পাভেল পার্থ
বিচিত্রসব সর্দি-কাশি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুরছে মানুষ। নিঝুম শীতের রাতে দালানের পর দালান থেকে ভেসে আসছে নিদারুণ কাশির আওয়াজ। বায়ুদূষণে প্রায়ই বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করছে ঢাকা। স্মরণ রাখা জরুরি বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। দূষণ আর দুর্নীতি অভিন্ন যমজ। যেখানেই দূষণ, সেখানেই দুর্নীতি। যেখানেই দুর্নীতি, সেখানেই দূষণ। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ তীব্র রাষ্ট্রীয় অবহেলা, কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির অভাব এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি। বায়ুদূষণের ফলে প্রতি বছর কয়েক লাখ জীবনের মৃত্যু ঘটছে, অসুস্থ হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। গড় আয়ু কমছে কয়েক বছর। অথচ এই বায়ুদূষণ থামাতে দৃশ্যমান কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নাই।
বায়ুদূষণ তো এমন নয় যে, কেবল গরিবকে আক্রান্ত করবে। শ্রেণি-বর্গনির্বিশেষে সব মানুষই বিপদে আছে। তাহলে আমরা কেন বায়ুদূষণ মোকাবিলার দায় ও দায়িত্বকে দৃশ্যমান করছি না। এমনকি গবেষণা বলছে বায়ুদূষণের কারণে জাতীয় অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকা যখন আবারো তীব্র বায়ুদূষণে আক্রান্ত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে, একজন তরুণ চিকিৎসক মৃত্যুর আগে বায়ুদূষণ নিয়ে তার জিজ্ঞাসাটি রাষ্ট্রের সামনে ছুড়ে দিয়ে গেছেন। ডা. সিদরাত জেবিন জটিল হাঁপানি সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ফেইসবুক প্রোফাইলে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘...ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ কী? এত প্রকৌশলী থাকার পরও দূষণের কারণ নিয়ে কোনো তথ্য নেই। কেউ কি বাতাসের মান আদৌ খতিয়ে দেখছে? মনে হয় না শুধু ধুলো আর নির্মাণসামগ্রীর জন্য এই অবস্থা। কিছু এলাকায় বাতাসে নিশ্চিয়ই বিষাক্ত গ্যাস আছে।’
সিদরাত জেবিনের এই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর কী আমাদের জানা আছে। চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে বায়ুদূষণ হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ভয়াবহ। ঢাকার তীব্র বায়ুদূষণ কি জেবিনের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলেছিল? এসব কি কোনোদিন তদন্ত হবে? বায়ুদূষণের কারণে প্রশ্নহীনভাবে ঘটে চলা মৃত্যু ও অসুস্থতার কোনো ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে? এসব অকাল মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে? কোন উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং উন্নয়ন তৎপরতা বায়ুদূষণের ফলে আমাদের জীবনের ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব নেবে? ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল, কিন্তু একমাত্র শীতকাল এলে বায়ুদূষণ নিয়ে কথাবার্তা হয় তারপর সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে যায়। বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০২২ কার্যকর করতে আমরা এখনো কোনো ধারাবাহিক সমন্বিত কর্মসূচি দেখিনি। এমনকি ‘বাংলাদেশ নির্মল বায়ু আইন ২০১৯’ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
কিন্তু এসব আইন, নীতি বা কাগুজে নির্দেশনা কী বায়ুদূষণ থামাতে পারবে? রাষ্ট্র বহু নির্দেশনা ও নীতি জারি করেছিল কিন্তু কেন সেসব বাস্তবায়ন হয়নি তা আলাপে আনতে হবে। অবেহলা ও গাফিলতিরগুলো চিহ্নিত করতে হবে। জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আইন ও নীতি কার্যকর করা কিংবা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব সবার জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। নগরে যথেষ্ট জলাভূমি, উদ্যান, গাছপালা, সবুজ বলয়, উন্মুক্ত চত্বর সুরক্ষিত রাখাও মধ্যমেয়াদি ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ। কিন্তু যখন আমরা তীব্র বায়ুদূষণের ভেতর বসবাস করছি তখন নিস্তার পেতে অন্ততপক্ষে জীবন বাঁচাতে আমাদের এই মুহূর্ত থেকেই বেশ কিছু কাজ করা জরুরি। পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র বায়ুমান নির্মলকরণের জোরালো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। চলতি লেখাটিতে তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু প্রস্তাবনা যুক্ত করা হয়েছে। আমরা আশা করব গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত সরকার সবাইকে নিয়ে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র সংস্কারে বায়ুদূষণকে অন্যতম জরুরি বিষয় হিসেবে অগ্রাধিকার দিবে।
তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদি তৎপরতা :
১. বায়ুমানের ওপর ঢাকাসহ দেশের বায়ুদূষিত এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক (সর্বাধিক দূষিত, মধ্যমমানের বিপজ্জনক এবং বিপজ্জনক) সতকর্তা ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। এসব এলাকায় করণীয় বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এক্ষেত্রে প্রচার প্রচারণায় আপডেট তথ্য প্রচার করা এবং ফোরকাস্ট করতে হবে। একইসঙ্গে শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বায়ুমান লাইভ ফোরকাস্ট করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যাদের বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড আছে তাদের ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. ঢাকা শহরে দিনে ২ বার পানি ছিটাতে হবে। সকাল ৬টার ভেতর এবং রাত ৯টার পর পানি ছিটানোর কাজ শেষ ও শুরু করতে হবে। কারণ তা না হলে পানি ছিটানোর গাড়ির কারণে যানজট ও নতুন জনদুর্ভোগ তৈরি হতে পারে।
৩. শহরের রাস্তা ও রাস্তার পাশের উদ্যানের গাছের ওপর থেকে পানি ছিটাতে হবে যাতে জমে থাকা ধুলাবালি পরিষ্কার হয়। পানি ছিটানোর ঘাটতি মেটাতে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা এবং আশপাশের বিল্ডিংয়ের মালিকদের সমন্বয় করা যেতে পারে।
৪. ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট প্রদত্ত নির্দেশনাগুলো যাচাই করে বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. নভেম্বর-ডিসেম্বর জানুয়ারি এই তিন মাস ঢাকা শহরে সব ধরনের নির্মাণ কাজে জরুরি ভিত্তিতে কড়া নির্দেশনা দিতে হবে। সব নির্মাণকাজ ঢেকে করতে হবে এবং এই সময়টাতে ধুলাবালি তৈরি হয় এমন নির্মাণকাজকে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হবে।
৬. সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ইত্যাদি জরুরি ভিত্তিতে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৭. ফিটনেসবিহীন যানবাহন দ্রুত সড়ক থেকে সরাতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রঙ করা বা পোড়ানো এই সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৮. তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে প্লাস্টিকসহ সব ধরনের বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ রাখতে হবে।
৯. শহর এলাকায় ধুলাবালি পরিষ্কারের জন্য ভ্যাকুয়াম টাইপ সুইপিং গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবে এই ধুলাবালি পরিষ্কার অবশ্যই রাত ৯টার পর শুরু করে সকাল ৬টার আগে শেষ করতে হবে।
১০. ইট, বালি ও পণ্যবাহী সব ট্রাক ও যানবাহনকে মালামাল ঢেকে পরিবহন করতে হবে এবং এক্ষেত্রে কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে। ৩ মাসের জন্য ধুলাবালি ওড়তে পারে এমন মালামাল বহনকারী যানবাহনের শহরে প্রবেশ সাময়িক সময়ের জন্য সীমিত করতে হবে।
১১. বায়ুমান সূচকের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের বিদ্যালয়ের সময়সূচি পরিবর্তন করা যেতে পারে। সকাল ১০ থেকে দুপুর ২ পর্যন্ত হতে পারে।
১২. শুষ্ক মৌসুমে মাস্ক পরিধানের জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এখন পরিবেশ ও স্বাস্থ্য উপযোগী কাপড়ের মাস্ক বাজারে খুবই অপ্রতুল। এক্ষেত্রে আবার তরুণ যুব উদ্যাক্তাদের মাস্ক তৈরিতে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। মাস্ককে সহজলভ্য করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে সরকারিভাবেও পাবলিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোতে মাস্ক সরবরাহ করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদি তৎপরতা :
১৩. শহর এলাকার আশপাশের অবৈধ, দূষণকারী ইটভাটা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে।
১৪. শহর এবং শহর এলাকার আশপাশের শিল্পকারখানার দূষণ এবং দূষণের মাত্রা চিহ্নিত করে তালিকা করে পর্যায়ক্রমে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
১৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উদ্যান, স্টেশন, বাজার এবং পাবলিক প্লেসগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বায়ুদূষণ মুক্ত করার ধারাবাহিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১৬. খসড়া ‘বাংলাদেশ নির্মল বায়ু আইন ২০১৯’ সর্বসাধারণের মতামত ও সম্মতি নিয়ে দ্রুত কার্যকর ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০২২ কার্যকর করতে পর্যায়ক্রমিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি তৎপরতা:
১৭. নগরের সব পার্ক, উদ্যান, লেখার মাঠ এবং সবুজ বলয় অক্ষত রাখতে হবে। মাঠ ও উদ্যানে ঘাসের আচ্ছাদন তৈরি করতে হবে।
১৮. নগরের সড়ক এবং উদ্যানে নিয়মিত ঋতুবৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতি রোপণ করতে হবে এবং গাছ রক্ষা করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে নগরের গাছগুলোতে পানি দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১৯. বায়ুদূষণের কারণে নগরের কুকুর, বিড়াল, পাখি ও অন্যান্য প্রাণিকুলের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে এবং প্রভাব মোকাবিলায় কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি তা পর্যায়ক্রমিক গবেষণার ভেতর দিয়ে বের করতে হবে।
২০. বায়ুদূষণকে জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় একটি জরুরি পরিবেশ ও উন্নয়নগত সংকট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বায়ুদূষণের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে গবেষণা করতে হবে। পাশাপাশি ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ ও বায়ুদূষণের খাতগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে। সামগ্রিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
২১. বায়ুদূষণ রোধে জাতীয় বাজেটে সুস্পষ্ট খাত উল্লেখ করতে হবে।
২২. প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের শিক্ষাসূচিতে বায়ুদূষণ রোধে করণীয় ও সচেতনতার বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।
২৩. বায়ুদূষণের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অসুস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য জরুরি ‘বায়ুদূষণ চিকিৎসা তহবিল’ গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে নগরের নিম্নআয়ের ও প্রান্তিক মানুষের বায়ুদূষণ জনিত অসুস্থতার চিকিৎসা ও ক্ষয়ক্ষতি পূরণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা করতে হবে।
২৪. বায়ুদূষণ রোধে তরুণ-যুব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পরিবেশ সংগঠন ও নাগরিক আন্দোলনকে উৎসাহিত ও সক্রিয় করতে সহযোগিতা করতে হবে।
২৫. বায়ুদূষণ রোধে কর্মরত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তকে উৎসাহিত করতে ‘নির্মল বায়ু পদক’ চালু করা যেতে পারে।
[লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য]
পাভেল পার্থ
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
বিচিত্রসব সর্দি-কাশি আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুরছে মানুষ। নিঝুম শীতের রাতে দালানের পর দালান থেকে ভেসে আসছে নিদারুণ কাশির আওয়াজ। বায়ুদূষণে প্রায়ই বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করছে ঢাকা। স্মরণ রাখা জরুরি বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। দূষণ আর দুর্নীতি অভিন্ন যমজ। যেখানেই দূষণ, সেখানেই দুর্নীতি। যেখানেই দুর্নীতি, সেখানেই দূষণ। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ তীব্র রাষ্ট্রীয় অবহেলা, কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির অভাব এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি। বায়ুদূষণের ফলে প্রতি বছর কয়েক লাখ জীবনের মৃত্যু ঘটছে, অসুস্থ হচ্ছে লাখো কোটি মানুষ। গড় আয়ু কমছে কয়েক বছর। অথচ এই বায়ুদূষণ থামাতে দৃশ্যমান কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নাই।
বায়ুদূষণ তো এমন নয় যে, কেবল গরিবকে আক্রান্ত করবে। শ্রেণি-বর্গনির্বিশেষে সব মানুষই বিপদে আছে। তাহলে আমরা কেন বায়ুদূষণ মোকাবিলার দায় ও দায়িত্বকে দৃশ্যমান করছি না। এমনকি গবেষণা বলছে বায়ুদূষণের কারণে জাতীয় অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকা যখন আবারো তীব্র বায়ুদূষণে আক্রান্ত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে, একজন তরুণ চিকিৎসক মৃত্যুর আগে বায়ুদূষণ নিয়ে তার জিজ্ঞাসাটি রাষ্ট্রের সামনে ছুড়ে দিয়ে গেছেন। ডা. সিদরাত জেবিন জটিল হাঁপানি সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ফেইসবুক প্রোফাইলে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘...ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ কী? এত প্রকৌশলী থাকার পরও দূষণের কারণ নিয়ে কোনো তথ্য নেই। কেউ কি বাতাসের মান আদৌ খতিয়ে দেখছে? মনে হয় না শুধু ধুলো আর নির্মাণসামগ্রীর জন্য এই অবস্থা। কিছু এলাকায় বাতাসে নিশ্চিয়ই বিষাক্ত গ্যাস আছে।’
সিদরাত জেবিনের এই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর কী আমাদের জানা আছে। চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে বায়ুদূষণ হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ভয়াবহ। ঢাকার তীব্র বায়ুদূষণ কি জেবিনের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলেছিল? এসব কি কোনোদিন তদন্ত হবে? বায়ুদূষণের কারণে প্রশ্নহীনভাবে ঘটে চলা মৃত্যু ও অসুস্থতার কোনো ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে? এসব অকাল মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে? কোন উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং উন্নয়ন তৎপরতা বায়ুদূষণের ফলে আমাদের জীবনের ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব নেবে? ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল, কিন্তু একমাত্র শীতকাল এলে বায়ুদূষণ নিয়ে কথাবার্তা হয় তারপর সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে যায়। বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০২২ কার্যকর করতে আমরা এখনো কোনো ধারাবাহিক সমন্বিত কর্মসূচি দেখিনি। এমনকি ‘বাংলাদেশ নির্মল বায়ু আইন ২০১৯’ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
কিন্তু এসব আইন, নীতি বা কাগুজে নির্দেশনা কী বায়ুদূষণ থামাতে পারবে? রাষ্ট্র বহু নির্দেশনা ও নীতি জারি করেছিল কিন্তু কেন সেসব বাস্তবায়ন হয়নি তা আলাপে আনতে হবে। অবেহলা ও গাফিলতিরগুলো চিহ্নিত করতে হবে। জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আইন ও নীতি কার্যকর করা কিংবা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব সবার জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। নগরে যথেষ্ট জলাভূমি, উদ্যান, গাছপালা, সবুজ বলয়, উন্মুক্ত চত্বর সুরক্ষিত রাখাও মধ্যমেয়াদি ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ। কিন্তু যখন আমরা তীব্র বায়ুদূষণের ভেতর বসবাস করছি তখন নিস্তার পেতে অন্ততপক্ষে জীবন বাঁচাতে আমাদের এই মুহূর্ত থেকেই বেশ কিছু কাজ করা জরুরি। পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র বায়ুমান নির্মলকরণের জোরালো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। চলতি লেখাটিতে তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু প্রস্তাবনা যুক্ত করা হয়েছে। আমরা আশা করব গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত সরকার সবাইকে নিয়ে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র সংস্কারে বায়ুদূষণকে অন্যতম জরুরি বিষয় হিসেবে অগ্রাধিকার দিবে।
তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদি তৎপরতা :
১. বায়ুমানের ওপর ঢাকাসহ দেশের বায়ুদূষিত এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক (সর্বাধিক দূষিত, মধ্যমমানের বিপজ্জনক এবং বিপজ্জনক) সতকর্তা ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। এসব এলাকায় করণীয় বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এক্ষেত্রে প্রচার প্রচারণায় আপডেট তথ্য প্রচার করা এবং ফোরকাস্ট করতে হবে। একইসঙ্গে শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বায়ুমান লাইভ ফোরকাস্ট করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যাদের বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড আছে তাদের ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. ঢাকা শহরে দিনে ২ বার পানি ছিটাতে হবে। সকাল ৬টার ভেতর এবং রাত ৯টার পর পানি ছিটানোর কাজ শেষ ও শুরু করতে হবে। কারণ তা না হলে পানি ছিটানোর গাড়ির কারণে যানজট ও নতুন জনদুর্ভোগ তৈরি হতে পারে।
৩. শহরের রাস্তা ও রাস্তার পাশের উদ্যানের গাছের ওপর থেকে পানি ছিটাতে হবে যাতে জমে থাকা ধুলাবালি পরিষ্কার হয়। পানি ছিটানোর ঘাটতি মেটাতে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা এবং আশপাশের বিল্ডিংয়ের মালিকদের সমন্বয় করা যেতে পারে।
৪. ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট প্রদত্ত নির্দেশনাগুলো যাচাই করে বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. নভেম্বর-ডিসেম্বর জানুয়ারি এই তিন মাস ঢাকা শহরে সব ধরনের নির্মাণ কাজে জরুরি ভিত্তিতে কড়া নির্দেশনা দিতে হবে। সব নির্মাণকাজ ঢেকে করতে হবে এবং এই সময়টাতে ধুলাবালি তৈরি হয় এমন নির্মাণকাজকে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হবে।
৬. সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ইত্যাদি জরুরি ভিত্তিতে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৭. ফিটনেসবিহীন যানবাহন দ্রুত সড়ক থেকে সরাতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রঙ করা বা পোড়ানো এই সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৮. তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে প্লাস্টিকসহ সব ধরনের বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ রাখতে হবে।
৯. শহর এলাকায় ধুলাবালি পরিষ্কারের জন্য ভ্যাকুয়াম টাইপ সুইপিং গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবে এই ধুলাবালি পরিষ্কার অবশ্যই রাত ৯টার পর শুরু করে সকাল ৬টার আগে শেষ করতে হবে।
১০. ইট, বালি ও পণ্যবাহী সব ট্রাক ও যানবাহনকে মালামাল ঢেকে পরিবহন করতে হবে এবং এক্ষেত্রে কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে। ৩ মাসের জন্য ধুলাবালি ওড়তে পারে এমন মালামাল বহনকারী যানবাহনের শহরে প্রবেশ সাময়িক সময়ের জন্য সীমিত করতে হবে।
১১. বায়ুমান সূচকের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের বিদ্যালয়ের সময়সূচি পরিবর্তন করা যেতে পারে। সকাল ১০ থেকে দুপুর ২ পর্যন্ত হতে পারে।
১২. শুষ্ক মৌসুমে মাস্ক পরিধানের জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এখন পরিবেশ ও স্বাস্থ্য উপযোগী কাপড়ের মাস্ক বাজারে খুবই অপ্রতুল। এক্ষেত্রে আবার তরুণ যুব উদ্যাক্তাদের মাস্ক তৈরিতে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। মাস্ককে সহজলভ্য করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে সরকারিভাবেও পাবলিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোতে মাস্ক সরবরাহ করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদি তৎপরতা :
১৩. শহর এলাকার আশপাশের অবৈধ, দূষণকারী ইটভাটা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে।
১৪. শহর এবং শহর এলাকার আশপাশের শিল্পকারখানার দূষণ এবং দূষণের মাত্রা চিহ্নিত করে তালিকা করে পর্যায়ক্রমে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
১৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উদ্যান, স্টেশন, বাজার এবং পাবলিক প্লেসগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বায়ুদূষণ মুক্ত করার ধারাবাহিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১৬. খসড়া ‘বাংলাদেশ নির্মল বায়ু আইন ২০১৯’ সর্বসাধারণের মতামত ও সম্মতি নিয়ে দ্রুত কার্যকর ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০২২ কার্যকর করতে পর্যায়ক্রমিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি তৎপরতা:
১৭. নগরের সব পার্ক, উদ্যান, লেখার মাঠ এবং সবুজ বলয় অক্ষত রাখতে হবে। মাঠ ও উদ্যানে ঘাসের আচ্ছাদন তৈরি করতে হবে।
১৮. নগরের সড়ক এবং উদ্যানে নিয়মিত ঋতুবৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতি রোপণ করতে হবে এবং গাছ রক্ষা করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে নগরের গাছগুলোতে পানি দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১৯. বায়ুদূষণের কারণে নগরের কুকুর, বিড়াল, পাখি ও অন্যান্য প্রাণিকুলের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে এবং প্রভাব মোকাবিলায় কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি তা পর্যায়ক্রমিক গবেষণার ভেতর দিয়ে বের করতে হবে।
২০. বায়ুদূষণকে জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় একটি জরুরি পরিবেশ ও উন্নয়নগত সংকট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বায়ুদূষণের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে গবেষণা করতে হবে। পাশাপাশি ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ ও বায়ুদূষণের খাতগুলোকেও চিহ্নিত করতে হবে। সামগ্রিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
২১. বায়ুদূষণ রোধে জাতীয় বাজেটে সুস্পষ্ট খাত উল্লেখ করতে হবে।
২২. প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের শিক্ষাসূচিতে বায়ুদূষণ রোধে করণীয় ও সচেতনতার বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।
২৩. বায়ুদূষণের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অসুস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য জরুরি ‘বায়ুদূষণ চিকিৎসা তহবিল’ গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে নগরের নিম্নআয়ের ও প্রান্তিক মানুষের বায়ুদূষণ জনিত অসুস্থতার চিকিৎসা ও ক্ষয়ক্ষতি পূরণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা করতে হবে।
২৪. বায়ুদূষণ রোধে তরুণ-যুব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পরিবেশ সংগঠন ও নাগরিক আন্দোলনকে উৎসাহিত ও সক্রিয় করতে সহযোগিতা করতে হবে।
২৫. বায়ুদূষণ রোধে কর্মরত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তকে উৎসাহিত করতে ‘নির্মল বায়ু পদক’ চালু করা যেতে পারে।
[লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য]