মোস্তফা কামাল যাত্রা
এক দেশ বহু জাতি। জাতিনির্ভর একক দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাঙ্গাল থেকে বাঙালি আর বাঙালি থেকে বাংলাদেশি। কিন্তু জাত কী বাংলাদেশে একটা?
নিশ্চয়ই না। তাই ‘দেশজ নাট্য’ তথা ‘ইনডিজেনাস থিয়েটার’ এবং ‘জাতীয় নাট্য’ তথা ন্যাশনাল থিয়েটারের কেন্দ্রীয় রূপ চূড়ান্ত করা খুব সহজ বিষয় নয়। সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো একটি দেশের ‘দেশজ বা জাতীয়’ যে অভিধায়ই বলি না কেন একটি কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী নেই এটা ভাবা যায় না।
ভূমিগত সীমারেখা তথা মানচিত্রগত স্বীকৃত রাষ্ট্র বা দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বহুজাতিক যে চর্চিত নাট্যধারাসমূহ রয়েছে তার মধ্যে অবশ্যই একটি দেশজ আবরণ দৃশ্যমান। কিন্তু চর্চিত সেই দেশজ নাট্য ধারাসমূহের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় বা জাতীয় স্বরূপ অদ্যাবদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘জাতীয় নাট্যশালা’ অদ্যাবধি চূড়ান্ত করতে পারেনি।
দেশব্যাপী চর্চিত নাট্যধারাসমূহের বুৎপত্তি আর উৎপত্তিগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার সবগুলোই এই ভূমি থেকে উদ্ভূত নয়। আবার ধর্মীয় আগ্রাসন বিবেচনায় সংস্কৃত নাট্যের উদ্ভব এই বঙ্গে হলেও তা দেশজ কী?
ইতিহাসের কালপর্বে ব্রিটিশ কলোনিয়াল প্রভাবজাত সময়কালে লিয়েবিদেফ কর্তৃক প্রসেনিয়াম ধারণায় যে নাট্যচর্চার সূচনা হয়েছিল এতদ্ব অঞ্চলে তার বঙ্গীয় স্বরূপও কি আমাদের দেশজ নাট্য?
উত্থাপিত প্রশ্নদ্বয়ের যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পেতে গবেষণামূলক বিশ্লেষণের পথপরিক্রমা অনুসরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিকতা এবং ভূ-প্রকৃতির গঠনকে বিবেচনায় নিয়ে এই প্রসঙ্গটি আলোকপাত করা জরুরি। কারণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বঙ্গ অঞ্চলের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আসলে ভূ-প্রকৃতিগত দিক বিবেচনায় সৃষ্ট নাট্য ঘরনাই হলো ওই ভূমির নিজস্ব নাট্য। সেখানে জাতপ্রথা মুখ্য বিবেচনা নয়। জাতিভেদে স্ব স্ব নাট্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই জাতীয় নাট্য-এর কেন্দ্রীয় স্বরূপ নির্ধারণ বা স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক পরম্পরার গতিপ্রকৃতির আলোকে মৌলিক কতগুলো বিষয়কে এই প্রসঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের ভূমি তথা মানচিত্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী জাতী, উপজাতীদের (নৃ-গোষ্ঠী) চর্চিত নাট্যক্রিয়া বহুমাত্রিক। সুতরাং সেখানে জাতীয় নাট্য-এর কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্রীয় ঘরনা সুনির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে সচেতন বিবেচনা প্রনিধানযোগ্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে প্রসেনিয়াম ধারণার বেড়িতে এই অঞ্চলের নাট্য চরিত্রকে গ-িবদ্ধ করা যৌক্তিক নয়। কেন না মুখ্যত: এতদ্ব অঞ্চলে চর্চিত নাট্যশৈলীসমূহ মুক্তাঙ্গণ আদলের অর্থাৎ উন্মুক্ত আবহের।
তাই বাংলাদেশের দেশজ নাট্য-এর স্বরূপ নির্ধারণে এই রাষ্ট্রের সীমারেখায় বসবাসকারী জাতী-উপজাতী তথা নৃ-গোষ্ঠীসমূহের চর্চিত নাট্যশৈলীগুলোর একটি সমন্বিত রূপ নির্ধারণ অত্যাবশ্যক।
যে সমন্বিত স্বরূপ নির্মাণে প্রয়োজন প্রাচীনকালে এতদ্ব অঞ্চলে জাত প্রথারভিত্তিতে যে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল তাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের একক বৈশিষ্ট্যম-িত নাট্য ঘরনার সংশ্লেষণে একটি সম্মিলিত নাট্যধারার উদ্ভব ঘটানো। যাতে নব্যনাট্য-এর প্রকৃতি জাতী-স্বত্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশজ চরিত্র ধারণ করতে সমর্থ হয়।
অর্থাৎ ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রগণ কর্তৃক যে স্বতন্ত্র নাট্যানুশীলন এই বঙ্গদেশে প্রাচীনকালে সূচিত হয়ে নানা রূপে রূপান্তরে আজো এতদ্ব অঞ্চল; বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশে চর্চিত হচ্ছেÑ তাকে ব্যাপক গবেষণার মধ্য দিয়ে একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নাট্য আদলে রূপান্তরিত করা। এক্ষেত্রে পরিবেশনা (প্রেজেন্টেশন) থেকে উপস্থাপনা (রি-প্রেজেন্টেশন) প্রক্রিয়ার নানা ধাপ ও নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক ও মৌলিক প্রসঙ্গগুলোর মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।
প্রশ্ন হলোÑ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সেই গুরু দায়িত্ব কার? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি কি কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন মনোনীত কমিটিকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করেছে? যারা আলোচ্য অভিধান চূড়ান্তকরণে কাজ করবে?
বিশ্বের যেসব দেশে জাতীয় নাট্য বা দেশজ নাট্য রয়েছেÑ তা নির্ধারণে সেই সব দেশ বা রাষ্ট্র কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিলÑ এই ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা সর্বাগ্রে আমাদের সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের জানা প্রয়োজন। যদিও বা সেই সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রের ভূ-প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপটের মধ্যে পার্থক্য থাকবে তথাপি তা জানা থাকলে সে সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা অন্তত পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই সে অভিজ্ঞতা আমাদের দেশজ নাট্য-এর জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্টকরণে রাখবে সহায়ক ভূমিকা।
আমার বিবেচনায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সহিত বিবেচনায় নেবেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নয় ‘দেশজ নাট্য আঙ্গিক’ চূড়ান্তকরণের পথকে প্রশস্ত করবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জাতীয় নাট্যশালার অবকাঠামোকে ব্যবহার করে মনোনীত বা নির্বাচিত কমিটির নেতৃত্বে সবার মতামত নিয়ে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বাগ্রে একটি নীতিগত কাঠামো অনুমোদন সময়ের দাবি।
সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও অনুমোদিত সেই কাঠামোর (নীতিমালা) আলোকে জাতীয় নাট্যশালার অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে একটি রোডম্যাপ মোতাবেক নির্ধারিত টাইম লাইনের মধ্যে এই কাজটি সুসম্পন্ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে করে এই রোডম্যাপ এর আওতায় গঠিত রাষ্ট্রীয় কমিটি, সংশ্লিষ্টজন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিস্থ জাতীয় নাট্যশালায় নিযুক্ত জনবলের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী সুনির্দিষ্ট করার জন্য উল্লেখিত খ-িত প্রস্তাবটি বিবেচনার উদ্যোগ নেয়া হোক। যাতে করে দ্রুততম সময়ে জাপানের ‘নো’ ও ‘কাবুকী’ এবং চীনের ‘অপেরা’ এর ন্যায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী তথা ঘরানার জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়।
এটা জাতীয় স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি একটি বিবেচনা। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দেশের বিশিষ্টজনদের অভিমত ও পরামর্শ এই প্রস্তাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের নাট্য নেতৃত্ব যেখানে বিশ্বনাট্য সভার নেতৃত্ব দিচ্ছেন; সেখানে দ্রুত উচিত কালক্ষেপণ না করে অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়া। যাতে করে বাংলাদেশের ‘দেশজ’ বা ‘ইনডিজেনাস’ নাট্যশৈলীÑ এর কেন্দ্রীয় আঙ্গিক নির্ধারনোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চূড়ান্ত করা দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়। অন্যথায় বিশ্বনাট্য সভায় আমাদের নাট্য নেতৃত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) কেন্দ্রীয় পর্ষদ অর্থাৎ ওয়ার্ড কংগ্রেস যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নাট্য ব্যক্তিত্বদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়Ñ সেহেতু বিশ্বনাট্য সভায় এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগেই দেশজ নাট্য এর কেন্দ্রীয় বা জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্টকরণ বাংলাদেশের জন্য অত্যাবশ্যক, তা ‘জাতীয় নাট্য’ অভিধায় না হয়ে ‘দেশজ নাট্য’ শিরোনামেই হওয়া যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।
[ লেখক : অতিথি শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ]
মোস্তফা কামাল যাত্রা
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
এক দেশ বহু জাতি। জাতিনির্ভর একক দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাঙ্গাল থেকে বাঙালি আর বাঙালি থেকে বাংলাদেশি। কিন্তু জাত কী বাংলাদেশে একটা?
নিশ্চয়ই না। তাই ‘দেশজ নাট্য’ তথা ‘ইনডিজেনাস থিয়েটার’ এবং ‘জাতীয় নাট্য’ তথা ন্যাশনাল থিয়েটারের কেন্দ্রীয় রূপ চূড়ান্ত করা খুব সহজ বিষয় নয়। সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো একটি দেশের ‘দেশজ বা জাতীয়’ যে অভিধায়ই বলি না কেন একটি কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী নেই এটা ভাবা যায় না।
ভূমিগত সীমারেখা তথা মানচিত্রগত স্বীকৃত রাষ্ট্র বা দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বহুজাতিক যে চর্চিত নাট্যধারাসমূহ রয়েছে তার মধ্যে অবশ্যই একটি দেশজ আবরণ দৃশ্যমান। কিন্তু চর্চিত সেই দেশজ নাট্য ধারাসমূহের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় বা জাতীয় স্বরূপ অদ্যাবদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘জাতীয় নাট্যশালা’ অদ্যাবধি চূড়ান্ত করতে পারেনি।
দেশব্যাপী চর্চিত নাট্যধারাসমূহের বুৎপত্তি আর উৎপত্তিগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার সবগুলোই এই ভূমি থেকে উদ্ভূত নয়। আবার ধর্মীয় আগ্রাসন বিবেচনায় সংস্কৃত নাট্যের উদ্ভব এই বঙ্গে হলেও তা দেশজ কী?
ইতিহাসের কালপর্বে ব্রিটিশ কলোনিয়াল প্রভাবজাত সময়কালে লিয়েবিদেফ কর্তৃক প্রসেনিয়াম ধারণায় যে নাট্যচর্চার সূচনা হয়েছিল এতদ্ব অঞ্চলে তার বঙ্গীয় স্বরূপও কি আমাদের দেশজ নাট্য?
উত্থাপিত প্রশ্নদ্বয়ের যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পেতে গবেষণামূলক বিশ্লেষণের পথপরিক্রমা অনুসরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিকতা এবং ভূ-প্রকৃতির গঠনকে বিবেচনায় নিয়ে এই প্রসঙ্গটি আলোকপাত করা জরুরি। কারণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বঙ্গ অঞ্চলের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আসলে ভূ-প্রকৃতিগত দিক বিবেচনায় সৃষ্ট নাট্য ঘরনাই হলো ওই ভূমির নিজস্ব নাট্য। সেখানে জাতপ্রথা মুখ্য বিবেচনা নয়। জাতিভেদে স্ব স্ব নাট্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই জাতীয় নাট্য-এর কেন্দ্রীয় স্বরূপ নির্ধারণ বা স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক পরম্পরার গতিপ্রকৃতির আলোকে মৌলিক কতগুলো বিষয়কে এই প্রসঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের ভূমি তথা মানচিত্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী জাতী, উপজাতীদের (নৃ-গোষ্ঠী) চর্চিত নাট্যক্রিয়া বহুমাত্রিক। সুতরাং সেখানে জাতীয় নাট্য-এর কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্রীয় ঘরনা সুনির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে সচেতন বিবেচনা প্রনিধানযোগ্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে প্রসেনিয়াম ধারণার বেড়িতে এই অঞ্চলের নাট্য চরিত্রকে গ-িবদ্ধ করা যৌক্তিক নয়। কেন না মুখ্যত: এতদ্ব অঞ্চলে চর্চিত নাট্যশৈলীসমূহ মুক্তাঙ্গণ আদলের অর্থাৎ উন্মুক্ত আবহের।
তাই বাংলাদেশের দেশজ নাট্য-এর স্বরূপ নির্ধারণে এই রাষ্ট্রের সীমারেখায় বসবাসকারী জাতী-উপজাতী তথা নৃ-গোষ্ঠীসমূহের চর্চিত নাট্যশৈলীগুলোর একটি সমন্বিত রূপ নির্ধারণ অত্যাবশ্যক।
যে সমন্বিত স্বরূপ নির্মাণে প্রয়োজন প্রাচীনকালে এতদ্ব অঞ্চলে জাত প্রথারভিত্তিতে যে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল তাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের একক বৈশিষ্ট্যম-িত নাট্য ঘরনার সংশ্লেষণে একটি সম্মিলিত নাট্যধারার উদ্ভব ঘটানো। যাতে নব্যনাট্য-এর প্রকৃতি জাতী-স্বত্তার ঊর্ধ্বে উঠে দেশজ চরিত্র ধারণ করতে সমর্থ হয়।
অর্থাৎ ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রগণ কর্তৃক যে স্বতন্ত্র নাট্যানুশীলন এই বঙ্গদেশে প্রাচীনকালে সূচিত হয়ে নানা রূপে রূপান্তরে আজো এতদ্ব অঞ্চল; বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশে চর্চিত হচ্ছেÑ তাকে ব্যাপক গবেষণার মধ্য দিয়ে একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নাট্য আদলে রূপান্তরিত করা। এক্ষেত্রে পরিবেশনা (প্রেজেন্টেশন) থেকে উপস্থাপনা (রি-প্রেজেন্টেশন) প্রক্রিয়ার নানা ধাপ ও নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক ও মৌলিক প্রসঙ্গগুলোর মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।
প্রশ্ন হলোÑ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার সেই গুরু দায়িত্ব কার? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি কি কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন মনোনীত কমিটিকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করেছে? যারা আলোচ্য অভিধান চূড়ান্তকরণে কাজ করবে?
বিশ্বের যেসব দেশে জাতীয় নাট্য বা দেশজ নাট্য রয়েছেÑ তা নির্ধারণে সেই সব দেশ বা রাষ্ট্র কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিলÑ এই ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা সর্বাগ্রে আমাদের সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের জানা প্রয়োজন। যদিও বা সেই সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রের ভূ-প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপটের মধ্যে পার্থক্য থাকবে তথাপি তা জানা থাকলে সে সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা অন্তত পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই সে অভিজ্ঞতা আমাদের দেশজ নাট্য-এর জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্টকরণে রাখবে সহায়ক ভূমিকা।
আমার বিবেচনায় আমাদের দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সহিত বিবেচনায় নেবেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নয় ‘দেশজ নাট্য আঙ্গিক’ চূড়ান্তকরণের পথকে প্রশস্ত করবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জাতীয় নাট্যশালার অবকাঠামোকে ব্যবহার করে মনোনীত বা নির্বাচিত কমিটির নেতৃত্বে সবার মতামত নিয়ে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বাগ্রে একটি নীতিগত কাঠামো অনুমোদন সময়ের দাবি।
সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও অনুমোদিত সেই কাঠামোর (নীতিমালা) আলোকে জাতীয় নাট্যশালার অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে একটি রোডম্যাপ মোতাবেক নির্ধারিত টাইম লাইনের মধ্যে এই কাজটি সুসম্পন্ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে করে এই রোডম্যাপ এর আওতায় গঠিত রাষ্ট্রীয় কমিটি, সংশ্লিষ্টজন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিস্থ জাতীয় নাট্যশালায় নিযুক্ত জনবলের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী সুনির্দিষ্ট করার জন্য উল্লেখিত খ-িত প্রস্তাবটি বিবেচনার উদ্যোগ নেয়া হোক। যাতে করে দ্রুততম সময়ে জাপানের ‘নো’ ও ‘কাবুকী’ এবং চীনের ‘অপেরা’ এর ন্যায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নাট্যশৈলী তথা ঘরানার জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়।
এটা জাতীয় স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি একটি বিবেচনা। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দেশের বিশিষ্টজনদের অভিমত ও পরামর্শ এই প্রস্তাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের নাট্য নেতৃত্ব যেখানে বিশ্বনাট্য সভার নেতৃত্ব দিচ্ছেন; সেখানে দ্রুত উচিত কালক্ষেপণ না করে অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়া। যাতে করে বাংলাদেশের ‘দেশজ’ বা ‘ইনডিজেনাস’ নাট্যশৈলীÑ এর কেন্দ্রীয় আঙ্গিক নির্ধারনোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চূড়ান্ত করা দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়। অন্যথায় বিশ্বনাট্য সভায় আমাদের নাট্য নেতৃত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) কেন্দ্রীয় পর্ষদ অর্থাৎ ওয়ার্ড কংগ্রেস যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নাট্য ব্যক্তিত্বদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়Ñ সেহেতু বিশ্বনাট্য সভায় এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগেই দেশজ নাট্য এর কেন্দ্রীয় বা জাতীয় স্বরূপ সুনির্দিষ্টকরণ বাংলাদেশের জন্য অত্যাবশ্যক, তা ‘জাতীয় নাট্য’ অভিধায় না হয়ে ‘দেশজ নাট্য’ শিরোনামেই হওয়া যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।
[ লেখক : অতিথি শিক্ষক, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ]