না। সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতার মূল্যায়ন ও বাছাইয়ের ক্ষমতা তৈরি হলে, তবেই সৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে। জনগণের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস তৈরি করতে হবে, এবং শিক্ষিত ও সচেতন সমাজই এটি করতে পারে।

জনগণ যেন একটি সুন্দর, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে, এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

back to top