গাজী তারেক আজিজ
গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বাংলাদের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন চলাকালীন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের বেঞ্চে কিছু আইনজীবী বিচারকদের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারেন। ঘটনাটি শুধু নিন্দনীয়ই নয়, ন্যাক্কারজনকও বটে। যে ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ স্তম্ভিত, হতভম্ব ও বিস্মিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে করা মন্তব্যের জেরে এ ঘটনা ঘটান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। ঘটনার পর বিচারপতিদ্বয় এজলাস ছেড়ে যান। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বলেও জানা গেছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসে যদি এ ধরনের ঘটনা কারো জন্য সুখকর তো নয়ই, উপরন্তু কষ্ট ও বেদনাদায়ক। ঘটনা জানাজানি হলে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন,
বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা শুধু একজন বিচারকের ওপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের ওপর আঘাত। এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করছে এ ঘটনা।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার সঙ্গে জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির বক্তব্য আরও স্পষ্ট এবং তড়িৎ পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল।
বৈঠকে পরিকল্পনা করে ডিম ছোড়ার অভিযোগ করছেন বিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকেই। তার মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগে থেকে পরিকল্পনা করে এভাবে আদালতের প্রতি অবমাননা করা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা চাই, এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আগেও কিন্তু আদালত অবমাননার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বুধবারের ঘটনায় আমরা কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এমনকি আইন উপদেষ্টাও কোনো কথা বলেননি। তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর মনে করছেন নিজেকে। যে ঘটনাটি ঘটে গেল, যারা এটা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। এটা তো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল। ভবিষ্যতে এই ঘটনা কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। একটা কোর্টে এটা হওয়া মানে পুরো জুডিশিয়ারিতেই হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ আদালতের একটা বেঞ্চে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো যেনতেন ব্যাপার নয়। আমরা আশা করেছিলাম, শুধু বিবৃতি নয়, কোনো একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন প্রধান বিচারপতি। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিচার করতে গিয়ে তিনি কোনো রায়ে কী লিখেছেন সে কারণে যদি অপদস্থ হতে হয়, তাহলে কোনো বিচারকই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বা মন্তব্য লিখতে পারবেন না।’
এর থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি? এই কথা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সব আইনজীবীকে হতবাক করেছে এহেন কা-, যা অতীতের সব পর্যায়ের ঘৃণিত কাজকেও নিমিষেই ছাপিয়ে গেছে। আইনজীবী কর্তৃক এরূপ কার্য এর আগে কখনো শোনা যায়নি। অন্তত আমার জানা মতে তো নয়ই!
সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এ পর্যন্ত কোন বক্তব্য বিবৃতি না দিলেও ঘটনাকে হালকা করে দেখার যে সুযোগ নেই সেটা বেশ ভালো করেই জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি ইতোমধ্যে দেশের সব আদালত ও বিচারকের নিরাপত্তায় জোর দিতে নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন।
আমরা এর আগেও দেখেছি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। তা-ও বিচারালয়ের জন্য ছিল অস্বস্তির এবং ভালো নজির স্থাপন করেনি, যা বলা হয়ে থাকে বিগত সরকারের কলঙ্কিত অধ্যায়ের একটি।
এতদিন পরেও যে বিষয়টি ঘুরেফিরে আসছে। তাহলে আমরা কি ধরে নেব এই অন্তর্র্বতী সরকারও সে পথেই হাঁটছে? যদিও একটু ভিন্নতা রয়েছে এই সরকার নির্বাচিত নয়। তাই বলে কি জবাবদিহি করতে হবে না? যদি তেমনটা ভেবে থাকে তবে হয়তো দায় এড়াতে বলতে পারে এমনটা সরকার কিংবা কোন সংস্থার কেউ করেনি। তথাপিও সরকারের তরফ থেকে অবশ্যই একটা ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ছিল দেশের জনগণের তথা বিচারপ্রত্যাশী জনগণের। যেহেতু ঘটনাটি ঘটিয়েছে সংশ্লিষ্ট আদালতে প্র্যাকটিসরত কতেক আইনজীবী। এসব কর্মকা- দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে আইনজীবীরা কি পেশাগত মর্যাদার কথা ভুলে যেতে বসেছেন? যদি তা-ই না হবে তাহলে রাস্তার মাস্তানদের কাতারে নিজেদের নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন? বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও একটা বিষয় মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করবে। এর বাইরে আদালতই হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষের জায়গা।
যেখানে থেকে বিচারক তথা বিচার বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো সমীচীন নয়, কারণ এই আদালতে প্র্যাকটিস করেই অধিকাংশ আইনজীবী বিচারপতি হয়েছেন। অতএব আইনজীবী হিসেবে সে সুযোগ নিশ্চয়ই বেশির ভাগের কাছে প্রত্যাশিত। আবার ন্যাচারাল জাস্টিস বলেও একটা কথা আছে। আপনি যা করবেন তা ঠিক কোন না কোন সময় আপনার দিকে তির হয়ে ফিরে আসবে। সে সময় হয়তো আপনার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারবেন না। বলেও বোঝাতে পারবেন না। শুধু গুমরে কেঁদে চোখ ভেজাবেন। অধিকন্তু তারা কোন না কোন দলের সমর্থক তো বটেই তবে অতিউৎসাহীও এতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। দেশের মানুষের বিচার বিভাগের প্রতি যে মর্যাদা বা সম্মান সেটা সমুন্নত রাখতে হলেও দোষী যদি কোন আইনজীবী কিংবা নেপথ্যের কেউ থেকে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরি হবে। তা না হলে যে কোন লোক এহেন আচরণ করে পার পেয়ে যেতে পারে, যা কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি আদালত আঙ্গিনায় অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করা থেকে নিভৃত করা যায়নি। উপর্যুপরি আরও বেড়েই চলেছে। মানুষ রাস্তাঘাট তো দূরে থাক এখন হাসপাতালেও নিরাপদ নয়। গত
৩০ নভেম্বর আওয়ামী আমলের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে যা ঘটানো হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে মাহমুদুর রহমানকেও আদালত অঙ্গনেই রক্তাক্ত করা হয়েছিল। এই সরকারের সময়ে সাবেক বিচারপতি সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা-ও ছিল অনভিপ্রেত। আর বিভিন্ন ভার্সিটিতে পিটিয়ে মারার কথা কে না জানে? তোফাজ্জলের সঙ্গে ঘটানো ঘটনায় মানুষ শিউরে উঠেছিল, যা দেখলে মানুষ মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হবে যে কারো!
এভাবে চলতে থাকলে মানুষ অনিরাপদ ভেবে হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গুপ্ত হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
যেটা সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ইঙ্গিত করেছেন। যদি সে পরিস্থিতির উদয় হয় তবে তা-ও যে ভয়াবহ হতে পারে সাম্প্রতিক পাকিস্তান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। আর এই উদাহরণ মোটেই আদর্শিক নয়। আমরা তেমন পরিস্থিতি প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই সরকার শুধু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবে না। নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মব থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে নির্বিঘেœ নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। অন্তত সে নিশ্চয়তা চাইবার অধিকার আমাদের সবার রয়েছে, যা সরকারের একচ্ছত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে বিপ্লব জনআকাক্সক্ষার কথা বলবার কথা। সেই বিপ্লব পথিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লে তার পরিণতও যে ভয়াবহ হবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তা-ই আদালতের এখতিয়ার হিসেবে এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যেমন জরুরি তেমনি সব আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বার কাউন্সিলের ভূমিকাও নজিরবিহীন হবে মর্মে জনমানুষ প্রত্যাশা করে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বাংলাদের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন চলাকালীন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের বেঞ্চে কিছু আইনজীবী বিচারকদের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারেন। ঘটনাটি শুধু নিন্দনীয়ই নয়, ন্যাক্কারজনকও বটে। যে ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ স্তম্ভিত, হতভম্ব ও বিস্মিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে করা মন্তব্যের জেরে এ ঘটনা ঘটান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। ঘটনার পর বিচারপতিদ্বয় এজলাস ছেড়ে যান। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বলেও জানা গেছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসে যদি এ ধরনের ঘটনা কারো জন্য সুখকর তো নয়ই, উপরন্তু কষ্ট ও বেদনাদায়ক। ঘটনা জানাজানি হলে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন,
বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা শুধু একজন বিচারকের ওপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের ওপর আঘাত। এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করছে এ ঘটনা।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার সঙ্গে জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির বক্তব্য আরও স্পষ্ট এবং তড়িৎ পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল।
বৈঠকে পরিকল্পনা করে ডিম ছোড়ার অভিযোগ করছেন বিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকেই। তার মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগে থেকে পরিকল্পনা করে এভাবে আদালতের প্রতি অবমাননা করা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা চাই, এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আগেও কিন্তু আদালত অবমাননার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বুধবারের ঘটনায় আমরা কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এমনকি আইন উপদেষ্টাও কোনো কথা বলেননি। তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর মনে করছেন নিজেকে। যে ঘটনাটি ঘটে গেল, যারা এটা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। এটা তো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল। ভবিষ্যতে এই ঘটনা কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। একটা কোর্টে এটা হওয়া মানে পুরো জুডিশিয়ারিতেই হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ আদালতের একটা বেঞ্চে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো যেনতেন ব্যাপার নয়। আমরা আশা করেছিলাম, শুধু বিবৃতি নয়, কোনো একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন প্রধান বিচারপতি। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিচার করতে গিয়ে তিনি কোনো রায়ে কী লিখেছেন সে কারণে যদি অপদস্থ হতে হয়, তাহলে কোনো বিচারকই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বা মন্তব্য লিখতে পারবেন না।’
এর থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি? এই কথা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সব আইনজীবীকে হতবাক করেছে এহেন কা-, যা অতীতের সব পর্যায়ের ঘৃণিত কাজকেও নিমিষেই ছাপিয়ে গেছে। আইনজীবী কর্তৃক এরূপ কার্য এর আগে কখনো শোনা যায়নি। অন্তত আমার জানা মতে তো নয়ই!
সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এ পর্যন্ত কোন বক্তব্য বিবৃতি না দিলেও ঘটনাকে হালকা করে দেখার যে সুযোগ নেই সেটা বেশ ভালো করেই জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি ইতোমধ্যে দেশের সব আদালত ও বিচারকের নিরাপত্তায় জোর দিতে নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন।
আমরা এর আগেও দেখেছি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। তা-ও বিচারালয়ের জন্য ছিল অস্বস্তির এবং ভালো নজির স্থাপন করেনি, যা বলা হয়ে থাকে বিগত সরকারের কলঙ্কিত অধ্যায়ের একটি।
এতদিন পরেও যে বিষয়টি ঘুরেফিরে আসছে। তাহলে আমরা কি ধরে নেব এই অন্তর্র্বতী সরকারও সে পথেই হাঁটছে? যদিও একটু ভিন্নতা রয়েছে এই সরকার নির্বাচিত নয়। তাই বলে কি জবাবদিহি করতে হবে না? যদি তেমনটা ভেবে থাকে তবে হয়তো দায় এড়াতে বলতে পারে এমনটা সরকার কিংবা কোন সংস্থার কেউ করেনি। তথাপিও সরকারের তরফ থেকে অবশ্যই একটা ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ছিল দেশের জনগণের তথা বিচারপ্রত্যাশী জনগণের। যেহেতু ঘটনাটি ঘটিয়েছে সংশ্লিষ্ট আদালতে প্র্যাকটিসরত কতেক আইনজীবী। এসব কর্মকা- দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে আইনজীবীরা কি পেশাগত মর্যাদার কথা ভুলে যেতে বসেছেন? যদি তা-ই না হবে তাহলে রাস্তার মাস্তানদের কাতারে নিজেদের নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন? বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও একটা বিষয় মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করবে। এর বাইরে আদালতই হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষের জায়গা।
যেখানে থেকে বিচারক তথা বিচার বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো সমীচীন নয়, কারণ এই আদালতে প্র্যাকটিস করেই অধিকাংশ আইনজীবী বিচারপতি হয়েছেন। অতএব আইনজীবী হিসেবে সে সুযোগ নিশ্চয়ই বেশির ভাগের কাছে প্রত্যাশিত। আবার ন্যাচারাল জাস্টিস বলেও একটা কথা আছে। আপনি যা করবেন তা ঠিক কোন না কোন সময় আপনার দিকে তির হয়ে ফিরে আসবে। সে সময় হয়তো আপনার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারবেন না। বলেও বোঝাতে পারবেন না। শুধু গুমরে কেঁদে চোখ ভেজাবেন। অধিকন্তু তারা কোন না কোন দলের সমর্থক তো বটেই তবে অতিউৎসাহীও এতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। দেশের মানুষের বিচার বিভাগের প্রতি যে মর্যাদা বা সম্মান সেটা সমুন্নত রাখতে হলেও দোষী যদি কোন আইনজীবী কিংবা নেপথ্যের কেউ থেকে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরি হবে। তা না হলে যে কোন লোক এহেন আচরণ করে পার পেয়ে যেতে পারে, যা কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি আদালত আঙ্গিনায় অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করা থেকে নিভৃত করা যায়নি। উপর্যুপরি আরও বেড়েই চলেছে। মানুষ রাস্তাঘাট তো দূরে থাক এখন হাসপাতালেও নিরাপদ নয়। গত
৩০ নভেম্বর আওয়ামী আমলের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে যা ঘটানো হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে মাহমুদুর রহমানকেও আদালত অঙ্গনেই রক্তাক্ত করা হয়েছিল। এই সরকারের সময়ে সাবেক বিচারপতি সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা-ও ছিল অনভিপ্রেত। আর বিভিন্ন ভার্সিটিতে পিটিয়ে মারার কথা কে না জানে? তোফাজ্জলের সঙ্গে ঘটানো ঘটনায় মানুষ শিউরে উঠেছিল, যা দেখলে মানুষ মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হবে যে কারো!
এভাবে চলতে থাকলে মানুষ অনিরাপদ ভেবে হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গুপ্ত হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
যেটা সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ইঙ্গিত করেছেন। যদি সে পরিস্থিতির উদয় হয় তবে তা-ও যে ভয়াবহ হতে পারে সাম্প্রতিক পাকিস্তান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। আর এই উদাহরণ মোটেই আদর্শিক নয়। আমরা তেমন পরিস্থিতি প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই সরকার শুধু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবে না। নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মব থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে নির্বিঘেœ নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। অন্তত সে নিশ্চয়তা চাইবার অধিকার আমাদের সবার রয়েছে, যা সরকারের একচ্ছত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে বিপ্লব জনআকাক্সক্ষার কথা বলবার কথা। সেই বিপ্লব পথিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লে তার পরিণতও যে ভয়াবহ হবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তা-ই আদালতের এখতিয়ার হিসেবে এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যেমন জরুরি তেমনি সব আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বার কাউন্সিলের ভূমিকাও নজিরবিহীন হবে মর্মে জনমানুষ প্রত্যাশা করে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]