আর কে চৌধুরী
সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। প্রাণহানি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এ মর্মান্তিক তথ্য উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে চব্বিশে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ২৯৪ জনের। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যে প্রাণহানি সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি। নিরাপদ সড়ক দাবিতে ২০১৮ সালে সারাদেশে নাড়া দেয়া এক ছাত্র-আন্দোলন হয়েছিল। তখন সরকার আইন প্রণয়নসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরে যথারীতি সেসব পূরণ হয়নি, সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি। দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি কিছুই কমেনি; বরং বেড়েছে। জুলাই বিপ-বের পর পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কিছুদিন সড়ক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। তখন বরং পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো ছিল। জনসাধারণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সম্মান, সহযোগিতা ও মান্য করেছে। এখন আবার বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এতে পেশাদার ট্রাফিক পুলিশের সদিচ্ছা, সক্রিয়তা এবং সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগছে। মানুষ হতাশ হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত নিরাপদ সড়কের জন্য দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে নেয়া, গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনিটরিং এবং কম গতির অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অবকাঠামো উন্নয়ন, ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং চালক-যাত্রী-পথচারী, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের শতভাগ সচেতনতা। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য যে বেশি, তা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হই, কানে হেডফোন লাগিয়ে চলি, মাদক সেবন করে গাড়ি চালাই, বেপরোয়া গতিতে চলি। দুর্ঘটনা ডেকে আনি নিজেরাই। অনেক নামি পরিবহনেও চালকরা দূরপাল্লার গাড়ি চালান প্রয়োজনীয় বিরতি-বিশ্রাম ছাড়াই। এদের প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীল হতে হবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের। সেখানেও তদারকি থাকতে হবে। সবার কার্যকর সচেতনতায় দেশের সড়ক নিরাপদ হোক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করবেন। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির দায়ও তাদেরই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এত আইন হলো, এত পরিকল্পনা নেয়া হলো, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। এটা যেমন আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলাও বটে। ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইন জারি হওয়ার পর চালকদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় ছিল, দুর্ঘটনা হলে শাস্তি পেতে হবে। পরবর্তী সময়ে আইনটি সংশোধনের নামে এমন অবস্থায় আনা হয়েছে যে তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতি আর নেই। দুঃখজনক হলো, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমপক্ষে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত এর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা মনে করি, যেভাবেই হোক সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতন হতে হবে পথচারীদেরও। একইসঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসবের পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিল এবং দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা হলে তা সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আইন আছে। প্রয়োগ নেই। প্রয়োগের জন্য চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকার কারণেই প্রয়োগ থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। দুর্ঘটনা বাড়ছে। ধেয়ে আসছে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। সম্প্রতি যানবাহনের চাপায় ও ধাক্কায় নিহত হওয়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হারও উদ্বেগজনক। সড়কে নিরাপদে চলাচল বিষয়ে অজ্ঞতা, অবহেলা এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগহীনতাই এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। সড়কে মৃত্যু ও নৈরাজ্যকর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমস্যাটিকে সবার আগে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হবেন, এটাই প্রত্যাশা।
[লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]
আর কে চৌধুরী
বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। প্রাণহানি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এ মর্মান্তিক তথ্য উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে চব্বিশে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ২৯৪ জনের। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যে প্রাণহানি সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি। নিরাপদ সড়ক দাবিতে ২০১৮ সালে সারাদেশে নাড়া দেয়া এক ছাত্র-আন্দোলন হয়েছিল। তখন সরকার আইন প্রণয়নসহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরে যথারীতি সেসব পূরণ হয়নি, সড়কে শৃঙ্খলাও ফেরেনি। দুর্ঘটনা, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি কিছুই কমেনি; বরং বেড়েছে। জুলাই বিপ-বের পর পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা কিছুদিন সড়ক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। তখন বরং পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো ছিল। জনসাধারণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সম্মান, সহযোগিতা ও মান্য করেছে। এখন আবার বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এতে পেশাদার ট্রাফিক পুলিশের সদিচ্ছা, সক্রিয়তা এবং সক্ষমতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগছে। মানুষ হতাশ হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত নিরাপদ সড়কের জন্য দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে নেয়া, গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনিটরিং এবং কম গতির অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অবকাঠামো উন্নয়ন, ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং চালক-যাত্রী-পথচারী, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের শতভাগ সচেতনতা। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য যে বেশি, তা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হই, কানে হেডফোন লাগিয়ে চলি, মাদক সেবন করে গাড়ি চালাই, বেপরোয়া গতিতে চলি। দুর্ঘটনা ডেকে আনি নিজেরাই। অনেক নামি পরিবহনেও চালকরা দূরপাল্লার গাড়ি চালান প্রয়োজনীয় বিরতি-বিশ্রাম ছাড়াই। এদের প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীল হতে হবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের। সেখানেও তদারকি থাকতে হবে। সবার কার্যকর সচেতনতায় দেশের সড়ক নিরাপদ হোক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করবেন। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব। ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহির দায়ও তাদেরই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এত আইন হলো, এত পরিকল্পনা নেয়া হলো, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। এটা যেমন আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলাও বটে। ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইন জারি হওয়ার পর চালকদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় ছিল, দুর্ঘটনা হলে শাস্তি পেতে হবে। পরবর্তী সময়ে আইনটি সংশোধনের নামে এমন অবস্থায় আনা হয়েছে যে তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতি আর নেই। দুঃখজনক হলো, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমপক্ষে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত এর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা মনে করি, যেভাবেই হোক সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতন হতে হবে পথচারীদেরও। একইসঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসবের পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিল এবং দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা হলে তা সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আইন আছে। প্রয়োগ নেই। প্রয়োগের জন্য চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকার কারণেই প্রয়োগ থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। দুর্ঘটনা বাড়ছে। ধেয়ে আসছে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। সম্প্রতি যানবাহনের চাপায় ও ধাক্কায় নিহত হওয়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হারও উদ্বেগজনক। সড়কে নিরাপদে চলাচল বিষয়ে অজ্ঞতা, অবহেলা এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগহীনতাই এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। সড়কে মৃত্যু ও নৈরাজ্যকর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমস্যাটিকে সবার আগে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হবেন, এটাই প্রত্যাশা।
[লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]