জাহিদুল ইসলাম
পৃথিবীতে একটি ভৌগোলিক উত্তর মেরু এবং একটি দক্ষিণ মেরু রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দুই মেরুতেই শীতকাল এবং গ্রীষ্মকাল ছাড়া আর কোন ঋতু নেই। শীতকালে মেরু অঞ্চলে সূর্যের দেখা মেলে না। গ্রীষ্মকালে ঠিক এর উল্টোটা হয় অর্থাৎ তখন মেরু অঞ্চলে সূর্য অস্ত যায় না। তবে মেরু অঞ্চলে সূর্য দিগন্ত রেখার খুব বেশি উপরে উঠে না। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল হয় দক্ষিণ মেরুতে তখন থাকে গ্রীষ্মকাল। কক্ষপথে পৃথিবী কিছুটা হেলে থাকার কারণে দুই বিপরীত মেরুতে একই সময়ে সূর্যের দেখা মেলে না।
ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ছাড়াও পৃথিবীর আরো দুটো মেরু রয়েছে। এ দুটো হলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু বা ম্যাগনেটিক পোল। অর্থাৎ চুম্বকের মতো পৃথিবীরও রয়েছে দুটি মেরু। পৃথিবী একটা চুম্বকের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারপাশে একটি অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র নামে পরিচিত। পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত লোহা জমাট বাঁধার ফলে এক ধরনের শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবেই কম্পাসের কাঁটা নড়ে উঠে দিক নির্দেশ করে।
কম্পাসের কাঁটাও একটি চুম্বক। চুম্বকের কাঁটার দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উত্তর মেরুর দিকে ফিরে থাকে। এর কারণ হলো দুটি চুম্বকের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ হয় এবং সম মেরুতে ঘটে তার উল্টোটা অর্থাৎ বিকর্ষণ। পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তর ও দক্ষিণ চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুই মেরুর মাঝে রয়েছে যথেষ্ট দূরত্ব। চৌম্বকীয় উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর মতো এক জায়গায় স্থির থাকে না।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র মহাকাশে বেশ খানিকটা বিস্তৃত। পৃথিবীটা হলো মহাকাশে ভাসমান একটি শক্তিশালী চুম্বক। আর এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি পৃথিবীকে নানা ধরনের ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্র না থাকলে পৃথিবী নামক গ্রহটি জীবজগতের জন্য বাসযোগ্য হতো না। এই প্রতিরক্ষা বলয় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে প্রতিনিয়তই রক্ষা করে চলছে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীকে সূর্যের তীব্র রশ্মি এবং মহাকাশের অন্যান্য ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এ বলয় না থাকলে পৃথিবীতে জীব-বৈচিত্র্য কল্পনা করা সম্ভব হতো না। চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া সৌরবায়ুর প্রভাবে বিলীন হয়ে যেত পৃথিবীর বায়ুম-ল। সূর্যের প্রচ- তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আছড়ে পড়তো পৃথিবীর বুকে। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর ভূ-ত্বকের নিচে কনক্রিটের আবাসস্থল তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে হতো। সুতরাং এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে আমাদের জীবনধারণের জন্য এই চৌম্বক্ষেত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজের অক্ষের উপর ঘুরে এবং এর কেন্দ্রের গলিত লোহা চক্রাকারে ঘুরে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে পৃথিবীর চৌম্বক মেরু নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে এবং এই পরিবর্তন প্রায় দুই থেকে তিন লাখ বছরে একবার ঘটে। পৃথিবীর কেন্দ্রে রয়েছে অতি উত্তপ্ত কঠিন লোহার গোলক। এর তাপমাত্রা প্রায় ৫ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেন্দ্রের কঠিন গোলকের চারপাশে আছে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার তরল পদার্থ। এ তরলের উপাদান মূলত লোহা ও নিকেল। তাপমাত্রা, চাপ এবং গঠনগত পার্থক্যের কারণে গরম ও কম ঘন পদার্থ বাইরের স্তরে বেরিয়ে আসে। একইভাবে বাইরের স্তরের ঘন পদার্থগুলো চলে যায় ভেতরের স্তরে। মূলত এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময় এটা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। তবে পৃথিবীর উচ্চচাপের কারণে একেবারে কেন্দ্রের গোলকটি তরল হতে পারে না।
সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবী তার নিজের অক্ষের উপর প্রতিনিয়তই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। নিজ অক্ষের ওপর পুরো একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড। পৃথিবীর এই লাটিমের মতো ঘোরার ফলেই প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্যের উদয় হচ্ছে এবং পশ্চিম দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
অর্থাৎ এই গতির ফলেই পৃথিবীতে দিনরাত্রি হয়। আর এটা হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। এই ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রে কোরিওলিস ইফেক্ট (গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতি) তৈরি হয়। এ কারণে কেন্দ্রের তরলে তৈরি হয় এক ধরনের ঘূর্ণিবর্ত। ফলে বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি হয়। আর এই বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র। বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত ধাতু কেন্দ্রের তরলের মাঝে ঘোরার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ প্রবাহ। বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় চৌম্বকক্ষেত্র। এ চক্র ক্রমাগত চলতেই থাকে।
[লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
জাহিদুল ইসলাম
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
পৃথিবীতে একটি ভৌগোলিক উত্তর মেরু এবং একটি দক্ষিণ মেরু রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দুই মেরুতেই শীতকাল এবং গ্রীষ্মকাল ছাড়া আর কোন ঋতু নেই। শীতকালে মেরু অঞ্চলে সূর্যের দেখা মেলে না। গ্রীষ্মকালে ঠিক এর উল্টোটা হয় অর্থাৎ তখন মেরু অঞ্চলে সূর্য অস্ত যায় না। তবে মেরু অঞ্চলে সূর্য দিগন্ত রেখার খুব বেশি উপরে উঠে না। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল হয় দক্ষিণ মেরুতে তখন থাকে গ্রীষ্মকাল। কক্ষপথে পৃথিবী কিছুটা হেলে থাকার কারণে দুই বিপরীত মেরুতে একই সময়ে সূর্যের দেখা মেলে না।
ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ছাড়াও পৃথিবীর আরো দুটো মেরু রয়েছে। এ দুটো হলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু বা ম্যাগনেটিক পোল। অর্থাৎ চুম্বকের মতো পৃথিবীরও রয়েছে দুটি মেরু। পৃথিবী একটা চুম্বকের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারপাশে একটি অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র নামে পরিচিত। পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত লোহা জমাট বাঁধার ফলে এক ধরনের শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবেই কম্পাসের কাঁটা নড়ে উঠে দিক নির্দেশ করে।
কম্পাসের কাঁটাও একটি চুম্বক। চুম্বকের কাঁটার দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উত্তর মেরুর দিকে ফিরে থাকে। এর কারণ হলো দুটি চুম্বকের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ হয় এবং সম মেরুতে ঘটে তার উল্টোটা অর্থাৎ বিকর্ষণ। পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তর ও দক্ষিণ চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুই মেরুর মাঝে রয়েছে যথেষ্ট দূরত্ব। চৌম্বকীয় উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর মতো এক জায়গায় স্থির থাকে না।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র মহাকাশে বেশ খানিকটা বিস্তৃত। পৃথিবীটা হলো মহাকাশে ভাসমান একটি শক্তিশালী চুম্বক। আর এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি পৃথিবীকে নানা ধরনের ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্র না থাকলে পৃথিবী নামক গ্রহটি জীবজগতের জন্য বাসযোগ্য হতো না। এই প্রতিরক্ষা বলয় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে প্রতিনিয়তই রক্ষা করে চলছে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীকে সূর্যের তীব্র রশ্মি এবং মহাকাশের অন্যান্য ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এ বলয় না থাকলে পৃথিবীতে জীব-বৈচিত্র্য কল্পনা করা সম্ভব হতো না। চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া সৌরবায়ুর প্রভাবে বিলীন হয়ে যেত পৃথিবীর বায়ুম-ল। সূর্যের প্রচ- তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আছড়ে পড়তো পৃথিবীর বুকে। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর ভূ-ত্বকের নিচে কনক্রিটের আবাসস্থল তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে হতো। সুতরাং এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে আমাদের জীবনধারণের জন্য এই চৌম্বক্ষেত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজের অক্ষের উপর ঘুরে এবং এর কেন্দ্রের গলিত লোহা চক্রাকারে ঘুরে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে পৃথিবীর চৌম্বক মেরু নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে এবং এই পরিবর্তন প্রায় দুই থেকে তিন লাখ বছরে একবার ঘটে। পৃথিবীর কেন্দ্রে রয়েছে অতি উত্তপ্ত কঠিন লোহার গোলক। এর তাপমাত্রা প্রায় ৫ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেন্দ্রের কঠিন গোলকের চারপাশে আছে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার তরল পদার্থ। এ তরলের উপাদান মূলত লোহা ও নিকেল। তাপমাত্রা, চাপ এবং গঠনগত পার্থক্যের কারণে গরম ও কম ঘন পদার্থ বাইরের স্তরে বেরিয়ে আসে। একইভাবে বাইরের স্তরের ঘন পদার্থগুলো চলে যায় ভেতরের স্তরে। মূলত এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময় এটা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। তবে পৃথিবীর উচ্চচাপের কারণে একেবারে কেন্দ্রের গোলকটি তরল হতে পারে না।
সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবী তার নিজের অক্ষের উপর প্রতিনিয়তই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। নিজ অক্ষের ওপর পুরো একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড। পৃথিবীর এই লাটিমের মতো ঘোরার ফলেই প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্যের উদয় হচ্ছে এবং পশ্চিম দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
অর্থাৎ এই গতির ফলেই পৃথিবীতে দিনরাত্রি হয়। আর এটা হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। এই ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রে কোরিওলিস ইফেক্ট (গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতি) তৈরি হয়। এ কারণে কেন্দ্রের তরলে তৈরি হয় এক ধরনের ঘূর্ণিবর্ত। ফলে বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি হয়। আর এই বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র। বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত ধাতু কেন্দ্রের তরলের মাঝে ঘোরার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ প্রবাহ। বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় চৌম্বকক্ষেত্র। এ চক্র ক্রমাগত চলতেই থাকে।
[লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]