এম এ হোসাইন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায়, যা শুধু দেশের মানুষের গভীর ত্যাগ ও দৃঢ়তাকেই প্রতিফলিত করে না, বরং দেশের পরিচয় গঠনে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক প্রভাবের জটিল আন্তঃক্রিয়াকেও তুলে ধরে। বাংলাদেশ যখন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে পুনর্বিবেচনা করার মধ্য দিয়ে বিজয় উদযাপন, শিক্ষা পুনর্মূল্যায়ন এবং স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রের রণকৌশল ও রাজনৈতিক পরিকল্পনার মহান বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে, তবে এর প্রকৃত মহিমা নিহিত রয়েছে ব্যক্তিগত ত্যাগ ও সাহসিকতার গল্পগুলোতে। সাধারণ মানুষ তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই রয়ে গেছেন অজানা নায়করূপে, যাদের অবদান বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিবরণের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের সময় এই ব্যক্তিগত কাহিনী, মৌখিক ইতিহাস এবং সম্প্রদায়ের গল্পগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর উদযাপিত বিজয় দিবস শুধু উদযাপনের দিন নয়, এটি স্বাধীনতার সর্বোচ্চ মূল্যের একটি গভীর স্মারকও। যদিও কিছু মুক্তিযোদ্ধার অবদান ইতিহাসে উদযাপিত হচ্ছে, কিন্তু অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা থেকে গেছেন অজ্ঞাত। প্রতিটি ব্যক্তির ভূমিকা, যত ছোটই হোক না কেন, এই সম্মিলিত বিজয়ে অবদান রেখেছে। এই নীরব যোদ্ধাদের স্বীকৃতি স্বাধীনতার জন্য করা ত্যাগের গভীরতর উপলব্ধি তৈরিতে অত্যন্ত জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি মানুষের হৃদয় ও বিবেকও সংঘটিত হয়েছিল। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ জনগণকে সংগঠিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রতিরোধের গান, আশার কবিতা এবং শিল্পের বহিঃপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুনর্বিবেচনা করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় গভীরভাবে জড়িত সেই সৃজনশীল চেতনার সঙ্গে, যা দেশের স্বাধীনতাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ওই সময়ের দেশপ্রেমিক গান, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ধারণ করা কবিতা এবং চিত্রশিল্পের মাধ্যমে জাতির চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজও গর্ব ও অনুপ্রেরণার উৎস। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ যে এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যহত রাখার সংগ্রাম করেছে তার প্রমাণ ৫ আগস্ট, ২০২৪। আমরা দেখেছি এক ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারা যেখানে দেশের প্রতিটি দেয়াল হয়ে উঠেছিল জীবন্ত প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা প্রায়শই ভোগান্তি ও সেবা প্রদানের প্রচলিত বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু নারীরা কেবল এসব ভূমিকায় আবদ্ধ ছিলেন না; তারা ছিলেন সক্রিয় যোদ্ধা, সংগঠক এবং প্রতিরোধের প্রতীক। তারা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছেন। তাদের এই অবদান ইতিহাসে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চিত্র উপস্থাপনের জন্য নারীদের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই নয়, এটি সামাজিক নিয়ম-নীতিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করারও একটি প্রচেষ্টা। যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, আন্দোলন সংগঠিত করেছিল, বা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান করেছিল, তাদের গল্পগুলোকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ তার ইতিহাসের আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সঠিক উপস্থাপনা করতে পারে। স্বাধীনতার পর সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজস্ব দলীয় আদর্শের জন্য আত্মীকরণ করতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু কখনো জাতীয়তার বাহক হিসেবে উন্মুক্ত করার মতো উদার হতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ছিল না; এটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিশীলতায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। আন্তর্জাতিক সহায়তা, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সংহতির আন্দোলনগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নেতাদের নৈতিক সমর্থনÑ এই সংগ্রামের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের আন্তঃসম্পর্কিত চরিত্রকে তুলে ধরে।
এই অবদানগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া শুধু ঐতিহাসিক সত্যের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সমকালীন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বিশেষ শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ক্ষেত্রে।
মুক্তিযুদ্ধের যে নীতিগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক অধিকারÑ এখনও প্রাসঙ্গিক। সমকালীন বাংলাদেশে এই আদর্শগুলো কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে জাতির অগ্রগতির পরিমাপ করা সম্ভব। স্বাধীনতার এত বছর পর জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়নে সফল হয়েছি তাই হবে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য পূরণের মাপকাঠি।
অর্থনৈতিকভাবে, বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে একটি উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অগ্রগতি দেশের জনগণের দৃঢ়তা এবং সংগ্রামী মনোভাবের প্রতিফলন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় সুস্পষ্ট ছিল। তবে, জাতির নেতৃত্বকে নিশ্চিত করতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা ভারতের মতো বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা যেন কোনভাবেই দেশের সার্বভৌমত্ব বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে আপস না করতে হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক নয়; এটি স্বনির্ধারণ, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি চলমান যাত্রা। আমাদের নেতৃত্বকে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার ভারসাম্য বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে হবে। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে বাংলাদেশে একাত্তরে পরাজিত শক্তির উদ্বেগজনক উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এসব গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে ক্ষুণœ করার অভিপ্রায়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই গোষ্ঠীগুলোর প্রচার থেকে সতর্ক থাকা এবং তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বর্ণনার ফাঁদে না ফেলতে পারে তার জন্য সজাগ থাকবে হবে। এই গোষ্ঠীগুলো ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছে এবং এখন ১৯৭১ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে। যদিও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো একটি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ তবে এটি মুক্তিযুদ্ধের মহৎ গুরুত্ব ভুলে যাওয়ার বা ক্ষুণœ করার বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়।
বিজয় দিবস শুধু ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়; এটি জাতির মুক্তির চিরন্তন উদযাপন। একটি সম্মিলিত নীরবতা পালনের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা একটি শক্তিশালী প্রতীকী উদ্যোগ হতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ জাতির একতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি চিরঋণী কৃতজ্ঞতাকে আরও সুসংহত করবে। কেবল উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মানুষের মত প্রকাশ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এবং সরকারের জবাবদিহিতার প্রচেষ্টার টুঁটি চেপে ধরাটা হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীর শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনর্মূল্যায়ন শুধু অতীতের একটি পর্যালোচনা নয়, বরং ভবিষ্যতমুখী একটি প্রয়াস। ব্যক্তিগত গল্পগুলোর উদযাপন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন, নারীদের ভূমিকা তুলে ধরা, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বোঝা এবং এর আদর্শগুলোর চলমান প্রভাব মূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
বিজয় দিবস হলো সেই আত্মত্যাগ এবং অগণিত মানুষের দৃঢ়তার স্মারক, যারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছিলেন। এটি একই সঙ্গে একটি আহ্বানÑ জাতি যেসব আদর্শের জন্য দাঁড়িয়েছিল, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য।
১৯৭১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের যাত্রা তার মানুষের অদম্য চেতনার সাক্ষ্য বহন করে। জাতি যখন বর্তমান ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, বিজয়ের পটভূমি পুনর্মূল্যায়ন নিশ্চিত করে যে অতীতের আত্মত্যাগগুলো ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করে চলবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায়, যা শুধু দেশের মানুষের গভীর ত্যাগ ও দৃঢ়তাকেই প্রতিফলিত করে না, বরং দেশের পরিচয় গঠনে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক প্রভাবের জটিল আন্তঃক্রিয়াকেও তুলে ধরে। বাংলাদেশ যখন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে পুনর্বিবেচনা করার মধ্য দিয়ে বিজয় উদযাপন, শিক্ষা পুনর্মূল্যায়ন এবং স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রের রণকৌশল ও রাজনৈতিক পরিকল্পনার মহান বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে, তবে এর প্রকৃত মহিমা নিহিত রয়েছে ব্যক্তিগত ত্যাগ ও সাহসিকতার গল্পগুলোতে। সাধারণ মানুষ তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই রয়ে গেছেন অজানা নায়করূপে, যাদের অবদান বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিবরণের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের সময় এই ব্যক্তিগত কাহিনী, মৌখিক ইতিহাস এবং সম্প্রদায়ের গল্পগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর উদযাপিত বিজয় দিবস শুধু উদযাপনের দিন নয়, এটি স্বাধীনতার সর্বোচ্চ মূল্যের একটি গভীর স্মারকও। যদিও কিছু মুক্তিযোদ্ধার অবদান ইতিহাসে উদযাপিত হচ্ছে, কিন্তু অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা থেকে গেছেন অজ্ঞাত। প্রতিটি ব্যক্তির ভূমিকা, যত ছোটই হোক না কেন, এই সম্মিলিত বিজয়ে অবদান রেখেছে। এই নীরব যোদ্ধাদের স্বীকৃতি স্বাধীনতার জন্য করা ত্যাগের গভীরতর উপলব্ধি তৈরিতে অত্যন্ত জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি মানুষের হৃদয় ও বিবেকও সংঘটিত হয়েছিল। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ জনগণকে সংগঠিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রতিরোধের গান, আশার কবিতা এবং শিল্পের বহিঃপ্রকাশ মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুনর্বিবেচনা করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় গভীরভাবে জড়িত সেই সৃজনশীল চেতনার সঙ্গে, যা দেশের স্বাধীনতাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ওই সময়ের দেশপ্রেমিক গান, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ধারণ করা কবিতা এবং চিত্রশিল্পের মাধ্যমে জাতির চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজও গর্ব ও অনুপ্রেরণার উৎস। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ যে এই ঐতিহ্যের সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যহত রাখার সংগ্রাম করেছে তার প্রমাণ ৫ আগস্ট, ২০২৪। আমরা দেখেছি এক ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারা যেখানে দেশের প্রতিটি দেয়াল হয়ে উঠেছিল জীবন্ত প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা প্রায়শই ভোগান্তি ও সেবা প্রদানের প্রচলিত বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু নারীরা কেবল এসব ভূমিকায় আবদ্ধ ছিলেন না; তারা ছিলেন সক্রিয় যোদ্ধা, সংগঠক এবং প্রতিরোধের প্রতীক। তারা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছেন। তাদের এই অবদান ইতিহাসে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চিত্র উপস্থাপনের জন্য নারীদের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই নয়, এটি সামাজিক নিয়ম-নীতিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করারও একটি প্রচেষ্টা। যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, আন্দোলন সংগঠিত করেছিল, বা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান করেছিল, তাদের গল্পগুলোকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ তার ইতিহাসের আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সঠিক উপস্থাপনা করতে পারে। স্বাধীনতার পর সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজস্ব দলীয় আদর্শের জন্য আত্মীকরণ করতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু কখনো জাতীয়তার বাহক হিসেবে উন্মুক্ত করার মতো উদার হতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ছিল না; এটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিশীলতায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। আন্তর্জাতিক সহায়তা, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সংহতির আন্দোলনগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নেতাদের নৈতিক সমর্থনÑ এই সংগ্রামের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের আন্তঃসম্পর্কিত চরিত্রকে তুলে ধরে।
এই অবদানগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া শুধু ঐতিহাসিক সত্যের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সমকালীন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বিশেষ শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ক্ষেত্রে।
মুক্তিযুদ্ধের যে নীতিগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক অধিকারÑ এখনও প্রাসঙ্গিক। সমকালীন বাংলাদেশে এই আদর্শগুলো কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে জাতির অগ্রগতির পরিমাপ করা সম্ভব। স্বাধীনতার এত বছর পর জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়নে সফল হয়েছি তাই হবে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য পূরণের মাপকাঠি।
অর্থনৈতিকভাবে, বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে একটি উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অগ্রগতি দেশের জনগণের দৃঢ়তা এবং সংগ্রামী মনোভাবের প্রতিফলন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় সুস্পষ্ট ছিল। তবে, জাতির নেতৃত্বকে নিশ্চিত করতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা ভারতের মতো বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা যেন কোনভাবেই দেশের সার্বভৌমত্ব বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে আপস না করতে হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক নয়; এটি স্বনির্ধারণ, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি চলমান যাত্রা। আমাদের নেতৃত্বকে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার ভারসাম্য বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে হবে। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে বাংলাদেশে একাত্তরে পরাজিত শক্তির উদ্বেগজনক উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এসব গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে ক্ষুণœ করার অভিপ্রায়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই গোষ্ঠীগুলোর প্রচার থেকে সতর্ক থাকা এবং তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বর্ণনার ফাঁদে না ফেলতে পারে তার জন্য সজাগ থাকবে হবে। এই গোষ্ঠীগুলো ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছে এবং এখন ১৯৭১ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে। যদিও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো একটি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ তবে এটি মুক্তিযুদ্ধের মহৎ গুরুত্ব ভুলে যাওয়ার বা ক্ষুণœ করার বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়।
বিজয় দিবস শুধু ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়; এটি জাতির মুক্তির চিরন্তন উদযাপন। একটি সম্মিলিত নীরবতা পালনের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা একটি শক্তিশালী প্রতীকী উদ্যোগ হতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ জাতির একতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি চিরঋণী কৃতজ্ঞতাকে আরও সুসংহত করবে। কেবল উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মানুষের মত প্রকাশ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এবং সরকারের জবাবদিহিতার প্রচেষ্টার টুঁটি চেপে ধরাটা হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীর শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনর্মূল্যায়ন শুধু অতীতের একটি পর্যালোচনা নয়, বরং ভবিষ্যতমুখী একটি প্রয়াস। ব্যক্তিগত গল্পগুলোর উদযাপন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন, নারীদের ভূমিকা তুলে ধরা, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বোঝা এবং এর আদর্শগুলোর চলমান প্রভাব মূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
বিজয় দিবস হলো সেই আত্মত্যাগ এবং অগণিত মানুষের দৃঢ়তার স্মারক, যারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছিলেন। এটি একই সঙ্গে একটি আহ্বানÑ জাতি যেসব আদর্শের জন্য দাঁড়িয়েছিল, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য।
১৯৭১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের যাত্রা তার মানুষের অদম্য চেতনার সাক্ষ্য বহন করে। জাতি যখন বর্তমান ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, বিজয়ের পটভূমি পুনর্মূল্যায়ন নিশ্চিত করে যে অতীতের আত্মত্যাগগুলো ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করে চলবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]