শেখর ভট্টাচার্য
বেগমপাড়া নামটিতে কোন আভিজাত্য নেই। ‘পাড়া’ শব্দটি আসলে কামার, কুমোর, জেলে ইত্যাদি পেশার লোকরা যেখানে বসতি স্থাপন করেছেন সেসব স্থানের নামের সঙ্গে যায় ভালো। কানাডার অন্টারিওর একটি অভিজাত শহর মিসেসাওগাতে ‘বেগমপাড়ার’ মতো একটি অনাধুনিক, ‘খ্যাত’ ধরনের নাম কোনভাবেই মানায় না। শুধু কী মিসেসাওগাতে? টরন্টোর বেলভিউর বিলাসবহুল হাইরাইজ কনডোমিনিয়াম, এই শহরেরই প্রাণকেন্দ্রে সিএন টাওয়ারের আশপাশ, টরন্টোর পাশের শহর রিচমন্ড হিল ও মার্কহামের অভিজাত এলাকায় আলোচিত ‘বেগমপাড়ার’ অবস্থান। অন্টারিওতে এমন দুই শতাধিক বেগমপাড়ার কথা শোনা যায়। সাধারণত যেসব এলাকায় বাংলাদেশিদের আনাগোনা নেই, স্থানীয় প্রবাসী পেশাজীবীরাও বসবাস করে না, সেসব এলাকাতেই বেগমপাড়া স্থাপিত হয়েছে।
বেগমপাড়া নিয়ে ষোলো, সতের বছর যাবত এতো আলোচনা হয়েছে যে, বেগমপাড়া আসলে কোথায়, কী, কেনো এরকম ব্যাখ্যা দেয়ারও প্রয়োজন হয় না আজকাল। তার পরেও একটু বলা ভালো, কানাডাতে আসলে সুনির্দিষ্টভাবে ‘বেগমপাড়া’ বলে কোনো জায়গা নেই। ‘বেগমপাড়া’ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দ্বারা যারা দ্বিতীয় আবাসভূমি তৈরি করেছেন সেই সব আবাস ভূমির প্রতীকী নাম। বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে আমাদের দেশের আমলা, ‘রাজনীতি পেশা’র পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে তাদের বেগম সাহেব এবং সন্তানেরা কালো টাকায় গড়া অভিজাত এলাকায় আয়েশি, নিরাপদ ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করে থাকেন। বেগম সাহেবদের স্বামীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা উপায়ে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সাধারণ মানুষের অর্থ লোপাট করে বিলাসি জীবনের ব্যবস্থা করে থাকেন এবং বিভিন্ন ছুটিছাঁটা, প্রশিক্ষণের নামে তারা বেগমপাড়ায় ‘স্বগৃহে’ বিলাসি জীবন উপভোগ করে থাকেন।
বেগম সাহেবরা সাময়িক ভাবে স্বামীবিহীন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে থাকেন। প্রবাস জীবনে তারা কোন পেশার সাথে যুক্ত না থেকেও, দু-চার-পাঁচ, দশ মিলিয়ন ডলারের বাড়ির মালকিন। নিঃসঙ্গতার কারনে বেগম সাহেবরা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন মাঝে মাঝে। সন্তান এবং সম্পত্তির গুরুদায়িত্ব পালন করে প্রবাস জীবন কাটাতে হয় এসব মহীয়সী নারীদের। সাহেবরা তো নামে বেনামে টাকা পাঠিয়ে, সম্পদের ব্যবস্থা করেই খালাস। বেগম সাহেবদের জীবনের এই ত্যাগের কথা না ভেবে বাংলাদেশের মিডিয়া এবং রাজনীতিতে তাদের নিয়েই বেশি বেশি আলোচনা করা হয় । এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল্য। রীতিমতো অবিচার, অনায্য আচরন।
সম্প্রতি কিছু বেগম-সাহেব মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে দেশ বাসির কাছে একটি খোলা চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেছেন। বেগম সাহেবদের মর্মপীড়া আমাদের মতো অতি-সাধারণ মানুষের হৃদয়কেও আবেগে ভারাক্রান্ত করে ফেলছে। আবেগের বশে ও সহমর্মী হয়ে একটি খোলা চিঠির নমুনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হলো। কোন ভাবে যদি এই নমুনা চিঠি বেগম সাহেবদের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে যন্ত্রণাক্লিষ্ট এসব বেগম সাহেবরা কিছুটা হলেও উপকৃত হতে পারেন, এই মহৎ উদ্দেশ্য হৃদয়ে ধারণ করে খোলা চিঠিটি প্রিয় পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলোÑ
খোলা চিঠি
হইতে ‘বেগমপাড়া’ (তথাকথিত/লোককথিত), টরন্টো, অন্টারিও
প্রিয় দেশবাসী ও ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশের অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা জানেন ২০০৭-২০০৮ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চমক সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশে বসবাসরত আমাদের আমলা ও রাজনীতিবিদ স্বামীদের নানাভাবে অর্জিত সম্পদ ও অর্থের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদের অমানবিকভাবে নাজেহাল করার কার্যক্রম হাতে নেয়। এমন কী তাদের অনেককেই কারা অন্তরীন পর্যন্ত করা হয়। নিরূপায় হয়ে আমাদের মহান স্বামীরা পরিবারের সদস্যদের জান মালের হেফাজতের জন্য সন্তান সহ কানাডা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব কর্মসূচির আওয়তায় নিশ্চিত বাসে প্রকল্প প্রেরন করা শুরু করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অনায্য আচরণের পূর্বেও বাংলদেশের অনেক সম্মানিত বিত্তশালী নিরাপত্তা ও বিলাসি জীবনযাপনের জন্য এভাবে নাগরিকত্ব গ্রহণের মাধ্যমে বিলাসী ও নিরাপদ জীবনযাপন শুরু করেন। এই খোলা চিঠির মাধ্যমে আমাদের পথ প্রদর্শকদের প্রতি প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমরা গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি সম্প্রতি বিশেষ করে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্ব থেকে বিশেষ করে কানাডায় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের তালিকায় রাজনীতিবিদরা নন, এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীরা এরকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা নিরাপদ ও বিলাসি জীবনের আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে এরকম বিভক্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্যে অত্যন্ত আশাহত।
প্রিয় দেশবাসী ও বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সম্মানিত অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা জানেন আমাদের আমলা স্বামীরা পিচ্ছিল বাঁশ বেঁয়ে বানরের ওঠা নামার অঙ্ক সহ অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতিবিদ স্বামীরাও বিভিন্ন প্রকল্প সফলভাবে সমাপ্ত করে, দেশের শনৈ-শনৈ উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছিলেন। তাদের মেধা ও শ্রম দ্বারা দেশকে প্রচুর সফলতা উপহার দিয়েছেন, তাই তাদের নৈতিক অধিকার জন্মেছে দেশ থেকে কিছু অর্থ সম্পদ নিয়ে নিরাপদে উন্নত দেশে বসবাস করার।
আপনারা অনেকেই জানেন, সাময়িকভাবে ‘স্বামীহীন’ হয়ে থাকা একজন স্ত্রীর জন্য কতোটুকু মানসিক অশান্তির কারন। নিঃসঙ্গতা জনিত এই অশান্তি কতোটুকু বিষাদ তৈরি করতে পারে তা শুধু ভুক্তভোগী নারীরাই অনুভব করতে পারেন। ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের এরকম নিঃসঙ্গ ও কঠিন জীবন সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যার নাম ছিল ‘বেগমপুরা’। সেই ‘বেগমপুরা’ থেকেই নাকি ‘বেগমপাড়া’ নামটি এসেছে। তবে কিছু ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষেরা বলে- ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাহেবেরা নাকি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে থাকতে বাধ্য হন এবং পরিবারকে উন্নত জীবন এবং সন্তানদের উন্নত শিক্ষার জন্য কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত দেশে রেখে থাকেন। ভেবে দেখুন সে সব দেশের চিত্র-নির্মাতা ও সুশীল সমাজের মানুষেরা তাদের সাহসী ও নিঃসঙ্গ নারীদের নিয়ে কতোটুকু সংবেদনশীল।
প্রিয় দেশবাসী ও সহানুভুতিশীল অভিবাসীবৃন্দ, আমাদের হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেছে, যেদিন আমরা অবলোকন করলাম কানাডায় বসবাসরত কিছু অভিবাসী আমাদের বিরুদ্ধে কিছুদিন পূর্বে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, এটি অমানবিক এবং দুঃসহ। এ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশি মিডিয়া পরম উৎসাহে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে।
আপনারা চেয়েছিলেন বিশ্বব্যপী এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে। বিশ্ব বিধাতা আপনাদের অন্যায় আচরনের পক্ষে ছিলেন না তাই তিনি আমাদের বিপক্ষে সুচিত আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেন। আশা করি অভিবাসী হিসাবে, ভবিষ্যতে আপনারা সমব্যথি হয়ে আমাদের স্বামীদের বিশ্বব্যাপী অভিজাত জীবনযাপনের প্রকল্প যাতে সফলতায় ভরে ওঠে, সেই ব্যাপারে ক্রমাগত উৎসাহ প্রদান করে যাবেন।
প্রিয় দেশবাসী ও সমব্যথী অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা অনেকেই জানেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ নামক দেশটি অচিরেই সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অনভিজাত রোগ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিছদিন পরপর আক্রমণ করে। বাংলাদেশের রাজধানী পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য নগরের মধ্যে অন্যতম। এই রাজধানীর বাতাসে সিসা ভেসে বেড়ায়। বাংলাদেশে বসবাস করা, রবিঠাকুরের ভাষায় ‘জেনে-শুনে বিষপান করার’ সমতুল্য বলে আমাদের মনে হয়। আপনারা জানেন ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসকেরা চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মতো দেশে ‘নীল রক্তের’ অভিজাত বলতে আমাদের মতো আমলা পরিবার ও কিছু রাজনীতিবিদদের পরিবার ছাড়া অভিজাত শ্রেণি বিরল। স্বাভাবীকভাবে আরাম-আয়েশে উন্নত দেশে জীবনযাপন করাÑ তাই এসব পরিবারের সদস্যদের ‘অধিকারের’ মধ্যে পড়ে। এই অধিকার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত।
প্রিয় দেশবাসী ও সমমনা অভিবাসীবৃন্দ, আশা করি এই নাতিদীর্ঘ খোলা চিঠির মাধ্যমে আমাদের বয়ানটি আপনাদের সামনে খোলাসা করতে পেরেছি এবং চিঠিটি পাঠ করার পর আপনারা যার যার অবস্থান থেকে আমাদের পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। আমাদের বিশ্বাস, আপনারা দেশের প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সামাজিক মাধ্যমে আমাদের ন্যায়সঙ্গত অবস্থান তুলে ধরার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। অভিবাসী ভাই ও বোনেরা অভিজাত এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি, সর্বশেষ মডেলের গাড়ি এবং আমাদের পরিশ্রমবিহীন বিলাসী জীবন দেখে যারা হিংসায় উন্মত্ত হয়ে আন্দোলন করছেন তাদের আমরা করুণা করি। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের খাদেম ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা করে শ্রেণী, পেশা, নির্বিশেষে সবাই লাভবান হই।
আপনাদের সহযোগিতার জন্য আগাম মোবারকবাদ।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
বেগমপাড়া নামটিতে কোন আভিজাত্য নেই। ‘পাড়া’ শব্দটি আসলে কামার, কুমোর, জেলে ইত্যাদি পেশার লোকরা যেখানে বসতি স্থাপন করেছেন সেসব স্থানের নামের সঙ্গে যায় ভালো। কানাডার অন্টারিওর একটি অভিজাত শহর মিসেসাওগাতে ‘বেগমপাড়ার’ মতো একটি অনাধুনিক, ‘খ্যাত’ ধরনের নাম কোনভাবেই মানায় না। শুধু কী মিসেসাওগাতে? টরন্টোর বেলভিউর বিলাসবহুল হাইরাইজ কনডোমিনিয়াম, এই শহরেরই প্রাণকেন্দ্রে সিএন টাওয়ারের আশপাশ, টরন্টোর পাশের শহর রিচমন্ড হিল ও মার্কহামের অভিজাত এলাকায় আলোচিত ‘বেগমপাড়ার’ অবস্থান। অন্টারিওতে এমন দুই শতাধিক বেগমপাড়ার কথা শোনা যায়। সাধারণত যেসব এলাকায় বাংলাদেশিদের আনাগোনা নেই, স্থানীয় প্রবাসী পেশাজীবীরাও বসবাস করে না, সেসব এলাকাতেই বেগমপাড়া স্থাপিত হয়েছে।
বেগমপাড়া নিয়ে ষোলো, সতের বছর যাবত এতো আলোচনা হয়েছে যে, বেগমপাড়া আসলে কোথায়, কী, কেনো এরকম ব্যাখ্যা দেয়ারও প্রয়োজন হয় না আজকাল। তার পরেও একটু বলা ভালো, কানাডাতে আসলে সুনির্দিষ্টভাবে ‘বেগমপাড়া’ বলে কোনো জায়গা নেই। ‘বেগমপাড়া’ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দ্বারা যারা দ্বিতীয় আবাসভূমি তৈরি করেছেন সেই সব আবাস ভূমির প্রতীকী নাম। বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে আমাদের দেশের আমলা, ‘রাজনীতি পেশা’র পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে তাদের বেগম সাহেব এবং সন্তানেরা কালো টাকায় গড়া অভিজাত এলাকায় আয়েশি, নিরাপদ ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করে থাকেন। বেগম সাহেবদের স্বামীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা উপায়ে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সাধারণ মানুষের অর্থ লোপাট করে বিলাসি জীবনের ব্যবস্থা করে থাকেন এবং বিভিন্ন ছুটিছাঁটা, প্রশিক্ষণের নামে তারা বেগমপাড়ায় ‘স্বগৃহে’ বিলাসি জীবন উপভোগ করে থাকেন।
বেগম সাহেবরা সাময়িক ভাবে স্বামীবিহীন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে থাকেন। প্রবাস জীবনে তারা কোন পেশার সাথে যুক্ত না থেকেও, দু-চার-পাঁচ, দশ মিলিয়ন ডলারের বাড়ির মালকিন। নিঃসঙ্গতার কারনে বেগম সাহেবরা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন মাঝে মাঝে। সন্তান এবং সম্পত্তির গুরুদায়িত্ব পালন করে প্রবাস জীবন কাটাতে হয় এসব মহীয়সী নারীদের। সাহেবরা তো নামে বেনামে টাকা পাঠিয়ে, সম্পদের ব্যবস্থা করেই খালাস। বেগম সাহেবদের জীবনের এই ত্যাগের কথা না ভেবে বাংলাদেশের মিডিয়া এবং রাজনীতিতে তাদের নিয়েই বেশি বেশি আলোচনা করা হয় । এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল্য। রীতিমতো অবিচার, অনায্য আচরন।
সম্প্রতি কিছু বেগম-সাহেব মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে দেশ বাসির কাছে একটি খোলা চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেছেন। বেগম সাহেবদের মর্মপীড়া আমাদের মতো অতি-সাধারণ মানুষের হৃদয়কেও আবেগে ভারাক্রান্ত করে ফেলছে। আবেগের বশে ও সহমর্মী হয়ে একটি খোলা চিঠির নমুনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হলো। কোন ভাবে যদি এই নমুনা চিঠি বেগম সাহেবদের দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে যন্ত্রণাক্লিষ্ট এসব বেগম সাহেবরা কিছুটা হলেও উপকৃত হতে পারেন, এই মহৎ উদ্দেশ্য হৃদয়ে ধারণ করে খোলা চিঠিটি প্রিয় পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলোÑ
খোলা চিঠি
হইতে ‘বেগমপাড়া’ (তথাকথিত/লোককথিত), টরন্টো, অন্টারিও
প্রিয় দেশবাসী ও ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশের অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা জানেন ২০০৭-২০০৮ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চমক সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশে বসবাসরত আমাদের আমলা ও রাজনীতিবিদ স্বামীদের নানাভাবে অর্জিত সম্পদ ও অর্থের ওপর লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদের অমানবিকভাবে নাজেহাল করার কার্যক্রম হাতে নেয়। এমন কী তাদের অনেককেই কারা অন্তরীন পর্যন্ত করা হয়। নিরূপায় হয়ে আমাদের মহান স্বামীরা পরিবারের সদস্যদের জান মালের হেফাজতের জন্য সন্তান সহ কানাডা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব কর্মসূচির আওয়তায় নিশ্চিত বাসে প্রকল্প প্রেরন করা শুরু করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই অনায্য আচরণের পূর্বেও বাংলদেশের অনেক সম্মানিত বিত্তশালী নিরাপত্তা ও বিলাসি জীবনযাপনের জন্য এভাবে নাগরিকত্ব গ্রহণের মাধ্যমে বিলাসী ও নিরাপদ জীবনযাপন শুরু করেন। এই খোলা চিঠির মাধ্যমে আমাদের পথ প্রদর্শকদের প্রতি প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমরা গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি সম্প্রতি বিশেষ করে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অব্যবহিত পূর্ব থেকে বিশেষ করে কানাডায় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের তালিকায় রাজনীতিবিদরা নন, এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীরা এরকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা নিরাপদ ও বিলাসি জীবনের আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে এরকম বিভক্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্যে অত্যন্ত আশাহত।
প্রিয় দেশবাসী ও বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সম্মানিত অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা জানেন আমাদের আমলা স্বামীরা পিচ্ছিল বাঁশ বেঁয়ে বানরের ওঠা নামার অঙ্ক সহ অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতিবিদ স্বামীরাও বিভিন্ন প্রকল্প সফলভাবে সমাপ্ত করে, দেশের শনৈ-শনৈ উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছিলেন। তাদের মেধা ও শ্রম দ্বারা দেশকে প্রচুর সফলতা উপহার দিয়েছেন, তাই তাদের নৈতিক অধিকার জন্মেছে দেশ থেকে কিছু অর্থ সম্পদ নিয়ে নিরাপদে উন্নত দেশে বসবাস করার।
আপনারা অনেকেই জানেন, সাময়িকভাবে ‘স্বামীহীন’ হয়ে থাকা একজন স্ত্রীর জন্য কতোটুকু মানসিক অশান্তির কারন। নিঃসঙ্গতা জনিত এই অশান্তি কতোটুকু বিষাদ তৈরি করতে পারে তা শুধু ভুক্তভোগী নারীরাই অনুভব করতে পারেন। ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের এরকম নিঃসঙ্গ ও কঠিন জীবন সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যার নাম ছিল ‘বেগমপুরা’। সেই ‘বেগমপুরা’ থেকেই নাকি ‘বেগমপাড়া’ নামটি এসেছে। তবে কিছু ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষেরা বলে- ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাহেবেরা নাকি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে থাকতে বাধ্য হন এবং পরিবারকে উন্নত জীবন এবং সন্তানদের উন্নত শিক্ষার জন্য কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত দেশে রেখে থাকেন। ভেবে দেখুন সে সব দেশের চিত্র-নির্মাতা ও সুশীল সমাজের মানুষেরা তাদের সাহসী ও নিঃসঙ্গ নারীদের নিয়ে কতোটুকু সংবেদনশীল।
প্রিয় দেশবাসী ও সহানুভুতিশীল অভিবাসীবৃন্দ, আমাদের হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেছে, যেদিন আমরা অবলোকন করলাম কানাডায় বসবাসরত কিছু অভিবাসী আমাদের বিরুদ্ধে কিছুদিন পূর্বে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, এটি অমানবিক এবং দুঃসহ। এ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশি মিডিয়া পরম উৎসাহে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে।
আপনারা চেয়েছিলেন বিশ্বব্যপী এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে। বিশ্ব বিধাতা আপনাদের অন্যায় আচরনের পক্ষে ছিলেন না তাই তিনি আমাদের বিপক্ষে সুচিত আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেন। আশা করি অভিবাসী হিসাবে, ভবিষ্যতে আপনারা সমব্যথি হয়ে আমাদের স্বামীদের বিশ্বব্যাপী অভিজাত জীবনযাপনের প্রকল্প যাতে সফলতায় ভরে ওঠে, সেই ব্যাপারে ক্রমাগত উৎসাহ প্রদান করে যাবেন।
প্রিয় দেশবাসী ও সমব্যথী অভিবাসীবৃন্দ, আপনারা অনেকেই জানেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ নামক দেশটি অচিরেই সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অনভিজাত রোগ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিছদিন পরপর আক্রমণ করে। বাংলাদেশের রাজধানী পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য নগরের মধ্যে অন্যতম। এই রাজধানীর বাতাসে সিসা ভেসে বেড়ায়। বাংলাদেশে বসবাস করা, রবিঠাকুরের ভাষায় ‘জেনে-শুনে বিষপান করার’ সমতুল্য বলে আমাদের মনে হয়। আপনারা জানেন ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসকেরা চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মতো দেশে ‘নীল রক্তের’ অভিজাত বলতে আমাদের মতো আমলা পরিবার ও কিছু রাজনীতিবিদদের পরিবার ছাড়া অভিজাত শ্রেণি বিরল। স্বাভাবীকভাবে আরাম-আয়েশে উন্নত দেশে জীবনযাপন করাÑ তাই এসব পরিবারের সদস্যদের ‘অধিকারের’ মধ্যে পড়ে। এই অধিকার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত।
প্রিয় দেশবাসী ও সমমনা অভিবাসীবৃন্দ, আশা করি এই নাতিদীর্ঘ খোলা চিঠির মাধ্যমে আমাদের বয়ানটি আপনাদের সামনে খোলাসা করতে পেরেছি এবং চিঠিটি পাঠ করার পর আপনারা যার যার অবস্থান থেকে আমাদের পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। আমাদের বিশ্বাস, আপনারা দেশের প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সামাজিক মাধ্যমে আমাদের ন্যায়সঙ্গত অবস্থান তুলে ধরার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। অভিবাসী ভাই ও বোনেরা অভিজাত এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি, সর্বশেষ মডেলের গাড়ি এবং আমাদের পরিশ্রমবিহীন বিলাসী জীবন দেখে যারা হিংসায় উন্মত্ত হয়ে আন্দোলন করছেন তাদের আমরা করুণা করি। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের খাদেম ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা করে শ্রেণী, পেশা, নির্বিশেষে সবাই লাভবান হই।
আপনাদের সহযোগিতার জন্য আগাম মোবারকবাদ।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]